সম্প্রতি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হিন্দু ধর্ম ও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিখতে একটি বিশেষ কমিটি ঘোষণা করেছে। হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের এই কমিটিকে ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে অতিমাত্রায় গৌরবান্বিত করে রং চড়ানোর আয়োজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকেই। দ্য হিন্দুর অনুরাধা রমনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ভারতীয় ইতিহাসের প্রবীণ অধ্যাপক রোমিলা থাপার। জবানের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে দেয়া হলো।
অনুরাধা রমন : আমরা শুনেছি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সাথে সেসময়ের মহাআখ্যানগুলো যেমন রামায়ণ এবং মহাভারতের একটি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। আপনি সেই প্রস্তাবনাকে কিভাবে দেখছেন?
রোমিলা থাপার : প্রথমত ইতিহাস কখনো কোন কমিটি করে লেখা যায় না, ইতিহাস লেখা হয় ঐতিহাসিকদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। কোন কমিটি সেখানে থাকলে এদের সর্বোচ্চ কাজ হতে পারে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেখা ইতিহাস নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ হাজির করা। মূলত মহাভারত বা রামায়ণের মত টেক্সট যেগুলোকে আমরা বলছি মহাকাব্য, সেগুলোর সন-তারিখ বের করা বেশ জটিলসাধ্য। সেকারণেই ভন্দরকার অরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সংস্কৃতের গবেষক ভি এস সুকথাঙ্কর মহাকাব্য মহাভারত প্রকাশকালের একটা সময়সীমা প্রস্তাব করেছেন, ৪০০ খৃষ্টপূর্ব থেকে ৪০০ খৃষ্টাব্দ।
আপনি ‘দ্য পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালস ইন ইন্ডিয়া’ লেখায় বলেছেন, “আমরা যে ধরণের সমাজে বাস করি সেখানে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের খুব দরকার।” যারা আসলে ঠিক সময়ে ঠিক প্রশ্ন করতে পারবেন। আমাদের এই “সমাজ” বলতে আপনি কোন সমাজ বুঝিয়েছেন?
থাপার : আমি আসলে এই গত পঁচিশ বছরের সময়কাল নিয়ে বলেছি। আরো বিশেষ করে বললে গত ৪-৫ বছর নিয়ে। কারণ তখন থেকেই যেকোন প্রশ্ন তোলাকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভাল চোখে দেখা হচ্ছে না।
এমনকি সরকার এবং তার আরো সহযোগী নানা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত ঠিক করে দিচ্ছে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। এমনকি কেউ যদি তার বাইরে এসেও প্রশ্ন করে, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে হামলা-মামলার সাথে। অনেককে প্রশ্নের জন্যে জীবনও দিতে হয়েছে, আবার অনেকে এই সত্য মিথ্যায় আস্থা না রাখায় শিকার হয়েছেন লাঞ্ছনার।
আজকাল অনেকেই ভারতীয় সমাজে সেক্যুলারিজম নিয়ে নানা তর্ক হাজির করছে, যা কিনা আমাদের সংবিধানের অন্যতম প্রস্তাবনা। সেক্যুলারিজম কি আসলেই কোন তর্ক-বিতর্কের দাবি রাখে?
থাপার : এটি খুবই গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন। সেক্যুলারিজম আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে আলাদা কিছু না, যাকে আমরা চাইলেই যখন-তখন আমাদের জীবন থেকে আলাদা করে দিতে পারি। এটি আসলে অন্যদের প্রতি আমাদের আচরণ কি রুপ হবে তা-ই নির্দেশ করে। এবং বেশিরভাগ সময়ই এই আচরণ ইতিবাচক আচরণ। ফলে যখন কেউ সেক্যুলারিজমকে প্রশ্ন করে, প্রশ্ন করতে হবে অন্যদের প্রতি কারো আচরণকে। এবং খোদ সেক্যুলারিজমই অন্তর্গতভাবেই একটি ইতিবাচক ব্যাপার। সেক্যুলারিজম একটি ক্ষেত্রে সকল ধর্মের সহাবস্থান চায়। সকল ধর্মের সমান মর্যাদাও চায়।
এবং এই কথাটা সবচেয়ে বেশি আহত করে যারা নিজেদের ধর্মকে সবার চেয়ে অগ্রগামী মনে করে। সংখ্যাগুরুর ধর্মের উপর ভিত্তি করে সুবিধা আদায় করে। কিন্তু সেক্যুলারিজম আসলে সকল ধর্মের গন্ডি থেকে বাইরে এসে সবাইকে সমাজের একান্ত নাগরিক হিসেবে পরিচিত করতে চায়। যেখানে এই সকল নাগরিক সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবে। ফলে সেক্যুলারিজম কখনো হিন্দুরাষ্ট্র চাইতে পারে না, যেখানে হিন্দুরা সর্বাধিক সুবিধা আদায় করবে। সকল নাগরিকের অবশ্যই সমান অধিকার থাকা সেখানে বাঞ্ছনীয়।
সেক্যুলার সমাজে ব্যক্তি পরিচয় ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। সে পরিচয় বর্ণ, গোত্র, ধর্ম বা ভাষার সীমানা পেরিয়ে নাগরিকের পরিচয়ে আবির্ভূত হয়। এই পরিচয় পরিবর্তনের কথাটা এখনো জরুরি ভিত্তিতে আলাপ হয় না। এই পরিচয় কখনো আবার জাতীয়তাবাদের হাত ধরেও আসতে পারে। তবে সেই জাতীয়তাবাদ কেবলই স্লোগানের নয়, বরং সকলের জন্যে সমান মানবাধিকার থাকবে এমন জাতীয়তাবাদ।
আপনার বই ‘টকিং হিস্ট্রি’তে আপনি আলোচনা করেছেন কিভাবে ইতিহাস লেখা হয়। কিন্তু আধুনিক আন্দোলনের কতগুলো জনপ্রিয় মিথ থাকে, সেটা হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন বা দলিত আন্দোলনেও। এবং এ সকল মিথ যেকোন এজেন্ডায় আন্দোলনকারীদের তৈরি এবং চালনা করে। ফলে এইসব আধুনিক মিথ নির্মাণকে আপনি কিভাবে দেখেন?
থাপার : আমরা সবাই কম বেশি মিথে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমরা যখন বুঝতে শিখি, তখন জ্ঞান আর মিথের মধ্যে তফাত করাও শিখি। হ্যাঁ, মিথ নিজেও এক ধরণের জ্ঞান তবে সেটি আমাদের আলোচ্য জ্ঞানের মত নয়। যেসব মিথের সাথে ইতিহাসের যোগাযোগ আছে, সেখানেও ঐতিহাসিকদের মতামত গ্রহণীয়।
একজন ইতিহাসবিদকে ইতিহাসের মিথ-সংক্রান্ত বয়ান এবং ঐতিহাসিক বয়ানের মধ্যে তফাত করতে হয়। আমি উনিশ শতকে ফিরে যাব না কিংবা বলবো না ইতিহাস আসলে সত্যের পূনঃনির্মাণ। কারণ আমরা জানিনা সত্য কী, অথচ সত্য অতীতেই বাস করে। ফলে ইতিহাসকে বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখলে লাভ হবে না। আমরা ইতিহাসের ক্ষেত্রে কোন এক্সপেরিমেন্ট করে প্রমাণ করতে পারি না যে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা। ফলে এখন কেউ কেউ বলে, ইতিহাসবিদের কাজ আসলে অতীতের কোন সত্যের পেছনে দৌঁড়ানো নয়, বরং অতীতকে বুঝতে পারা এবং ব্যাখ্যা করতে পারাই তার কাজ।
মিথ এক্ষেত্রে অতীতের ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসবিদের ব্যাখ্যা এক্ষেত্রে মিথ থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যা থেকে আলাদা হবে, কেননা ইতিহাসবিদ কখনো অলীক চিন্তা বা কল্পনা থেকে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। তাকে কথা বলতে হয় নির্ভরযোগ্য তথ্য থেকে। কিন্তু মিথ আপনাকে অতীত বুঝতে সাহায্য করতে পারে কেননা মিথ থেকে কোন সমাজ সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা পাওয়া যায়। তাই, মিথ থেকে আপনি অনুভব করতে পারবেন, সেসময়ের মানুষ কিভাবে কল্পনা করত, কেন করত এবং কীই বা কল্পনা করত। আপনি আরো গুরুত্ব দিয়ে সেসব পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, কিন্তু এভাবেও ভাবতে পারেন যে, আসলে কিসের ভিত্তিতে এই জাতি এই ধরণের মিথ তৈরি করছে।
তাহলে আপনি পদ্মাবতের মিথ নিয়ে কি বলবেন?
