শর্মিলা বসু ইতিহাসের গবেষক হিসেবে সারা দুনিয়ায় পরিচিত। তার বই ‘ডেড রেকনিং : মেমোরিজ অফ দি ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার’ নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বিতর্ক জারি আছে। বইটি এ দেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধই বলা চলে। অনেক গবেষক শর্মিলার বক্তব্যটি প্রশ্নবিদ্ধ বলে তার অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। ওই পরিপ্রেক্ষিতে শর্মিলা বসু গত ২০১১ সালের ৯ মে ‘আলজাজিরা’য় লিখে এসব প্রতিক্রিয়ার জবাব দেন। ‘জবান’-এর পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করে দেয়া হলো-
মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যাওয়া ‘আরব বসন্ত’ সম্পর্কে সব জল্পনা দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধের শিক্ষার কথাই স্মরণ করে দেয়। ওই সময় পাকিস্তানও একটি সামরিক শাসনের অধীন ছিল। ফলে এটিকে সহজেই ‘খলনায়ক’ হিসাবে চিহ্নিত করে বিদ্রোহী পূর্ব প্রদেশে একটি জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে ওঠে যেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চাইছিলেন।
যখন সেখানকার শাসকরা বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয় তখন ভারত সেখানে বাজির ঘোড়ার মতো প্রবেশ করে তাদের উদ্ধার করে। এর মধ্য দিয়ে ‘বখাটে ছেলে’র সঙ্গে যুদ্ধ করা ভদ্র ছেলের বিজয় হয় এবং বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করে। ওই বয়ানটিই গত ৪০ বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। আমিও কলকাতায় ওই বয়ান শুনেই বেড়ে উঠেছি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও এটিই ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল।
বেশ কয়েক বছর আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ঘটনার গভীরতা লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। খেয়াল করেছি, অনেক বাংলাদেশি স্বীকার করেছেন, দুনিয়া তাদের জাতির জন্মের ভয়াবহতার কথা ভুলে গেছে। ওই কষ্টের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণের অভাব দোষের বলেই বলে মনে করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই যুদ্ধের নিখুঁত অধ্যয়ন হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে এটি ছাড়া দুনিয়ার কাছে আসলে ১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল এর স্মরণ করা বা বোঝা অপ্রত্যাশিত।
আমার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ সম্পর্কে বহুল প্রচলিত কিন্তু সামান্য নথিভুক্ত হওয়া তথ্যের যে বিরোধগুলো তা মানবিকভাবে যতটা সম্ভব তুলে আনা, এমনকি ওই যুদ্ধে যারা ধরা পড়েছিল কিন্তু পরিসংখ্যানের মুখোমুখি হয়নি তাদের দিকটিও দেখা। আশা করেছিলাম, ওই বিস্তর তথ্য এই জমিনে মানবিক পরিস্থিতির কীরূপ বিপর্যয় হয়েছিল ওই দ্বন্দ্বের ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে সাহায্য করবে।
আমার গবেষণা ছিল মূলত স্মৃতিনির্ভর। ইংরেজি ও বাংলা- উভয় ভাষায় ওইসব স্মারক ও স্মৃতিচিহ্ন পড়েছিলাম। কিন্তু মাঠে ব্যাপক কাজ শুরু করেছি, বিশেষ ঘটনাগুলোয় উপস্থিত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করেছি এবং তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত ও চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। এসব গভীরভাবে বোঝার জন্য যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষের মানুষের কাছ থেকে স্মৃতিগুলো একাধিক উৎস থেকে শুনতে চেয়েছি যাতে একটি নিরপেক্ষ ও সুসংহত গবেষণাকর্ম আকারে সম্পন্ন হয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে ওই গবেষণার শুরুতে একাত্তর নিয়ে ছোটবেলা থেকে যে গল্পগুলোর মধ্যে বেড়ে উঠেছি এর অন্তর্গত সমস্যাগুলো উপলব্ধি করতে থাকি। ১৯৭১ সাল নিয়ে যে প্রমাণগুলো মাঠ পর্যায় থেকে উঠে এসেছে তা অনেক ‘প্রভাবশালী সত্য’টিতেও সমস্যা আক্রান্ত করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ওই ‘ঘটনাগুলি’কে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে বা মনগড়া, বিকৃত কিংবা অর্থ প্রকাশে সত্য গোপন করা হয়েছে। দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেকেই কোনো চিন্তা ছাড়াই ওইসব অসমর্থিত আলোচনার পুনরাবৃত্তি করেছেন। কেউ কেউ হয়তো জানতেন, জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে মিথনির্ভর ওইসব কাহিনীতে সমস্যা ছিল। তবুও এখন পর্যন্ত জনগণকে ওইসব জানাতে তারা কিছুই করেননি। চিন্তা করেছিলাম, যার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিলাম ওই ১৯৭১ সালের গল্পের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি, তা বলতে গেলে একটি ভিন্ন গল্পই বলতে হবে।
