পৃথিবীর ইতিহাসে আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া কোন জাতি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এমনটি দেখা যায়নি। ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনেরই কোন এক পর্যায়ে রাষ্ট্র কিংবা বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাতে তুলে নিতে হয়েছে হাতিয়ার, গঠন করতে হয়েছে গেরিলা সংগঠন। সারা দুনিয়ার এমন বহু অন্দোলনের মধ্য থেকে ১২টি বামপন্থি সংগঠন সম্পর্কে সংক্ষেপে তথ্য ও পরিচিতি হাজির করছি আজ।
অ্যাকশন ডাইরেক্ট (ফ্রান্স)
অ্যাকশন ডাইরেক্ট একটি ফরাসি বামপন্থি সশস্ত্র সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো সংগঠনটির প্রধান জন মার্স রাউলিয়ান গ্রেফতার হওয়ার পর এটি আলোচনায় আসে। অ্যাকশন ডাইরেক্ট ছিলো মূলত রেভ্যলুশনারি ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন এবং আর্নাড কোর গ্রুপ ফর পপুলার অটোনমি নামক দুটি সশস্ত্র সংগঠনের সম্মিলিত রূপ। ১৯৭৯ সালের দিকে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধে কর্মসূচি দিয়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অ্যাকশন ডাইরেক্ট ৫০ টিরও বেশি টার্গেটে হামলা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্স সরকার সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়।
সিমবিয়ানস লিবারেশন আর্মি (যুক্তরাষ্ট্র)
দি ইউনাইটেড ফেডারেটেড ফোর্স সিমবিয়ানস লিবারেশন আর্মি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গেরিলা সংগঠন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল প্রর্যন্ত সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সংগঠনটি ব্যাপক সক্রিয় ছিল। সংগঠনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থি আন্দোলনের একটি সমন্বিত সংগঠন হিসেবে নিজেকে আদর্শ করে তুলেছিল। ধারণা করা হয় দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবী দলগুলির থেকে শিক্ষা নিয়েই এই আন্দোলনটি গড়ে ওঠে। নারীবাদী, বর্ণবাদ-বিরোধিতা এবং পুঁজিবাদ বিরোধী আদর্শ গ্রহণ করে দলটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। যদিও ধীরে ধীরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক-ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। তবে তাদের বিরুদ্ধে সব থেকে আলোচিত অভিযোগটি ছিলো, বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার সত্ত্বাধিকারী পেট্টি হার্স্টকে অপহরণ করার ঘটনাটি। তখন সারা দুনিয়াব্যাপি আলোচনার ঝড় উঠেছিলো।
পপুলার ফোর্স ২৫ এপ্রিল (পর্তুগাল)
‘পপুলার ফোর্স অফ ২৫ এপ্রিল’ পর্তুগালের একটি বিখ্যাত বামপন্থি গেরিলা দল। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বোম্বিংয়ের ফলে তাদের হাতে ১৮ জনের বেশি নাগরিক মারা যায়। ব্যাংক ডাকাতি বোমা হামলাসহ তাদের বিরুদ্ধে বিস্তার অভিযোগ ছিলো। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে দলটি মিসাইল হামলা করে ছয়টি ন্যাটো জাহাজে আক্রমণ করে। এর কিছুদিন পরে দলটি ‘১৯৭৪ মিলিটারি’ নাম নিয়ে পর্তুগিজ সরকার উৎখাতের চেষ্টা করে। কিন্তু সরকার উৎখাতে ব্যার্থ হলে দলটির প্রায় সকল সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে দলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।
ব্ল্যাক লিবারেশন আর্মি (যুক্তরাষ্ট্র)
আমেরিকার মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং সারা জীবন কালোদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি সবাইকে অহিংস আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করলেও অদ্ভুত ব্যাপার হলো ১৯৬০ এবং ১৯৭০ দশকে সব থেকে বেশি গেরিলা সংগঠন গড়ে উঠেছিলো তার নিজের কমিউনিটির মধ্যেই। ব্লাক লিবারেশন আর্মি ছিলো সে রকমই একটি সংগঠন। সে সময় পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থানের কারণেই তারা আমেরিকাব্যাপি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তাদের স্লোগান ছিলো “অস্ত্র হাতে তুলে নাও, কালো মানুষদের অধিকার ছিনিয়ে নাও।” কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দলটির বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ এনে প্রচারণা চালায় তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। ব্যাংক-ডাকাতি, বোমাবাজি থেকে বিভিন্ন রকম কর্মের সাথে তাদের নাম জড়িয়ে খবর বের হতে থাক। শেষ পর্যন্ত তারা যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের শাসন দাবি করতে শুরু করে। এসব অভিযোগে বড় বড় নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে সরকার।
দি রেভুল্যুশনারি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (তুরস্ক)
দি রেভুল্যুশনারি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট হলো তুরস্কের মার্ক্সিস্ট মতাদর্শ ভিত্তিক সংগঠন। ১৯৭৮ সালে এই সংগঠনটি এক হামলা চালিয়ে ১২ জন পুলিশ সদস্যসহ ৮০ জনেরও বেশি সাধারণ নাগরিক হত্যা করে আলোচনায় আসে। এরপর কিছুটা নিস্তেজ হয়ে গেলেও ২০০০ সালে দিকে এটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইরাকে তুরস্কের মদদে মার্কিন আগ্রাসনের পর দলটি ইরাকে প্রবেশ করে এবং আলকায়েদার কৌশল অনুসরণ করে ব্যাপক আত্মঘাতী হামলা চালায়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই সংঘটনটির তিন শীর্ষ নেতাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৩ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।
বাস্ক আর্মড রেভুল্যুশন ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশন (ফ্রান্স ও স্পেন)
বাস্ক আর্মড রেভ্যুলুশন ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশন বা ইরাবলৎস, ১৯৮২ সালে স্পেন এবং ফ্রান্সে বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতির বিরোধিতা করে একটি স্বাধীন মার্কসবাদী বাস্ক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটিতে প্রথমিক পর্যায়ে সদস্য সংখ্যা ২০ জনেরও কম ছিলো। কিন্তু এই কয়েকজনে মিলে তারা আমেরিকার বিনিয়োগকৃত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা চালায়। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে, দলটি ফ্রান্স এবং ও স্পেনের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে। তাদের হামলার প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু হতো বিভিন্ন ভবন, যার ফলে তাদের হামলায় নিহত কিংবা আহতের সংখ্যা কম হলেও আর্থিকবভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। বিশেষ করে তাদের হামলার মুখে জেনারেল মোটরস, কোকা কোলা, ফোর্ড, জেরক্স, সিটিবার্কে সহ বড় বড় কোম্পানি লাখ লাখ ডলার ক্ষতির মুখে পড়ে।
শাইনিং পাথ
সত্তর বা আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ল্যাতিন আমেরিকার যে কয়টি গেরিলা সংগঠন অদ্যবধি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের মধ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব পেরু অন্যতম। এই মাওবাদী গেরিলা সংগঠনটিই সারা বিশ্বে শাইনিং পাথ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ পেরুর স্যান ক্রিস্টোবাল হুমাংগা ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির দর্শনের অধ্যাপক এবিমিয়েল গুজমানের হাত ধরেই এর যাত্রা শুরু। শাইনিং পাথের প্রতিষ্ঠাতা এবিমিয়েল গুজমান, স্যান ক্রিস্টোবাল অব হুমাংগা ইউনির্ভাসিটিতে দর্শন শাস্ত্র পড়াতেন। ১৬৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শাইনিং পাথের আতুড়ঘর বলা হয়। ধারণা করা হয়, দর্শনশাস্ত্রে বোদ্ধা গুজম্যান তার লেকচারের মাধ্যমে ছাত্রদের শাইনিং পাথে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। তবে শাইনিং পাথ প্রথম দৃশ্যপটে আসে ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে। পেরুর স্বৈরতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতা পোক্ত করার ঘোষণা দিলে ১৯৮০ সালে এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে কিছু প্রতিবাদী ছাত্র দক্ষিণ আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত সুসাই শহরের ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও পেপার পুড়িয়ে দেয়। এরপরেই তারা সরাসরি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত তারা সরকার বিরোধী লড়াই করে চলেছে।
জাপানিজ রেড আর্মি
