যেভাবে ইরানি চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নিল

যেভাবে ইরানি চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নিল

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদ দাবাশির লেখাটি গত ২১ মার্চ প্রকাশ করা হয়। ‘জবান’-এর পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করে দেয়া হলো-

গত ১৬ মার্চ শুক্রবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কিংবদন্তি ইরানি ফিল্মমেকার আমির নাদেরি-র সঙ্গে নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের। তার চলচ্চিত্র নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে সেখানকার ‘মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্ট’।

নাদেরির চলচ্চিত্রের মূল আকর্ষণ স্থির চিত্রায়ণের দুর্নিবার শক্তি যা আপনাকে নাড়া দিতে বাধ্য। প্রদর্শনী শুরু হয় ‘দি রানার’ দিয়ে। এটি ইরানে নাদেরির নির্মিত শেষ ছবি। পরে তিনি আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপে ছবি নির্মাণে মনোযোগ দেন।

অবশ্য আমেরিকা, ইউরোপে এটিই নাদেরির প্রথম প্রদর্শনী নয়। চলচ্চিত্র নিয়ে আমার আগ্রহ আছে এবং খুব ভালোভাবেই খোঁজখবর রাখা হয়। এ কারণেই আমি আমেরিকা, ইউরোপে নাদেরির সাফল্য সম্পর্কে জানি। পরতে পরতে রহস্যময়তার ভাঁজ তার চলচ্চিত্রকে করেছে অনন্য ও অনুকরণীয়।

নাদেরি ও তার বন্ধু আব্বাস কিয়েরোস্তােমি (১৯৪০-২০১৬) বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের জগতে এক ধরনের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাদের হাত ধরে ইরানি চলচ্চিত্র দেশের সীমানা পেরিয়ে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা দখল করেছে।

এটি কীভাবে ঘটলো এবং আমাদের কী বার্তা দেয়?

সমুদ্রসম বাধার বিরুদ্ধে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের লড়াই

নাদেরির চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই চলচ্চিত্র জগতে আমার প্রবেশ ঘটে। দক্ষিণ ইরানের আবাদান শহরে ১৯৪৬ সালে জন্ম নেন নাদেরি। বয়সে তিনি আমার খুব বড় ছিলেন না। এরপরও ১৯৭০ সালে যখন তেহরানে পড়তে যাই তখন চলচ্চিত্র জগতে তিনি খুব প্রশংসিত এবং আলোচিত ছিলেন। ওই সময়টায় তিনি ‘গুডবাই ফ্রেন্ড’ ছবির মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্র নির্মাণের ইনিংস শুরু করেন।

পাহলভি রাজত্বের ওই সময়ে অর্থ, ক্ষমতা, ভোগ-বিলাসের প্রাচুর্য ছিল। মার্কসবাদী কিছু গেরিলা যোদ্ধার উৎপাত ছাড়া আকাশে কোনো বিপ্লবের মেঘ ছিল না। নাদেরি তখন ক্যামেরার পেছনে অদৃশ্য হয়ে যান এবং আমাদের জন্য একটি নতুন জগৎ নির্মাণ করেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, নাদেরির চলচ্চিত্রগুলো ওই সময়ের রাজনীতির সুরে বাধা থাকলেও রাজনীতিতে একেবারে নিমজ্জিত হয়ে যায়নি।

‘গুডবাই ফ্রেন্ড’-এর গল্পটি ছিল এক ভ্যাগাবন্ড চোরকে নিয়ে যে তার পরবর্তী চুরির পরিকল্পনা করছিল। একাকী একজনের অনতিক্রম্য বাধার বিরুদ্ধে নিঃসঙ্গ লড়াই শুধু নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য- এটাই নাদেরির চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি। প্রায় ৫০ বছর পর ২০১৬ সালে ‘মাউন্টেন’ ছবিতেও তিনি একই গল্প বলেছেন।

