নারীবাদের ‘লিঙ্গসর্বস্ব ইসলামবিদ্বেষ’ এর কালে সাবা মাহমুদ পাঠের জরুরত

নারীবাদের ‘লিঙ্গসর্বস্ব ইসলামবিদ্বেষ’ এর কালে সাবা মাহমুদ পাঠের জরুরত

বাংলাদেশে নারীবাদের নামে যে ধরণের রবীন্দ্রপ্রভাবিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এলিটিজম এবং পশ্চিমা বা কোলকাতার চিন্তা ও রুচির দাসত্ব লক্ষ্য করা যায় তা আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি সর্বোপরি চিন্তাশীলতার জন্য ক্ষতিকর। ‘জেন্ডারড ইসলামোফোবিয়া’ ধারণাটি বেশ নতুন। এর মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক ইসলামভীতি বা বিদ্বেষ চর্চার সমস্যাকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশেও ক্যালকেশিয়ান নারীবাদ মূলত ইসলামবিদ্বেষী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সাবা মাহমুদ এইসব বিদ্বেষপূর্ণ নারীবাদের ভেতরের তাত্ত্বিক গোমর ফাঁস করেছেন। বাংলাদেশের জন্যও সাবা মাহমুদের সূত্র ধরে আলোচ্য প্রবন্ধের বিষয়গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম, আশা করি একতরফা অন্ধ চিন্তাভাবনার বাইরে আমরা পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এইসব বিষয় দেখার সুযোগ পাবো।


 

আশঙ্কা করা যায় এই লেখার বেশির ভাগ পাঠকের কাছেই সাবা মাহমুদ তেমন পরিচিত নন। অনেক সময় বিখ্যাত কোন দেশের বিখ্যাত লোক মরে গিয়েও পরিচিত হয়ে উঠেন। সেই ক্ষেত্রে অবশ্য মিডিয়ার প্রচার একটা ভুমিকা পালন করে। আর সাবা মাহমুদ নামটাও অন্য ইউরোপ/আমেরিকান নামের মতো না বা তাকে গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতো নামের মধ্যে ইংরেজ ইংরেজ ভাবওয়ালা ‘স্পিভাক’ টাইপের কোন শব্দও বসাতে হয় নাই। যদিও তিনি সারা দিন এন্টি-কলোনিয়াল বুলি বিলি করেন।

সাবা মাহমুদ এই এশীয় আরও ভালো করে বললে, এই মুসলমানি নাম নিয়েই সারা দুনিয়ার চিন্তকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। বাংলায় একটা কথা আছে, ‘অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না’। তেমনি সাবা মাহমুদকে না চিনলেও সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তিনি দুনিয়ার মায়া ছেড়ে গত ১০ মার্চ (২০১৮) দেহত্যাগ করেছেন। তিনি যেহেতু খুব সেলিব্রেটি টাইপের কেউ না; তাই আমাদের কোন মিডিয়াতে তিনি খবর হননি। কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া অবশ্য খবর করেছে, তাও খুব কম। যা হোক তাঁর গুরুত্ব খবর হওয়া না হওয়ার উপর নির্ভর করে না। তিনি এই দুনিয়াতে নাই। কিন্তু তাঁর কাজের গুরুত্ব আমার ধারণা দিন দিন বাড়বে। আমাদের এই পৃথিবীর মধ্যে অনেকগুলা পৃথিবী আছে। লম্বা আলাপে না গিয়ে সহজে বলা যায়, এই যেমন আমরা শুনি; প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব। যদিও এমন ডাকনামের রাজনীতি ও মতাদর্শগত অবস্থান নিয়া অনেকের ব্যাপক আপত্তি আছে। কিন্তু এর বাইরেও আপনি যদি চিন্তা করেন, আপনার সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মতাদর্শগত অবস্থানের ভিত্তিতেও দুনিয়াতে নানারকম বিভাজন আছে। একই দুনিয়াতো দূরের কথা; একই ঘরের মধ্যে আরও ঘর আছে, ঘরানা আছে। এই যে চিন্তার কারণে আলাদা হয়েও এক সাথে থাকার সমস্যাটা মাঝে মাঝে ভয়াবহ রুপ ধারণ করতে পারে। এক দুনিয়ার সাথে আর এক দুনিয়ার এই সম্পর্কটা কোন কোন সময় রক্তাক্ত রুপ নিতে পারে।

এই একই পৃথিবীতে চিন্তা ও আদর্শগত কারণে ভিন্ন দুনিয়া তৈরি হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল, সেকুলার ও নন-সেকুলার সমাজ, দেশ বা বিশ্বাস। বর্তমানে এদের মধ্যেই সবচেয়ে বড় বিভাজন ও রক্তারক্তির সম্পর্ক চলছে, এরা এখন সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে হাজির। অবশ্যই এই ‘ননসেকুলার বা অ-সেকুলার’ বলতে এখন একতরফাভাবে মুসলামদেরকেই বুঝানো হয়। পশ্চিমা সমাজে যেই ধরণের ঘৃণার সংস্কৃতি উৎপাদন করা হয়, এই ধরণের বিশ্বাস ও অসেকুলারদের বিরুদ্ধে তার সরব চর্চা চলে পশ্চিমাদের চিন্তা ও রুচির দাসত্ব করা অপশ্চিমা দেশেও। এখানেই কলোনিয়াল চিন্তার সাথে, কলোনিয়াল উত্তরকালের অন্য চিন্তার মোকাবেলার প্রশ্ন জড়িত।

আর এই কারণেই সাবা মাহমুদের গুরুত্ব দিন দিন বাড়বে। ৯/১১ এর পরে বুশ দুনিয়ার সাথে যে সভ্যতার যুদ্ধ বা যে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছেন, তাতে তারা একটা সুযোগ দিয়েছিল আমেরিকান মুসলমানদের জন্য। সবাইকে ‘গুড মুসলিম’ হয়ে যেতে বলেছিল। এই ‘গুড মুসলিম’ প্রকল্প সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন সাবা মাহমুদ। এই গুড মুসলিম প্রকল্প আসলে পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদের পক্ষে কিছু অনুগত মুসলিমদের জড়ো করার পায়তারা ছাড়া আর কিছুই না। (দেখুন; সেকুলারিজম, হারমেনিউটিক্স এন্ড এম্পায়ার; দ্য পলিটিক্স অফ ইসলামিক রিফর্মেশন- সাবা মাহমুদ) কারণ পশ্চিম নিজেই ইসলামোফোবিক হয়ে নিজের সুবিধার জন্য ইসলামের মধ্যে নয়া শাসনতান্ত্রিক বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছে ৯/১১ এর পরে। এই ঘটনার পরে দুনিয়ার ইতিহাস ও চিন্তার পদ্ধতি কতটা পাল্টে গেছে, তা সাদা চোখে আন্দাজ করা মুশকিল। আসলেই এটা একটা ভয়াবহ সভ্যতার সংঘাত আকারে হাজির হয়েছে। এর পরিপেক্ষিতে সাবার কাজের গুরুত্ব কতটা বাড়বে, আগামী দিনে আমরা দেখব। তবে এখানে তিনি কি কি প্রশ্ন/ডিসকোর্স নিয়ে কাজ করেছেন তার সব ‘থিসিস’ ধরে ধরে এখানে আলোচনা সম্ভব নয়। সেটা করবও না। এখানে তাঁর চিন্তা ও কাজের কয়েকটি দিক নিয়ে খুবই সংক্ষেপে একটি সরল বয়ান পেশ করেই শেষ করব। যাতে আগ্রহীরা নিজ গরজে অধ্যয়নের ব্যাপারে উৎসাহী হতে পারেন।

১.
সাবা মাহমুদ দুই পৃথিবীর সেতু ছিলেন। এই যে পশ্চিমের নিজের প্রতি অন্ধ অহং এবং শিক্ষার নামে একধরণের অশিক্ষা থেকেই যেকোন বিশ্বাসকে বর্তমানে ইসলামকে বুঝবার ক্ষেত্রে ঘৃণাবাদী মনোভাব জন্ম লাভ করেছে পশ্চিমে। তার নিজের ভেতর লুকায়িত খৃষ্টীয়-চৈতন্য উদারপন্থার নামে আড়ালের চেষ্টা চলছে। অথচ অন্যদিকে নিজেকে ক্রমাগত সেকুলার দাবি করছে- এটা একটা দুনিয়া।

আর অন্যদিকে পশ্চিমের প্রতি একধরণের আক্রোশ, অকাট্য বিরোধীতা। নিজের বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে পশ্চিমকে শত্রু জ্ঞান করা-এটা আরেকটা দুনিয়া। এই দুই দুনিয়ায় একপক্ষ অপরপক্ষকে নিয়ে ভয়াবহ গালগপ্পও তৈরি করে ফেলেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো, যোগাযোগের সমস্যা। যে সমস্যা আসলে দার্শনিক ও মতাদর্শগত যোগাযোগের সমস্যা। পশ্চিম যে তরিকায় চিন্তা করে, ভাবে, অপশ্চিম তা অনুসরণ করে না। আবার অপশ্চিম যা ভাবে, যেভাবে ভাবে, পশ্চিমও তা আমলে নেয় না। ফলে এই দুইয়ের দুনিয়া দীর্ঘ অপরিচয় ও বিরুদ্ধতার প্রতিযোগিতায় উপনীত হতে হতে এখন যুদ্ধাবস্থায় পৌছেছে। এই দুই দুনিয়ার মধ্যে দার্শনিক পদ্ধতি মোতাবেক ডায়লগের মানে আলাপের বা যোগাযোগের অন্যতম সেতু ছিলেন সাবা মাহমুদ। ফলে উনার গুরুত্ব ঠিক প্রচারপ্রিয় লেখক, রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের হিসেবে বুঝা যাবে না। আরও একটু গভীরে আরও বৃহত্তর চিন্তার পরিসরে সাবা কে পাঠ করতে হবে।

