প্রায় ‘পাঁচ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করছে’ বলে হঠাৎই বেশ শোরগোল শুরু হয়েছে যোগাযোগ মাধ্যমে। অবশ্য এ ব্যাপারে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা বেশ ভালোভাবেই জানেন, দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতায় এ অবস্থায় এসেছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ভারতীয়দের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ বা ছয় লাখ হলেও রেমিট্যান্সের আকার বেশ বড়। সেটি ১০.২২৫ বিলিয়ন ডলার (সূত্র : পিউ রিসার্চ সেন্টারের রেমিট্যান্স ফ্লো ওয়ার্ল্ডওয়াইড ২০১৬)। প্রকাশিত রেমিট্যান্স এটা হলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি হওয়াও সম্ভব। কারণ নন-ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার হয়ে থাকতে পারে যেগুলো হিসাবে আসে না। ফলে ভারতের জন্য বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয়ের উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এটিকে নেহাত আবেগী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ খুব বেশি নেই। দেশপ্রেম বা ভারত বিরোধী অজুহাত দিয়ে প্রতিবাদ করে কিছুটা সুখ পাওয়া যাবে হয়তো। কিন্তু আখেরে ফল কিছুই হবে না। বড়জোর তারা অবৈধ থেকে বৈধ হবে আর সরকার কিছু ট্যাক্স পাবে।
অনেকে বলছেন, আমাদের দেশে এত বেকার থাকা সত্ত্বেও এত ভারতীয় কাজ করে! এখানে বোঝার ব্যাপার আছে। আমাদের দেশে যারা বেকার তাদের চাকরি ভারতীয়রা খাচ্ছে না। বুঝতে হবে, রেমিট্যান্স ছাড়াও আমাদের দেশে ভারতীয় বা অন্যান্য এক্সপার্টদের পেছনে কোম্পানিগুলোর আরো খরচ আছে। সাধারণত এসব এক্সপার্টদের থাকা, ক্লাব ফি, সন্তানদের এডুকেশন- এগুলোও কোম্পানিকে বহন করতে হয়। এর মানে, রেমিট্যান্সের অংক বাদেও বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর খরচ আরো, গড়পড়তা হিসাবে বছরে (২০১৬) প্রায় ১৩ বিলিয়ন থেকে ১৫ ডলার। এছাড়া ক্রয় ঋণের (এলসি) মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিভিন্ন টেকনিক্যাল নো-হাউ সার্ভিস কেনার ব্যাপারটিও এর মধ্যে নেই। এটা আমদানি হিসেবেই গণ্য হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখনকার চরম প্রতিযোগিতামূলক বাজারে একটি দেশীয় কোম্পানি কেন দেশে শস্তা শ্রম রেখে বিদেশি লোক নিয়োগ দেবে? কারণ ওই এক্সপার্টদের জায়গায় সমান দক্ষতা সম্পন্ন লোকবল বাংলাদেশে নেই। নেই মানে, নেই-ই। এখন হয়তো ভারতীয়দের আধিপত্য। কিন্তু শ্রীলংকা বা চায়নিজরাও কম নেই বাংলাদেশে।
ওই যে দক্ষতা ও জ্ঞানের সংকট- এর কারণ কী? গত এক যুগে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে প্রসার ঘটেছে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যোগ্য মানবসম্পদ প্রস্তুত করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেদিক দিয়ে বিচার করলে এখনো মান্ধাতা আমলের। গত দুই যুগের পোশাক শিল্পের দ্রুত অগ্রসরতার মধ্যেও আমাদের বলার মতো কোনো ভালো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ভালো প্রকৌশলী বের হয় এক-দুইটা টেক্সটাইল কলেজ ছাড়া। ফলে এতবড় যন্ত্রনির্ভর শিল্প কে চালাবেন? কারখানায় উৎপাদন কে দেখবেন? সরকার বাদ দিলেও বেসরকারি খাতের লোকজনও এদিকে খুব বেশি নজর দিচ্ছে বলে মনে হয় না। এর কারণ হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের শিক্ষা খাত একটি বাণিজ্য ও নৈরাজ্য ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একটা ঘর ভাড়া করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকে শিক্ষককে দিয়ে ব্যাচের পর ব্যাচ বিবিএ, এমবিএ বের করে বেশ লাভবান হতে পারলে কে যায় এত মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকে।
আরেক অভিশাপের নাম অনার্স-মাস্টার্স। মানুষের মাথার মধ্যে, মগজের মধ্যে ঢুকে গেছে তাকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় সাত-আট বছর পড়াশোনা করে দর্শনের যে হাজারো গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন তাদের ভবিষ্যৎ কী? বাংলা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান? শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি, সরকারি চাকরি আর কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সামনে আরো বড় সংকট আসছে। কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন দক্ষতাভিত্তিক পেশার জয়জয়কার। যে যা পারেন তাকে সেটিই বেশ ভালোভাবে পারতে হবে।
গত দশকে বেশকিছু ব্যবসা খাত দক্ষিণ এশিয়ার দিকে শিফট হয়েছে। পোশাক খাত বাদ দিলেও সামনে ইলেকট্রনিকসের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হবে দেশে। প্রসেস শুরু হয়ে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকা-জাপান-চীন হয়ে ওই শিল্প এখন বাংলাদেশ-ভারত-ভিয়েতনাম-পাকিস্তানে আসতে শুরু করেছে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই গাড়ি উৎপাদন শুরু হবে বাংলাদেশেই। সেটি বিদেশি ব্র্যান্ড হোক বা দেশিই হোক। আর বাংলাদেশও এখন খুচরা ব্যবসা থেকে ক্রমেই উৎপাদনমুখী ব্যবসার দিকে মনোযোগী হবে। এছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ কিছু ভারী নির্মাণ শিল্পও আসবে। রয়েছে বিশাল প্রযুক্তি খাত এবং কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। কিন্তু দক্ষ জনবলের জায়গায় আমরা কি প্রস্তুত? দক্ষ জনবল তৈরি হওয়ার কোনো রাস্তা কি আছে? দেখা যায়? বিশ্ববিদ্যালয়য়ের আর্টস আর বিজনেসের লাখো শিক্ষার্থী কি পারবেন ওই দায়িত্ব নিতে? পারবেন না। তারা বেকার থেকেই যাবেন। উদ্যোক্তারা স্বভাবতই বাইরে থেকে লোক আনবেন। ব্যবসা তো আর হাতছাড়া করা যায় না! অটোমেশনের এই যুগে দক্ষ লোকবল না থাকলে ওই সমস্যা থাকবেই।
আমাদের একটা বিশাল সুযোগ ছিল দেশের বাইরে অদক্ষ জনবল রফতানিকারক থেকে ক্রমেই দক্ষ জনবল রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার। আশির দশক থেকে আমরা বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক পাঠাচ্ছি। এখন পর্যন্ত দক্ষ শ্রমিশক্তি রফতানিতে যেতে পারলাম না। পারলে জ্ঞানবিদ্যা ও কারিগরি দক্ষতা আমরা দেশেও ব্যবহার করতে পারতাম। আর বৈদেশিক মুদ্রাও হুমকির সম্মুখীন হতো না। এদিক দিয়ে ভারত, ফিলিপিন্স, শ্রীলংকা ও ভিয়েতনাম অনেক এগিয়েছে। আমরা যে তিমিরে ছিলাম ওই তিমিরেই রয়ে গিয়েছি।
এরপরও আমাদের যেসব মেধাবী দেশের বাইরে বিভিন্ন খাতে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন তারাই চাইলে কিছুটা পারেন ওই জায়গাটায় কাজ করতে। হাজার মাইল দূরে পড়ে থাকা ওইসব মেধাবী কি দেশে আসতে চান? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, চান কিন্তু পারেন না। এখানে সুশাসনের প্রশ্নটা জড়িত। যে ব্যক্তি বিদেশে হ্যান্ডসাম ইনকাম করেন, একটা মোটামুটি সিকিরড লাইফ পার করছেন তিনি দেশে আসবে কেন? টাকা বেশি আয় করতে পারলেও আসবেন না। কারণ এই দেশ গুন্ডারা চালায়। এখানে ট্যাক্স আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোনো সেবা নেই। জানমালের নিরাপত্তা নেই। শিক্ষার বন্দোবস্ত নেই। চিকিৎসার ব্যাপারটি ভয়াবহ। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সব সংস্থা। চোর-বাটপাররা সমাজের মাথা। রাস্তাঘাট-অবকাঠামোর অবস্থা এমন যে, ঢাকার বাইরে গেলে মনে হয় দেশের বাইরে যাওয়া এর চেয়ে সহজ। বিচার নেই, ইনসাফ নেই। এগুলো রাজনৈতিক কোনো কিছু ণয, ফ্যাক্ট। সব সরকারের আমলের অবস্থাই একই রকম ছিল। উন্নতি না হয়ে বরং অবনতির দিকে। ওই একই কারণে শত সংগ্রাম করেও যারা একটু মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন তারাই ওড়াল দিচ্ছেন বিদেশে। এই ওড়াল ঠেকাবেন কে?
