বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি মাইক্রোসফট এর প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। শোনা যায়, সন্তানদের জন্য এই অর্থ না রেখে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ এ সব সম্পদ দান করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে গেটস দম্পতি বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তি। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন সংকটে এখান থেকে অর্থ প্রদান করেন তারা। ২০১২ সালে বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ১৯০ কোটি ডলার ব্যয় করেন এ দম্পতি।
গত মাসে বিল গেটসের ওয়েবসাইট গেটসনোটস ডটকমে সবার কাছে প্রশ্ন চাওয়া হয়। প্রায় ১ হাজার ৭০০ প্রশ্ন আসে, সেখান থেকে বাছাই করে বিল ও মেলিন্ডা গেটসের দেওয়া ৭টি প্রশ্নের জবাব–
যেসব তরুণরা পৃথিবীতে নতুন ও ভালো কিছু করতে চায় তাদের প্রতি আপনার কি বলার আছে?
বিল গেটস : প্রথমে একটি নির্দিষ্ট কাজের প্রতি মনস্থির করে কাজে নেমে পড়ুন। যেখানে আপনি আপনার সময়, অর্থ, মেধা, শ্রম বিনিয়োগ করবেন। আর যদি আপনি নিঃস্বার্থে মানুষের জন্য কিছু করতে চান তাহলে পৃথিবীতে হাজারো দাতব্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা এসব আইডিয়া বিশ্লেষণ কিংবা কাজে বেশ দক্ষ। সেক্ষেত্রে আমার পছন্দের প্যাট্রিক ডুগানের “চ্যারিটি নেভিগেটর”, আর্থার সিমিদের “গাইড স্টার” সাইটগুলোর সহায়তা নিতে পারেন। যারা আপনার আইডিয়াগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে।
মেলিন্ডা গেটস : পৃথিবীতে প্রতিভা কিংবা সৃষ্টিশীলতা নিয়ে মানুষ জন্মায় না। বরং একটি সমস্যা দেখলে তার তৎক্ষণাৎ সমাধান বের করতে হয়। সাহস, ইচ্ছা, কমিটমেন্ট কিংবা কাজটি করার জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জনই আপনারে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
মন খারাপ হবার মত কোন ঘটনা শুনলে কেমন অনুভুতি হয়?
মেলিন্ডা গেটস : যেসব বাবা-মা বিভিন্ন মহামারী, দুর্ঘটনায় তাদের সন্তান হারিয়েছেন তাদের পাশে বসে ঘটনাগুলো শোনা সত্যিই কষ্টের ব্যাপার। আমি এবং বিল এমন ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। এতে আমরা মানসিকভাবে বেশ আহতও হই। এবং এগুলো থেকে উত্তরণের জন্য আমরা সাধ্য অনুযায়ী কাজও করার চেষ্টা করি।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে আমাদের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলবে বলে আপনারা মনে করেন?
বিল গেটস : প্রতিদিন নিত্য নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব আমাদের জীবনে অবসরের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অত্যাধুনিক ট্রাক্টর, অটোমেটিক ডিশ ওয়াশার, বিভিন্ন প্রকার রোবটের প্রভাব আমাদেরকে প্রতিদিনের কাজকর্ম থেকে অবসরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। যেমন ধরো মানুষগুলো এসব প্রযুক্তির প্রতি ক্রমশ নির্ভর হয়ে প্রতিদিনের কাজকর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্রমশ অলস হয়ে যাচ্ছে।
মেলিন্ডা গেটস : প্রযুক্তি কিংবা গণিত, যাই বলেন না কেনো, এর প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্র। আজকাল ডাক্তারের চিকিৎসা, অপরাধের শাস্তি কিংবা ব্যাংকের ঋণ দেয়ার পদ্ধতি সবকিছুই ক্রমশ গণিত নির্ভর হয়ে পড়ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ‘রেসিজম’ এবং ‘সেক্সিজম’ বিষয়দুটিকে পাশাপাশি রাখলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে সমস্যা দুটি মানব মস্তিষ্কে সমাধান করলে তা কখনোই পুরোপুরি ফেয়ার হয় না। তবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাকে এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে কল্পনা করলে সহজেই বোঝা যায় যে তা অন্তত মানব মস্তিষ্কে সমাধানের চেয়ে অনেকাংশে ফেয়ার ও ইউজফুল হবে।
নবায়নযোগ্য শক্তির কোন বিষয়টা আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রতিযোগী হিসেবে দাড়াতে পারে?
বিল গেটস : জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট কাজে যারা জড়িত বা ইনভেস্ট করছেন তাদেরকে তিনটা বিষয় ধরিয়ে দিতে চাই। প্রথমেই আসবে সৌরশক্তির ব্যাপারটা। সারা বছরে প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টা করে এনার্জি প্রডিউস করা বায়ু কিংবা সৌরশক্তির ক্ষেত্রে সম্ভব না। তাই আমাদের পরবর্তী লিউকুইড ফুয়েল বা তরল জালানির দিকে পা বাড়াতে হচ্ছে। যা কিনা সৌরশক্তি ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মত এক প্রকার হাইড্রোকার্বন তৈরি করে শক্তি সঞ্চয় করছে। আর তৃতীয় বিষটি হচ্ছে জিওথার্ম। যারা এসব খাতে ইনভেস্ট করছেন তারা জিওথার্ম পদ্ধতি থেকেও ভালো কিছু বের করে নিয়ে আসতে পারেন। মোটকথা হচ্ছে প্রত্যেকটি বিষয়েই আমাদের সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ কেউ জানে না কোন বিষয়টা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান বাধা হয়ে দাড়াতে পারে।
সারা পৃথিবীতে নারী অধিকার ব্যাপারটার অগ্রগতি কতটুকু বলে আপনাদের মনে হয়?
মেলিন্ডা গেটস : পৃথিবীতে এখনো বিপুল সংখ্যক নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কিংবা চিকিৎসা যা-ই বলেন সবকিছুতে এখনো নারী অধিকার সমভাবে প্রতিষ্টিত হয়নি। এখনো পর্যাপ্ত নারীশিক্ষার অভাবে সন্তান জন্মদানকালে মারা যাচ্ছে হাজারো নারী। যদিও এমন মৃত্যুর হার ক্রমশ কমছে। আধুনিক বিশ্বে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৎপরতায় হয়তো তা সম্ভব হচ্ছে। আমি আশাবাদী যে, খুব দ্রতই এই সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণ হবে।
মেলিন্ডা গেটসের কাছে প্রশ্ন, আপনাদের “পিভোটাল ভেঞ্চারস” নামক সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? এটি কিভাবে কাজ করছে?
মেলিন্ডা গেটস : গত কয়েক বছরে আমি প্রতিষ্ঠানটির সাথে কাজ করে যা বুঝেছি তা হচ্ছে, নারীরা যদি কোন ভালো কাজের জন্য পর্যাপ্ত উপকরণ, সাহস কিংবা অনুপ্রেরণা পায় তাহলে তারা তাকে সাহায্য করে এবং সমাজে এর প্রভাবটা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তাই আমাদের প্রতিষ্ঠানটি সবার আগে স্বাস্থ্য সচতনতা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোর দিকে বেশি গুরুতে দেয়।
২০১৫ সালে কাজ শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি নারীর ক্ষমতায়ন, তাদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তি শিক্ষাদান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
পৃথিবীতে মানব সভ্যতা আপনার জীবদ্দশায় কোন জিনিসটা অর্জন করবে বলে মনে হয়?
বিল গেটস : সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা। আমি মনে করি, প্রত্যেকটা মানুষ সে কোথায় বসবাস করে, কিংবা তার আয়ের পরিমাণের উপর তার উন্নতি নির্ভর করে না। প্রত্যেকেরই সমান সুযোগ থাকে সেখান থেকে উঠে এসে নতুন কিছু করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার। এটা যে অসম্ভব কিছু না তা পৃথিবীতে এরই মধ্যে অনেকেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। আরেকটা ব্যাপার দেখেন, এক সময় বিপুল সংখ্যক শিশু পাঁচ বছর বয়স পেরোনোর আগেই মারা যেত। ১৯৯০ সালের পর অবশ্য সেটা কমে অর্ধেকে দাড়িয়েছে। আর এখন পৃথিবীতে প্রায় ৮৬ ভাগ শিশু বিনামুলে টিকা পাওয়ায় শিশুমৃত্যুর হার আরো কমে যাচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে আমি আশা করি একসময় আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুটাও ইউরোপ, আমেরিকার শিশুদের মত সুস্বাস্থ্যে বেড়ে উঠবে।