সাম্প্রতিক কালে জুলিয়ান হাম্মারের মতো তাত্ত্বিকরা দেখাচ্ছেন, কিভাবে পশ্চিমা নারীবাদ আসলে লিঙ্গসমতার অজুহাতে একধরণের ইসলামবিদ্বেষী আচরণ করে। ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণার সংষ্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পশ্চিমা নারীবাদ ও বাংলাদেশের তথাকথিত নারীবাদ প্রায় জানের দোস্ত। ইসলাম নিয়ে মুখস্ত কিছু অনুমান থেকে এরা ধরেই নেয়, বোরকা, পর্দা, নারীর প্রতি ইসলামের যেসব বিধান রয়েছে তা পালনের মধ্য দিয়ে ইসলাম একটা নারী-নিপীড়ক ধর্ম। অথচ সাবা মাহমুদের ব্যাখ্যায় ইসলামের ভিতর নারীদের কাজের পরিসর প্রভাব এইসব পশ্চিমা অনুমানকে হাস্যকর প্রমাণ করে ছেড়েছে। তাই পশ্চিমে তো বটেই আমাদের দেশেও সাবার ব্যাপারে হাইব্রিড সেকুলারদের রয়েছে একধরণের ভীতি। নারীবাদের নামে ইসলামের প্রতি ঘৃণার চর্চার জন্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাংষ্কৃতিক রাজনৈতিক প্রবণতা দেখলেই সেসব পরিস্কার বোঝা যাবে। দেশে নারীবাদের নামে যা চর্চা হয় তাকে বলা চলে, ‘জেন্ডারড ইসলামফোবিয়া’ বা ‘লিঙ্গসর্বস্ব ইসলামভীতি’। এর ফলে এখানকার নারীবাদীরা হরেদরে ইসলামবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। মনে করে ইসলামের বিরুদ্ধে না লিখলে নারীর পক্ষে দাঁড়াবে কিভাবে। এই অশিক্ষার বিরুদ্ধে সাবার কাজ বৈপ্লবিক বলতে হবে। আর ইউরোপে-আমেরিকাতে তো প্রতিনিয়ত পথেঘাটে মুসলিম নারীরা হয়রানি ও হামলার শিকার হচ্ছেন। আমাদের দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেড়েছে; অথচ এনজিওবাজ নারীবাদিরা, পশ্চিমা দালালরা না পারছেন কোন সামাধান দিতে না পারছেন সফল প্রতিবাদ করতে। সেই আলোচনায় আজ যাবো না। নারীবাদের ইসলামোফোবিয়া নিয়ে আগ্রহীরা দেখতে পারেন “ইসলামোফোবিয়া ইন আমেরিকা : দ্য এনাটমি অফ ইনটলারেন্স; সম্পাদক কার্ল ডব্লিউ আর্নেস্ট”।

ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সাবা মারা যাওয়ার সংবাদটা আমি পাঠ করেছি এই দুই-দুনিয়ার একটা শক্ত সেতুর পতন হিসেবে। নিশ্চয়ই এই পতন একটা বাস্তবিক সেতুর পতনের চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়েছে। এই দুই দুনিয়ার চিন্তার সাথে দার্শনিক তর্ক জারি রাখার দায়িত্ব বা কাজটা আসলে এই সভ্যতার শত্রুতার ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়ারই কাজ। সেই দিক থেকে সাবার কাজটা কতটা জরুরি ছিল তা ব্যাখ্যার কোন অবকাশ রাখে না আশা করি। মূল আলাপে যাওয়ার আগে সাবার কাজের কিছু দিক চিনে নিবো।

নারীবাদের আলোচনায় সাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, ‘অধিকার’ বা রাইট এর ধারণাটি যে আসলে ব্যক্তির স্বৈরতন্ত্রী ও স্বেচ্ছাচারিতার মূলভিত্তিকে কেন্দ্র করেই গঠিত হয়েছে; তা তিনি খুবই মুন্সিয়ানার সাথে তত্বায়ন করেছেন। পশ্চিম মনে করে মুসলিম নারী খুবই অত্যাচারিত, সে কোন অধিকার পায় না, ফলে পশ্চিম যখন যেচে এসে অধিকার নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে যায় তখন সমাজের ‘এথিকাল’ অর্ডারকে পাশ কাটিয়ে একধরণের স্বেচ্ছাচারিতার উৎপাদন করা হয়। যার মূল উপকারিতা ভোগ করে আসলে মুক্তবাজার। নারী নতুন ধরণের নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। কাজেই পশ্চিমের নারীবাদের নসিহতকে আমলে না নিয়েও একটি সমাজের মৌল বৈশিষ্ট্যকে, মোরাল দিকগুলোকে নারীরা কিভাবে নিজেদের মধ্যে সংগত করে আন্দোলন তৈরি করেন। কিভাবে নতুন রাজনীতি এখানে তৈরি হয়, তাই দেখতে চেয়েছেন সাবা মাহমুদ। এই দিকে থেকে দেখলে বেগম রোকেয়ার সাথেও খানিকটা মিল আছে বলতে হবে। অবশ্যই রাজনৈতিক ও পদ্ধতিগত ফারাক বিশাল

 

২.
শিক্ষা জীবনে বেশ সফল বলতে হবে সাবাকে। পকিস্তানে জন্ম নেয়া এই আমেরিকান নৃতাত্ত্বিকের কাজের পরিধি বেশ বিস্তৃত। তবে তিনি সাধারণত যেইসব এরিয়াতে কাজের জন্য আলোচিত তার মধ্যে অন্যতম হল- ধর্ম, সেকুলারিজম, আইন ও রাজনীতি, নীতিশাস্ত্র, জেন্ডার ও যৌনতা, ভায়োলেন্স, ইসলাম, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া। তিনি ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে ৪ বছর প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার পরে শিকাগো বিশ্বাবিদ্যালয়ে শিক্ষতার মধ্য দিয়ে একাডেমিক জগতে প্রবেশ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিও-কালচারাল অ্যানথ্রোপোলজি’র শিক্ষক ছিলেন। এতসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি অবশ্য নিজেকে বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ও চিন্তক তালাল আসাদের শিষ্য পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। তার সারা জীবনের কাজও তালাল আসাদের চিন্তা-ভাবনার কাছে কোন না কোনভাবে ঋণী। আর এই বিষয়টি সাবা প্রায় তার প্রতিটি কাজে এতো গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে হালকাভাবে পড়লে মনে হবে তালাল আসাদের বাইরে বুঝি সাবার কোন জরুরি কাজ নাই, প্রশ্ন নেই জ্ঞান-জগতে। তাই সাবার কাজ কতটা গুরুত্ব বহন করে তা বুঝবার জন্য একটু গভীর মনোনিবেশ দরকার।

তবে সাবার এইসব ভারি ভারি একাডেমিক পরিচয় শুনে মনে হতে পারে তিনি তাহলে আর দশটা শিক্ষকের মতোই। কিন্তু মোটেই তা নন তিনি। সাবার জীবন শুরু হয় মূলত একজন একটিভিস্ট হিসেবে। প্রথম জীবনে ছিলেন বামপন্থি, প্রগতিশীল ধারায় আস্থাশীল একজন নারীবাদী। পরে নিজের অবস্থানকে ধীরে ধীরে ক্রিটিক বা পর্যালোচনা করতে শুরু করেন। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার নারীবাদের সূত্র ধরে তিনি পশ্চিমা নারীবাদের মূলসূত্রটিকে এমন ভাবে ক্রিটিক করেন যে, পশ্চিমা বড় বড় চিন্তকরা তাকে আমলে নিতে বাধ্য হন। অল্প সময়েই ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন এই বিষয়ক জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনার পরিমন্ডলে। কিন্তু শুধু কাগজে কলমে উনার কাজ সীমাবদ্ধ ছিল না। সরাসরি রাজনীতির মাঠে ক্ষমতার বিন্যাসের জটিল খেলাও তার নাম উচ্চারিত হয়েছে। আমেরিকার যুদ্ধ-বিরোধী তাত্ত্বিকদের মধ্যে সাবা অন্যতম। তাছাড়া তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান এরদোগানের কন্যা ইসরা এরদোগান বার্কলেতে সাবা মাহমুদের ছাত্রী ছিলেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা ইমেইলে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগের বাইরেও সাবা সরাসরি তুরস্কের রাজনীতে বেশ ভাল ভূমিকা রাখতেন। কন্যার সূত্র ধরে তিনি এরদোগানের খুব কাছের মানুষদের একজন হয়ে উঠেন। এরদোগানকে সমর্থন করা নিয়ে সাবাকে ঘিরে রয়েছে নানান বিতর্ক। সাবা কখনও এইসবে কান দিতেন না। সাবার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। সেটা তিনিও পছন্দ করতেন। এই তথ্য এখানে উল্লেখ করার মানে হল, তিনি শুধু কাঠখোট্টা একাডেমিক জগতের মানুষ ছিলেন না। সরাসরি রাজনীতির ক্ষমতার হিসেবনিকেশও রাখতেন।

আমরা এবার এক নজরে দেখে নিবো সাবা মাহমুদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো। এবং বাংলাদেশে সাবাকে কেন গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করতে হবে সেই দিকটি নিয়ে কথা তুলেই আলাপ শেষ করব।

 

৩.
সাবা মাহমুদের প্রথম এবং সবচেয়ে আলোচিত বই, ‘পলিটিক্স অব পাইটি; দ্যা ইসলামিক রিভাইভাল এন্ড দ্যা ফেমিনিস্ট সাবজেক্ট’। এর পরে সর্বশেষ বইটির নাম, ‘রিলিজিয়াস ডিফারেন্স ইন এ সেকুলার এইজ: এ মাইনোরিটি রিপোর্ট’।

এছাড়াও তিনি ‘ইজ ক্রিটিক সেকুলার’ -নামে একটি বইও করেছেন। এবং এই বইতে তিনি ছাড়া আরও লিখেছেন, তালাল আসাদ, জুডিথ বাটলার ও ওয়েন্ডি ব্রাউন। এই বইটি ক্রিটিক্যাল ডিসিপ্লিনের পরিমন্ডলে এতো বড় ধাক্কা দিয়েছে যে, এটা নিয়ে এখনও তর্ক বেশ গরমই আছে বলতে হবে। পশ্চিমা পর্যালোচনার পুরো ট্রেডিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এই নয়া প্রস্তাবনা।

এই যে ‘ক্রিটিক’ যাকে বাংলায় পর্যালোচনা বলতে পারেন তার উপরই পশ্চিমা জ্ঞানকান্ড দাঁড়িয়ে আছে। আর এই ক্রিটিকের সিলসিলাটা সেকুলার কি না এই প্রশ্ন পোস্টমর্ডান যুগে হাজির করা পশ্চিমা চিন্তার ইতিহাসের জন্য বিশাল থ্রেট। যেখানে খোদ ‘সেকুলার’ ধারণাটি একটি আলোকায়ন যুগের আধনিকতাবাদী ধারণা এবং যা একটি মূলত শাসনতান্ত্রিক ডকট্রিন (হুকুমত) হিসেবে টিকে আছে পশ্চিমে। (দেখুন: তালাল আসাদ: ফরমেশন অফ সেকুলারিজম)। ফলে সেকুলার ধারণাটি এখন আর বিনা ক্রিটিকে কেউ মেনে নেয় না। তো এমন অবস্থায় খোদ পর্যালোচনা বা ক্রিটিক ব্যাপাটিকেই সেকুলার ক্যাটাগরিতে আবিস্কার করা বা বিচার করতে নামা সত্যিই অনেক বড় প্রকল্প।

এইসব কাজের বাইরে সাবা মাহমুদ মূলত অনেক আলোচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। ফলে খুব বেশি বই না লিখলেও তিনি যখনই কলম ধরেছেন কোন না কোন দার্শনিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যার পদ্ধতিগত আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। কাজেই তার বই সংখ্যা বা লেখা পরিমাণ দিয়ে কাজের বা গুরুত্ব বিবেচনার সুযোগ নাই। এই ধরণের চিন্তকদেরই বলা হয়, ইন্টারভেনশনাল থিংকার। এরা কোন না কোন বিষয়ে ইন্টারভেন করেন। এরা নাম ছাপানোর কাঙাল টাইপের লেখালেখির সমস্যা থেকে মুক্ত। কাজেই লেখালেখি দিয়ে নয় বরং চিন্তার গুরুত্ব দিয়েই উনারা জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হন।

সাবার কাজের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে হলে একটা করে বই লিখতে হবে। সেই দিকে না যেয়ে বাংলাদেশে সাবা মাহমুদকে কেন পড়তে হবে, কেন তিনি জরুরি, কি কারণে আমাদের জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ তার একটিমাত্র দিক নিয়ে কথা বলেই আজ শেষ করি।

‘পলিটিক্স অফ পাইটি’র প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে অন্ধের মতো ইসলাম ও নারীর সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা আধুনিকতাবাদী বা ভোগবাদী সংষ্কৃতির জায়গা থেকে নারীর জন্য দরদী হওয়া এখন মূর্খতা হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য

 

৪.
উনার প্রথম বই, ‘পলিটিক্স অব পাইটি’ বের হলে তিনি যেমন নন্দিত হয়েছেন, তেমনি নিন্দিতও হয়েছেন। বিশেষ করে পশ্চিমের ইসলামোফোবিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ব্যাপক অস্বস্তি তৈরি করেছে তাঁর এই ইন্টারভেনশনাল কাজটা।

কিন্তু যেহেতু তিনি নৃবিজ্ঞানের পদ্ধতি ধরে এবং পশ্চিমের জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে খুবই জোরালোভাবে তর্কটা তুলেছেন। তাই তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারো সুযোগ ছিল না। তিনি স্টুয়ার্ট হল, জুডিথ বাটলারসহ হালের বড় বড় চিন্তকদের মনযোগ পেয়েছেন। তিনি মূলত তালাল আসাদ থেকে সেকুলার তত্ত্বায়ন আর জুডিথ বাটলার থেকে জেন্ডার ও নারীবাদের ক্রিটিক বিষয়ক তত্ত্বায়ন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। যা তার কাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার কাজই পশ্চিমা চিন্তকদের ভাবতে বাধ্য করেছে বা বলা যায় তার কাজের রেসপন্স করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক পশ্চিমা তারকাচিন্তক। আর এই পদ্ধতিগত মুন্সিয়ানার জন্য তিনি অবশ্যই তালাল আসাদের কাছে সব সময়ই ঋণী। আসলে সাবা নিজেই বলেছেন, “আমার কাজ যদি তালাল আসাদের ছায়ায় গড়ে ওঠে এবং এই ছায়াটা যদি আমি ভালোভাবে অনুসরণ করতে পারি নিজেকে ধন্য মনে করব।”

এবং তিনি নিজেকে ধন্য মনে করতে পারেন। যে ‘জিনিওলজিক্যাল’ পদ্ধতি নিয়ে নৃবিজ্ঞানে আসাদ আগমণ করেছেন, ইসলামের নৃবিজ্ঞান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন; সেই একই পথে সাবাও নারী, সার্বভৌমত্ব, যৌনতা ও ধর্ম-রাজনীতির নয়া পাঠ দাঁড় করিয়েছেন। বলাই বাহুল্য এই পদ্ধতির মূল দার্শনিক অবদানে রয়েছেন মহান দার্শনিক নিৎসে। নিৎসের সব চেয়ে ভাল পাঠক বা ছাত্র মিশেল ফুকোর অবদান ও জ্যাক দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন মিলে গোটা পোস্টমর্ডান জ্ঞানতাত্ত্বিক পাটাতনই আসলে এই নতুন চিন্তার বিপ্লবী উত্থানকে সম্ভব করে তুলেছে। জ্ঞানচর্চার নিয়মের মধ্যেই এই ধারাবাহিকতার বিষয়টি নিহিত রয়েছে। একজন এরপরে আর একজন এসে তর্কটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। সাবা এই পরিসরে নারীবাদ, সেকুলারিজম ও রাজনৈতিক ইসলামের পরিমন্ডলে যেভাবে ইন্টারভেন করেছেন তা জ্ঞানের নতুন দরজা খুলতে সাহায্য করেছে, করবে -তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

এই দরজা খোলার অভিজ্ঞতাটা সাবা নিজেই ‘পলিটিক্স অব পাইটি’র ভূমিকাতে বিস্তারিত বলেছেন। তাঁর বয়ানের সাথে সাথে বাংলাদেশের নারীবাদীদের কথা মনে হতেই প্রথমে যেটা মনে আসল তা হল, সাবা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখান থেকেই তিনি নতুন করে শুরু করেছেন। অনদিকে আমাদের দেশের নারীবাদ এই ব্যর্থতার জায়গাটাকে আগলে ধরে বসে আছেন। মূর্খতাকে আপন অহংকার করে নিয়েছেন। উস্কে দিচ্ছেন সমাজে বিভাজনের রাজনীতি।

জাতীয়তাতাদের নামে সন্ত্রাসের যুগে বা উত্তর-উপনিবেশ কালে কলোনিয়াল (পড়ুন পশ্চিমা) জ্ঞান ও রুচির প্রাধান্য কিভাবে সমাজে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে তা নানান দিক থেকে খতিয়ে দেখবার জন্য ‘পোস্টকলোনিয়াল’ আইডিয়ার বিভিন্নমূখী প্রবণতা নিয়ে একটি ভাল জ্ঞানশাস্ত্র বা ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে। যদিও গ্লোবালাইজেশনের কালে কলোনিয়ালিজম, নিও-কলোনিয়ালিজম, পোষ্ট-কলোনিয়ালিজমের বাজার এখন তেমন ভালো না। কারণ কলোনিয়াল ডিসকোর্সকে ক্রিটিক করার জন্য এতো ঘোরা পথের দরকার নাই। জ্যাক দেরিদা কাজটা সহজ করে দিয়ে গেছেন। যে কোন ডিসকোর্সকে ‘ডিকন্সট্রাক্ট’/ নবনির্মাণ করবার সহজ সূত্র আজ হাজির। তারপরেও এই ধারার চর্চার একটা সামাজিক বা সঠিক করে বললে, রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। মূলত এরা ছিল কোন না কোন ভাবে মার্কসবাদী। পরে এরা আবার নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। এদেরই একটি ধারা সাবল্টার্ন স্টাডিজ নামে পরিচিতি। যার গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক মনে করা হয় গায়ত্রী স্পিভাককে। এখন সেই আলোচনা বাদ রাখি। তো এই ধারার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এরা জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিমন্ডলে নতুন কোন ‘ভাষা’ বা ডিসকোর্স তৈরি করতে পারে নাই। দার্শনিক পদ্ধতির দিক থেকেও তেমন শক্তিশালি না। এবং সবচেয়ে বড় গাফলতি হল, পশ্চিমের প্রধান অস্ত্র সেকুলারিজম যে এখন একটি ডকট্রিন হয়ে উঠেছে এটা নিয়ে কোন ক্রিটিক নাই। এদের ব্যাখ্যার রাজনীতির বাইরে কোন গভীর দার্শনিক ইন্টারভেনশন নাই। সেই দিক থেকে সাবা মাহমুদ আসলেই অবাক করা চরিত্র। তিনি জানাচ্ছেন, তাঁর মতো যারা পাকিস্তানের ৭০ এবং ৮০ র দশকে রাজনীতি-সচেতন হয়ে উঠেছেন তাদের প্রধম অভিজ্ঞতা হল, তাঁরা দেখল, পোস্টকলোনিয়াল ন্যাশনালিজম বা উত্তর-উপনিবেশি জাতীয়তাবাদ নতুন জিকির তুলে জাতীয় জীবনে হাজির হচ্ছে। ঠিক বাংলাদেশের মতোই অবস্থা। আসলেই নতুন রুপে এরা হাজির হলেও এটা সেই পুরানা কলোনিয়াল মাল-মসল্লা নিয়েই জাতীয় রাজনীতি ও সমাজ জীবনে হাজির হয়। এর সথে নতুন যুক্ত হয়েছে, গণতন্ত্রমনা স্বাধীনচেতা বামপন্থি নারীবাদের উত্থান। এটাও আসলে নতুন ছিল না। এটাও ছিল সেই পশ্চিমা কলোনিয়াল, আলোকায়ন, আধুনিকতাবাদী বা একটি শাসণতান্ত্রিক প্রকল্প। যা জাতীয়তাবাদের নামে, পশ্চিমের বাইরে অন্য অনেক দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চেপে বসেছে। সাবা মাহমুদও প্রথম জীবনে ক্ষ্যাপা বামপন্থি নারীবাদী ছিলেন। সমাজের মধ্যে ধর্ম বা বিশ্বাসের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ককে কোনভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। বরং ধর্ম কিভাবে নারীকে পরাধীন করে বিশেষ করে ইসলাম কিভাবে নারীকে পরাধীন করে রেখেছে- এই পশ্চিমা তত্ত্বই তিনি ধারণ করে বামপন্থি নারীবাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এই ভ্রম ভাঙতে বেশি সময় তার লাগল না। তিনি যখন দেখলেন, ধর্ম বা ইসলাম ব্যাপারটা পশ্চিম যেভাবে প্রমোট করছে, যেভাবে নারীর বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করাচ্ছে এবং যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারীকে পশ্চিমা পুঁজির বাজারের প্রয়োজনে ক্ষেপিয়ে তুলছে তার কিছুই তো পশ্চিমা সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে নাই। তিনি খোঁজ নিতে শুরু করলেন, ইসলামের ভেতর নারীদের অবস্থা আসলেই কেমন? যারা ধর্মকে পরাধীনতার বিষয় মনে করেন না। কিংবা মনে করেন, নীতি বা আল্লাহর বিধান বা নিজের আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের পরিমন্ডলে গিয়ে সাবার চোখ খুলে গেল। তিনি কায়রোতে মসজিদগুলোতে দেখলেন নারীরা ধর্ম পরিচয়ের ভিতরই কিভাবে নিজেদের জন্য লড়াই করছেন। নিজেদের এই ধর্ম পরিচয়কেই রাজনীতির বাহন করে তুলছেন। তিনি ২ বছর মাঠে থেকে গবেষণা করলেন। লিখলেন দুনিয়া কাঁপানো, ‘পলিটিক্স অব পাইটি’।

বইটির ভূমিকায় সাবা মাহমুদ বলেছেন, ইরানি বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা নারীবাদীদের বয়ান কতটা উৎকল্পনায় ভরা। ইরানি বিপ্লবে নারীরা ধর্মপরিচয়কে সাথে করেই জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে শরিক হলো। তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব এই নারীবাদীদের দেখিয়ে দিল ইসলামের ভিতর থেকেও একটি বিপ্লবে নারীরা কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই অভিজ্ঞতার তত্ত্বায়ন ইসলাম ও নারীবাদ নিয়ে আলোচনার নতুন দরজা খুলে দিলো। এখন দেশে দেশে এই ‘পলিটিক্স অব পাইটি’র দেখা মিলছে। মিলছে নানা র‍্যাডিকাল নারীবাদেরও। এমনকি এখন জেহাদি নারীবাদের নিয়েও কাজ হচ্ছে। কোন সন্দেহ নাই, পশ্চিমা নারীবাদ ইসলামকে শত্রু মনে করে যে মনগড়া উগ্র ভোগপ্রিয় ও বাজার-বান্ধব নারীবাদ দুনিয়াতে প্রমোট করেছে তার বাইরেও নারীর নয়া বিশ্ব উন্মোচনে সাবার কাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকছে।

 

নতুন করে নারীর এই দিকটি অবিস্কার করতে গিয়ে প্রথমে সাবা যেটাকে ভালোভাবে ধোলাই করেছেন তা হলো, পশ্চিমের ফাঁপা ‘স্বাধীনতার’ বাকোয়াজিকে। লিবারালিজম বা উদার নীতির উপর ভর করে যে নারীবাদ এই বাহাদুরি করছে তা আসলে ‘সভ্যতার যুদ্ধে’র মধ্যে শরিক হয়ে বসে আছে নিজের অজান্তেই। অনেকে মনে করেন নারীবাদের আলোচনায় সাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, ‘অধিকার’ বা রাইট এর ধারণাটি যে আসলে ব্যক্তির স্বৈরতন্ত্রী ও স্বেচ্ছাচারিতার মূলভিত্তিকে কেন্দ্র করেই গঠিত হয়েছে; তা তিনি খুবই মুন্সিয়ানার সাথে তত্বায়ন করেছেন। পশ্চিম মনে করে মুসলিম নারী খুবই অত্যাচারিত, সে কোন অধিকার পায় না, ফলে পশ্চিম যখন যেচে এসে অধিকার নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে যায় তখন সমাজের ‘এথিকাল’ অর্ডারকে পাশ কাটিয়ে একধরণের স্বেচ্ছাচারিতার উৎপাদন করা হয়। যার মূল উপকারিতা ভোগ করে আসলে মুক্তবাজার। নারী নতুন ধরণের নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। কাজেই পশ্চিমের নারীবাদের নসিহতকে আমলে না নিয়েও একটি সমাজের মৌল বৈশিষ্ট্যকে, মোরাল দিকগুলোকে নারীরা কিভাবে নিজেদের মধ্যে সংগত করে আন্দোলন তৈরি করেন। কিভাবে নতুন রাজনীতি এখানে তৈরি হয়, তাই দেখতে চেয়েছেন সাবা মাহমুদ। এই দিকে থেকে দেখলে বেগম রোকেয়ার সাথেও খানিকটা মিল আছে বলতে হবে। অবশ্যই রাজনৈতিক ও পদ্ধতিগত ফারাক বিশাল।

তিনি দেখালেন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিকদের মধ্যে ব্যক্তি বা নারী-স্বাধীনতার নামে পশ্চিম যে উৎকল্পনা হাজির করেছেন তা কোনভাবেই নারীর জন্য মুক্তির পথকে পরিস্কার করে না, করবেও না। তিনি এই ‘স্বাধীনতার’ সেকুলার ধারণার এপিস্টিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্রিটিক করলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি সেকুলারিজমের গোমর ভাঙতে শুরু করলেন। দেখালেন, যে সেকুলার-আধুনিকতাবাদী পজিশন থেকে এই ধরণের নারীবাদ গজিয়েছে তা কোন ভাবেই ‘মোরাল’ বা এথিকস এর প্রশ্নটা সমাধান করতে পারে না। অথচ ইসলামের মধ্যেই যারা নারীবাদের এই ধরণের ব্যাখ্যার বাইরে ধর্মকে আশ্রয় করে জীবন চালাচ্ছেন, তারা এইসব প্রশ্ন খুব সহজে সমাধান করেছেন। তিনি এথনোগ্রাফিক স্টাডি, জিনিওলজিকাল ও এপসিটোমলজিক্যাল পদ্ধতিতে তার এই থিসিস পশ্চিমের নারীবাদের সামনে হাজির করলে, সত্যিই এই সেকুলার ও ফাঁপা স্বাধীনতার বাকয়োজ করা নারীবাদ সঙ্কটে পড়ল। তিনি কায়রোতে নব্বইয়ের নারী আন্দোলনকে ভালো ভাবে স্টাডি করে দেখালেন, সেখানের নারীরা মসজিদ ও দাওয়াতের মাধ্যমে কিভাবে নারীদের নিজেদের সমস্যা সামাধানের জন্য শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্র ঘেরাও করতে সক্ষম হলেন। যেখানে পশ্চিমে নারীবাদ ভ্রুণ হত্যার সমস্যার আজও কোন সামাধান করতে পারে নাই। তিনি দেখান, মিশরের নারীরা কিভাবে কোরআনের ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে এই ধরণের যৌনতার সমস্যা সামাধান করলেন। ফলে দেখা গেল ধর্মীয় বলে কোন কিছুকে পাশ কাটিয়ে গেলে, তাকে না জেনে মুখস্ত ঘৃণার চর্চা করে গেলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জ্ঞানের বাইরে থেকে যায়। যা সাংষ্কৃতিক দূরত্ব ও সংঘাতকে পোক্ত করে তুলে।

এমন সব কাজের জন্য সাবাকে পশ্চিমে এমনকি এশিয়ার দেশগুলোতে বেশ ভালো সমালোচনা সহ্য করতে হয়। তার প্রথম বইটি নিয়ে পাকিস্তানের বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। তাকে গোঁড়াবাদী বলে ট্যাগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি সহজে বললেন, আমি তো অবস্থান নিয়ে তর্ক করছি না। কে কোন অবস্থানে আছেন তাও জরুরি না। আমার কাছে জরুরি হল, এইসব অবস্থানকে ব্যাখ্যা করা। তিনি গোড়া বলেই আমার আলোচনার বিষয় হতে পারবে না, এটা আরও বড় গোড়ামী শুধু নয়, এতে কোনভাবেই বিরাজমান পরিস্থিতিতে বদল আসবে না।

সাবা কোনভাবেই মানতে রাজি না যে, যারা ধর্ম-চর্চা করেন তাদের আইডিয়াকে সিরিয়াসলি পর্যালোচনা না করে ঢালাও ভাবে যদি ঘোষণা করা হয়, এরা একটি মিথ্যা আদর্শের বলি; তা হলে কোন কাজের কাজ হবে। একজন স্কলার হিসেবে, চিন্তক হিসেবে তিনি মুখস্ত বুলি আওড়াতে চান না। তিনি পশ্চিমের এই যে প্রচার, ‘মুসলিম ওমেন এজ ভিকটিমস টু দেয়ার কালচার এন্ড রিলিজিয়ন’ মানে মুসলমান নারীরা তাঁর ধর্ম ও সংষ্কৃতি দ্বারা অত্যাচারিত, নির্যাতিত; এই ধরণের সরল প্রচারের রাজনীতিতেও তিনি কান দিতে চান না। তিনি ভেতরে ঢুকে দেখতে চান আসলে কি ঘটে, কিভাবে ঘটে। এবং তা পশ্চিমের সামনে কাউন্টার থিসিস আকারে হাজির করেছেন খুবই পদ্ধতিগত ভাবে। তার বই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, বাংলাতে এখনও হয়নি। একটা প্রবন্ধও পুরো অনুবাদ চোখে পড়েনি। আশা করি আগামীতে তার কাজ নিয়ে আরও সিরিয়াস আলোচনা হবে। আমাদের সমাজের পরিস্থিতিতে সাবা মাহমুদ খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ এখানেও কেবল মুখস্ত বিভাজন তৈরির প্রচার, রয়েছে দুই দুনিয়ার ঝগড়া। সাবার কাজ তাই এখন আমাদের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের নারীবাদ খুবই ভালগার পর্যায়ে আছে। সাবার কাজকে এই প্রেক্ষিতে যুক্ত করে প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন চিন্তকদের কাজ করতে হবে।

সাবা মাহমুদ এতো অল্প সময়ে এতো বিষয় নিয়ে ভেবেছেন, নিশ্চয়ই বেঁচে থাকলে আরও অনেক কাজ আমরা পেতাম। কিন্তু আফসোস করে লাভ নাই। জ্ঞানের এই সিলসিলা বহন করতে হয় জীবিত মানুষকেই, মৃতরা পাশে থাকেন।  সাবা মাহমুদ সারা দুনিয়ায় ছুটেছেন কাজের জন্য, গবেষণার জন্য, শেখার জন্য। তিনি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতাও দিতেন। অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। আগামীতে সেসব সম্পাদনা হয়ে প্রকাশিত হবে আশা করা যায়। তিনি জীবিত থাকতে যেমন দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাজের প্রসংশা করা হতো, অনেক দিন এটা জারি থাকবে। সত্যি বলতে কি, সেকুলারিজম, নারীবাদ, ধর্ম, যৌনতা নিয়ে বড় বড় গবেষকদের কাজে সাবা মাহমুদের বই-পত্রের রেফারেন্স একটা কমন ফ্যাশনও হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে।

উপরে যেটা বলছিলাম, এই যে ‘জেন্ডারড ইসলামোফেবিয়া/বিদ্বেষ’ বা লিঙ্গসর্বস্ব ইসলাম ভীতির চর্চা চলছে- এই পরিসরে সাবা মাহমুদের কাজ পশ্চিমা তথা গোটা নারীবাদের প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। ফলে এখন সাবা মাহমুদের কাজের গুরুত্ব বা জরুরত অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়েছে বলা চলে। তাকে মনযোগ দিয়ে পাঠ করার এটাই উপযুক্ত সময়। ইসলাম ও নারীর সম্পর্ক পশ্চিমা খাপে না দেখে খোদ ধার্মিকতার রাজনীতি (পলিটিক্স অফ পাইটি) কিভাবে ইসলামের মধ্যে জারি আছে তা দেখতে চেষ্টা করা দরকার। ইসলাম ও নারীর সম্পর্ককে আর আগের প্রগতিবাদী দিক থেকে দেখলে হবে না। ‘পলিটিক্স অফ পাইটি’র প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে অন্ধের মতো ইসলাম ও নারীর সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা আধুনিকতাবাদী বা ভোগবাদী সংষ্কৃতির জায়গা থেকে নারীর জন্য দরদী হওয়া এখন মূর্খতা হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। যে কারণে বাংলাদেশের নারীবাদকে আমি কতিপয় অশিক্ষিত নারীর আস্ফালন হিসেবেই দেখি। যাই হোক, সাবা এই অন্ধ-দুনিয়ার মধ্যে একটা যোগাযোগের জন্য সেতু হিসেবে কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন বলা চলে। বাকিটা আমাদের দায়িত্ব। তাহলেই কেবল এই সেতুর কাজটি অব্যাহত থাকবে।