তার মানে এই নয় যে, তার চলচ্চিত্রের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। ‘হারমোনিকা’ (১৯৭৩) ও ‘তাংসির’ (১৯৭৩) অবশ্যই কয়েক প্রজন্মকে রাজনীতির দীক্ষা দেবে। এরপরও তার অন্য চলচ্চিত্রগুলোর গল্প মোটামুটি একই রকম, ‘পাহাড়সম বাধার বিরুদ্ধে একজনের একাকী লড়াই’।

নাদেরির ওই নিজস্বতার জায়গাটি বৈশ্বিকভাবে সবার নজরে আসে ‘দি রানার’ (১৯৮৪) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। গল্পটি ছিল দক্ষিণ ইরানের একাকী এক বালককে কেন্দ্র করে।

একজন গল্পকথক

নাদেরি ১৯৮০ সালে তার জন্মভূমি ত্যাগ করেছিলেন এবং তখন থেকে নিউ ইয়র্কে বসবাস শুরু করেন। তাই বলে তার চলচ্চিত্র আমেরিকান হয়ে যায়নি, বরং আরো পরিপক্বতা ও মহত্ত্বের দিকে এগিয়েছে। এখন তা অবস্থান করছে একদম চূড়ায়। এটিকে প্রকাশ করার জন্য শক্তিশালী ভাষা এখনো গড়ে ওঠেনি।

নাদেরি ইরানে তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরে আমেরিকা এবং খুব সম্প্রতি তিনি জাপান ও ইটালিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাহলে তাকে কী বলা যায়? একজন ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাকি আমেরিকান, জাপানিজ কিংবা ইতালিয়ান? এ প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ নাদেরি বিশুদ্ধ মেটাফোরের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রকে এক ধরনের ট্রান্সন্যাশনাল রূপ দিয়েছেন। তিনি তার গল্পের প্রতি অতিমাত্রায় সৎ। তিনি শুধুই এক গল্পকথক। নাদেরিই তার রূপক-চলচ্চিত্রের সারাংশ।

নাদেরি একবার আমাকে একটি গল্প বলেছিলেন। ইরানিয়ান সেন্সরশিপের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাদেরির কাছে তার পরবর্তী সিনেমার অনুমোদনের জন্য স্ক্রিপ্ট চান। নাদেরি তখন একটা কাগজ ও কলম নেন এবং একটি সোজা লাইন টানেন। এরপর বলেন, এটাই আমার স্ক্রিপ্ট। একটি বালক লাইনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবে এবং এটিই তার গল্প। এটি ছিল তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ওয়াটার ওয়াইন্ড ডাস্ট’ (১৯৮৯)-এর স্ক্রিপ্ট।

ওই গল্পটি আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দেয় প্রসিদ্ধ স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী জন মিরো-র (১৮৯৩-১৯৮৩) কথা। বার্সেলোনায় একটি প্রদর্শনীতে তার শেষ কাজগুলো দেখছিলাম। সেখানে তার তিনটি চিত্রকর্ম এক সঙ্গে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনটি বড় সাদা ক্যানভাস। ক্যানভাসগুলোর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে শুধু একটি চিকন কালো লাইন আঁকা।

বিশুদ্ধ মেটাফোর

খুব অল্পসংখ্যক নির্মাতাই তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময় দেখা অদ্ভুত গল্পগুলো বিশ্বকে জানাতে পারেন। তাদের জন্মভূমির সঙ্গে মিশে থাকা পুষ্পের সৌরভ একান্ত নিজের প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে অন্যকে জানাতে পারেন। নাদেরি তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষত তার মাস্টারপিস ‘দি রানার’-এর মাধ্যমে তিনি ওই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।

আমাদের মানতে হবে, নাদেরি ইরানি নির্মাতা। কিন্তু তার নির্মাণের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বকে জন্মভূমিতে তিনি নিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে তার জন্মভূমিকে দিয়েছেন বৈশ্বিক স্বীকৃতি। তা তিনি করেছেন একেবারে বিশুদ্ধ ও অসাধারণ মেটাফোর, ভয়ানক নির্জনতা ও একাকিত্বের মানব চরিত্র চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে।