সাংবাদিক জেমস এম ডুরসে-র লেখাটি ‘ফেয়ার অবজারভার’-এ প্রকাশ করা হয়। ‘জবান’-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মিনহাজ আমান-
সৌদি আরবকে তার ‘কলঙ্কিত’ চরিত্র থেকে মুক্তি ও মডারেট ইসলামের অদ্ভুত এক অচেনা অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রিন্স মোহাম্মদ এক নতুন রক্ষণশীল সমাজের ইঙ্গিত দিয়েছেন যা আবার তার মতে অতিরিক্ত রক্ষণশীলও নয়। কিন্তু তার ওই সমাজে এখনো ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা নেই, রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো দূর কা বাত। প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ‘সিবিএস নিউজ’-এর ‘সিক্সটি মিনিটস’-এ সাক্ষাৎকারে প্রিন্স মোহাম্মদ তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছেন।
ওই সফর মূলত ছিল আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন-এর অব্যহতির পর সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরো মজবুত করার প্রত্যাশায়। কারণ প্রিন্স মোহাম্মদ ও তার দৃশ্যত আরেকপক্ষ আরব আমিরাতের মোহাম্মদ বিন জায়েদ মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি কাতার অবরোধ প্রশ্নে তাদের কর্তৃত্বের পক্ষে টিলারসন-কে খুব বেশি আগ্রহী হিসেবে পাননি।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা সেখান থেকে ট্রাম্পের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক মাস আগেই ওই সফর আয়োজিত হয়। ফলে ওই চুক্তি ব্যর্থ হলে মধ্যপ্রাচ্য আবার পারমাণবিক অস্ত্রক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ‘সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না। কিন্তু ইরান যদি বানায় তাহলে আমরা তখন আর পিছু হুটবো না’- সিবিএস-কে এর কমই জানান প্রিন্স মোহাম্মদ।
প্রিন্সের ওই সফর তার দেশকে আধুনিক করার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। তবে কোনো অতিরিক্ত রক্ষণশীলতার প্রচারও চাননি যেখানে তিনি আগামী দিনের স্বৈরশাসক হওয়া সত্ত্বেও প্রগতির কথা বলতে চেয়েছেন।
প্রিন্স মোহাম্মদ ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের সাক্ষাতে অস্ত্র বিক্রিসহ দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরো লাভজনক করার দিকে নজর দিয়েছেন। এছাড়া সৌদি আরবের ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আমেরিকার সহায়তাও বৃদ্ধি পেতে পারে। দু’নেতাই বিশ্বাস করছেন, এর মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
অন্যদিকে প্রিন্স মোহাম্মদের সাক্ষাতের তালিকায় ছিলেন ওই দেশের কংগ্রেসের সদস্যবৃন্দ, থিংক ট্যাংক, শিক্ষক সমাজ, তেল আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, হলিউড ও সিলিকন ভ্যালির নানান প্রতিনিধি।
প্রিন্স মোহাম্মদ ও ট্রাম্প প্রশাসন ওই দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে নিজ দেশে প্রদর্শনের ওপর জোর দিয়েছেন। সৌদি রাজপুত্রকে তার দেশকে দেখানো জরুরি যে, তিনি ইয়েমেনে যুদ্ধ করে আন্তর্জাতিক সমালোচনার পরও দেশে তার ক্ষমতা বেড়েছে। এর উপর সেখানে রয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক নানান বাধা। একই সঙ্গে আছে চার দশক ধরে সেখানে চলা অতি রক্ষণশীল সুন্নি ইসলাম।
এটি ইয়েমেনে ব্যাপক মানব ক্ষয়ক্ষতির পর বিপর্যয় দেখে অনেকে মনে করেন, সেখানে সৌদি বিরোধী মানসিকতা যুদ্ধের পরও টিকে থাকবে। কিন্তু সৌদি আরবের এসব নীতি ওই ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেখানে একদিকে যেমন সাহায্য হিসেবে বিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা থাকলেও কিছু সাহায্য তারা পেয়েছেন, অনদিকে তেমন উল্টো দশ হাজার ইয়েমেনি নাগরিককে সৌদি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত করে তাদের নতুন সংকটে ফেলে দিয়েছে।
প্রিন্স মোহাম্মদের দেখানো উচিত, ২০১৭ সালের নভেম্বরে সৌদি পরিবারের সদস্যসহ বেশ কয়েক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা সত্ত্বেও ওই বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ধরে রাখতে পারছেন। এমনকি গ্রেফতারকৃতদের নানান সময়ে অত্যাচারের কথাও বেশ সাড়া ফেলেছিল ওই সময়ে।
