মিডিয়ায় ব্যাংকিং সেক্টরের কোন ধরণের নেতিবাচক খবর না ছাপানোর দাবি জানিয়ে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশের বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকগণ।
গত শুক্রবার রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত র্যাবের কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রী আব্দুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সরকারের কাছে এমন দাবি জানিয়েছেন দেশের ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক (বিএবি)। এ সময়ে তারা অর্থমন্ত্রীর কাছে নয় দফা প্রস্তাবনাসহ একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এমন খবর দিয়েছে।
তাদের মতে নেতিবাচক সংবাদ গ্রাহকদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং তারা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারান। এমনকি গ্রাহকদের নিকট “সঠিক তথ্য” তুলে ধরাও ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন এক্সিম ব্যংকের পরিচালক নজরুল ইসলাম মজুমদার।
এমন দাবির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মিডিয়ায় ব্যাংকিং খাতের সংবাদ প্রচারে যে কোন ধরণের নিষেধাজ্ঞা দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের অবৈধ এবং অস্বাভাবিক ঋণ প্রদানের সংবাদ প্রচারিত হয়।
নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, “একটি সংবাদপত্র এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছে, যা ব্যংকের সুনামের জন্য ক্ষতিকর”। তিনি বলেন, আমরা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাথে ‘অর্থনৈতিক তথ্য আইন’ নিয়ে আলোচনা করেছি।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচবিএম ইকবালও অনুরূপভাবে ব্যাংকিং খাতের বিরুদ্ধে কোন নেতিবাচক খবর প্রচার না করতে অনুরোধ করেছেন।
গত দুই বছর ব্যাংকিং খাতের অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে অনেক ভুয়া কোম্পানিকে বড় বড় ঋণ দেয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। এসব সামনে আসায় ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থায়ও কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেসিক ব্যংকের প্রায় সারে চার’শো কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়। বিসমিল্লাহ গ্রুপ পাঁচটি ব্যাংক থেকে এগারো’শো কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। সোনালি ব্যাংক কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মত ঘটনা আলোচনায় আসে।
সর্বশেষ, ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি ব্যাংকের নিয়ম বহির্ভূত ঋণ প্রদানের বিষয়টি আলোচনায় আসে। ফারমার্স ব্যাংক বর্তমানে গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।
গত এক বছরে পুরো ব্যাংক খাতে ফেরত দিতে অক্ষম এমন ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকায়।
এমতাবস্থায় ব্যাংক পরিচালকদের এমন অস্বাভাবিক দাবিকে ব্যাংক ও ব্যবসা খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংকিং খাতে কি ঘটছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে, এজন্য কোন আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার প্রয়োজন নেই।”
তার মতে, “কোন ব্যাংক যদি মনে করে তাদের বিরুদ্ধে ভুল সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, তাহলে তারা প্রেস কাউন্সিলে আপত্তি জানাতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, সালাউদ্দিন আহমেদের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, “সংবাদপত্র ‘নেতিবাচক সংবাদ’ প্রকাশ করে, কারণ এটা অর্থনৈতিক খাতের উপরে আঘাত বিধায়।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “জনগণের স্বার্থে মিডিয়ার উচিৎ অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি বিষয়ক সংবাদ প্রচার করে যাওয়া।” তার মতে, “জনগণ কষ্টের টাকা ব্যাংকে জমা রাখে, তাই তাদের অধিকার আছে এ বিষয়ক তথ্য জানার।”
ব্যাংক পরিচালকদের দাবি মোতাবেক সরকারি ফান্ডগুলোর ৫০ শতাংশ টাকা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রাখা যাবে, আগে যেখানে ২৫ শতাংশের সীমা নির্ধারিত ছিল। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন।