ভ্যান গগ : ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে বর্ণময় জীবনের আলোকচ্ছটা

৩০ মার্চ ভ্যান গগের জন্মের ১৬৫ বছর

ভ্যান গগ : ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে বর্ণময় জীবনের আলোকচ্ছটা

১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই, এক বিষন্ন সন্ধ্যায় প্যারিসের উত্তর-পশ্চিমের অখ্যাত গ্রাম ঔর্ভস এর শষ্যক্ষেতে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ নিজের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালালেন। ঠিক দুইদিন পর ৩৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু-মুহুর্তে যেই ভ্যান গগ যেকোন বিচারে চূড়ান্তরকম ব্যর্থ, বাউন্ডুলে, শারীরিক ও মানসিক পীড়ায় কপর্দকহীন এক পাগল আঁকিয়ে, সেই তিনিই আজ মৃত্যুর শতাধিক বছর পর চিত্রকলা জগতের সর্বকালের ইতিহাসের এক মহানায়কে পরিণত হয়েছেন। জীবদ্দশায় যাকে প্রতিনিয়ত নানামূখী আঘাতে-পীড়নে জর্জরিত হয়ে সকলের নিকট থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে, বেঁচে থাকাকালীন যার আঁকা কেবলমাত্র একটি ছবি বিক্রি হয়েছিল, সেই শিল্পীর চিত্রকর্ম আজ গোটা দুনিয়ার আর্ট গ্যালারিগুলোর গর্বের সংগ্রহ। দারিদ্রের কশাঘাতে অহর্নিশ আহত ভ্যান গগের আঁকা কোন ছবি কোন দুর্লভ মুহুর্তে আজ যখন নিলামে ওঠে, তখন জগতের তাবৎ জাদুঘর, সংগ্রহশালা, বিত্তশালী শিল্পপ্রেমিক ও সংগ্রাহকেরা তা কেনার জন্যে রীতিমত হামলে পড়েন। বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়া দশটি ছবির কয়েকটিই ভ্যান গগের আঁকা চিত্রকর্ম। জীবদ্দশায় অবিশ্বাস্য রকমের রিক্ত ভ্যান গগ যেন মহাকাব্যের সেই ট্র্যাজিক নায়ক, যিনি সমকাল দ্বারা নিপীড়িত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন; কিন্তু মৃত্যুর পর উপলব্ধি ও সহানুভূতির দ্বারা হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি।

ভ্যান গগ হল্যান্ডের বেলজিয়ান সীমান্তের কাছে জুন্ডার্ট নামক স্থানে ১৮৫৩ সালের ৩০শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন প্রটেস্ট্যান্ট পল্লীযাজক। অনটনময় সংসারের বোঝা বইতে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভ্যান গগ বিখ্যাত শিল্পকর্ম পরিবেশক গুপিল গ্যালারির সামান্য কেরানির কাজে যোগদান করেন। প্রথম চার বছর হেগ এবং পরবর্তীতে দুই বছর লন্ডনে কাজ করেন ভ্যান গগ, এসময় থেকেই শিল্পকলার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হতে থাকেন ভ্যান গগ। ১৮৭৫ সালে ভ্যান গগকে সংস্থাটির সদর দপ্তর প্যারিসে বদলি করা হয়। শোনা যায়, সেসময় তিনি ক্রেতাদের পছন্দের ছবি সরবরাহ না করে তাদেরকে ভিন্ন আবহের ছবি ক্রয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন, এমনকি সেখানে তিনি ক্রেতাদের সাথে একরকম বিবাদ-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন। অনিবার্য ফলস্বরুপ মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। তার চাকুরি হারানোর অন্যতম কারণ ছিল, চিত্রশিল্প ব্যবসা যে একটি সুসংগঠিত জালিয়াতি, তা প্রকাশ করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না।

ভ্যান গগ শৈশব থেকেই ছিলেন অন্তর্মুখী, আবেগপ্রবণ ও প্রচন্ড আদর্শবাদী। চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর তিনি ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এবং তারপর ধর্মশিক্ষা বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে চলে যান। ১৮৭৬ সালে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন এবং একটি পুস্তক বিপণিতে অল্প কিছুদিন কাজ করেন। পরবর্তীতে আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রাসেলসে একটি ধর্মশিক্ষা কলেজে তিনি ধর্ম ও যাজকবৃত্তি শিক্ষালাভের চেষ্টা করেন। শিক্ষালয়ের নিয়মানুবর্তিতা আর নৈমিত্তিকতা তাকে অতিষ্ট করে তোলে এবং তিনি ব্যর্থ হন। কিন্তু ধর্ম ও সেবামূলক কাজের প্রতি প্রবল আবেগ থেকে ১৮৭৮ সালে বেলজিয়ামের বরিনেজ অঞ্চলে খনিশ্রমিকদের মাঝে ধর্ম প্রচারের কাজে যোগ দেন ভ্যান গগ। পরম পছন্দের বৃত্তি হওয়াতে প্রচন্ড উৎসাহে নেমে পড়েন তিনি। দায়িত্বের চেয়ে অতিরিক্ত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তিনি নিজেকে কাজে প্রবৃত্ত করেন। অত্যন্ত আবেগী ভ্যান গগ দরিদ্র আর অসহায় খনিশ্রমিকদের বঞ্চনা দেখে প্রায়শই তার নিজের রোজগার ও সর্বস্ব দান করে দিতেন। বেলজিয়ামের সেই কয়লাখনির শ্রমিকদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও নিজের হৃদয়ের রক্তাক্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন মজুরদের স্কেচ আঁকতে আঁকতে। কখনো ব্রাসেলস, কখনো হেগ এবং ড্রেন্থের জেলে এলাকা হয়ে ভ্যান গগ ১৮৮০ সাল থেকে পারিবারিক নিবাস ন্যুয়েনেন এ বাস করতে থাকেন, এবং ছোট ভাই থিওর অর্থানুকুল্যেই শিল্পকলার দীক্ষা নিতে থাকেন। ১৮৮৫ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, এ সময় তিনি তার পাশেই ছিলেন। এরপর এন্টর্প হয়ে ১৮৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অপুষ্টি ও দারিদ্রে রোগজীর্ণ শরীর নিয়ে ভ্যান গগ প্যারিসে তার ভাই থিও’র আশ্রয়ে এসে হাজির হন।

ন্যুয়েনের চার্চ (১৮৮৪)

প্যারিসে এসে থিও’র মাধ্যমে পিসারো, গগা, সেজানদের মতো নামকরা শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন তিনি। এদের সবার কাছ থেকেই ভ্যান গগ শিল্পকলার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন নির্বিচারে, কিন্তু রেখেছেন যেটুকু তার প্রয়োজন। “ইম্প্রেশনিজম” তাকে একসময় প্রবলভাবে আলোড়িত করে। ইম্প্রেশনিস্ট ও ডিভিশনিস্ট শিল্পীকূলের মাঝে তাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছিল জ্যা ব্যাপ্টিস্ট গুইলামিন ও বর্ষীয়ান ক্যামিল পিসারো।

১৮৮৭ সালের শেষ নাগাদ ভ্যান গগের কাছে প্যারিসের জীবন হয়ে উঠলো ক্লান্তিকর। ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় আর্লে নামক জায়গায় আস্তানা গাড়লেন।

ইউরোপের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের আবহাওয়াগত পার্থক্য ব্যাপক। উত্তরের রৌদ্রহীন, কুয়াশাচ্ছন্ন, ধুসর ও বর্ণহীন প্রকৃতির তুলনায় ভূ-মধ্যসাগরের সন্নিকটের দক্ষিণাঞ্চল অনেক বেশি উষ্ণ, রৌদ্রোজ্জল ও বর্ণবিভায় ঝলমলে। আর্লেতে এসে ভ্যান গগ যেন তার স্বপ্নের বিষয়বস্তুর সন্ধান পেলেন। এখানকার পথঘাট, প্রান্তর, সরল-সজীব গ্রামীণ মানুষের জীবনাচরণ তার ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের ছটায় স্থান করে দেয়।

দ্য পটেটো ইটার (১৮৮৫)

প্রতিদিন তিনি মেঠোপথ ধরে অনেকদূর হেঁটে যেতেন, এবং একটি বিষয় নির্বাচন করে রং-তুলি-ক্যানভাসে তা গেঁথে রাখতেন। ক্লান্তি নেই, ক্ষুধা, নেই, প্রখর রোদ মাথায় এমনকি টুপিহীন অবস্থায় অবিশ্রান্ত এঁকেছেন ভ্যান গগ। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তুলির উদ্দীপ্ত আঁচড়ে ক্ষিপ্ত একের পর এক তৈলচিত্র ও স্কেচ। উজ্জ্বল স্পন্দিত রক্তিম লাল, পান্না সবুজ, রৌদ্রাভ হলুদ ও প্রদীপ্ত নীলবর্ণের নান্দনিক ব্যবহারে অনবদ্য হয়ে উঠেছে ভ্যান গগের আঁকা ছবিগুলো।

