ক্রিকেটে নৈতিকতার অভাব; কঠোর হতে হবে আম্পায়ারদের

ক্রিকেটে নৈতিকতার অভাব; কঠোর হতে হবে আম্পায়ারদের

ক্রিকেটকে বলা হয়ে থাকে ভদ্রলোকের খেলা। ভদ্রলোকের খেলা বলার পেছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। অন্যান্য অনেক খেলার তুলনায় ক্রিকেটে সাংঘর্ষিকতার সুযোগ কম। তবে আসলেই কি ক্রিকেট ভদ্রলোকদের খেলা? একদিকে আইপিএলের মতো লিগগুলোর ক্রিকেট কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক আগ্রাসন, অন্যদিকে খেলোয়াড়দের বেপরোয়া আচরণ, ফিক্সিং ও বল টেম্পারিং করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে আইসিসি বিভিন্ন ‘নিয়ম’ করেছে। ওই নিয়মের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না খেলার মাঠে।

আইপিএলের বাণিজ্যিক আগ্রাসন নিয়ে আগেও কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ক্রিকেটের কয়েকটি ঘটনা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। প্রশ্ন উঠছে খেলার সৌন্দর্য নিয়ে। যেমন- নিদাহাস ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার খেলা চলাকালীন দুই দলের খেলোয়াড়দের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। অন্যদিকে সমসাময়িক আরেকটা ঘটনা ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট চলাকালে। তা হলো প্রথম টেস্টে ডেভিড ওয়ার্নারের আক্রমণাত্মক আচরণ, দ্বিতীয় টেস্টে উইকেট পাওয়ার পর রাবাদার উগ্র উদযাপন এবং তৃতীয় টেস্টে স্টিভেন স্মিথের দল কর্তৃক বল টেম্পারিং।

ক্রিকেট খেলায় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় বা উগ্র আচরণ এখন যেন খুব স্বাভাবিক বিষয়। প্রায় সব সিরিজেই এখন খেলোয়াড়রা পেশাদারিত্ব ভুলে গিয়ে নিজেদের মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডে ৫টি ম্যাচ পণ্ড হয়েছিল শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের কারণে। তাই ক্রিকেটের নিয়ম-কানুনে কড়াকড়ি করার জন্য আইসিসি কিছু নতুন নিয়ম প্রবর্তনের কথা বলে। যেমন, ফুটবলের মতো লাল ও হলুদ কার্ডের ব্যবস্থা করা। ওই নিয়মগুলো তখন না হলেও ২০১৭ সালে ক্রিকেটের ‘কোড অফ কন্ডাক্ট’-এ পরিবর্তন এনেছে আইসিসি। তা হলো গুরুতর অসদাচরণের দায়ে ক্রিকেটারদের মাঠ থেকে বের করে দিতে পারবেন আম্পায়ার। আচরণের মাত্রা ছাড়ালেই আম্পায়ার দিতে পারবেন লাল কার্ড এবং মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হবে ক্রিকেটারদের। আইসিসির ওই নিয়ম প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বলেছিলেন, ওই নিয়মের মাধ্যমে স্লেজিং কমানো সহজ হবে না।

মুশফিকের ওই কথার প্রমাণই যেন দিলেন নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার খেলোয়াড়রা। খেলা চলাকালে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা এবং আনন্দ উদযাপনে প্রকাশ পায় উগ্রতা ও অশ্রদ্ধা। যদিও ওই ম্যাচে নিষিদ্ধ হননি কোনো দলের খেলোয়াড়ই তবুও অন্য চিত্র দেখা গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার রাবাদার ক্ষেত্রে। ডিমেরিট পয়েন্টস-এর জন্য চলতি টেস্ট সিরিজে নিষিদ্ধ করা হয় তাকে। ম্যাচ ফি’র ৫০ শতাংশ জরিমানার পাশাপাশি পরবর্তী দুই টেস্টে নিষিদ্ধ হন তিনি। কারণ ওই সিরিজের তিন ডিমেরিট পয়েন্ট-এর সঙ্গে আগের আরো পাঁচ পয়েন্ট যোগ হয় তার। নিয়ম অনুযায়ী ২৪ মাসের মধ্যে আট ডিমেরিট পয়েন্ট হয়ে গেলে পরবর্তী দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ হবেন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়। প্রথম টেস্টে স্টিভেন স্মিথকে আউট করার পর তার কাঁধে ধাক্কা দেয়ার অভিযোগ ওঠে কাগিসো রাবাদার বিপক্ষে। পরে তা সত্যি প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় টেস্টে আবারও দেখা যায় আক্রমণাত্মক রাবাদাকে। ডেভিড ওয়ার্নারকে আউট করার পর তাকে বাইরে চলে যেতে ইশারা করেন তিনি। ফলে নিষিদ্ধ হন ওই পেসার। অন্যদিকে ওয়ার্নারের সঙ্গে আফ্রিকার উইকেটরক্ষক ডি কক-এর বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়ক ড্রেসিংরুমে যাওয়ার সময় তেড়ে যান ডি কককে লক্ষ্য করে। অস্ট্রেলিয়ানদের এমন আচরণে অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই নড়ে-চড়ে বসেছেন। অনেকেরই দাবি, অস্ট্রেলিয়া সব সময়ই ‘আগলি ক্রিকেট’ খেলে এসেছে। তারা নিশ্চয় শেন ওয়ার্ন বা ম্যাকগ্রাদের বেপরোয়া আচরণ ভুলে যাননি।

এতো নিয়মের পরও ক্রিকেটারদের আগ্রাসী মনোভাব দিনকে দিন বেড়ে চলছে। অন্যদিকে কমছে নৈতিকতা ও খেলার প্রতি শ্রদ্ধা। খেলার মাঠে খেলোয়াড়রা প্রায়ই ভুলে যাচ্ছেন ক্রিকেট যে ভদ্রলোকদের খেলা!

নৈতিকতার অবক্ষয়ে আরেকটা প্রমাণ বলা যায় চলতি দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়া সিরিজে বল টেম্পারিংয়ের ঘটনা। ক্রিকেট আইন অনুযায়ী বল চকচকে করতে কোনো কৃত্রিম বস্তু ব্যবহার করা যাবে না। বল ভিজে গেলে তোয়ালে দিয়ে মুছে নেয়া যাবে, কাদা লাগলে তা আম্পায়ারের সামনে সরানো যাবে, এমনকি বল চকচকে করতে থুতুও ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু কৃত্রিম কিছু ব্যবহার করা যাবে না। যদি বল চকচকে করতে কখনো কৃত্রিম কিছু ব্যবহার চেষ্টা করা হয় তাহলে তা হবে অনৈতিক। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা ওই কাজটি করতে গিয়েই ধরা পড়েছেন।

ক্রিকেটে টেম্পারিংয়ের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। সর্বপ্রথম বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ ওঠে ১৯৯৪ সালে লর্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মাইকেল আথারটনের বিপক্ষে। ২০০১ সালে শচীন টেন্ডুলকার। ২০০৬ সালে পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে খেলা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বোলার স্টুয়ার্ট ব্রড ও জেমস এন্ডারসনের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ উঠেছিল। একই বছর পাকিস্তানের ক্রিকেটার শহিদ আফ্রিদির বিরুদ্ধেও বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ ওঠে। অবশ্য দলবেঁধে পরিকল্পনা করে টেম্পারিংয়ের ঘটনা ক্রিকেট বিশ্ব এর আগে কখনো দেখেনি।

অস্ট্রেলিয়ায় একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। তা হলো ‘দেশের সরকারের পর সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কের।’ স্টিভেন স্মিথ দ্বারপ্রান্তে ছিলেন তাদের দেশের সেরা অধিনায়কদের একজন হওয়ার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওই টেস্ট সিরিজে নানান বিতর্কের জন্ম দেয় ক্রিকেটের কর্তা দলটি। কলঙ্ক এড়াতে বোর্ড কর্তৃক অধিনায়ক স্মিথ ও সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের ওপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। দু’জনই সব আন্তর্জাতিক ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন এক বছরের জন্য। একই সঙ্গে ৯ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় আরেক খেলোয়াড় ব্যানক্রফটকে।

ওই ঘটনাটি ঘটে শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার কেপটাউন টেস্টে। অস্ট্রেলিয়া দলের ক্যামেরন ব্যানক্রফট হলুদ টেপ-জাতীয় কিছু হাতে নিয়ে বল ঘষার সময় ধরা পড়ে টেলিভিশন ক্যামেরায়। পরে খেলা শেষে অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন বল টেম্পারিংয়ের চাঞ্চল্যকর পরিকল্পনার কথা। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল লিডারশিপ গ্রুপের সিদ্ধান্ত।’ এ স্বীকারোক্তির পরের দিনই অস্ট্রেলিয়া সরকার স্মিথকে অধিনায়কত্বের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে চাপ দেয়। ফলে অধিনায়কত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাকে। সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারও সরে দাঁড়ান তার পদ থেকে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি অবশ্য বল টেম্পারিংয়ের ওই ঘটনায় মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচ থেকে নিষিদ্ধ করে স্মিথকে। জরিমানা করা হয় তার পুরো ম্যাচ ফি এবং ব্যানক্রফটকে নিষেধাজ্ঞা না দিলেও করা হয় ম্যাচ ফির ৭৫ শতাংশ জরিমানা।

ডেভিড লয়েড, নাসির হুসেন প্রমুখ সাবেক খেলোয়াড় ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন ওই ঘটনায়। ডেভিড লয়েড বলেন, ‘শুধু এই নির্দিষ্ট সিরিজ নয়, শুধু ওই কয়েক খেলোয়াড়ই নন, ডারবান যা ঘটেছে তা উদাহরণ মাত্র। খেলোয়াড়দের মধ্যে শ্রদ্ধা কমে গেছে। তারা শুধু নিজেদেরই অপমানিত করছেন না, অপমান করছেন ম্যাচ অফিসিয়ালদেরও। সবকিছুর ঊর্ধ্বে অপমান করছেন ক্রিকেট খেলাটিকে।’

নিয়ম-কানুন করে কোনো লাভ নেই যদি খেলোয়াড়রা নিজেদের শ্রদ্ধা করতে না পারেন? সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর হচ্ছে ক্রিকেটীয় আইনে আছে শুধু সীমা অতিক্রমের কথা। ওই সীমা নির্ধারণ করে দেবেন কে? কীভাবে বুঝবেন আচরণ সীমা লঙ্ঘন করেছে? অবশ্য আইনে এটি পরিষ্কারভাবে বলা আছে, দলের দায়িত্ব অধিনায়কের ওপর। এটি ঠিক যে, খেলায় নৈতিকতা আনতে অধিনায়ক থেকেই শুরু করতে হয়। ক্রিকেটে অধিনায়কের দায়িত্ব শুধু রণকৌশল সাজানো নয়, দলটিকে শৃঙ্খলে রাখার দায়িত্বও পড়ে তার কাঁধেই। এ কারণে মাঠে বা মাঠের বাইরে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে দলটিকে সুশৃঙ্খলায় রাখতে।

অবশ্য আম্পায়রদেরও কিছু ভুল রয়েছে। মাঠে তারা সব দেখেন ও শোনেন। কিন্তু সবসময় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। বর্তমানে যেহেতু আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারিদের ক্ষমতা রয়েছে সেহেতু প্রয়োজনীয় যে কোনো পদক্ষেপ নেয়া উচিত তাদের। আম্পায়াররা চাইলে আচরণবিধির জন্য খেলোয়াড়দের কার্ড দেখাতে পারেন। দরকার হলে লাল কার্ড দেখাতেও দ্বিধা করবেন না তারা। মাঠে বা মাঠের বাইরে কোনো খেলোয়াড়ের বেপরোয়া আচরণের জন্য যদি লাল কার্ড দেখানো, চলতি খেলা থেকে বাদ দেয়া কিংবা পরবর্তী তিন ম্যাচ বহিষ্কার করা হয় তাহলে দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। আর এতেই তারা শিক্ষা নেবেন। অনেক সময় দেখা গেছে, খেলোয়াড়রা ইচ্ছা করেই সময় নষ্ট করেন– বার বার পানি খাওয়ার বিরতি নেন, বলে বলে ফিল্ডিং পরিবর্তন করেন ইত্যাদি। এ জন্য খেলার পর জরিমানা করা হয়। অথচ মাঠের আম্পায়াররা তখনই হলুদ কার্ড দেখাতে পারেন। তাদের হাতে ওই ক্ষমতা আছে। এতে খেলোয়াড়রা মাঠেই সতর্ক থাকবেন।

ক্রিকেট অনেক দিন ধরে খেলা হচ্ছে। সত্তর বা আশির দশকেও ক্রিকেট ছিল। তখনো খেলোয়াড়দের মধ্যে ‘চিটচ্যাট’ হয়েছে। তখনো ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু তারা কেউই উগ্র ছিলেন না। খেলা ও খেলোয়াড়দের প্রতি এমন অশ্রদ্ধা দেখাননি তারা। এখন একজন আরেকজনকে জাতি-বর্ণ, এমনকি পরিবারের সদস্যদের নিয়েও গালমন্দ করেন। তাছাড়া বর্তমানে অনেক খেলোয়াড়ই স্ট্যাম্পের মাইক্রোন থাকার বিপক্ষে। কারণ স্ট্যাম্পের মাইক্রোফোনে অনেক শব্দ চলে আসে যা আম্পায়াররা সাধারণত শোনেন না। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলায় যেমন ইংলিশ ব্যাটসম্যানকে উদ্দেশ অশ্লীল মন্তব্য করেন রাবাদা। পরে স্ট্যাম্পের মাইক্রোফোনে ধরা পড়লে তাকে দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ করা হয়।

খেলোয়াড়দের ওইসব আচরণ যেন মাশরাফির কথাটাই মনে করিয়ে দেয় বার বার- ‘ক্রিকেটাররা রোল মডেল নন। আমাদের রোল মডেল ভাববেন না।’ রোল মডেল যদি নাও ভাবি, ক্রিকেটের ভদ্রতার ঐতিহ্য ধরে রাখা দরকার। খেলাটিকে আবারও ভদ্রলোকের খেলা, জেন্টলম্যানদের খেলায় পরিণত করার জন্য সবার আগে আইসিসি-কেই এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া অধিনায়ক ও কোচসহ এগিয়ে আসতে হবে আম্পায়ারদেরও।

অন্যদিকে আম্পায়ারদের আরো কঠোর হতে হবে। আইনের প্রয়োগ করতে হবে। কোনো একটি দৃষ্টান্ত দাঁড়িয়ে গেলে তা ছড়িয়ে পড়বে। ক্রিকেট ভদ্রতার খেলা। তাই এখনই ভদ্রতা, শ্রদ্ধা, সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের প্রিয় ক্রিকেটে।