বাংলাদেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজটিতে খেলতে না পারার কারণে তিনি ছিলেন আক্ষেপের নাম। আর চলতি মাসটি তিনি শেষ করেছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশ দলের সাধের ‘ময়না’ সাকিব আল হাসান।
নিহাদাস ট্রফির অলিখিত সেমিফাইনালের শেষ ওভার। আচমকাই হট্টগোল। বাউন্ডারি লাইন থেকে দুই ব্যাটসম্যানকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন সাকিব। হতভম্ভ সবাই! এর পরের ঘটনা সবারই জানা। মজার বিষয় হলো এ বিষয়ে আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে জ্ঞান নসিহত করেছেন সুনীল গাভাস্কার, হরভজন সিং এবং শ্রীলঙ্কার মিডিয়া। বিষয়টিকে ‘মজার’ বলার কারণ ব্যাখ্যা করার আগে বলি, দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের অনেকেই গলা মিলিয়েছেন তাদের সাথে।
এবার আসি নসিহতকারীদের ‘মজার’ কেন বললাম সে বিষয়ে। হরভজন সিং নিজেই এক বিতর্কিত ক্রিকেটার। সতীর্থের গালে প্রকাশ্য ময়দানে সপাটে চড় বসিয়েছিলেন তিনি। রয়েছে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগও। তিনি নসিহত করছেন সভ্য আচরণের! এটাকে কৌতুক বৈ কি বলবেন? সমালোচনাটা আরো মজার, তিনি গোটা বাংলাদেশ দলকেই নিষিদ্ধ করতে বলেছেন কয়েক ম্যাচের জন্য। হরভজন বোধকরি ভারতের খেলা খুব একটা দেখেন না, দেখলে অবশ্যই জানতেন যে সাকিব না বরং অভব্য আচরণের জন্য নিয়ত শিরোনাম হয়ে থাকেন তার দেশেরই দলপতি।
আরেক নসিহতকারী কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার। যিনি আম্পায়ারের দেয়া এলবিডব্লিওয়ের এর সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে সতীর্থসহ মাঠ ত্যাগ করেছিলেন। বয়সের কারণে তিনি হয়তো ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস তো বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয় না। তাই সুনীল গাভাস্কারের মনে রাখা উচিত ছিলো সে ঘটনাটি। যাই হোক ফাও নসিহতে খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই।
এবার আসেন লঙ্কান মিডিয়ায়। এই শ্রীলঙ্কাই রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে দুবার মাঠ ছেড়েছিলো আম্পায়ার মুরালিধরনের বলকে ‘নো’ কল করায়। সেটি ম্যাচের এমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো সময়েও ঘটেনি। আর এবার প্রেমাদাসায় কি হলো? লেগ আম্পায়ারের কল অগ্রাহ্য করলেন মূল আম্পায়ার। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন নজির কয়টা দেখাতে পারবেন? আপনার শেখানো বিদ্যা রপ্ত করে আপনাকেই যদি কেউ ঘায়েল করে সেটি খুব একটা সুখকর লাগার কথা না। লঙ্কানদের হালতও একই রকম। বয়কট নিয়ে সমালোচনা করা আর যে দেশের মিডিয়াই করুক অন্তত লঙ্কান মিডিয়ার শোভা পায় না।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, অর্থাৎ সাকিবের সে আচরণ সহীহ ছিলো কি না সে প্রসঙ্গে। একদম স্পষ্ট করেই বলতে চাই, সেদিন ওই মুহুর্তে সাকিবের মাঠ ছেড়ে চলে আসার আহ্বান ছিলো যৌক্তিক। ম্যাচের ওভারের উত্তেজনার কথা বাদ দিন, এমনিতেও লেগ আম্পায়ারের কল মূল আম্পায়ার অগ্রাহ্য করেছেন; এমন নজির কয়টা আছে? ‘১৫ বিশ্বকাপের আম্পায়ারিং এর সে দৃশ্যের কথা তো আমরা ভুলিনি। সুতরাং, বারবার আম্পায়ারের ‘ভুল’ এর খেসারত আমরা দিব, এটা তো হতে পারে না। যারা বলছেন অন্যভাবেও প্রতিবাদ করা যেত, যেমন ম্যাচ শেষে ম্যাচ রেফারির কাছে লিখিতভাবে জানিয়ে বা অন্য কোনো পন্থায়। এ যুক্তির পুরোটাই হাস্যকর। ম্যাচ শেষ হয়ে যাবার পর নালিশ জানিয়ে কি হতো? ম্যাচের ফল বদলাতো তাতে? দু লাইনের দুঃখ প্রকাশে ফাইনাল খেলা হতো বাংলাদেশের? বরং ওই সময় সাকিবের ওই আহ্বান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে বাঘ এখন গর্জন করতে জানে। সাকিব এর আগে আচরণগত কারণে জরিমানা গুনেছেন, এটা সত্য। কিন্তু সেদিনের ঘটনার সাথে আগের ঘটনাগুলোর যোগসূত্র খোঁজাটাই অযৌক্তিক।
