গোলবলের মুক্তিযুদ্ধ

গোলবলের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকৃতির নিয়ম মেনে দিন শেষে নামে রাত। রাতঘুমে কত স্বপ্ন অজান্তেই জেগে ওঠে মনের কোণে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। সারা দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম শেষ করে ঘুমের রাজ্যে নিরীহ বাঙালি। অন্যদিকে কশাই টিক্কা কষছেন ঘুমন্ত বাঙালিকে পুড়িয়ে মারার ছক। তখনো ঘরির কাঁটা মধ্যরাতের রেখা ছোঁয়নি, আচমকাই দানব টিক্কার সৃষ্ট দাবানলে বদলে গেল চিরচেনা ঢাকা। চারদিকে মানুষের আহাজারি, পুড়ন্ত লাশের অসহনীয় গন্ধ, সাঁঝবেলাতেও স্বাভাবিক ঢাকা যেন আচমকাই পরিণত হলো নরকে। ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কার পৈশাচিকতার নির্মমতায় স্তব্ধ গোটা বিশ্ব। চারদিকে চিৎকার, চেনামুখ যার সঙ্গে মাত্র সাঁঝবেলাতেও জমিয়ে আড্ডা হয়েছে চোখের সামনে তার মৃতদেহ, বিভীষিকার বাস্তব চিত্র চোখের সামনে রেখে জীবনটা হাতে নিয়ে কোনো রকম প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরারা। বাংলাদেশের ফুটবল নামের গোলক চর্মটার সঙ্গে যদি সামান্য সখ্যও থাকে কারো এ নামটি না চেনার কোনো কারণ নেই।

শুধু প্রতাপ শংকর হাজরাই নন, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেলুচিস্তানের কশাইখ্যাত টিক্কার কর্মতৎপরতার অংশ যা কেড়ে নিয়েছিল বহু নিরস্ত্র-ঘুমন্ত বাঙালির প্রাণ তা থেকে অনেকেই কোনো রকম জীবনটা নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন সেদিন। জীবন তো রক্ষা হলো পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা থেকে। কিন্তু নীড়হারা ওইসব মানুষ যাবে কোথায়? এক রাতের ব্যবধানেই স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক থেকে প্রতাপ শংকর হাজরারা পরিণত হলেন শরণার্থীতে। যে যেভাবে পারলেন পালিয়ে ঠাঁই নিলেন সীমান্তের ওপারে- মুটে-মজুর থেকে সব পেশার মানুষ। বাদ গেলেন না ফুটবলাররাও। শুধু প্রতাপ শংকর হাজরাই নন, অনেক ফুটবলারই আশ্রয় নিলেন বিভিন্ন ক্যাম্পে।

অস্ত্র হাতে আনাড়ি বাঙালিকে বুলেট দিয়ে দমন করা টিক্কা-ইয়াহিয়ার প্রচেষ্টার কড়া জওয়াব দেয়ার জন্য ক্যাম্পগুলোয় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বাঙালিরা। কিন্তু প্রবাসী সরকার শুধু ময়দানি যুদ্ধই নয়, ভিন্ন পথ খুঁজে ফিরছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা বিশ্বাবাসীকে জানান দিয়ে জনমত আদায়ের। এ জন্য কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিবেদিতপ্রাণ কণ্ঠসৈনিকরা। তাদের উদ্দীপনামূলক ওই গানগুলো আজও লোম খাড়া করে দেয় বাঙালির। প্রবাসী সরকার যখন পথ খুঁজছে জনমত আদায়ের তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পন্থা অবলম্বন করলেন সাইদুর রহমান প্যাটেলরা। যুদ্ধকালীন তা এর আগে কেউ করেননি। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। আর এর দায়িত্বরত ব্যক্তিরা দিলেন এক অভিনব প্রস্তাব- বিভিন্ন ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটবলারদের এক করে একটি ফুটবল টিম গঠন করার। আর ওই সমিতির উদ্যোগেই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল যেটি যুদ্ধ ময়দানের বাইরে থেকে সাহায্য করবে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত আদায়ে। বিভিন্ন ক্যাম্পে ছড়িয়ে থাকা ফুটবলারদের এক করে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। এ কাজটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আলী ইমাম, সাইদুর রহমান প্যাটেল ও প্রতাপ শংকর হাজরারা।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আকাশ বাণীতে প্রচারিত এক রেডিও বার্তায় বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থিত সব ক্রীড়াবিদকে হাজির হতে বলা হয় মুজিবনগরে। এতে সাড়া দিয়ে প্রথমে ৪০ জন গিয়ে যোগ দেন উন্মুক্ত বাছাইয়ে। সেখান থেকে প্রাথমিক অবস্থায় প্রথমে ২৫ জনকে এবং পরে আরো পাঁচজনকে নিয়ে গঠন করা হয় ৩০ জনের একটি দল। কিন্তু দলটি শেষ পর্যন্ত আর ৩০ জনের থাকেনি। একদম শেষ দিকে যোগ দিয়ে সংখ্যাটিকে ৩১-এ উত্তীর্ণ করেন তূর্য হাজরা। আগে-পরে নামটি কোথাও শুনেছেন? যদি না শোনেন তাহলে জেনে রাখুন ওই তূর্য হাজরাই আজকের কাজী সালাউদ্দিন। ৩৪ জন খেলোয়াড় এবং কোচ ও ম্যানেজারসহ মোট সদস্য দাঁড়ায় ৩৬ জনে। কশাই টিক্কার কর্মফলে বাংলার সবুজ জমিনকে লালে রঞ্জিত হতে দেখে কিশোর সালাউদ্দিন নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারেননি। সচ্ছল ঘরের সন্তান সালাউদ্দিন প্রবাসে নিশ্চিত জীবনের বদলে টিক্কার বর্বরতার প্রতিশোধ স্পৃহায় হাতে তুলে নেন অস্ত্র। পরে ওই অস্ত্র রেখে যুদ্ধে নামেন পা দিয়ে যে কাজটি তিনি সবচেয়ে ভালো পারতেন। শুধু সালাউদ্দিনই নন, ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বল পায়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন অনেকেই। অনেকে আবার এক-দুই ম্যাচ খেলে ফিরে গিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে।

