ফের ট্রেবল জিতছে বার্সা?

ফের ট্রেবল জিতছে বার্সা?

ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা। ২০০৯ সালে পেপ গার্দিওলার অধীনে প্রথম স্প্যানিশ ক্লাব হিসেবে এক মৌসুমে তিন শিরোপা জয়ের অনন্য ইতিহাস গড়ে। সেবার মোট ছয়টি ট্রফি ঘরে তোলে মেসি- ইনিয়েস্তারা। তারপর ২০১৪/১৫। কোচ লুইস এনরিকে কাতালানদের ট্রেবলের স্বাদ দেন নতুন করে। এরপর মেলেনি আর। এবার নতুন গুরু ভালভার্দে শিষ্যদের নিয়ে ট্রেবলে চোখ রেখেছেন। চাইলেই কি আর সবকিছু সহজে ধরা দেয়? মেলাতে হয় নানান হিসাব নিকাশ, দাঁড়িপাল্লায় মাপতে হয় সম্ভাবনা-ঝুঁকি। এবারের আয়োজনে থাকছে তেমন কিছু। আমাদের চোখে বার্সার ট্রেবল পাওয়া, না পাওয়ার তত্ত্ব তালাশ।

যেসব কারণে পেতে পারে

 

লিগ টাইটেল : লা লিগায় নিজেদের ২৫তম টাইটেল মোটামুটি নিশ্চিত কাতালানদের। ২৯ ম্যাচে ৬৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলে শীর্ষে আছে তারা। বাকি আছে ০৯ রাউন্ড, সেকেন্ড পজিশনে থাকা অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের সঙ্গে ব্যবধান ১১ পয়েন্ট। এমন অবস্থায় লা লিগার ইতিহাসেই কোন দলের কামব্যাক সম্ভব হয়নি। লিগের নিঃস্পত্তি অনেকটা হয়ে গেছে বলা যায়।

সিডিআর ফাইনাল এবং ইউসিএল শেষ আট : সিজনের শুরুতে রিয়ালের কাছে স্প্যানিশ সুপার কাপে হারলেও সিজনের প্রায় শেষে এসে আরেকটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ‘কোপা দেল রে’র ফাইনালে বার্সেলোনা। আসন্ন এপ্রিলের ২২ তারিখ রাতে গত সাত সিজনে ছয়বার ফাইনাল খেলা বার্সাকে কতটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে  সেভিয়া, সেটিই দেখার বিষয়। তার আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আটে ইতালিয়ান ক্লাব রোমার চ্যালেঞ্জ। অবশ্য, বার্সা জানে কিভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।

মি. মেসি : লিওনেল মেসি। ত্রিশ বছরের তরুণ। পার করছেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময়। ক’দিন আগেই ৬০০ ক্যারিয়ার গোলের মাইলফলক স্পর্শ করলেন। টানা তিন ম্যাচে ফ্রি কিকে গোল দিয়ে নতুন করে তাঁকে নিয়ে ভাবাতে বাধ্য করেছেন সবাইকে। মেসি মাঠে থাকা মানে বার্সার অফুরান অক্সিজেন। তার জাদুতে ভোজবাজির ন্যায় পাল্টে যায় খেলার গতিপথ। মেসি। কারো কাছে ভিনগ্রহী, কারো কাছে সর্বেসর্বা। সব ছাপিয়ে তিনি এ গ্রহের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। মেসির দিনে ম্লান বাকি সব। খাদের কিনারা থেকে দলকে যেমন ওঠাতে পারেন, বিপক্ষকেও পতিত করতে পারেন কৃষ্ণগহ্বরে। ২০১৭/১৮ মৌসুমের প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমপ্লিট। লা লিগায় ২৮ ম্যাচ খেলে ক্ষুদে জাদুকরের গোল ২৫টি, তার প্রত্যক্ষ সহায়তায় সতীর্থদের কাছ থেকে গোল এসেছে আরো ১২টি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সার ১২ গোলের ৬টিই তার! আট ম্যাচে এছাড়াও এসিস্ট করেছেন ২টি। কাতালানরা পৌঁছেছে কোপা দেল রে’র ফাইনালে। ৫ ম্যাচে মেসির অবদান ৩ গোল, ২ এসিস্ট। মোট ৪৩ ম্যাচে ৩৫ গোল ১৬ এসিস্টে মেসি আছেন চেনা ছন্দেই।