থাপার : এটিও আসলে একটি মিথের ধারাবাহিকতা। পদ্মাবতীর পুরো কাহিনীটাই আসলে একজন পণ্ডিত মুসলিমের লেখা কবিতা। এবং একজন কাল্পনিক মানুষকে নিয়ে লেখা এই কবিতাটি তখন সবার কাছে খুব আদৃত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বলা যায়, এই ব্যাপারটি আমাকে একদম ভাবায়নি, কারণ আমি নিজেও প্রাচীন কুলজি নিয়ে কাজ করেছি যেখানে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব ক্ষমতাসীন পরিবারগুলোর বেশিরভাগই খুব উঁচু শ্রেণীর ছিল না। বরং এরা ছিল রোমাঞ্চপ্রিয় জাতি, যারা ক্ষমতার বাজি ধরত। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতায় আরোহণ করল, তাদের ক্ষমতার জৌলুস হিসেবে রাজকীয় পিতামহ, প্রপিতামহের দরকার পড়লো। ফলে তাদের কিছু পূর্ব-পুরুষ স্রষ্টার প্রয়োজন পড়লো। এক সময়ে এই দায়িত্ব পালন করতো সভাকবিরা, পরবর্তীতে সে দায়িত্ব বর্তায় ব্রাহ্মণদের ওপর। এবং তারাই দায়িত্বের অংশ হিসেবে এধরণের নির্মিত অতীত তৈরি করতো।
তারা হয়তো সামান্য একটি ঘটনা লিখে গেছেন, যা পরবর্তীতে আমাদের কাছে অনেক বেশি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তাহলে এখন কেন আগের মতো এই ধরণের বিশেষ পূর্বপিতাদের দরকার পড়লো? এর সাথে সমকালীন রাজনীতি এবং সমাজের মিল খুজতে গেলে উত্তর বেরিয়ে আসবে। সমাজ পরিবর্তনের ধারা আজ এমন জায়গায় পৌছেছে যেখানে যারা উচ্চ ক্ষমতায় আসীন ছিলেন, আজ তারা সেখানে জায়গা পাচ্ছেন না। ফলে তাদের মধ্যে একধরণের সামাজিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে এই মুহুর্তে সে হাতের কাছে যা পায়, তাই নিয়ে রাস্তায় স্লোগান দেওয়া শুরু করে। পদ্মাবতীও সেরকম একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
হিন্দুত্ববাদকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় ব্যাপারের সাথে সবমসয়ই গুলিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু ইদানিং অন্যান্য ধর্মীয় গোত্র থেকে উঠে আসা রাজনীতিক বিজেপি নেতৃবৃন্দ যেমন নরেন্দ্র মোদী, শিবরাজ সিং চৌহানের উত্থান দেখে আপনার মনে হয় না হিন্দুত্ববাদ আসলে অনেকটা সামাজিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে?
থাপার : শুরু দিকে এরকমটাই বলা হতো যে, আসল হিন্দুত্ববাদ পুরোটাই আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী। তখন সেটি কেবল একটা আদর্শ ছিলো, এখন তার রাজনৈতিক দল হয়েছে। এবং সে দলের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতেও তাদের অন্যান্য গোত্রে ছড়িয়ে পড়তে হবে। এবং এক্ষেত্রে সহজতম উপায় হচ্ছে, কোন পিছিয়ে পড়া বা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে বলা, আমাদের সাথে এলে তোমরা উন্নত জীবন পাবে। এবং আজকাল তাই হচ্ছে। ফলে আজকাল গুজরাটের মতো নানা জায়গায় বিভিন্ন গোত্রে হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে পড়ছে। এখন তাদের দলে অব্রাহ্মণ এমনকি অহিন্দুও আছে। দলিতদের ক্ষেত্রেও নিজেদের সুবিধার জন্যে তাদের ধর্মে ছাড় দিতে হচ্ছে। আরো নানা পিছিয়ে পড়া গোত্রেও আপনার পৌছানো সহজ যদি কেবল আপনি বলেন, রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদের চর্চা করেও তাদের দলে যে কেউ যুক্ত হতে পারেন। এবং তাদের হালচাল দেখে মনে হচ্ছ, এসব ছাড় দিতে তারা প্রস্তুত।