প্রথম অবস্থায় দল গঠনের জন্য প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন বাংলা ফান্ড থেকে ১৪ হাজার রুপি দেন প্রাথমিক খরচ মেটাতে। ওই টাকাতেই বন্দোবস্ত করা হয় বাসযোগ্য একটি ব্যবস্থার। ঠিকানা গড়া হয় কর্নানী মেনশন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ১৭ নম্বর ফ্ল্যাটে। প্র্যাকটিসের জন্য বাছা হয় লেক সার্কাস ময়দান।

এরপরই এলো ইতিহাস সৃষ্টিকারী ওই অধ্যায়। ২৪ জুলাই স্থির হয় নদিয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে প্রথম নিজ দেশের নামে মাঠে নামবেন বাংলার দামাল ছেলেরা।

২৪ জুলাই : এদিনটিকে বেছে নেয়া হয় নদিয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের ম্যাচের জন্য। ওই খবর চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘জয় বাংলা’র তারকা ফুটবলারদের পোস্টারে ছেয়ে যায় গোটা নদিয়া। লোকমুখে প্রচারের মাধ্যমে সীমান্তের এপারেও চলে আসে ওই খবর। ম্যাচের দিন সীমান্ত পার হয়ে মানুষের ঢল নামে। এর আগের দিন ২৩ জুলাই কোচ ননী বসাকের নেতৃত্বে কলকাতা থেকে নদিয়া এসে পৌঁছায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলাররা। তাদের স্বাগত জানান তৎকালীন নদিয়ার জেলা শাসক দীপক কান্তি ঘোষসহ স্পোর্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের পদস্থ কর্মকর্তারা।

২৪ জুলাই : এটি বাংলাদেশের শুধু ফুটবলই নয়, ক্রীড়া ইতিহাসেরই অন্যতম গৌরব উজ্জ্বল দিন। ম্যাচ শুরুর অনেক আগে থেকেই মাঠে ভিড় করতে থাকে সাধারণ দর্শক। মাঠের একটি অংশ ছেয়ে যায় লাল-সবুজে। নির্ধারিত সময়ে দু’দলই মাঠে উপস্থিত। উপস্থিত ম্যাচ পরিচালনার সথেঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইসহ নদিয়ার জেলা শাসক স্বয়ং। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও খেলা শুরু হয় না। আপাতদৃষ্টিতে এটি শুধুই একটি ফুটবল ম্যাচ হলেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলারদের কাছে ছিল নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়ার মিশন। তাই তারা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণের দাবি জানান ম্যাচ পরিচালনাকারীদের কাছে। এক পর্যায়ে পায়ের বুটও খুলে ফেলার দিকে অগ্রসর হন জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বাধীন ওই নওজোয়ানরা। তখনো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। এ অবস্থায় একটি ‘কাল্পনিক’ দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানো সমর যুদ্ধে বিনা অস্ত্রে লড়াইয়ের মতোই অসম্ভব এক চিন্তা। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত দ্বারস্থ হতে হয় দীপক কান্তি ঘোষ ওরফে ডি কে ঘোষের কাছে। যে দেশটিকে তখনো তার দেশের কেন্দ্রীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি ওই দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে দেয়ার পরিণতি কী হতে পারে এ সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত ছিলেন ওই আমলা। তবে নিজের চাকরির ঝুঁকি নিয়েই তিনি সম্মতি জানালেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলারদের দাবির প্রতি। সৃষ্টি হলো অভূতপূর্ব, অবস্মরণীয় এক দৃশ্যের। কল্পিত এক দেশের পতাকা নিয়ে মাঠে দৌড়াচ্ছেন কিশোর তূর্য থেকে তসলিম উদ্দিন শেখরা। অশ্রু সজল চোখে মাঠ প্রদক্ষিণ করছেন ননী বসাকের শিষ্যরা এবং কান পাতা দায় হয়ে উঠেছে জয় বাংলা ধ্বনিতে। যে যেভাবে পারছেন চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন লাল-সবুজে যে লাল-সবুজ বুলেটের জুজুতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন টিক্কা-ফরমানরা। অবশেষে শুরু হওয়া ম্যাচটি শেষ হয় ২-২ গোলে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পক্ষে প্রথম গোলটি করেন শাজাহান।

সেদিনের ওই সিদ্ধান্তের খেসারত ডি কে ঘোষ দিয়েছিলেন বরখাস্ত হয়ে। অবশ্য পরে ওই আদেশ আর বহাল থাকেনি। কিন্তু নিজের সাধের চাকরি হারানোর আশঙ্কা মাথায় নিয়েও স্বাধীন বাংলার পক্ষে যে অবস্থানটি নিয়েছিলেন এ জন্য চিরকালই বাংলার মানুষের মনে শ্রদ্ধার আসনে আসীন থাকবেন তিনি। খেসারত দিয়েছিল নদিয়া জেলা ফুটবল অ্যাসেসিয়েশনেও। ফলে পরে আর কোনো দলই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সঙ্গে নিজ নামে খেলতে পারেনি। নদিয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে ওই ম্যাচের পর ভারতজুড়ে আরো ১৬টি ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

এর মধ্যে অন্যতম মুম্বাই (বম্বে)-এ হওয়া ম্যাচটি। মহারাষ্ট্রের হয়ে ওই ম্যাচে মাঠে নামেন ভারত ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নওয়াব মনসুর আলি খান পতৌদি। ম্যাচটি নবাব পতৌদি শুধু সাধারণ খেলোয়াড় হিসেবেই খেলেননি, মহারাষ্ট্র দলের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। ম্যাচটি দেখতে মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন রুপালি জগতের অন্যতম উজ্জ্বল তারকা দীলিপ কুমার। উপস্থিত থেকে উপভোগ করেই ক্ষ্যান্ত ছিলেন না তিনি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য গঠিত ফান্ডে অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন এক লাখ রুপি। ওই খেলাগুলোয় ফলাফলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জনমত গঠনে সরকারকে সহায়তা করা এবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ। ভারতজুড়ে খেলা ১৬টি ম্যাচ থেকে সরকারের ফান্ডে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জমা দিয়েছিল পাচ লাখ টাকা। ওই সময়ের বিবেচনায় এর গুরুত্ব অসীম।

আজকের এই ফুটবলের দৈন্যদশা দেখে আমরা নিয়তই হাহাকার করি। অথচ জানিই না যে, ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম গৌরব উজ্জ্বল গল্পের লেখক আমাদের ফুটবলাররাই। যুদ্ধরত দেশের হয়ে জনমত আদায়ের সেটিই প্রথম ঘটনা। অথচ কী নিদারুণ অবহেলায় ইতিহাসের পাতার এক কোণে পড়ে রয়েছে ওই গৌরব উজ্জ্বল কীর্তি যে পাতায় জমেছে ধুলার আস্তর, কালেভদ্রে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে যার স্মরণ কেউ করেন না।

কিছু আক্ষেপ ও প্রশ্ন

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অন্যতম গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়। অথচ ওই অধ্যায়ের নায়করা কি প্রাপ্য সম্মানটুকু কখনো পেয়েছেন? এই যে সেদিনের কিশোর তূর্য হাজরািযিনি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে বল পায়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন, যুবা বয়সের ওই পিন্টু-আইনুল হকরা- তারা কি পেয়েছেন প্রাপ্য স্বীকৃতি, সম্মান? স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য আইনুল হক কবরে শায়িত হয়েছেন রাষ্ট্রিয় মর্যাদা ছাড়াই। বিস্ময় নিয়ে দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু বলেছিলেন, কর্তব্যরত কর্মকর্তা বোধ করি কখনো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের নামই শোনেননি! এও সম্ভব? কত ভুঁইফোড় আজ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় বয়ানে কাত করে দেন সবাইকে। কিন্তু আড়ালে-আবডালে উপেক্ষিত থেকে যান ওই প্রকৃত নায়করা। কেন? নামের শেষে বুদ্ধিজীবী নামক গালভরা উপাধি নেই বলে, নাকি কোনো এনজিওর মোসাহেবি করতে যাননি বলে? কী আশ্চর্য আমাদের চেতনা! স্বীকৃত এক মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই কবরে শায়িত হলেন। অথচ চেতনার সর্বদা উচ্চকিত ওই কণ্ঠস্বরগুলো থাকলো নীরব! যেন কিছুই ঘটেনি। সরব হবেই বা কেন? আইনুল হকের নাম বেচে যে দু’পয়সা কামানোর সুযোগ নেই। তবে ওই আইনুল হক তিনটি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। শুধু আইনুল হকই কেন, অনেকেই নিদারুণ অবহেলায় হয় ধুঁকে মরছেন নতুবা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন আক্ষেপ নিয়ে।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটির সদস্যরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন জাতির জনক বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে। তা আজ ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের একটি। তারা পরিচিতিও পেয়েছিলেন জয় বাংলার সন্তান হিসেবে। নদিয়ার ওই ম্যাচসহ প্রতিটি ম্যাচেই মাঠ প্রকম্পিত হতো জয় বাংলা ধ্বনিতে। অথচ চলতি মাসের ৭ মার্চ ওই ভাষণ উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচিতে এই জয় বাংলা স্লোগানেই শ্লীলতাহানির শিকার হয়ে ক্ষোভ-ঘেন্নায় দেশ ছাড়তে চেয়েছেন এক ভুক্তভোগী অসহায় নারী। বড় জানতে ইচ্ছা হয়, এ কথাটি শোনার পর কেমন লেগেছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই যুবাদের যারা যৌবন-জীবনের মায়া ত্যাগ করে, নিজের দিকে ফিরে না তাকিয়ে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দেয়ার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে? এমন দেশ কী চেয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া পিন্টু? এ জন্যই কি সেদিন পা-কে অস্ত্র বানিয়ে লড়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে? বড় জানতে ইচ্ছা হয়। বাঙালির জন্য ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি অত্যন্ত আবেগের। এটি ছেলেখেলার কোনো স্লোগান নয়। এই স্লোগান যখন এমন জঘন্য কাজে ব্যবহার করা হয় তখন কতটা আঘাত লাগতে পারে সত্যিকার যোদ্ধাদের মনে? বড় জানতে ইচ্ছা করে।

শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ওইসব গর্বিত সদস্যেদের নাম যারা ফুটবলটিকে মুক্তির হাতিয়ার বানিয়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে।

কোচ : ননী বসাক

অধিনায়ক : জাকারিয়া পিন্টু

সহ-অধিনায়ক : প্রতাপ শংকর হাজরা

ম্যানেজার : তানভীর মাজহার তান্না

সদস্য
আলী ইমাম
মোহাম্মদ কায়কোবাদ
অমলেশ সেন
আইনুল হক
শেখ আশরাফ আলী
বিমল কর
শাহজাহান আলম
মনসুর আলী লালু
কাজী সালাউদ্দিন
এনায়াতুর রহমান
কেএন নওরেশুজ্জামান
সুভাষ সাহা
ফজলে হোসাইন খোকন
আবুল হাকিম
তসলিম উদ্দিন শেখ
আমিনুল ইসলাম
আবদুল মমিন জোয়ার্দার
মনিরুজ্জামান পেয়ারা
মো. আবদুস সাত্তার
প্রাণ গোবিন্দ কুণ্ডু
মুজিবর রহমান
মে. জে. (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী
লুৎফর রহমান
অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়
সনজিত কুমার দে
মাহমুদুর রশিদ
সাইদুর রহমান প্যাটেল
দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
মো. মোজাম্মেল হক
বীরেন দাস বীরু
আবদুল খালেক

নিহার কান্তি দাস

আশ্চর্য লাগে, কষ্টও লাগে। মুক্তিযুদ্ধে যাদের নূন্যতম ভূমিকা নেই তারা আজ শেখাচ্ছে চেতনার বুলি। আর যারা জীবন বাজি রেখে ময়দানে লড়াই করে এনে দিয়েছেন গর্বের এই লাল-সবুজ মুক্ত জমিন তারা সোনালি অতীত ক্লাবের কোনো এক কোণে জীবদ্দশাতেই যেন অতীত হয়ে বসে আছেন। হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা সত্যিকারের ওই বীরদের যারা জানান দিয়েছিলেন লাল-সবুজের অস্তিত্ব এবং আমাদের উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ।