বড় দলকে হারানোর খেসারত দিল আয়ারল্যান্ড

বড় দলকে হারানোর খেসারত দিল আয়ারল্যান্ড

ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইসিসি কি স্বাধীনভাবে কাজ করে নাকি ভারতীয় প্রভাবে পরিচালিত কোনো বাণিজ্যিক সংস্থা? এমন প্রশ্ন করেছেন আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড। এর আগেও নানা সময়ে আইসিসি’র নির্দিষ্ট কিছু দেশের প্রতি পক্ষপাতমূলক অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেয় আইরিশরা। নিজেদের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টাই করে ক্রিকেট বিশ্বের নজরে আসে আয়ারল্যান্ড। এবং সে বিশ্বকাপের পুরো আলোটা নিজেদের দিকে তারা টেনে নেয় পরের ম্যাচে পরাক্রমশালী পাকিস্তানকে বিদায় করে দিয়ে। বিশ্বকাপের অভিষেক আসরেই সুপার এইটে ওঠার আনন্দেই তুষ্ট না থেকে সুপার এইটে বাংলাদেশকেও ৭৪ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে আয়ারল্যান্ড।

প্রথম আসরের সাফল্য যে কোনো চমক ছিলো না তার প্রমাণ তারা রেখেছে পরের বিশ্বকাপেও। ২০১১ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে রেকর্ড ৩২৮ তাড়া করে সবাইকে হতবাক করে দেন পোর্টারফিল্ডরা। একই বিশ্বকাপে দ্বিতীয়বারের মতো তিনশো তাড়া করে আরো স্পষ্ট করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দেয় আইরিশরা। সে ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিলো নেদারল্যান্ডস।

তিনশো তাড়া করে জয় যে আইরিশদের মজ্জাগত সেটির প্রমাণ ক্রিকেট বিশ্ব পায় ২০১৫ এর বিশ্বকাপে। এবার তাদের হাতে হেনস্তার শিকার দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ৩০৪ রান আইরিশরা টপকে যায় চার উইকেট হাতে রেখেই। সে বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়েকেও হেনস্তা হতে হয় আয়ারল্যান্ডের হাতে। বিশ্বকাপে খেলা ২১ ম্যাচে আয়ারল্যান্ড জিতেছে সাতটি ম্যাচে। টাই করেছে একটি। আর জয় পাওয়া সাতটি ম্যাচের পাচটিই এসেছে টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে, যার মধ্যে দুটি দল সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এমন অসাধারণ রেকর্ড এর পরেও আসন্ন বিশ্বকাপ আয়ারল্যান্ড দর্শক হয়েই উপভোগ! করবে।

অন্যদিকে ২০০৭ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই ভারতের বিদায়ে বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় আইসিসি। যার ফলে ‘বড় দল’গুলোর সুরক্ষায় ফরম্যাটেই বদল নিয়ে আসে তারা। আসন্ন বিশ্বকাপে কয়েকটি বড় দল কমপক্ষে একে অপরের বিপক্ষে নয়টি ম্যাচ খেলবে। আইসিসির আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে নেয়া এ প্রকল্পে শুধু আয়ারল্যান্ডই না বাদ পড়েছে ‘৯২ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া জিম্বাবুয়েও। বিশ্বকাপে চমক দেখিয়ে দর্শকদের বিনোদিত করার পুরষ্কার আইসিসি আয়ারল্যান্ডকে দিলো দর্শকে পরিণত! করেই।

বাছাইপর্ব নামক এই প্রক্রিয়াটা যে কতটা প্রহসনমূলক ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি তথ্যেই। বাছাই পর্বে অংশ নেয়া দশটি  দলের মধ্যে মাত্র দুটি দলকে দেয়া হয়েছে চূড়ান্ত পর্ব খেলার অনুমোদন!

আইসিসির প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের পেছনে যে বাণিজ্যিক লাভ খোঁজার প্রবণতা এটা কিন্তু নতুন না। ‘৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেলেও পাচটি টেস্ট দলকে হারানোর পরেও টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে আয়ারল্যান্ডকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। তিক্ত হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পেছনে ক্রিকেটীয় নৈপুণ্যের সাথে লাভজনক বাজারেরও বেশ বড় একটা ভূমিকা ছিলো। অথচ শুধুমাত্র বাজার না থাকার কারণে, অাইরিশদের এই দীর্ঘ অপেক্ষা; আর আরেক চমক কেনিয়া তো ক্রিকেট বিশ্ব থেকে অদৃশ্যই হয়ে যাচ্ছে বলতে গেলে।

বিশ্বের আরেক জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা যেখানে আরো বড় পরিসরে বিশ্বকাপের আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরো বেশি দেশকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য, সেখানে আইসিসি হাটছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে।

অভিযোগের আঙ্গুলটা আবারো ভারতের দিকেই ওঠার কারণ, ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিদায়টাই কাল হয়ে দাড়িয়েছিলো আইসিসির কাঙ্খিত মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে। এই ভারতের প্রতি নতজানু নীতি ক্রিকেটের প্রতি সাধারণ সমর্থকদের করে তুলছে বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ। এমনিতেই আইপিএলের প্রভাবে প্রায় দু’মাস নির্বাসনে থাকবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। এখন, বিশ্বকাপেও ভারতের সুরক্ষা নিশ্চয়তায় যদি সম্ভাবনাময় দেশগুলোকে এভাবে ছুড়ে ফেলা হয় তাহলে তার প্রভার পরবে সুদুর প্রসারী। এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার বদলে ক্রিকেট জগতটাকেই করে ফেলছে সংকুচিত।

আগে অনেকে ঠাট্টাচ্ছলে আইসিসিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল এর বদলে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল বলতো। বাছাই পর্ব নামক প্রহস এর পরে এটি বোধয় এখন সত্যই লাগতে শুরু করেছে পোর্টারফিল্ডদের।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক কেভিন পিটারসেনের একটি টুইটের কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতে মাত্র পাঁচ-ছয়টি দেশই টেস্ট খেলবে। তিনি কথাটা বলেছিলেন টেস্টে ছোট দলগুলোর খারাপ পারফরম্যান্স এর দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু, তার এই বচনটিই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে যেতে পারে ভিন্নভাবে। ভারতীয় নীতিতে চলা আইসিসির ‘খেলা কম মুনাফা বেশি নীতি’ই এক সময় কাল হয়ে দাড়াতে পারে গোটা ক্রিকেটের জন্য। যখন পারফরমেন্সের জন্য নয়, বরং এই একচোখা ধরণের নীতিমালায় বীতশ্রদ্ধ অন্যদলগুলো নিজেরাই সরে দাঁড়াতে পারে ক্রিকেট থেকে।