এবার আসা যাক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার যে ঝুঁকি সাকিব নিয়েছেন সেদিকে। কাদের বন্ধু বলছেন? শ্রীলঙ্কাকে? ঐ দিনের ম্যাচ শেষে মারধরের শিকার হয়েছিলেন টাইগার শোয়েব, যিনি পুলিশের সাহায্য চেয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। ম্যাচ শেষে পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চে সাকিব যাবার সময় দুয়ো ধ্বনিতে মাঠ কাপিয়ে ছেড়েছিলেন তাদের দর্শকরা। অথচ, ঘটনার মূল হোতা তাদেরই স্বদেশি দুই আম্পায়ার। এখানেই শেষ না ঘটনা। তিন দেশের সিরিজ। অথচ, ফাইনালের আগেই ভারত-শ্রীলঙ্কার নাম সমেত ছাপা হয়েছে কার পাস। যা দেয়া হয়েছিলো বাংলাদেশ দলের সাথে যাওয়া অফিসিয়ালদেরও। এটা অপমান না? এ ঘটনার পর আজ অব্দি লঙ্কান বোর্ড দুঃখ প্রকাশ করে কোনো বিবৃতি দেয়নি। অথচ, আপনি তাদের দিব্যি বন্ধু দেশ বানিয়ে বসে আছেন, বাহ্!
এখানেই শেষ ভাবছেন? মাঠে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সবচেয়ে বাজে আচরণের শিকার হয় লঙ্কানদের হাতেই। এটা আমার না, স্বয়ং সাকিবের বয়ান। আর স্লেজিংয়ে নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকা পালন করতেন ক্রিকেটের দুই ভদ্রলোক সাঙ্গাকারা এবং জয়াবর্ধনে। জয়াবর্ধনে তো এটুকুতেই থামেননি। এশিয়ান টেষ্ট চ্যাম্পিয়ন্সিপের ম্যাচে; যখন বাংলাদেশ একদমই নতুন একটি দল, তখন মারভান আতাপাত্তুসহ স্বেচ্ছায় ব্যাটিং থেকে অবসর নিয়েছিলেন বাংলাদেশি বোলারদের বল নির্বিষ ঠেকায়! নব্য কোনো অতিথিকে এমন অপমানের নজির ক্রিকেটের ইতিহাসেই আর নেই।
অশোকা ডি সিলভার কথা মনে আছে? সাবেক এই লঙ্কান আম্পায়ার জীবনে যত ভুল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সাথে দিয়েছেন গোটা ক্যারিয়ারেও সমান সংখ্যক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কি না সন্দেহ। তিনি তো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য এক ধরণের আতঙ্কের নামেই পরিণত হয়েছিলেন। কোনো বাংলাদেশি বয়কট করেছিলো তার কোনো সিদ্ধান্তকে?
সাকিব বরং সেদিন দেখিয়ে দিয়েছেন বাঘ এখন গর্জন করতেও জানে। লঙ্কানদের শেখানো বিদ্যা তাদের ওপর প্রয়োগ যে লঙ্কানরা মানতে পারেনি সেটি তো ম্যাচ শেষে লঙ্কান সিনিয়র ক্রিকেটারদের আচরণেই প্রকাশ পেয়েছে। বরং নাজমুল অপুর উদযাপন মক করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছে লঙ্কান ফিল্ডাররাই। সমালোচনা হলে লঙ্কানদের হওয়া উচিত, হওয়া উচিত সেই ‘কথিত’ দেশ প্রেমিকদের, যারা সাকিবের ওই আচরণে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
এখন সময় বদলে গিয়েছে। বাংলাদেশ এখন ভারত-লঙ্কার চোখে চোখ রেখেই কথা বলে। এটা তাদের সহ্য হবার কোনো কারণ যে নেই, তা তো উপরেই স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাই, সাকিবসহ গোটা দলকে নিষিদ্ধ করার মতো দেউলিয়া মন্তব্য করেন হরভজন এর মত ব্যক্তিরা। আর এটাই প্রমাণ করে, সাকিব কতটা সঠিক ছিলেন। আর ক্রিকেটের এমন আচরণে আবারো প্রমাণিত হলো, বন্ধু দেশ বা রাষ্ট্র বলে কিছু নেই, এটা একটা মিথ।