সফল পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী ক্রীড়াবিদ

সফল পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী ক্রীড়াবিদ

আর সব খাতের মতোন ক্রীড়াঙ্গনেও নারীর অবদান কম নয়। বর্তমান সময়ে নারীদের পথচলা যতটা সাবলীল, দৃশ্যপট আগে তেমন ছিল না। যদি গায়ের রঙ হয় কালো, দুনিয়াটাই তখন অন্ধকার। তবে, ব্যতিক্রম সর্বদা আছে। বর্ণবাদ,  লোকের নজর সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাফল্যের পথে রেখে গেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর যার রেশ ধরে বর্তমান রাঙাচ্ছেন অনেকেই। ক্রীড়াঙ্গনের তেমন পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী ক্রীড়াবিদকে নিয়ে আজকের আয়োজন।

 ৫. লায়লা আলী

কিংবদন্তি পিতা মোহাম্মদ আলীর সাথে লায়লা অালী। Image: Ed Mulholland/WireImage

মোহাম্মদ আলী। গত শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ। বক্সিংয়ের মহামানব। আচ্ছা, যখন শুনবেন মহামানবের রাজত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে হাতবদল হচ্ছে নিশ্চয় খুশি হবেন? যদি শোনেন উত্তরাধিকারী একজন মেয়ে, তাহলে? চমকে যাবার কথা। বক্সিং জগতটাও এভাবে চমকে গিয়েছিলো যখন জানতে পারে পেশাদার বক্সিংয়ে নাম লেখাচ্ছেন আলী তনয়া লায়লা আলী। সমালোচনা হয়েছে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে যখন লায়লা সিদ্ধান্ত নেন, তখন এমনকি সায় ছিল না স্বয়ং মোহাম্মদ আলীরও। এ পেশায় কতটা ঝুঁকি তা তার চেয়ে ভাল কে জানে। কিন্তু, মেয়ের শরীরে যে তারই রক্ত, থেমে যাবার প্রশ্নটাই অবাঞ্ছিত। বাবাকে তাই আশ্বস্ত করলেন কন্যা। “আমি মেয়েদের বিরুদ্ধেই খেলতে যাচ্ছি, ছেলেদের নয়। তাছাড়া, শরীরে জিনটা তোমারই।” লায়লা আলী খেলেছেন। ১৯৯৯ সালে ২১ বছর বয়সে প্রথম রিংয়ে নেমে ২০০৭-এ খেলা ছাড়ার আগে ক্যারিয়ার সাজিয়েছেন ২৪ ম্যাচে ২৪ জয়ে। এর মধ্যে একুশটিই নকডআউট! প্রথম ম্যাচে সকলে দেখতে এসেছিল মোহাম্মদ আলীর মেয়ের খেলা, শেষ ম্যাচে যা রূপান্তরিত হয়েছে লায়লা’র ম্যাচে।

♦ ৪. সেরেনা উইলিয়ামস

শিরোপা হাতে সেরেনা উইলিয়ামস

সেরেনা জেমিকা উইলিয়ামস। ছত্রিশ বছরের উড়ন্ত পাখি। ছত্রিশে পুরুষরাও খেলতে নামার আগে ভাবে, সায় দেবে তো শরীর? সেরেনাও ভাবেন। পারবো তো টুর্ণামেন্ট জিততে? ২০১৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস মার্কিন কৃষ্ণকলি সেরেনা উইলিয়ামসকে দেয় ‘আমেরিকা’স গ্রেটেস্ট অ্যাথলেটের খেতাব। সেরেনার বর্ণাঢ্য জীবনে আলো কেবল এতটুকুই নয়। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পাম বিচ গার্ডেনে জন্ম নেওয়া সেরেনার টেনিসে পথচলা শুরু ১৯৯৫ সালে। প্রথমবার র‌্যাংকিংয়ের চূড়ায় আরোহণ করেন ২০০২ সালে। এরপর নামেন প্রায় দুই বছর ছয় মাস পর। সপ্তাহের হিসেবে পাক্কা ১৮৬ সপ্তাহ। নারী টেনিসের আরেক কিংবদন্তি স্টেফি গ্রাফের সাথে যা যৌথ সর্বোচ্চ। একটানা শীর্ষে থাকার রেকর্ড ভাগ করে নিলেও সবচেয়ে বেশি আটবার নাম্বার ওয়ান হবার রেকর্ডটা তার একারই। বাবার হাত ধরে শুরু হয় টেনিস ইতিহাসের পাতায় অমরত্বের পথে যাত্রা। শুরু থেকে আজ অব্দি গুরু হিসেবে আছেন বাবা রিচার্ড উইলিয়ামসই।

২৩ গ্র‍্যান্ডস্লাম জেতা সেরেনা লড়াই করেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। যুক্ত আছেন বর্ণবাদবিরোধী সংস্থা ব্ল্যাক ম্যান লিভ এর সাথে। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য তিনি সদা নিবেদিত প্রাণ। ২০০৮ সালে সেরেনা উইলিয়ামস ফাউন্ডেশনের অনুদানে কেনিয়ায় তৈরি করা হয় হাইস্কুল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বৃত্তি প্রদান করছেন। ২০১৬ সালে জ্যামাইকায় গড়ে তোলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১৬-তে সেরেনাকে নিয়ে ‘সেরেনা : দ্য আদার সাইড অব গ্রেটনেস’ শিরোনামে তৈরি করা হয় ডকুমেন্টারি। ২০০৫ সালে বড় বোন ভেনাসকে সঙ্গে নিয়ে লিখে ফেলেন একটি বইও। যার নাম- টেন রুলস অব লিভিং, লাভিং এন্ড উইনিং।

♦ ৩. আলথিয়া গিবসন

আলথিয়া গিবসন

সেরেনা উইলিয়ামসের সাহসী পথচলায় আলথিয়া গিবসন বড়সড় প্রেরণার নাম। গায়ের রঙয়ের সীমাবদ্ধতা ভেঙ্গে বনে যান প্রথম কালো নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে। টেনিস কোর্টে নেমেই নিজেকে সফল ভাবেননি তিনি। জিতেন ১৯৫৭ সালের ইউএস ওপেন। ওটা কাকতাল ছিল? এমনটা ভাবতে দেননি নিন্দুককে। পরের বছর ১৯৫৮তেও ধরে রাখেন শিরোপা। স্বীকৃতি পেতে দেরি হয়নি। এহেন সাফল্যে সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে টানা দুইবছর পান সেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার।

টেনিসেই থেমে থাকেননি তিনি। নিজের প্রতিভার প্রমাণ রেখেছেন পেশাদার গলফ খেলে। তবে তিনি বেঁচে রবেন টেনিসে। ক্রীড়াজীবন শেষে গায়িকা এবং অভিনেত্রী হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন। পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি শহরের ক্রীড়াপ্রধানের দায়িত্ব। ১৯৭১ সালে টেনিসের হল অব ফেমে জায়গা পাওয়া এই কিংবদন্তি আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯২৭ সালে জন্ম নেন। ২০০৩ সালে ৭৬ বছর বয়সে নিউজার্সিতে মৃত্যুবরণ করেন নির্ভীক এই নারী। তাঁর একটি অমূল্য উক্তি–

“হেরে যাওয়া ব্যক্তি সর্বদা সমস্যার অংশ হয়, জয়ী ব্যক্তি সর্বদা সমাধানের। পরাজিতের সবসময়
বাহানা থাকে, বিজয়ীর থাকে আয়োজন। কাজ সম্পর্কে পরাজিতের দৃষ্টিভঙ্গি, এটি হয়ত সম্ভব কিন্তু কঠিন।
বিজয়ী ভাবে, এটি হয়ত কঠিন কিন্তু সম্ভব।”

♦ ২. উইলমা রুডলফ

১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ের পর উইলমা রুডলফ (মাঝে)

উসাইন বোল্ট টানা দুই অলিম্পিকে গোল্ডের ট্রেবল জিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন সুউচ্চে। অলিম্পিকে অংশ নেয়া স্পেশাল প্রতিযোগী দক্ষিণ আফ্রিকার অস্কার পিস্টোরিয়াসকে মনে আছে? একজোড়া কৃত্রিম পা নিয়ে সুস্থ সবল মানুষের সাথে অভিন্ন ট্র‍্যাকে দৌঁড়েছেন তিনি। জীবন এখানেই অনন্য, অভূতপূর্ব সৌন্দর্যে বিমোহিত। জানেন কি? পিস্টোরিয়াস আর বোল্ট দুজনকেই একত্রে দেখেছিল ১৯৬০ অলিম্পিক এর আসর! তখন এ দুইজনের জন্ম হয়নি বটে কিন্তু সেবারের যুক্তরাষ্ট্র দলের ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের নারী প্রতিনিধি ‘উইলমা রুডলফ’ আজকের বোল্ট-পিস্টোরিয়াসেরই আদিরূপ। উইলমা শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে অলিম্পিকে আসেননি, কিন্তু শৈশবে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকবছরের জন্য দুটো পা’ই প্রায় বিকল হয়ে পড়ে তাঁর। সেই তিনিই পরে ১৯৬০ রোম অলিম্পিকে তিনটি সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে বনে যান ট্রেবলজয়ী প্রথম আফ্রো আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারী। জেতেন ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ৪ গুণিতক ১০০ মিটার স্প্রিন্টের দলগত ইভেন্টে।  ১৯৬০ এবং ‘৬১ সালে সাংবাদিক সংস্থার পক্ষ থেকে নির্বাচিত হন সেরা স্প্রিন্টার। খেলোয়াড় হিসেবে ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ছাড়লেও ছাড়তে পারেননি পাকাপোক্তভাবে। বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন নানান ভূমিকায়। নিজ রাজ্য টেনেসির স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কোচিং ডিগ্রি সম্পন্ন করে নামেন কোচিং পেশায়। কখনো কোচ, কখনো শিক্ষক, কখনো বা অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধারাভাষ্যকার রূপে। বর্ণাঢ্য জীবনটা থেমে যায় ৫৪ বছর বয়সে। ২০০৪ সালে আমেরিকান ক্রীড়াঙ্গনে অসামান্য অবদান রাখায় তাকে ভূষিত করা হয় আজীবন সম্মাননায়। উইলমা গ্লোডিয়ান রুডলফ পৃথিবীর বুকে বিচরণ করেছেন ২৩ জুন ১৯৪০ থেকে ১২ নভেম্বর ১৯৯৪ পর্যন্ত।

♦ ১. অ্যালিস কোচম্যান

অলিম্পিকে প্রথম স্বর্ণজয়ী নারী অ্যালিস কোচম্যান। Image: AP Photo

আলবেনি, জর্জিয়া। ১৯২৩ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখে জন্ম নেওয়া অ্যালিস কোচম্যান ফ্রেড এবং এভলিন কোচম্যান দম্পতির পঞ্চম সন্তান। অ্যালিসরা মোট দশ ভাইবোন। বাবার সামর্থ্য ছিল না তাকে পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের সুবিধা দেওয়ার। ঘরে তৈরি সরঞ্জামে চলত অনুশীলন। অ্যালিস কোন টুর্ণামেন্টে অংশ নিতে পারতেন না গায়ের রং কালো বলে। কোচম্যান নজরে আসেন স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে ‘হাই জাম্প’-এ রেকর্ড ভাঙ্গা পারফর্ম করে।

তারপর পিছু ফিরতে হয়নি তাকে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৮, টানা দশবার হাই জাম্পের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের টাইটেল বগলদাবা করেন। তার বিচরণ অব্যাহত থাকে ৫০ মিটার, ১০০ মিটার এমনকি দলগত ৪০০ মিটার ড্যাশেও। নিজের একাডেমি তুসকিগি ইনস্টিটিউটের বাস্কেটবল দলের হয়ে জেতেন তিনটে চ্যাম্পিয়নশিপ।

তারপর ১৯৪৮ অলিম্পিক। হাই জাম্পের নাম্বার ওয়ান নিজের রাজত্ব ধরে রাখেন অলিম্পিকেও। পান সোনার পদক। এতেই তিনি নাম লেখান ইতিহাসের অমর অধ্যায়ে। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয় করে নেন। চিরকাল ঔজ্জ্বল্য ছড়াবেন ২০১৪-র জুলাইতে ৯১ বছর বয়সে কার্ডিয়াক ব্লক হয়ে জন্মস্থান আলবেনিতেই মৃত্যুবরণ করা এই কিংবদন্তি।

সালে কোকাকোলার ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সাইন করে তিনি নাম লেখান আরেকটি ইতিহাসে। এখানেও তিনি প্রথম আফ্রো আমেরিকান নারী হিসেবে কোকাকোলার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। অলিম্পিক জয়ের পর মাত্র ২৪ বছর বয়সেই পড়াশুনা এবং চাকরির খাতিরে থামিয়ে দেন লম্ফঝম্প। অবসর নিয়েছেন ঠিকই, রয়ে যায় লিগ্যাসি। ছোট্ট ক্যারিয়ারের মূলধন দিনে দিনে বেড়েছে তার। ১৯৭৫ সালে ইউএস ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের হল অব ফেমের পর ১৯৭৯ সালে জায়গা পান নিজ দেশ জর্জিয়ার হল অব ফেমে। ১৯৯৬ সালে সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি মেলে। আটলান্টা অলিম্পিকের আগে ঘোষিত সর্বকালের সেরা ১০০ অ্যাথলেটের একজন হিসেবে নিজেকে দেখতে পাওয়াটা সৌভাগ্যের চাইতে বেশি কিছুই বটে। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক হল অব ফেমেও আপন আলোয় উজ্জ্বল তিনি। বিশ্বজুড়ে কেবল কৃষ্ণাঙ্গ নয় বরং সকল নারী ক্রীড়াবিদের আদর্শ এই জর্জিয়ান ক্রীড়ারাণী।