তবু আশার আলো কাউকে না কাউকে তো জ্বালতেই হয়। ওই আলো সরকারকেই জ্বালাতে হবে। সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। বেকার তৈরি না করে দক্ষ জনবল তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কারিগরি ও বিশেষায়িত শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন করতে হবে যারা নিজেদের ডিসিপ্লিনে পৃথিবীর যে কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। আর ব্যবসার আকার-প্রসার বাড়ানোর জন্য এখনই দীর্ঘ মেয়াদি ও যথাযথ পরিকল্পনা না নিলে আসন্ন সম্ভাবনাও কাজে লাগানো যাবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো মালয়েশিয়া। ১৯৬৯ সালে নেয়া নিউ ইকনোমিক পলিসি (এনইপি) এবং তারপর ১৯৯৬ সাল থেকে নেয়া প্রতি পাঁচ বছর মেয়াদে ‘প্রথম মালয়েশিয়া পরিকল্পনা ১৯৬৬-৭০’, ‘দ্বিতীয় মালয়েশিয়া পরিকল্পনা ১৯৭১-৭৫’, ‘তৃতীয় মালয়েশিয়া পরিকল্পনা ১৯৭৬-৮০’, ‘চতুর্থ মালয়েশিয়া পরিকল্পনা ১৯৮১-৮৫’, ‘পঞ্চম মালয়েশিয়া পরিকল্পনা ১৯৮৬-৯০’, ‘ষষ্ঠ মালয়েশিয়া পরিকল্পনা ১৯৯১-৯৫’, সপ্তম মালয়েশিয়া পরিকল্পনা১৯৯৬-২০০০’। এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো দেখলে বোঝা যাবে, একটা দক্ষ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন একটা অর্থনীতিকে কী দিতে পারে। মালয়েশিয়ার কথা এই কারণে বলা যে, বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক ধারা এর সঙ্গে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসের মিল পাওয়া যায়। তা না হলে অকারণে একে-ওকে দোষ দিয়ে বেড়াতে হবে আর নিজে না খেয়ে থাকতে হবে, নৌকায় বিদেশ পাড়ি জমাতে হবে, অত্যাচারিত হতে হবে, বিদেশে বেড়াতে গেলে আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার ধমক খেতে হবে।
একটা বিষয় বলে শেষ করতে চাই। শুনতে অত্যন্ত খারাপ শোনালেও, লজ্জা লাগলেও এটা সত্যি, বাংলাদেশের শিক্ষার মান এখন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, এখানে সাধারণ মানের একটি কলেজ থেকে পাস করা একজন সাধারণ আর্টস বা সমাজ বিজ্ঞান, এমনকি বাণিজ্যের গ্র্যাজুয়েটের চেয়ে ড্রাইভিং জানা একজন অশিক্ষিতের ভবিষ্যৎ নিরাপদ। আমাকে গালি দেন দেন। কিন্তু নিজেই চিন্তা করুন, মন থেকে মেনে নিতে পারি বা না পারি, এটা এখন একটা ফ্যাক্ট। এখন চলছে দক্ষতার যুগ, কেরানিগিরির যুগ আমরা বহু আগেই পার হয়ে এসেছি।