যুগে যুগে নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে হালের বারাক ওবামার মতো বৈশ্বিক নেতারা চেষ্টা চালিয়েছেন বর্ণবাদ নামক বিষাক্ত বৃক্ষের শিকড় উপড়ে ফেলতে। লাভ যে খুব একটা হয়নি তা তো দিব্য চোখেই দৃশ্যমান। সমাজের সাধারণ স্তরেই শুধু নয়, বর্ণবাদ নামক এই ক্যান্সার বাসা বেধেছে খেলাধুলার জগতেও। আর যে দেশটা এ ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় ভুক্তভুগি সেটি হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। খুব বেশি দিন না, ২০১০ সালেই কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে কাটাতারের আবদ্ধ বেড়ায় বেধে রাখার দৃশ্য দেখেছি আমরা। তারও আগে ক্রিকেট থেকে বর্ণবাদের দায়ে প্রায় দু যুগ নির্বাসিতও থাকতে দেখেছি। ২০১০ এই যখন এই হালত ছিলো বর্তমানে অবস্থা ঠিক কতটা বদলে মনে হয়? খুব যে একটা বদলায়নি সেটা বোঝা যায় অশ্বেতাঙ্গদের সুযোগ দেয়ার জন্য এখনো কোটা প্রথা বহাল রাখার দৃশ্য দেখেই। অথচ হামিশ আমলা, জেপি ডুমিনি, ভার্নন ফিলানর্ডার, কাগিসো রাবাদা বা হালের লুঙ্গি এনগিডিরা অনায়াসেই সুযোগ পেতে পারেন যেকোনো দলে। তারপরও কোটা প্রথা বহাল রাখাই বলে দেয়, সামাজিকভাবে আফ্রিকানরা এখনো কোন যুগে রয়েছে। আমার এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য বর্ণবাদ নয়। বরং, অশ্বেতাঙ্গ হবার দায়ে পূর্ণ যোগ্যতা থাকার পরেও যার অধিনায়কত্ব প্রাপ্তি শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানরা মেনে নিতে পারেননি সেই হাশিম মোহাম্মদ আমলা আনসারি।
জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই আফ্রিকায়। নেতৃত্ব দিয়েছেন অনুর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দলেরও। তারপরেও, শেকড় ভারতে, আর চামড়া বাদামি হওয়ায় আমলা হয়ে যান অশ্বেতাঙ্গ। তাই অাফ্রিকার ৩৩ টেস্ট অধিনায়কের বদলে তাকে বলা হলো পূর্ণকালীন দায়িত্ব পাওয়া প্রথম অশ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান অধিনায়ক। আমলার অধিনায়কত্ব প্রাপ্তি শুধু সাধারণ শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানরাই না, মানতে পারেনি অনেক মিডিয়াও। টেস্টে আফ্রিকার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরিসহ অসংখ্য গর্ব করার মতো কীর্তিও মুছে দিতে পারেনি তার অশ্বেতাঙ্গ পরিচয়। শুধুই ব্যাটসম্যান হিসাবেই তিনি মহান? না, আদমি হিসাবেও আমলা অসাধারণ। এই লেখাটায় আমরা দেখতে চাই আমলার সকল দিক, যা তাকে আলাদা করেছে ক্রিকেট বিশ্বের বাকি সবার থেকে।
আমলার নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শুশ্রুমন্ডিত এক আদমির অবয়ব। বুক সমান নেমে আসা দাঁড়িই বলে দেয় ধর্মের প্রতি তার অণুরাগের কথা। এ কথাটা ক্রিকেট বিশ্ব অনেক পরে জানলেও ধর্মের প্রতি আমলার এই আনুগত্য কিন্তু কৈশরকাল থেকেই। অনুর্ধ্ব ১৯ দলে থাকার সময়ই নিয়মিত সালাত আদায় করা আমলা রুমমেটকে জিজ্ঞাসা করে নিতেন ভোর বেলায় তার ইবাদাত তার রুমমেটের কোন সমস্যার কারণ হবে কি না? এখানে আমলার দুটি পরিচয় পাওয়া যায় পয়লা, তার ধর্মানুরাগের এবং দ্বিতীয়ত ধর্মপালন অপরের সমস্যার হেতু হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সচেতনতার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন হয়ে উঠলেন অন্যতম তারকা, তখনও বদলায়নি এই স্বহজাত গুণ। নিজ ধর্মের বিষয় তিনি যেমন অন্ধরুপে অনুগত একই রকম শ্রদ্ধাশীল অপর ধর্মাবলম্বীদের মতামত শোনার ক্ষেত্রেও। যা তাকে করে তুলেছে কট্টর কথিতদের চেয়ে আলাদা। এ থেকে যে আমলার ব্যক্তিত্বের একটি রুপ প্রকাশ প্রায় এমনই না শুধু, বরং দলের অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার বলুন বা তরুণরাও এ থেকে শিক্ষা নেয় ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল হবার।
ধার্মিক শব্দটা শুনলেও আমাদের চোখের সামনে নিজের অজান্তেই ভেসে ওঠে গুরুগম্ভীর এক মুখ। অথচ আমলার রয়েছে প্রচন্ড রকমের রসবোধ। আড্ডারত সতীর্থদের থেকে দুরে এক কোনে বসে হয়তো যত্ন নেবেন নিজের প্রিয় ব্যাটের, কিন্তু কানদুটো থাকবে আড্ডার আলোচনায়। তাৎক্ষণিক কোন টিপ্পনিতে হয়তো তিনি যে সব শুনেছেন তার জানান দিবেন না, কিন্তু দল যখন বিমর্ষ; ঠিক তখনই আগের আড্ডার নির্জাস থেকে নেয়া রসে হাসিয়ে মারবেন সবাইকে। যার কারণে ড্রেসিংরুমে আমলা ভীষণ প্রিয় এক মুখ।
আফ্রিকান খেলোয়াড়রা বিশ্বাস করে যে আমলা দলে থাকা মানেই বাড়তি ত্রিশটি রান যোগ করে ব্যাটিংয়ে নামা। হয়তো তিনি শূণ্যতেই ড্রেসিংরুমে ফিরেছেন, তবুও বিশ্বাসের এ জায়গাটি থাকে অটল। কারণ, আমলা কখনোই নিজের অভিজ্ঞতা গোপন রাখেন না, বরং প্রত্যেককে সাহায্য করেন নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। যা দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় তরুণ ক্রিকেটাররা। খুবই দ্রুত পিচের কন্ডিশন, প্রতিপক্ষের শক্তির ওপর সঠিক ধারণা করার সহজাত একটি গুণ আমলার রয়েছে। তাই যতদ্রুতই আউট হন না কেন ড্রেসিংরুমে ফিরে সতীর্থদের সঠিক পরামর্শটি খুব সহজেই দিতে পারেন তিনি। আর তার এ অভিজ্ঞতাটাই আফ্রিকার স্কোর বোর্ডে বাড়তি ত্রিশটি রান যোগ করে বলে বিশ্বাস করে আফ্রিকান খেলোয়াড়রা। আরো একটি গুণ আমলার অনন্যতার প্রমাণ বহন করে। নিজের সাফল্যের কলাকৌশলটুকু নিজের মাঝেই আটকে না রেখে বরং সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে ভালোবাসেন তিনি। যা নতুনদের তো বটেই, উপকৃত করে ফর্মের সাথে যুদ্ধরত খেলোয়াড়দেরকেও।
ব্যক্তি হিসাবে দলে যিনি এতটা জনপ্রিয় ব্যাটিংয়ে জুটি বাঁধার ক্ষেত্রে তিনি কেমন, এ প্রশ্নটি মনে উকি দেয়া স্বাভাবিক। আফ্রিকার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ তিনটি জুটির দুটিতেই জড়িয়ে আছে আমলার নাম। জ্যাক ক্যালিসের সাথে জুটি বেধে ৬১ দশমিক ২৯ গড়ে করেছেন ৩ হাজার ৯২৩ রান। এবং গ্রায়েম স্মিথের সাথে জুটি বেধে ৫৭ দশমিক ১৫ গড়ে করেছেন ৩ হাজার ৬৫৮ রান। আমলার সাথে জুটি বাঁধাটা খুবই উপভোগ করতেন স্মিথ। কারণ, দ্রুত লয়ে রান তুলতে অভ্যস্ত আমলা চাপ কমিয়ে দেন সতীর্থের ওপর থেকে। মজার বিষয় হচ্ছে, দুজনের কারোই আফ্রিকান ভাষা সে রকম আয়ত্বে ছিলো না। ভাঙ্গা আফ্রিকান আরো চোস্ত ইংরেজিতে দুজন দুজনের সাথে কথা চালাতেন।
একটু নজর দেয়া যাক যে কারণে আমলা জগতখ্যাত, সেই ব্যাটিংয়ের আমলনামার দিকে। অদ্ভুত ব্যাকলিফট, প্রথাভাঙ্গা স্ট্যান্সের কারণে শুরুর দিকে আমলার সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। মুগ্ধতাও যে ছিলো না তা না। যেমন সাবেক আফ্রিকান অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথই আমলার এই বিচিত্র স্ট্যান্সের একজন বড় ভক্ত। হওয়াটাও স্বাভাবিক, কারণ স্মিথের স্ট্যান্সও ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী। শুরুর দিকে কাঙ্খিত সাফল্য না পাওয়ায় সন্দেহবাদীদের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হবে বলে অনুমান করেছিলেন অনেকে। কিন্তু অনুমান আর বাস্তবতা এক জিনিস না। আফ্রিকার ইতিহাসের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরির মালিক আমলার রেকর্ড ভান্ডারই প্রমাণ করে সন্দেহবাদীদের সেই অমূলক অনুমানকে তিনি শুধু ভুলই না হাস্যকরে প্রমাণ করে ছেড়েছেন। সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার ডেল স্টেইন যখন বলেন যে, আমলার বিপক্ষে বোলিং করার পর তার নিজেকে কোনো বোলারই মনে হয় না, আত্মবিশ্বাস গিয়ে ঠেকে তলানিতে তখনই বোঝা যায় ব্যাটসম্যান হিসাবে আমলা কোন মানের।
রহস্যটা কি? কোন জাদুমন্ত্রবলে পুরো পরিস্থিতিই বদলে দিলেন তিনি? একটাই কাজ, পরিশ্রম। কঠোর পরিশ্রম। আমলার মতো কঠোর পরিশ্রমী ক্রিকেটার আফ্রিকা তো বটেই ইতিহাসেই বিরল। নেটে সর্বোচ্চ সময় কাটানো এই ব্যাটসম্যান সহকারী কোচদের জন্য রীতিমতো এক দুঃস্বপ্নের নাম। যতক্ষণ নিজেকে পরিপূর্ণ প্রস্তুত মনে না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নেটে প্র্যাক্টিস চালিয়ে যান। এবং, তাও প্রথাগত কোনো পদ্ধতিতে না। দৃষ্টির প্রখরতা বাড়াতে আমলা নেটে হাজির হন একব্যাগ গলফ বল নিয়ে। এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচকে বলেন দ্রুত গতিতে সে বলগুলো গুড লেংন্থে তার দিকে ছুড়ে মারতে। এটি যেমন তার দৃষ্টির প্রখরতা বাড়াতে সাহায্য করে তেমনি জানিয়ে দেয় নিজেকে নিখুঁত করে তুলতে কতটুকু সচেষ্ট তিনি। এটা তো একটা দিক, বোলারদের মুখোমুখি হবার সময় প্রচন্ড আক্রমণাত্বক থাকেন তিনি নেটে। আগেই যেটা বলা হয়েছে, আমলার এই রুপ আত্মবিশ্বাস টলিয়ে দেয় ডেল স্টেইনের মতো বোলারেরও।
এতটা পরিশ্রম যিনি করেন তার কি কোনো খুত আছে? বা থাকা সম্ভব? এ বিষয়েও কথা বলেছেন স্টেইন। যিনি মনে করেছিলেন আমলার দূর্বলতা তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। দুবার স্লোয়ারে আমলাকে পরাস্ত করা স্টেইনগান আমলাকে বধ করার জন্য তৃতীয়বার যখন এ অস্ত্রটি ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালালেন, তখন যে জওয়াবটি আমলা দিয়েছিলেন সেটিকে লা জওয়াব কবুল করে স্টেইন বলেছেন আমলার সত্যিকার অর্থে কোনো দূর্বলতা নেই। আমলাকে আউট করা এক ধরণের জুয়া খেলার মতো। কোনো এক ধরনের বলে হয়তো তিনি অস্বস্তিবোধ করতে পারেন দু একবার, কিন্তু সে বলটিকেই পরবর্তিতে বাউন্ডারিতে পরিণত করতে পারেন অনায়াসে।
আমলার ব্যাটিং এর একটা অলস সৌন্দর্য্য রয়েছে। চরম আগ্রাসী মনোভাবেও যখন ব্যাটিং করেন সে সময়ও তার শান্ত সৌম্য চেহারা আপনাকে দ্বিধায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আমলাকেই আখ্যা দিয়েছেন নিজের মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে কঠিন ব্যাটসম্যান হিসাবে। ওভারে টানা পাঁচটি বল ডট দিলেও শেষ বলে সহজেই বাউন্ডারি আদায় করে বোলারকে হাসিমুখে হতাশা করাটাকে ক্রিকেটের অন্যতম সুন্দর একটি দৃশ্যে পরিণত করেছেন তিনি। পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমলা বরাবরই স্থির। ঠান্ডা মাথায় ঠোঁটের হাসিটুকু সামান্য ম্লান হতে না দিয়ে যেভাবে তিনি বোলারদের দুঃস্বপ্ন উপহার দেন, সেটি ব্যাখ্যা করার মতন সঠিক কোনো শব্দ বোধ করি এখনো সৃষ্টি হয়নি।
অনেক সময়ই অমিত প্রতিভাধরদের নৈপুণ্য পরিসংখ্যানের বোবা সংখ্যায় বোঝা যায় না। কিন্তু আমলার ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম। পরিসংখ্যানও কথা বলছে আমলার হয়েই। তৃতীয় আফ্রিকান হিসাবে অপেক্ষায় রয়েছেন ৯ হাজার রানের ল্যান্ডমার্ক ছোঁবার। ১১৬ টেস্টে ৪৮ দশমিক ৩১ গড়ে তার সংগ্রহ ৮ হাজার ৯৩৯ রান। শতক এবং অর্ধশতকের সংখ্যা যথাক্রমে ২৮ এবং ৩৯টি। টেস্টের চেয়েও উজ্জ্বল আমলার ওয়ানডে রেকর্ড। ১৬৪ ম্যাচে ৫০ দশমিক ২৩ গড়ে করেছেন ৭ হাজার ৫৩৫ রান। শতক ২৬টি, অর্ধশতক ৩৫টি। ওয়ানডেতে দ্রুততম ২ হাজার, ৩ হাজার, ৪ হাজার, ৫হাজার, ৬ হাজার এবং ৭ হাজার রানের মাইলফলক ছোঁবার কৃতিত্বও আমলারই। সাথে যোগ করুন দ্রুততম সময়ে অষ্টম, নবম, এগারোতম, তেরোতম থেকে ছাব্বিশতম সেঞ্চুরির রেকর্ড। একমাত্র আফ্রিকান ব্যাটম্যান হিসাবে রয়েছে ওয়ানডেতে ২৫টি সেঞ্চুরি। ভিরাট কোহলির সাথে যৌথভাবে দ্রুততম ৫০টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির রেকর্ডেরও মালিক তিনি। মাত্র চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই কমপক্ষে ২৫টি সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান তিনি।
দলের সতীর্থদের নিকট জনপ্রিয়তা এবং ব্যাটসম্যান হিসাবে ধারাবাহিক সাফল্যই যে আমলার অধিনায়কত্ব প্রাপ্তির একমাত্র কারণ ছিলো এমনটা কিন্তু না। আমলা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ২০০২ অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা আফ্রিকান দলের। মাত্র ২১ বছর বয়সে নেতৃত্ব লাভ করেন ঘরোয়া দল কাওয়াজুলু-নাটাল দলের। সুতরাং এক যুগেরও বেশি সময় আফ্রিকার নেতৃত্ব দেয়া গ্রায়েম স্মিথের বিকল্প হিসাবে আমলা ছিলেন একরকম অটোমেটিক চয়েজ। কিন্তু এখানেই এসে বদলে যায় হিসাব। যার ব্যাটের ওপর ভরসা করে একের পর এর ম্যাচে হেসেছে আফ্রিকানরা, তিনি আফ্রিকার ৩৩ম টেস্ট অধিনায়কের বদলে হয়ে যান প্রথম অশ্বেতাঙ্গ পূর্ণাঙ্গ অধিনায়ক।
প্রথম থেকেই অনেকেই বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেননি। কারণ, আমলার জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই আফ্রিকাতে হলেও তার পূর্ব পুরুষ ভারতীয়। তাই, একজন ভারতীয়র হাতে কতটা নিরাপদ আফ্রিকান দল এমন সব অপ্রিয় প্রশ্নও ওঠা শুরু হয়। তখন, আমলার অতীত পুরোটাই যেন অদৃশ্য হয়ে যায় চোখের সামনে থেকে। মাত্র ১৪ টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। যার চারটিতে আফ্রিকা জিতেছে, চারটিতে হেরেছে এবং বাকি ছয়টি হয়েছে ড্র। অধিনায়কত্বের পাশাপাশি নিজেকে আফ্রিকান প্রমাণের চাপটাও বোধয় চেপে বসেছিলো আমলার ওপর। তাই, সর্বদা হাসা ব্যাটটার সাথে সাথে মুখটাও মলিন হতে শুরু করে। আমলা খুব বেশি সময় নেননি সড়ে দাড়ানোর জন্য। বাড়তে থাকা সমালোচনার সুর আরো চওড়া হবার আগে স্বেচ্ছায়ই সড়ে দাড়ান অধিনায়কত্ব থেকে। অথচ, অধিনায়ক আমলাও দলের অন্দরে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়।
তাই অধিনায়কত্ব ছাড়ার অনেক দিন পর মুখোমুখি হয়েছিলেন এক গণমাধ্যমের। যেখানে মন খুলে কথা বলেছেন বলেছেন বর্ণবাদসহ স্পর্শকাতর কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে।
বর্ণবাদ প্রসঙ্গে আমলা…
আমি বলবো, আপনার জীবনে আপনি কঠিন সময়ে মধ্য দিয়েই যাবেন। আমার জীবনে আমি সবচেয়ে কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে স্কুল জীবনের পরে, ক্লাব পর্যায়ে, এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পেশাদার ক্রিকেটার হিসাবে। অব্যশ্যই শুরুর দিকে এ সকল বিষয় আপনাকে ভীত করে তুলবে। কিন্তু আমি যতো পেছনে ফিরে তাকাই, আমার মনে হয়, সত্যি বলতে কি বর্ণবাদ বিষয়টা আসলে ক্রেজি। এখন বয়স বাড়ার কারণে, আমি খুব ভালো করেই লক্ষ্য করতে পারি বাকি খেলোয়াড়রা কিভাবে এই বর্ণবাদী আচরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমার নিজেরও একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। যখন টেম্বা (টেম্বা বাভুমা) প্রথম সেঞ্চুরিটি পেলো, আমি মোটেও অবাক হইনি। কারণ, আমি জানি ও একটা দারুণ খেলোয়াড়। এটা একটা দারুণ অনুভুতি যে বিষয়টি এখন অন্যরাও জানে। আমাকে ওর কনভিন্স করার কিছুই ছিলো না, কিন্তু অন্যদেরকে অবশ্যই করতে হতো।