চোয়ালবদ্ধ রক্ষণ : চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গ্রুপ এবং শেষ ষোল মিলিয়ে ম্যাচ আটটি। বার্সা গোল খেয়েছে মাত্র একটি! উমতিতি, পিকে, আলবারা আছেন; শেষ ভরসা হিসেবে আছেন মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগেন। লা লিগাতেও তারা দুর্দান্ত। ২৯ ম্যাচে মাত্র ১৩ গোল হজম করেছে স্প্যানিশ জায়ান্টরা। বলাই যায়, গত কয়েক সিজনের মধ্যে টিম বার্সেলোনার অন্যতম সেরা রক্ষণভাগ গড়ে তুলেছেন কোচ ভালভার্দে।

পরিচয় এবং অভ্যস্ততা : ট্রেবল। এক ফুটবল মৌসুমে তিন শিরোপা জেতার নামই হচ্ছে ট্রেবল। বিশ্বের বাঘা বাঘা বহু দলের ট্রেবল নেই। বার্সার আছে। একটি নয়, একাধিক! তারা জিততে জানে। গার্দিওলা জেতালেন, লুইস এনরিকে জেতালেন। তারা দুজন বন্ধু ছিলেন। আর্নেস্তো ভালভার্দেও ওই দুইজনের বন্ধু! তারচেয়ে বড় কথা বার্সার সর্বশেষ ট্রেবলজয়ী দলের অনেকেই আছেন এ দলে। মেসি, ইনিয়েস্তা, পিকে, বুস্কেটস, সুয়ারেজ, রাকিটিচ, সার্জিও রবার্তো, স্টেগেন, আলবাদের দলটা বেশ সমৃদ্ধ। তারও আগে চোখ বুলিয়ে ২০০৯ সালে গার্দিওলার প্রথম ট্রেবলজয়ী দলের কাছে গেলে সেখান থেকেও মিলবে অভিজ্ঞতা। মেসি, ইনিয়েস্তা, পিকে, বুস্কেটস হেক্সাজয়ী সে দলের অন্যতম অগ্রসেনা ছিলেন।

 

না পাওয়ার ঝুঁকি

 

মেসি নির্ভরশীলতা : ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা আর ফুটবল দানব মেসি যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল! তারা একে অপরকে ছাড়া থাকে না, থাকতে পারে না। মেসিবিহীন বার্সা নুনবিহীন পান্তার সমতুল্য। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিওলের সাথে ডার্বি ম্যাচে একাদশে ছিলেন না মেসি। ১ গোলে পিছিয়ে যায় কাতালানরা। সেকেন্ড হাফে মাঠে নামেন জাদুকর। একটি গোল করিয়ে দলকে বাঁচান পরাজয়ের লজ্জা থেকে। শুধু সেদিন নয়, তিনি বরাবরই বার্সার ত্রাতা। দলে সুয়ারেজের মত প্রসিদ্ধ নাম্বার নাইন থাকতে পারেন; আলকাসার, দেম্বেলেদের মত প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরা থাকতে পারেন কিন্তু বেলাশেষে মেসিই এদের নিয়ন্ত্রক। কাতালানদের পক্ষে সবচাইতে বেশি সময় তিনিই কাটান। অজস্রবার শূন্য আশার দুয়ার থেকে সম্ভাবনা ছিনিয়ে দলকে বাঁচিয়েছেন লিও। মেসিও মানুষ। তারও ছন্দপতন ঘটে। তাই, অতিমাত্রায় মেসি নির্ভরতা উল্টো হিতে বিপরীত হতে পারে নীল মেরুণ শিবিরের জন্য।

মিডফিল্ড এবং বেঞ্চ : ২০১৭/১৮ সিজনে কাতালানদের ডিফেন্স যতটা শক্তিশালী ও কার্যকরী ততটাই ভঙ্গুর তাদের মধ্যভাগ! একেবারেই নড়বড়ে যে তা নয়। টিম বার্সার সাথে ঠিক যায় না এমনটা। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা দারুণ ছন্দে আছেন। তার সঙ্গে জাভি থাকার ওই সময়টায় মিডফিল্ড নিয়ে না ভাবলেও চলত। এখন দায়িত্ব নেবার কেউ নেই। ডিফেন্সিভ মিডে বুস্কেটস আছেন। সার্জিও রবার্তো, রাকিটিচরা আছেন। তবে পুরনো ছন্দে নেই। সিজনের শুরুতে সাড়া ফেলা পাওলিনহো, পর্তুগিজ আন্দ্রে গোমেজরা এখনো ঠিক ভরসার মূর্ত প্রতীক হতে পারেননি।