গ্রেফতারকৃতদের বেশির ভাগের কাছ থেকে তাদের সম্পত্তির নানান তথ্য এবং কারো কারো কাছ থেকে অর্থ আদায় করাও হয়েছে। ওই দেশের সরকার এসব দখলদারের কাছ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আদায়ের প্রত্যাশা করে। ওই গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অন্যতম প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালাল যিনি আবার একই সঙ্গে সফল ব্যবসায়ী জানুয়ারিতে মুক্তি পেয়েছেন। এর বদলে প্রিন্স মোহাম্মদের নিজস্ব বেশকিছু প্রকল্পে তাকে অর্থ প্রদান করতে হয়।
প্রিন্স মোহাম্মদ মডারেট ইসলামের এক অপ্রচলিত ধারা সামনে এনে নিজের ইমেজ ধরে রাখছেন। এ জন্য তাকে অতি রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে কাজ করে তার সংস্কার চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। ইরানের শিয়া প্রভাব রুখে দিতে সুন্নিদের যেভাবে টাকা দিয়ে সৌদি আরব এক ধরনের বৈশ্বিক প্রভাব তৈরি করেছিল সেটি থামাতেই এসব করছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রাসেলস-এ সৌদি পরিচালিত মসজিদের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া, নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া ও খেলার মাঠে প্রবেশাধিকার সেটিরই ইঙ্গিত।
ওই প্রকাশ্য পদক্ষেপের পরেও প্রিন্স মোহাম্মদ আসলে কী করতে চান তা অস্পষ্ট। যেমন- নারীদের সব জায়গায় প্রবেশাধিকার থাকলেও আসলে তিনটি স্টেডিয়ামে মাত্র নারীরা প্রবেশ করতে পারছেন।
অবশ্য যখন দেখা গেল প্রিন্স মোহাম্মদের ক্ষমতা ও দখলদারিত্বের ব্যাপারগুলোয় ফাঁক রয়েছে তখন নারী নেতৃত্ব প্রশ্নে তিনি কোনো ধরনের পরিবর্তনের পক্ষে একটি শব্দও বলেননি। ফলে রেস্টুরেন্টসহ নানান জায়গায় লিঙ্গ ভেদাভেদ নিয়ে তার বক্তব্য গরহাজির রইলো। এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অবশ্য বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, সৌদির নারীরা এখনো পূর্ণ অধিকার পাননি। তবে এমন অনেক অধিকার আছে যা ইসলামে থাকা সত্ত্বেও এখানের নারীরা পাচ্ছেন না। যেহেতু আমরা আজ অনেক দূর চলে এসেছি সেহেতু সামনের পথ বেশি লম্বা নয়।’
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ আস’আদ আবু খলিল। তার ব্লগের হলো ‘অ্যাংরি আরব নিউজ সার্ভিস’। এখানে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রিন্স মোহাম্মদের সাক্ষাতের ছবি পোস্ট করা হয়। তাদের কোনো পাশেই কোনো নারীকে রাখা হয়নি।
ইংরেজি সিনেমা দেখার কল্যাণে শেখা ইংরেজির পরও আরবিতে কথা বলা প্রিন্স মোহাম্মদ কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলেছেন এবং ওই অনুযায়ী নারী সাংবাদিকের সঙ্গে বসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চরমপন্থীদের দাবি, নারী-পুরুষের একই কর্মক্ষেত্র বন্ধ করতে হবে। তারা আসলে নারী-পুরুষ কোথাও নির্জনে থাকা এবং একই কর্মক্ষেত্রে থাকার মধ্যে তফাতটা বোঝেন না।’
প্রিন্স মোহাম্মদ বলেন, নারীরা কী পরবেন এ বিষয়ে তাদের স্বাধীনতা আছে। তবে তা যেন শালীন ও সম্মানজনক হয়। কিন্তু তিনি পরিষ্কার করেননি আসলে কোন পোশাক শালীন। তবে সেটি কালো বোরকা নয়- এমনটাই দাবি তার।
এটা নিঃসন্দেহ যে, প্রিন্স মোহাম্মদের ওইসব সামাজিক ধর্মীয় সংস্কার ও প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক পরিবর্তন তার বহুমুখী ব্যবসায় গুণগত পরিবর্তন আনবে। তিনি হোয়াইট হাউসের সমর্থনেও বেশ এগিয়ে যাচ্ছেন। ‘এই সফরে প্রিন্সের আমেরিকার প্রেসিডেন্টের আনুকূল্য পাওয়া সেখানের মার্কিন বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে যা আগেই হওয়া উচিত ছিল’ বলে অভিমত দেন ‘সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর এন্থনি এইচ কর্ডেসম্যান।
এর মানে হিসেবে বলা যায়, কূটনীতি ও ব্যবসায় ওই সফর বেশ দেনদারবের মধ্য দিয়েই আগাবে।