দক্ষিণ আফ্রিকান দলের পরিচয় বদল প্রসঙ্গে আমলা বলেন…
দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট দলের পরিচয় দেশের পরিচয়ের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এবং আফ্রিকা এখন সবাইকে নিজের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে। বিষয়টিকে আমি যেভাবে দেখি, আপনি যখন কাউকে আপনার সম্পর্কে জানাতে যাবেন, আপনি প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়েই সেটি করবেন। আর যারা মুখস্ত ধ্যান ধারণা নিয়ে বসে আছে, তারা বলবে, ফিরে এসো, ফিরে এসো, ওখানে বিপদ আছে! ওখানে সিংহ আছে, এটা আফ্রিকা। প্রচলিত ধারণাটি এমনই
নিজের প্রসঙ্গে বলেন…
আমি নিজেকে কেন বাক্স বন্দি করে রাখবো? আমি একজন বাবা, একজন সন্তান, একজন ভাই, একজন আফ্রিকান… যার শিকড় ভারতে। এটা খুব সহজ একটা বিষয়। আমি তেমনই যেমনটা আমি হতে চেয়েছে, বাকি কে কি ভাবলো সেটি আমি তাদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছি। আমি মানুষের পারসেপশান, প্রিজুডিস বদলাতে পারবো না। ‘প্রিজুডিস’ শব্দটার উৎপত্তি ‘প্রিজাজ’ থেকে, সুতরাং কেউ যদি প্রিজাজ করতে চায়, করুক
রিকি পন্টিং এর ভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে…
আমি তাকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছি, যেভাবে সে ডমিনেট করতো, আমি খুবই উপভোগ করতাম বিষয়টা। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তার বিপক্ষে কয়েকটি ম্যাচ খেলার, এবং আমি তাকে চমৎকার কয়েকটা সেঞ্চুরি করতে দেখেছি আমাদের বিপক্ষে। দেশে এবং বিদেশে। সুতরাং, তার শেষ ম্যাচে সে যখন আউট হলো আমি খুশি ছিলাম, কারণ আমরা টেস্টটা জিতেছিলাম। একই সাথে আমার ভিতর একটা দুঃখবোধও কাজ করছিলো, আর কখনোই এই অসাধারণ ব্যাটসম্যানটিকে একমাঠে দেখতে পারবো না।
সুমাইয়াহ আমলার স্বামী হাশিম আমলা ১৯৮৩ সালের এই দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে জন্মগ্রহণ করেন। এ দম্পতির রয়েছে দুটো পুত্র সন্তান। হাশিম আমলার ভাই আহমেদ আমলাও একজন ক্রিকেটার।
দুঃখের বিষয় এই যে, মুসলিম হবার কারণে যে হাশিম আমলাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছিলেন সাবেক অজি ক্রিকেটার ডিন জোন্স, সেই আমলার পূর্বপুরুষের দেশ ভারতে আজ মুসলিমরা চরমভাবে নিগৃহীত। শুধু মাত্র ভারতীয় শিকড়ের কারণে, আফ্রিকা তো বটেই ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হবার পরেও যিনি অনেক আফ্রিকানের কাছে এখনো একজন ‘অশ্বেতাঙ্গ’ বলেই পরিচিত; সেই ভারতের এই হালত আমলাকে কতটা ব্যাথিত করে সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।