ভ্যান গগ প্রণয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, ভুগেছেন অদ্ভুত মানসিক অস্থিরতা আর যন্ত্রণায়। কখনো আবার ক্যাফেতে গিয়ে পরিচারিকাকে নিজের কান কেটে দিয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন স্থানীয় পত্রিকায় শিরোনাম। একসময় নিজেই নিজেকে ভয়ঙ্কর ভাবতে লাগলেন। রাস্তায় বেরোলে দুষ্টু ছেলের দল তাকে উত্যক্ত করতো। স্থানীয় অধিবাসীদের আর্জিতে মেয়র তাকে মনোরোগ-আশ্রমে পাঠিয়ে দেন। এখানেই ভ্যান গগ আঁকেন প্রায় ১৫০টি তৈলচিত্র, অসংখ্য রেখাচিত্র আর জলরঙে আঁকা ছবি। এসব ছবির প্রত্যেকটিই তার শৈল্পিক বিস্ফোরণের একেকটি মাইলফলক। মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত ভ্যান গগ তার শেষ ৭০ দিনে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এঁকেছেন ৭০টি তৈলচিত্র ও ৩০টি জলরংচিত্র। কিন্তু শিল্পবোধের আঙ্গিকে বিচার করলে প্রতিটি ছবি কালোত্তীর্ণ ও অমূল্য সম্পদ। তিনি যেন বুঝতে পারছিলেন তার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও তার মনোরোগ চিকিৎসক ডা. গ্যাচেটের মতো অনেককে অমর করে গেছেন প্রতিকৃতি অঙ্কন করে।

দ্য নাইট ক্যাফে (১৮৮৮)
পোট্রেইট অফ ডা. গ্যাচেট (১৮৯০)

ভ্যান গগ সম্পর্কে অনেক রংচড়ানো কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল। কিন্তু ১৯২৭ সালে ও ১৯২৯ সালে ছোটভাইকে লেখা তার পত্রগুচ্ছ প্রকাশিত হলে বোঝা যায়, কতটুকু পরিশীলিত ও সুশৃঙ্খল শিল্পমানসের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার সেই চিঠিগুলো ছিল শিল্পী জীবনের দৈনন্দিন জীবনযাপন, অর্থাভাব, ক্ষোভ, অসুস্থতা, গ্লানির রোজনামচা যা বিশ্বের পত্রসাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ।

১৮৯০ সালে ভ্যান গগের মৃত্যুর ছয়মাস পর তার ভাই থিও অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। থিও’র স্ত্রী জোহানার আন্তরিক আগ্রহ আর প্রচেষ্টায় ১৮৯১ সালের মাত্র ১০টি ছবি নিয়ে ভ্যান গগের শূন্যতা বুকে নিয়ে প্যারিসে প্রথম প্রদর্শনী হয়। ১৮৯২ সালে হেগে তার আঁকা ছবি নিয়ে বড় রকমের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তার আঁকা সানফ্লাওয়ার, দি পটেটো ইটার্স, আর্লের ক্যাফে, স্টারি নাইটসহ অনেক ছবি যা জীবদ্দশায় কদর না পেলেও আজ একেকটি মাস্টারপিস। উজ্জ্বলরঙের ব্যবহার বিশেষ করে রৌদ্রাভ হলুদ রঙ তার ছবির হাইলাইট। তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে যতো আলোচনা হয়েছে তা খুব কম শিল্পীকে নিয়েই হয়েছে।

তাকে নিয়ে লেখা আরভিং স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’ একটি ক্ল্যাসিক সাহিত্যকর্মের মর্যাদা পেয়েছে গোটা পৃথিবীজুড়ে।

ভ্যান গগের শিল্পীজীবন মাত্র এক দশকের আর তার পূর্ণ বিকশিত সৃষ্টিকাল কয়েকটি বছরমাত্র। এই স্বল্প সময়ে তিনি অর্জন করেছেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আসন। জীবনে এত বেশি বঞ্চনা ও মৃত্যুতে এতটা অধিক অভিনন্দন পৃথিবীর অন্য আর কোন শিল্পীর উপর বর্ষিত হয়নি। তিনি নিজেই লিখেছেন, “জীবনে কোন মহৎ ঘটনাই আকস্মিকভাবে ঘটতে পারে না, তাকে ইচ্ছাশক্তিতেই ঘটাতে হয়।” ভ্যান গগের সাহিত্যপাঠ ছিল প্রচুর। পূর্বাপর বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি ও শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভ্যান গগ চিত্রশিল্পের ভাষাকে এমন এক প্রবল শক্তি ও আকর্ষণ দান করেছেন যা যুগ যুগ ধরে অগণিত শিল্পপ্রেমিকদের হৃদয়কে আলোড়িত করবে।