১৯৭১ সালে লেবাননে থাকা কালে জাপান সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর ফুসাকো শিগেনোবু জাপানিজ রেড আর্মি নামে এই বাম মতাদর্শিক মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলেন। ইসরায়েলের লড এয়ারপোর্টে পিএফএলপি কর্তৃক সংঘটিত ২৭ জন ইসরায়েলি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পরই মূলত আলোচনায় উঠে আসে জাপানিজ রেড আর্মি। শিগেনোবু জাপানের বামপন্থি সংগঠন রেড আর্মি অংশের (শিকেগুন-হা) নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন। বিপ্লবের সমর্থনে শিকেগুন-হা নিজস্ব দল গঠন করেন এবং ১৯৬৯-এর সেপ্টেম্বরে তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তারা মূলত জাপানে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ চাইতেন। ১৯৭১ সাল থেকে জাপানিজ রেড আর্মি এবং পিএফএলপি বা ফাতাহর সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। ফুসাকো শিগেনোবু ২০০০ সালের নভেম্বরে জাপানের ওসাকা থেকে গ্রেফতার হন। এতে সারা বিশ্ব বিস্মিত হয়। কারণ সবাই ভাবত ফুসাকো লেবাননে থাকেন। তাকে আসামি করা হয় নাটকীয় আক্রমণ, অপহরণ, ছিনতাইয়ের অভিযোগে। সমালোচকরা তাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভীতি উদ্রেককারী মহিলা সন্ত্রাসী’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তামিল ইলম (শ্রীলঙ্কা)
লিবারেশন টাইগারস অফ তামিল ইলম শ্রীলঙ্কার একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী, গেরিলা সংগঠন। তারা শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে অবস্থান করে উত্তর এবং পূর্বাংশ নিয়ে পৃথক ও স্বাধীনতামিল রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এছাড়াও, এলটিটিই তামিল টাইগার্স নামে সর্বসমক্ষে পরিচিত হয়ে হত। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মে, ১৯৭৬ সালে। এর প্রধান ছিলেন ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ, যিনি ১৮ মে, ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় নিহত হন। তামিল ইলম এমন একটি গেরিলা সংগঠন যাদের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীও ছিলো। ২০০৯ সালে সরকারি বাহিনীর প্রবল আক্রমণে ইলম নেতা প্রভাকরণ মারা গেলে এই বিদ্রোহী সংগঠনটি কার্যত নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। প্রভাকরণের মৃতদেহ দ্রুত দাহ করে ফেলা হয় এবং সরকারি বাহিনী সেখানে কোন জনসমাগম হতে দেয়নি। পরবর্তী নেতা হিসেবে সেলভারসা পাথমানাথম দায়িত্ব নেন, তবে সেবছরের আগস্টেই তিনি মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার হন। মালয়েশিয়া সরকার তাকে শ্রীলঙ্কার সরকারের হাতে তুলে দেয়।
ভুটান টাইগার ফোর্স (ভুটান)
ভুটান কমিউনিস্ট পার্টির (বিসিপি-এমএলএম) সশস্ত্র বাহিনী ‘ভুটান টাইগার ফোর্স’ মূলত গেরিলা বাহিনী হিসেবে কাজ করে থাকে। ২০০৩ সালের ২২ এপ্রিল যাত্রা শুরু হয় ভুটান টাইগার ফোর্সের। ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী ছোট্ট এলাকা নিয়ে গঠিত দেশ ভুটান। পার্শ্ববর্তী দুই শক্তিশালী দেশের চাপের কারণে দীর্ঘদিন ভুটান নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল বহির্বিশ্বের কাছে। এমনকি টেলিভিশন, ইন্টারনেট সব কিছুই সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল দেশটিতে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত।
রাজতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতা ভেঙে নয়া গণতান্ত্রিক ভুটান প্রতিষ্ঠা এই দলটির মূল দাবি। আদর্শিকভাবে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট-মাওয়িস্ট ভাবনাপন্থি হওয়ায় সার্বিকভাবে সামাজিক সাম্য ও বৈষম্যহীনতার দাবিকে সামনে রেখেই তারা লড়াই করে থাকে। প্রায়ই অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে এই গেরিলা দলটিকে শুরু থেকেই নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, লোকবল- সব কিছু দিয়ে সাহায্য করে আসছে। ভুটানে নিষিদ্ধ হলেও ‘ভুটান টাইগার ফোর্স’ এখনো আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা দল হিসেবে কাজ করছে। দলটি ২০০৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের ২৩শে এপ্রিল ও ৩০শে ডিসেম্বর, ২০০৯, ২০১০ সালে কয়েকটি গণযুদ্ধ পরিচালনা করে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। দলটির বর্তমান গেরিলা সদস্যের আনুমানিক সংখ্যা ৬০০ থেকে ১ হাজার জনের মধ্যে।
সর্বহারা পার্টি (বাংলাদেশ)
ষাটের দশকে রুশ-চীন মহাবিতর্ক, মাও জে দঙয়ের নেতৃত্বে চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব (জিপিসিআর) এবং ভারতে নকশালবাড়ী সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থানের প্রভাবে বাংলাদেশে (তখন নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান) মাওবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। যদিও বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু হয়েছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষে গত শতাব্দীর ২০ দশকে। ভারতবর্ষের পর পাকিস্তান আমলেও একই অবস্থা চলতে থাকে। ‘৬০-এর দশকে এ দেশে সত্যিকার বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা মাওবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সলের মাঝামাঝি একটি সত্যিকার কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে অন্যান্য কিছু আন্তরিক বিপ্লবী প্রতিষ্ঠা করেন “মাওসেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার।’’ তারপর এই বিপ্লবীরা ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ব বাংলায় একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার লক্ষে “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন পরে যা সর্বহারা পার্টিতে রূপ নেয়। এরাই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একই সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এই যুদ্ধের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ৩ জুন এক সম্মেলনের মাধ্যমে “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” বিলুপ্ত করে সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রসরদের নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি” প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন সিরাজ সিকদার। ’৭১-মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ভারত ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন বাহিনী বিশেষত: “মুজিব বাহিনী” মাওপন্থিদের হত্যা শুরু করলে স্বাধীনতার পর সিরাজ সিকদারের বাহিনী দেশ জুড়ে ব্যাপক লড়াই শুরু করে।
’৭৪ সালের ১৫-১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে “কালো দিবস” ঘোষণা করে সর্বহারা পার্টির আহ্বানে হরতাল পালিত হয়। ’৭৫ সালের ১ জানুয়ারি সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন এবং ২ জানুয়ারী তখনকার সরকার তাকে বন্দি অবস্থায় ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করে। বলা হয়ে থাকে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘ক্রসফায়ার’।
নিউ পিপলস আর্মি (ফিলিপাইন)
১৮৯৮ সালে মাত্র ২০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বিনিময়ে স্পেন ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জকে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়! একই বছরে দেশটি প্রথম রিপাবলিক সরকার গঠন করলেও স্পেনের এই অমানবিক আচরণে সহজেই অনুমেয় হয় যে এতো সহজে স্বাধীনতার স্বাদ তারা পাবে না। আমেরিকা নানা শোষণ-পীড়নের মধ্য দিয়ে ফিলিপাইনকে নিজেদের একটি অলিখিত ঔপনিবেশিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে লাগল। যার পরপরই ১৯৪৬ সালের ৪ জুলাই জাপানের সহযোগিতায় সর্বপ্রথম দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬০ সালে ‘নিউ পিপলস আর্মি (এনপিএ)’ নামে এই গেরিলা দলটির অভ্যুত্থান ঘটে। দলটি মূলত ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য ফিলিপিন (সিপিপি)’-এর সশস্ত্র সংগঠন। যার মূল আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ। ১৯৬৯ সালের ২৯ মার্চ ৭২ জন যোদ্ধা ও হালকা অস্ত্র নিয়েই প্রথম মিশনে নামেন ‘সর্বহারা বিপ্লব’ কায়েম করতে চাওয়া এই গেরিলা দলটি। ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনীতে নিয়োজিত আমেরিকান কর্নেল জেমস এন রোইয়েকে হত্যার মধ্য দিয়েই দলটি তার আত্মপ্রকাশ করে। স্থানীয় মানুষের কাছে জনপ্রিয় এই দলটিকে যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা দলটিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণা দিয়ে কালো তালিকাভুক্ত করে রেখেছে।