বর্মা আরেকজন নতুন প্রেসিডেন্ট পেল। ৬৭ বছর বয়সী উ উইন মিন্ট দেশটির ১০ম প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসার পর দু’বছরের মধ্যে সুচি তার প্রেসিডেন্ট বদল করলেন। বর্মায় অনেকেই মনে করছেন প্রেসিডেন্ট পদের এই পরিবর্তন মোটেই আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। চরমভাবে সেনা প্রভাবিত দেশটিতে তুলনামূলকভাবে একজন তরুণ ও রাজনৈতিকভাবে অধিকতর বিচক্ষণ ব্যক্তিকে এই পদে এনে ক্ষমতাসীন দল এনএলডি দেশটির রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইছে। মূলত সুচির ইচ্ছাতেই এটা হচ্ছে এবং বলা যায় তিনি এর মধ্যদিয়ে খানিকটা চমকে দিয়েছেন বর্মাবাসীকে এবং সেনাবাহিনীকেও। সশস্ত্র বাহিনীর তৈরি করা সংবিধানের ৫৯ নং ধারার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পদে সুচির অভিষেকের কোন সুযোগ না থাকলেও মূলত তিনিই এই পদের নিয়োগ ও কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে যাচ্ছেন।
নতুন প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট একজন অত্যন্ত সক্রিয় পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। রেঙ্গুনের নিকটবর্তী তামুউই থেকে তিনি পার্লামেন্টে প্রতিনিধি ছিলেন। কয়েক মাস আগে একমাত্র মেয়ের বিয়েতে দাওয়াতপত্রে ‘দয়া করে কোন উপহার আনবেন না’ কথা লিখে উইন মিন্ট দেশটির রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বিশেষ আলোচনার খোরাক হন। কারণ বর্মার এলিট পরিমন্ডলে এরূপ বিয়েতে উপহার হিসেবে বিলাসী সামগ্রীর ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসনে দুর্নীতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত দেশটিতে উইন মিন্ট ইতোমধ্যে তার এইরূপ এডভোকেসির জন্যও বিখ্যাত যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করা উচিত। সম্ভবত এসব কারণেই পার্লামেন্টে সম্মিলিতভাবে ৬৩৬ জন সদস্যের বিপরীতে এনএলডি’র ৩৮৭ জন সদস্য থাকা সত্ত্বেও দলটির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৪০৩টি। যা প্রমাণ করছে কিছু কিছু আঞ্চলিক এবং অ-বার্মার জাতিসত্তা প্রভাবিত দলও উইন মিন্টের ব্যাপারে আশাবাদী। এও স্মরণযোগ্য যে দু’বছর আগে সুচির মনোনীত পূর্বতন প্রেসিডেন্ট পেয়েছিলেন ৩৬০ ভোট।
এক সময় আইন পেশায় থাকা নতুন প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে বর্তমান এনএলডি’র অন্যতম তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন নেতা মনে করা হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট পদে তার অবস্থান সুচির আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঘরে-বাইরে পর্যুদস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হয়তো আরেকবার চেষ্টা চালাবেন তিনি।
২০১৫ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় সুচির নির্বাচনী শ্লোগান ছিল ‘সময় এসেছে পরিবর্তন’-এর। বলা বাহুল্য যে, গত দুই বছর যাবৎ ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতি ও জনজীবনে অর্থবহ পরিবর্তন তেমন কিছু হয়নি– বরং বর্মার নীতিনির্ধারণে সুচি ও তার দলের ভূমিকা ক্রমে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। ফলে সুচির শেষোক্ত পদক্ষেপকে একটা বাজি হিসেবে তুলনা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সংবিধানের ২৩৫ নং ধারার আলোকে নতুন প্রেসিডেন্ট নতুন করে মন্ত্রিসভাও গঠন করতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই সেখানেও সূচিই হবেন শেষ কথা বলার মালিক এবং অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্য থেকে নতুন নির্বাহিদের বাছাই করা হতে পারে। তবে তাতে প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র বিষয়ে অতীতের মতোই তার মতামতের মূল্য থাকবে সামান্যই।
সুচির নতুন করে এইরূপ নড়েচড়ে ওঠার একটি বড় কারণ নিশ্চিতভাবেই আরাকানের রোহিঙ্গা সংকট। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যদিয়ে সুচিকে যে করুণ অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে তাতে ক্রমে দেশটির অর্থনীতিতেও অতিসম্প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত পর্যটন খাতে ব্যাপক খরা চলছে এখন। কৃষি ও খনিজ খাতের বাইরে পর্যটনই বর্মার অর্থনীতির এক বড় ভরসা। উপরন্তু ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্থনৈতিক অবরোধেরও মৃদু হুমকি রয়েছে।
এছাড়া সুচির সামনে আরেকটি বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জাতিগত শান্তিপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে না পারা। ক্ষমতায় এসেই তিনি দু’বার ঐ লক্ষ্যে শান্তি সম্মেলন করলেও (পেংলং সম্মেলন নামে পরিচিত) সেনাবাহিনীর সংস্কারহীন কঠোর অবস্থানের কারণে পুরো প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে। নতুন প্রেসিডেন্ট যদিও পূর্বজনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত ধাঁচের ও কৌশলী হিসেবে পরিচিত– কিন্তু সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার বোঝাপড়া বিরাট পরীক্ষার মুখে পড়বে আসন্ন দিনগুলোতে। তবে ৭৩ বছর বয়সী সুচি নিশ্চিতভাবেই কিছু নির্বাহী চ্যালেঞ্জ এখন উইন মিন্টের দিকে ঠেলে দেবেন এবং সরকারকে দৃশ্যমান করে তুলতে নতুন করে উদ্যোগী হবেন। ইতোমধ্যে প্রায়ই সুচির অসুস্থতার খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং এইরূপ খবরের পটভূমিতেই কারেন ইউনিয়ন সম্প্রতি এক বিবৃতিতে শান্তি প্রক্রিয়া পরিচালনার ভার প্রেসিডেন্টের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে।