সন্তানকে কি অতিরিক্ত প্রাধান্য দিচ্ছেন?

সন্তানকে কি অতিরিক্ত প্রাধান্য দিচ্ছেন?

তিন সন্তান রয়েছে এবং তারা কেউই এখনো কৈশোর পার করেনি এমন এক দম্পতিকে সম্প্রতি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনাদের পরিবারে কে বা কারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?’

অন্যসব আদর্শ মা-বাবার মতো তাদেরও উত্তর ছিল, ‘আমাদের শিশু সন্তানরা।’

‘কেন?’ কী কারণে তারা গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে চাইলে নির্দিষ্ট কোনো উত্তর মেলেনি। আবেগ হাতড়িয়ে কিছু কথা বলেন তারা। তখন বিশেষজ্ঞের অভিমতটা তুলে ধরা হয়– ‘আপনাদের শিশু সন্তানদের এমন স্ট্যাটাস বা অবস্থান দেয়ার কোনো সঠিক কোনো যুক্তি আসলে নেই।’

এরপর বর্তমানে সংসারে (সবক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই) শিশু সন্তানদের নিয়ে যেসব সমস্যা হরহামেশা তৈরি হয় এর কারণ বুঝতে চেষ্টা করা হয়। সমস্যাগুলোর কারণ হলো, শিশুদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয় যেন তাদের মা-বাবার বিয়ে, সংসারের অস্তিত্ব বজায় থাকে কেবল শিশু সন্তানের জন্যই। অথচ বাস্তবতা প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত। শিশু সন্তানরাই বরং মা-বাবার বিয়ে আর সাংসারিক নানান উন্নতির দ্বারা স্থিতিশীল একটি পরিবার বিনির্মাণের বদৌলতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়।

দেখা গেছে, মা-বাবা না থাকলে শিশু সন্তানরা ভালো খেতে পেতো না। তাদের পরিপাটি পোশাকের ব্যবস্থা হতো না। ছিমছাম যে বাড়িতে তারা থাকে সেটি পেতো না। তারা যে আনন্দময় নির্বিঘ্ন সময় কাটায় তাও সম্ভব হতো না। মা-বাবার অনুপস্থিতিতে দুর্ভাবনাহীন একটা জীবনের পরিবর্তে (মাঝে মধ্যে নিজেরা দুর্ভাবনা উদ্রেক করা সত্ত্বেও) বরং তাদের একটি দুশ্চিন্তাময় ও অভাবী জীবন কাটবে।

এই আলোচনার সত্যিকারের মূল বিষয় এটিই। আমরা যারা ষাট সত্তরের দশকে জন্ম নিয়েছি, তাদের সবাই জানে, মূল বিষয়টি আসলে এখানেই। কারণ আমরা যখন শৈশব-কৈশোরেই ছিলাম তখন পরিবারে আমাদের মা-বাবাই অগ্রগণ্য ছিলেন। ওই কারণেই আমরা মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করেছি, গুরুজনদের যত্ন নিয়েছি। হ্যাঁ এমনটাও জানি, কোনো এক সময় আমেরিকায় ভার্জিনিয়ায় কিছু ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত নাগরিক বিবেচনা করা হতো।

যে সাধারণ বিষয়গুলোয় আলোচনা করছি তা থেকে এমনটা বলা ভুল হবে না যে, মা-বাবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের তুলনা বা বিশ্লেষণে এটি আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল, আমাদের মা-বাবার কাছে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কটিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। ওই উপলব্ধির জন্যই আমরা তাদের শয্যায় শুতে যেতাম না কিংবা তাদের কথাবার্তায় কখনো ব্যাঘাত ঘটাতাম না। স্কুলে ক্লাস-পরবর্তী যাবতীয় কার্যক্রমের তুলনা করলে ঘরে পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াটাই বেশি গুরুত্ববাহী ছিল।

মা-বাবা নানান কথা বলতেন। আমাদের সঙ্গে যতটা বলতেন এর চেয়ে বেশি বলতেন নিজেদের মধ্যে। প্রয়োজনের চেয়ে বাড়তি গুরুত্ব না পাওয়ায় অন্যসব শিশু যে সময় থেকে হয় এর চেয়ে আগে-ভাগেই আমরা স্বাধীনচেতা মনোভাবের অধিকারী হতে পেরেছিলাম।

কোনো প্রতিষ্ঠানে যেমন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) থাকেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেনাবাহিনীতে একজন মেজর জেনারেল থাকেন, একটি শ্রেণিকক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থাকেন শিক্ষক, তেমনি একটি পরিবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসলে মা-বাবা।

শিশু সন্তানদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা। কারো প্রাথমিক লক্ষ্যই এমন সরলরৈখিক হওয়া উচিত নয় যে, কোনো শিক্ষার্থী একাধিক খেলায় অন্যদের চেয়ে পারদর্শী হবে, অলিম্পিকের সাঁতারু দলে জায়গা করে নেবে আবার প্রথম সারির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মানব মস্তিষ্কের খ্যাতিমান কোনো শল্যচিকিৎসকও হবে।

কোনো শিশুকে গড়ে তোলার প্রাথমিক লক্ষ্য এমন হওয়া উচিত যেন তার দ্বারা তার নিজস্ব কমিউনিটি ও সংস্কৃতি শক্তিশালী বা উপকৃত হয়।

‘পরিবারে আমাদের শিশু সন্তানরাই সবচেয়ে অগ্রগণ্য’- এমন ধারণা বা চর্চা হচ্ছে শিশুদের ‘বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন’ ভাবিয়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক একটি পদক্ষেপ। আপনারা এমনটি চাইবেন না। এটি আপনার শিশু সন্তানের অজ্ঞাতেও না তার জন্য জরুরি, না জরুরি দেশের ভবিষ্যতের জন্য।


পরিবার ও শিশুর লালনপালন বিশেষজ্ঞ এবং বিখ্যাত কলামিস্ট জন রোজমন্ড এর কলাম অবলম্বনে লিখিত। লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাপলস ডেইলি নিউজে গত ১ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়।