বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস যদি ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থাকে স্পন্সর দেয়া বন্ধ না করে তবে তারা বয়কটের মুখোমুখি হতে পারে। কারণ ইসরায়েল অবৈধভাবে দখলকৃত পশ্চিম তীরের দলসমূহকে তাদের সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই মর্মে জার্মানির এই কোম্পানিকে ফিলিস্তিনের ১৩০টি ফুটবল ক্লাব ও স্পন্সর সংস্থা একটি স্মারকলিপি দিয়েছে।
এতে অ্যাডিডাসের সিইও ক্যাসপার ররস্টেডকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, “ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থার প্রধান স্পন্সর হচ্ছে অ্যাডিডাস। অ্যাডিডাস ইসরায়েল কতৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সহযোগিতার শামিল এমন কাজ থেকে যেন বিরত থাকে।”
অ্যাডিডাস আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাসসহ ইউরোপিয়ান লিগের শীর্ষ স্পন্সর। অন্যান্য অঞ্চলেও অ্যাডিডাস তার প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সে অঞ্চলের সেরা ক্লাবগুলিতে স্পন্সর করে যাচ্ছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার অরল্যান্ডো পাইরেটস ও অ্যাজাক্স কেপ টাউন- এই দলগুলি দক্ষিণ আফ্রিকার ‘দেশীয় প্রিমিয়ার লীগে’ অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়া রিবোক ব্র্যান্ডের মালিকানাও অ্যাডিডাসের।
অপরাধ থেকে মুনাফা
‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে বিস্তারিত দেখানো হয়েছে যে, মুনাফা আদায়ের ক্ষেত্রে বিশ্ব ফুটবল পরিচালনার সংস্থা ‘ফিফা’ কীভাবে ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থা কতৃক পশ্চিম তীরের অবৈধ বসতিপূর্ণ এলাকায় খেলা পরিচালনা করেছে, যার মাধ্যমে মারাত্মকভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি জনগণ ও মানবাধিকার কর্মীরা অনেক বছর ধরে ‘ফিফা’ থেকে এসব অবৈধ বসতিপূর্ণ এলাকার ক্লাবসমুহকে বাদ দেয়ার পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছে।
এ নিয়ে আশ্বাস দেয়া স্বত্বেও ফিফা বারবার ইসরায়েলি চাপের কাছে মাথা নত করছে। গত মে মাসে, ফিফার সভাপতি গিয়ানিনি ইনফান্তিনো সংস্থার কংগ্রেসে একটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ইসরায়েলকে নিষেধাজ্ঞার মুখ থেকে রক্ষা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত অক্টোবর মাসে ‘ফিফা’ শর্ত সাপেক্ষে ইসরায়েলি দলসমূহকে দখলকৃত অঞ্চলে খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সবুজ সংকেত প্রদান করে। অথচ ফিফার নিজস্ব নিয়ম ভঙ্গ করে সংস্থাটির একজন সদস্য দখলকৃত অঞ্চলে অনুমতি না নিয়ে আরেকটি খেলার আয়োজন করে। ফলে ফিলিস্তিনিরা এখন সরাসরি তাদের স্পন্সরদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করছে।
বয়কটের হুমকি
ফিলিস্তিনের ক্লাব মালিকরা অ্যাডিডাসকে সতর্ক করে দিয়ে বলছে যে, “যদি তারা দখলদার ইসরায়েলের এসব কুকর্মে সহায়তা অব্যাহত রাখে তবে তারা আরব বিশ্ব, এমনকি সারা বিশ্বের ক্রেতাদের নিকট অ্যাডিডাসের পণ্য বয়কটের ডাক দেবে।”
তারা অ্যাডিডাসকে আরও সতর্ক করেন, জাতিসংঘের ডাটাবেসে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, তারা কীভাবে অবৈধ বসতি স্থাপন করেছে এবং ফিলিস্তিনের ভূমিতে অবৈধ উপনিবেশ স্থাপন করে কীভাবে এসব কোম্পানি লভ্যাংশ আদায় করছে।
ফিলিস্তিনের জাতীয় দলের খেলোয়াড় মাহমুদ সারসাক এই দাবির পক্ষে বলেন, “ফিলিস্তিনি ফুটবলাররা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলি সেনা ও টিয়ার গ্যাস হামলার শিকার। তারা আমাদের খেলা দেখতে যেতে দিচ্ছে না। আমরা আমাদের সতীর্থদেরকে হত্যা করতে দেখছি এবং আমাদের স্টেডিয়ামে বোমা মারা হচ্ছে।”
সারসাক নিজেও ইসরায়েলিদের জেলে তিন বছর কোন ধরণের অভিযোগ বা বিচার ছাড়া বন্দি ছিলেন। শেষমেশ তিন মাসের টানা অনশনের মাধ্যমে তিনি যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হন তখন তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
সারসাক বলেন, “ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থার স্পন্সর ‘অ্যাডিডাস’-এর আইকনিক লোগোকে ইসরায়েলিরা আমাদের অধিকার হরণের কাজে ব্যবহার করছে। অ্যাডিডাসের এই মুহূর্তে উচিৎ ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থার সাথে তাদের চুক্তি ভঙ্গ করা।”
আন্তর্জাতিক আইন লংঘন
মানবাধিকার কর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ ব্যাপারে ঐক্যমত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, দখলদারদের সাথে যে কোন ধরণের ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড বৈধ নয় এবং তা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন অমান্যের শামিল।
‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ ইসরায়েলিদের অবৈধ আবাসন অঞ্চলে সব ধরণের ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার আহবান জানিয়েছে। ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ সরকারকে আবাসন সামগ্রী আমদানি বন্ধের আহবান জানিয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে, মানবাধিকার কর্মী ও ফিলিস্তিনিদের বয়কটের হুমকির মুখে জাপান ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ‘হোন্ডা’ একটি ‘মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতা ইভেন্ট’ বর্জন করেছে, যা ইসরায়েলের অবৈধ আবাসন অঞ্চলে আয়োজন করা হয়েছিল।
যদিও প্রতিযোগিতার আয়োজকরা অজুহাত হিসাবে নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ এবং প্রতিকূল আবহাওয়াকে দায়ী করেছেন কিন্তু ইসরায়েলি মিডিয়া এর জন্য বয়কট এবং চুক্তিবাতিল আন্দোলনের প্রভাবকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন।
ফুটবল ক্লাবগুলো এর আগে জেরুসালেমে ইসরায়েলের আয়োজন করা ‘জেরুসালেম ম্যারাথনে’ কোম্পানিটির স্পন্সরশিপ বাতিলের ঘটনা উল্লেখ করে। সেবার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে অ্যাডিডাস তাদের স্পন্সরশিপ উঠিয়ে নেয়।
হিন্দ আওয়াদ, ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলবিরোধী একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক বয়কটের প্রচারণার কথা জানিয়ে বলেন, ২০১৬ সালে অ্যাডিডাস ‘আন্তর্জাতিক অ্যাসেসিয়েশন অফ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের’ স্পন্সরশিপ ডোপিং এবং দুর্নীতি কেলেঙ্কারির কারণে বাতিল করে দেয়।
ফলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণের সাথে জড়িত থাকার কারণে ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থার স্পনসরশিপ নিশ্চিতভাবেই বাতিল হওয়া উচিৎ।
আওয়াদের মতে, “অ্যাডিডাসের সঠিক কর্মকাণ্ড করা তাদের দায়িত্ববোধের মধ্যে পড়ে, পাশাপাশি ফিলিস্তিনি ফুটবল ক্লাবগুলোর উচিৎ ইসরায়েলি ফুটবল সংস্থার স্পন্সরশিপ বাতিলের জন্য আন্দোলনের চিন্তাভাবনা করা।”
অ্যাডিডাস এর জবাবে বলেছে, “মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো তাদের কর্পোরেট দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে।”
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে অ্যাডিডাস এই দাবির ব্যাপারে কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় যাতে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষা হয়।