গত দুই মৌসুম রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তাদের বেঞ্চের প্লেয়াররা। হামেস, মোরাতাদের মত তারকারা ছিল মাদ্রিদের বেঞ্চে। বার্সারও আছে। আলকাসার, গোমেজ, ডিগনেরা। এদের সময় দিলে একদিন আস্থার প্রতিদান মিলবে। আপাতত তারা আহামরি নয়, তাই অনায়াসেই বেঞ্চ নিয়ে গর্ব করার জো ভালভার্দের নেই।

কৌতিনহো ফ্যাক্টর : ফিলিপে কৌতিনহো। বার্সেলোনার ব্রাজিলিয়ান সেনসেশন। লিভারপুল কাঁপিয়ে বহু আরাধ্য ট্রান্সফারে বার্সায় যোগ দিয়েছেন। কৌটা ইস্যুতে জানুয়ারির ট্রান্সফার মার্কেট বেশ সরগরম ছিল। তাকে নিয়ে এত হইচই মাতামাতি অহেতুক নয় তা তিনি মাঠে সুযোগ পেয়ে বুঝিয়েছেন। এতে আফসোস বাড়ে কাতালান ভক্তদের। লিগ এবং কোপা দেল রে অনেকখানি নিশ্চিত হলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল এখনো বহুদূর। কিয়েভের ফাইনালে মাঠে নামতে পাড়ি দিতে হবে কোয়ার্টার, সেমির বাঁধা। তপ্ত সে পথে কৌটার সার্ভিসটা কাজে দিতে পারত বার্সার, কৌটা যে খেলতেই পারছেন না। নক আউট স্টেজে ভুল চলে না। ট্রেবলের সম্ভাবনায় দাঁড়ানো বার্সার তো আরো নেই। পা হড়কালেই ট্রেবলের স্বপ্ন অন্তত এক মৌসুম বাক্সবন্দি হয়ে যাবে!

ইউসিএল শেষ আট, অতঃপর : গত দুই মৌসুম বার্সেলোনার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল কোয়ার্টার ফাইনালেই। ২০১৫/১৬ তে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, ২০১৬/১৭ তে জুভেন্তাস মেসিদের বিদায় ঘন্টা বাজায়। এবার প্রতিপক্ষ তুলনামূলক সহজ। ইতালির দল এএস রোমার বাঁধা উৎরাতে বার্সাকে তেমন খাটতে নাও হতে পারে। মঞ্চটা সেরাদের সেরা হবার বলেই কি না কেউ ছোট নয়। একটি ভাল মূহুর্তই পারে রোমকে উল্লাসের নগরী বানাতে। রোমাকে হারিয়ে সেমিতে উঠলে কাঁটার পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবে না। শিরোপার দাবি নিয়ে সেরা দলগুলিই অপেক্ষায় রবে ওখানেও।

অতি আত্মবিশ্বাস : অতিরিক্ত কোন জিনিসই ভাল নয়। আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকাটা যেমন সমীচীন নয়, তেমনি এর উড্ডয়নে পতিত হবার ঝুঁকিও প্রবল। চলতি সিজনে বার্সা একপ্রকার উড়ছে বলা যায়। লিগে ২৯ ম্যাচেও নেই কোন পরাজয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আটে ওঠা পর্যন্তও তাই। গ্রুপ পর্বে অপরাজিত, রাউন্ড অব সিক্সটিনে চেলসিকে এক লেগে ৩-০ তে হারিয়েছে, অপরটি গোলশূন্য ড্র। সিডিআরের ফাইনালে তারা। সিজনের একেবারে শুরুতে স্প্যানিশ সুপার কাপে চিরশত্রু রিয়াল মাদ্রিদের কাছে পরাজয়ের পর তারা আর পিছু ফেরেনি! কে জানে, কোপার ফাইনালে ভুলতে বসা হারের বিস্বাদ সেভিয়া দেয় কি না! তার আগে আসছ সপ্তাহে রোমায় নাকি কেটে যায় পা, বলা মুশকিল।