আমার বইয়ের ভিত্তি
আমার বই ‘ডেড রেকনিং : মেমরিজ অফ দি ১৯৭১’ প্রকাশের ক্ষেত্রে কয়েক বছরের মাঠভিত্তিক গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়েছে যা ‘হার্স্ট অ্যান্ড কোং’ ও ‘কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস’ থেকে প্রকাশিত। এতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশের তিক্ততার ফলে ভ্রান্ত যুদ্ধের ওপর দৃষ্টিপাত করেছে যা শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ্য ‘গরম’ যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছিল। তা পরে এক বছরেরও বেশি চলতে থাকে। এটিতে প্রথমবারের মতো যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত সংঘাতের সব পক্ষ থেকে এক ডজন মানুষের স্মৃতি একত্র করা হয়েছে। বর্ণনাটি এমন দাঁড়িয়েছে যা ওই যুদ্ধ সম্পর্কে ‘বিতর্কের অনেক দিক পুনরায় উত্থাপন করবে।’
অনেকেই ডেড রেকনিং না পড়েই ওই সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। বইটির কিছু ব্যাপারের জন্য সেটিকে একটি ‘নিষিদ্ধ কাজ’ হিসেবেই পর্যবেক্ষকদের কাছে গৃহীত হয়। ‘মিথ বিধ্বংসী’ একটি কাজ হিসেবে বইটি জাতীয়তাবাদনির্ভর কিছু কল্পকাহিনী দুর্বল করে দেবে, বিশেষ করে যা কয়েক দশক ধরে নির্ভয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই পার পেয়ে গেছে। বইটি কয়েক পণ্ডিত ও সাংবাদিকের কাছ থেকে উচ্চ প্রশংসা পেয়েছে যারা আগাম পাণ্ডুলিপি পড়েছেন। কিন্তু বইয়ের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ‘সাহসী’ শব্দটি বেশ অশুভ আবেদন তৈরি করেছে। আমাকে কয়েক স্কলাররা ব্যক্তিগতভাবে প্রশংসা করেছেন। অন্যরা আমাকে যুদ্ধ বিমানের মতো প্রস্তুত হতে বলেছেন। এভাবে ‘মিথ বিধ্বংসী’ বইটি কিছুদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গিয়েছিল। এমনকি এক ‘মিথ বিধ্বংসী’ পণ্ডিত পর্যন্ত আমার বই মার্কেট আউট হওয়াতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, বছর ধরে চলা আমার চরম অজনপ্রিয়তা আর নানান আক্রমণ থেকে আমি মুক্তি পেতে যাচ্ছি।
বিশ্লেষক ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ‘নিন্দা’ রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট কাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এখনো আমরা অনেক সময় ‘ভালো বনাম শয়তান’-এর গল্পের প্রলোভনে আকর্ষিত হয়ে সরলীকরণের মধ্যে পড়ি অথবা বিজয়ী ‘ইতিহাস’ চ্যালেঞ্জ করতে ব্যর্থ হই।
তেমনিভাবে তথাকথিত ‘আরব বসন্ত’-এ নিপীড়কদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের গল্পটিও ওই রকমই একটি অভিযোগের শিকার হয়েছিল। ওই ঘটনায় হোসনি মোবারকের পতনে উল্লাসরত বেশ কয়েক পুরুষের যৌন নিপীড়ন ও হত্যা চেষ্টার শিকার হয়েছিলেন সিবিএস-এর বৈদেশিক সংবাদদাতা লারা লোগান। কায়রোর তাহরির স্কয়ারের ওই ঘটনাটি শিরোনাম থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং এখনো ওই ধরনের দ্বন্দ্ব অপ্রকাশ্য থেকে যাচ্ছে যা আসলে তোলা উচিত নয়। কারণ সোজা ভাষায় ‘তাহরির স্কয়ার’ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রেমীদের নিপীড়কের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে সাহস জোগাচ্ছে।
অন্যান্য দেশের মানুষ বলতো, তারা নিজেদের ‘তাহরির স্কয়ার’ তৈরি করতে চান। অথচ লোগান এমন একটি সাহসী বিবরণ তুলে ধরেছিলেন যেখানে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইকারীরাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে বোরখা পরা মিসরীয় নারীরা লোগানের জীবন রক্ষা করেছিলেন। তাকে সৈনিকদের সহায়তায় উদ্ধার করা হয়েছিল। ফলে তার ওই বিবরণ একটি সম্পূর্ণ ‘ভিন্ন তাহরির স্কয়ার’কে আমাদের সামনে হাজির করেছে।
এটি আমাদের সাবধান করে দেয়, একটি নিপীড়িত শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতাকারীরা অহিংসা, গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন হবে এটি ভাবা উচিত নয়। এটি আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জটিলতা ও গৃহযুদ্ধের জটিলতাগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে। এছাড়া যা আমরা কল্পনা করছি বা চাই তা শেষ কথা নয়, বরং প্রমাণের ভিত্তিতে যা ঘটবে সেটিই শেষ কথা।
দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রভাবে তার বিশেষ প্রতীকায়ণের ফলে বছরটি আলাদা হয়ে রয়েছে। ফলে বাঙালিদের কাছে একাত্তর একটি জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ যা সহজ সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এটি সামরিক একনায়কত্ব দ্বারা নিষ্ঠুর নিপীড়ন, যুদ্ধ, উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক। কিন্তু সত্যিই ব্যাপারটি কি এত সহজ ছিল? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী পক্ষ থেকে পাকিস্তানি খলনায়ক ও বাংলার ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় অযৌক্তিক পুনরাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতের ক্রীড়নকের ভূমিকায় রেখে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী অংশটিরও নিজস্ব কণ্ঠস্বর ছিল। ভারতে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের জন্য একটি স্বদেশ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। সেখানে শুরু থেকেই সমস্যা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মুসলমানদের একটি বড় অংশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী ভারতে থাকতে চেয়েছিল এবং এর দুটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান একটি প্রতিকূল অবস্থানে ছিল যেখানে তারা শত্রু ভারত দ্বারা আলাদা হয়ে এক হাজার মাইল দূরে দুই প্রান্তে ছিলেন। ১৯৭১ সাল সৃষ্টির মাত্র ২৩ বছর পরই মুসলিম জাতীয়তাবাদ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ভুলটি ছিল কোথায়? এবং যারা জেনেছিলেন যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের স্মৃতি কি বলে?
যারা দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব জাতীয়তাবাদী মিথটি বিরক্ত না করার প্রত্যয় নিয়েছিলেন তাদের আঘাত করেছে ডেড রেকনিং প্রকাশের দিনটি। ১৯৭১ সালের বিশেষ কাহিনী ভিত্তি করেই এখানকার রাজনীতি, গণমাধ্যম, একাডেমি ও উন্নয়নের ভিত দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালের সব যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলো অবিচলভাবে ওই সংঘাতে পক্ষপাতিত্ব করেছে। যেহেতু বিজয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ও তাদের মিত্র ভারত সেহেতু দুনিয়াজুড়ে এমন সব কাহিনী প্রচার হয়েছে যার কোনো নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হয়নি। তাই বিক্ষিপ্তভাবে ওই বিভাগের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে।
ডেড রেকনিং বই প্রকাশে যারা নিজেদের জন্য হুমকি অনুভব করছিরেন তাদের পক্ষ থেকে অনুমানকৃত প্রতিক্রিয়াই পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমত. বইটি বাজারে আসার আগেই নিন্দা করার একটি প্রচেষ্টা হয়েছে। এমনকি ইন্টারনেটে অযাচিত মন্তব্য ছাড়াও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুৎসা রটেছে। এমন ব্যক্তিদের দ্বারা এসব হয়েছে যারা ওই বইটি পড়েননি বা তাদের ওইসব কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ জ্ঞানই যে শক্তি ওই ভয় তাদের মধ্য ছিল।
মানুষ যখন বইটি পড়বে তখন তারা ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে এর নতুন অনেক ব্যাপার জানবেন। অবশ্য অনেকে বইটি নিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করছেন যাতে অন্যরা বইটি পড়ার আগ্রহ না পান, এমনকি কয়েক ব্যক্তি পড়ার আগেই বইটির প্রশংসা করার চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে। এটিও সমানভাবে অর্থহীন পরিশ্রম। স্পষ্টভাবে বললে বলা যায়, যারা ওই বইটি পড়েননি তাদের কাছে বইটির বিষয়ে বলার কোনো মূল্যও নেই।
দ্বিতীয়ত. বইয়ের বিরোধীতাকারীরা দাবি করেছেন, বইটিতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া অত্যাচার থেকে সেনাবাহিনীর নিষ্কৃত দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শাসক শ্রেণির বাহিনী দ্বারা সংঘটিত অত্যাচারের ওপর ওই বইয়ের বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে সব বিবরণ দেয়া আছে। ফলে সামরিক বাহিনীর নিষ্কৃত দেয়ার অভিযোগ স্পষ্টতই মিথ্যা। প্রশ্ন হলো, কেন তারা এমন কিছু সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেন যা মানুষ বই পড়তে শুরু করলে সহজেই খুঁজে নিতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর যতটা জটিল মনে হতে পারে এর তুলনায় ওই মিথ্যা দাবিটিই আরো জটিল। অবশ্য নিন্দুকরা প্রত্যাশা করতে পারেন, ওই ধরনের দাবি করে মানুষকে বই পড়ার থেকে বিরত রাখতে পারবেন।
এর উত্তরটিও এই বইয়ে দেয়া আছে। বইয়ের মধ্যে ওই বাহিনী সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত তথ্যের সংশোধন দেয়া হয়েছে যেসব তথ্য ব্যবহার করে বছরের পর বছর জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তানিদের ‘খলনায়ক’ বানিয়ে সুখানুভূতি নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের চটে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, ওই গ্রন্থে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নানান অত্যাচারের পাশপাশি বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে অত্যাচারের দিকেও পাঠককে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ফলে ‘জাতীয়তাবাদী’ পক্ষ দ্বারা সংঘটিত অত্যাচারের প্রকৃতি ও পরিমাণ সম্পর্কে অনেক কাহিনী উঠে এসেছে। তাই এটি আবিষ্কারের ফলে ‘খলনায়ক বনাম নির্দোষ’-এর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী মিথ ঘুরে গেছে।
ডেড রেকনিং বই নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, বইটি কেন এমন সব প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে যা অন্য বইগুলোয় সচরাচর দেখা যায় না। এর একটি কারণ হতে পারে, একাত্তর নিয়ে বেশির ভাগ গবেষণাই আমাদের আবেগের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। ওই বইটিই মূলত প্রথম কোনো বই যা মাঠ পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান উঠিয়ে এনেছে এবং সবপক্ষের স্মৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দুই ঐতিহাসিক রিচার্ড সিসোন ও লিও রোজ ওই যুদ্ধের কূটনৈতিক এবং নীতি-নির্ধারণী বিষয়াদি নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিরেন। ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস থেকে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত তাদের বই ‘ওয়ার অ্যান্ড সেসেশন : পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ’-এ ওই যুদ্ধের চলতি বয়ানগুলোয় নানান প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের ওই কাজ পণ্ডিত মহলের চোখে পড়েনি, আপামর জনতা তো দূর কা বাত।
যাহোক, মূলত ডেড রেকনিং বইটি নিয়ে বিশেষ আলাপ ওঠার কারণ বোধহয় স্বয়ং আমি। কারণ আমি বাঙলি ও ভারতের একটি জাতীয়তাবাদী পরিবার থেকেই উঠে এসেছি। যেহেতু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে অন্যান্য হিন্দু বাঙালিরা তাদের সশ্রদ্ধ সমর্থন জানিয়েছিলেন সেহেতু তাদের একাত্তরের বয়ানটিও নিজেদের পক্ষ থেকেই দেয়া। ফলে তাদের বয়ানে বিশ্বাস না রেখে এবং অস্বস্তিকর সত্যগুলোর ক্ষেত্রে নীরবতা বজায় না রেখে যখন আমার তথ্য অনুযায়ী কথা বলতে শুরু করলাম তখন তারা আমাকে ‘বেইমান’ বলা শুরু করলেন। আসলে তারা সব সময় একাত্তরের কিছু রূপকথা পুঁজি করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন।
এটি খেয়াল করা জরুরি, দক্ষিণ এশিয়ায় যে কোনো ঘটনা ঘিরে এক ধরনের মিথ তৈরি করা খুবই সাধারণ লক্ষণ। ডেড রেকনিং লেখার ক্ষেত্রে আমার ‘সাহস, গোঁড়ামিমুক্ত ও নিখুঁত গবেষণা’ আমাকে ‘আগামী দিনের ইতিহাস চর্চায় ভূমিষ্ঠ হওয়া ঝড়’ বলে মনে করেন ভারতের প্রখ্যাত এক সাংবাদিক। তেমনি বাংলাদেশের প্রবীণ এক পণ্ডিত লিখেছিলেন, ‘শর্মিলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা উঠলে এটি প্রদর্শন জরুরি যে, ইতিহাস চর্চায় রাজনৈতিক মূল্যবোধ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।’
দক্ষিণ এশিয়ানরা কোনো অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি হলেই নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। কিন্তু ওই ধারা ডেড রেকনিংয়ের ক্ষেত্রে বজায় রেখে তেমন লাভ হবে না। কারণ ওই বইয়ে যা আছে তা মূলত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস যাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা তাদের ক্ষেত্রে ওই ইতিহাসের মিথ ভাঙা খুব সহজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি, ১৯৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে যে বিতর্ক ডেড রেকনিং তুলে দিয়েছে ওই তর্ক খুব জরুরি ছিল। এছাড়া একটি ভাতৃঘাতী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আধুনিক বিশ্বে মুসলিমদের একমাত্র নিবাস দেশ ভেঙে যাওয়ার সত্যগুলো আরো বেশি আলোচিত হবে এর মধ্য দিয়ে।