কিংবদন্তি ক্রুইফের প্রস্থানের ২ বছর

কিংবদন্তি ক্রুইফের প্রস্থানের ২ বছর

২০০৮ এর সর্বজয়ী বার্সেলোনাকে মনে আছে? জোসেফ গার্দিওলার অধীনে এক মৌসুমে সম্ভাব্য ছয় শিরোপার সবকটি জিতে আলোড়ন ফেলে দেওয়া দলটা তারপর থেকেই লিখে চলেছে নিত্যনতুন গল্প। কি অমানুষিক পারফর্ম করেছিল সেবার। সেই থেকে এখন অব্দি তারা নিজেদের সাফল্যের গ্রাফে বজায় রাখছে দারুণ ব্যালেন্স। গার্দিওলাকেই তবে নব্য বার্সার রূপকার বলা যায়? জোসেফ বার্সাকে ধারাবাহিতা শিখিয়েছে, ভুরি ভুরি শিরোপা জিততে শিখিয়েছে। ‘তিকিতাকা’ নামক কৌশলকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এতকিছুর পরেও তাকে ঠিক রূপকার বলা যায় না। ইয়োহান ক্রুইফ এর আগেই বার্সার খোলনলচে পাল্টে অন্য ধাতুতে রূপান্তর করে দিয়ে গেছেন।

‘ইফ ইউ আর ফার্স্ট, ইউ আর ফার্স্ট
ইফ ইউ আর সেকেন্ড, ইউ আর নাথিং’

কথাটি ক্রুইফ খুব ভাল করে জানেন। ফুটবলের ইতিহাস ও পরিসংখ্যান সংরক্ষণকারী সংস্থা ‘আইএফএফএইচএস’ এর জরিপে গত শতাব্দীর সেরা ফুটবলার হন পেলে। সে তথ্য সকলের জানা। দ্বিতীয় হয়েছিল কে তা জানি? তিনি ইয়োহান ক্রুইফ, ১৯৮৮-৮৯ সিজন থেকে ১৯৯৩-৯৪ পর্যন্ত আমূল বদলে যাওয়া বার্সার ড্রিম ট্রিম এর স্রষ্টা। কি কাকতাল, নিজ পরিবারেও তিনি দ্বিতীয় সন্তান! পেলের কাছে জায়গা হারালেও কাতালানদের হৃদয়ে তিনি গেড়েছেন শ্রদ্ধা, ভালবাসার পোক্ত আসন। তাকে মনে না রাখার জো নেই। কাতালানদের যা কিছু অমর অধ্যায় তার অধিকাংশের সূচনা ক্রুইফ লিখেছেন নিজ হাতে। লা মেসিয়া, যেখান থেকে উঠে এসে বিশ্ব শাসন করছেন মেসি-ইনিয়েস্তারা, সেই খামার বাড়ির ভাবনা প্রথম উঁকি মারে ইয়োহানের মাথায়। বার্সেলোনার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ পাঁচটি। সামনে আরো জিতবে। কিন্তু, প্রথম সবকিছুর আবেদন সবসময় আলাদা। ১৯৯২ সালের তৎকালীন ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ইতালির ক্লাব সাম্পদোরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে বার্সার ঘর চেনে কাপটি। ১২০ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ শেষে হাতের ললিপপ ছুঁড়ে ফেলে করা বুনো উল্লাসে মত্ত ক্রুইফ কেবল কোচ হিসেবেই সফল নন। ১৯৭৩ সালে রেকর্ড ট্রান্সফারে স্পেনে পাড়ি জমানো সাক্ষ্য দেয় তাঁর সামর্থ্যের। খেলোয়াড়-কোচ দুই ভূমিকাতেই চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা সাতজনের ছোট্টো তালিকায় তিনিও আছেন। কোচ ছিলেন নিজ দেশ হল্যান্ডের ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডামের। লীগ জেতাতে না পারলেও দুটো ডাচ কাপ জেতান তাদের।

ইয়োহান ক্রুইফ। বার্সায় যার অবদান সম্পর্কে ক্রীড়া সাংবাদিক গ্রাহাম হান্টার বার্সেলোনাকে নিয়ে লেখা বইয়ে লিখেছেন- ‘যদি বার্সেলোনার সদস্যরা রাতের পর রাত দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানায়, তার বিছানা ঠিক করা থেকে যাবতীয় ফাইফরমাশ খেটে দেয় তাও ক্রুইফের ঋণ শোধ হবে না’! সত্যিই, ৮ বছরের কোচিংয়ে ১১ শিরোপা জিতিয়েছেন, প্রায় দুই যুগ পর ৪ মৌসুমে ১৫ শিরোপায় গুরুকে পেছনে ফেলেছেন ক্রুইফের মিডফিল্ডের প্রাণ গার্দিওলা। দীক্ষা তো নিয়েছেন প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকেই। সাধে কি আর বিশ্লেষকরা বলেন, কাতালানদের ইতিহাস দুই ভাগে বিভক্ত। ক্রুইফ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী যুগ।

ব্যালন ডি’অর, সেরা ফুটবলারের রাজ মুকুট। আয়াক্স এবং বার্সেলোনার ক্রুইফ, দুদলের হয়েই ব্যালন জিতেছেন। ১৯৭১, ‘৭৩, ‘৭৪। মেসি-রোনালদোর পাঁচটি করে থাকতে পারে, প্রথমবার তিন অঙ্ক ছোঁয়ার দুঃসাহস ক্রুইফ দেখিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে হল্যান্ডের কমলা জার্সিতে অভিষিক্ত টোটাল ফুটবলের অন্যতম অংশ ইয়োহান ১৯৭৭ সালে অবসরের আগে দেশের জন্যে খেলেছেন ৪৮ ম্যাচ, গোল সংখ্যা ৩৩। বার্সা নয় কেবল, তিনি ইতিহাসে বেঁচে রবেন আয়াক্স কিংবদন্তি হিসেবেও। ১৯৫৭ সালে আয়াক্সে শুরু যুব ক্যারিয়ার। ১৯৪৭ সালের ২৫শে এপ্রিল আমস্টারডাম শহরেই জন্ম তাঁর, স্টেডিয়ামের দূরত্ব ঘর থেকে মিনিট পাঁচেকের! ১৯৬৩ পর্যন্ত যুবদলে, তারপর ‘৬৪-৭৩ মূলদলে ক্রুইফনামার ফার্স্ট পার্ট লিখেন। ১৯৭৩ এ পাড়ি জমান নীল মেরুনের কাতালান রাজ্যে। ৭৮ এ ক্লাব ছাড়ার পর আমেরিকা, ফের স্পেনের লেভান্তে ঘুরে প্রিয় আয়াক্সে। ১৯৮৪ সালে ক্যারিয়ার শেষ করেন আরেক ডাচ ক্লাব ফেইনুর্দে। ক্রুইফের প্রতি সম্মান জানিয়ে আয়াক্স তাদের ১৯৯৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটি তাঁকে উৎসর্গ করেন।

খেলোয়াড়ি জীবন যেখান থেকে শেষ করেন, কোচ হিসেবে যাত্রার প্রারম্ভ সেখান থেকেই। বার্সায় শেষ দুই বছর ট্রফিলেস থাকায় তাকে বরখাস্ত করে টিম তা সত্ত্বেও কাতালানদের অভিভাবক হিসেবে ছিলেন আমৃত্যু। এক সময় ধূমপান করতেন প্রচুর। ফুসফুসে বাসা বাঁধে ক্যান্সার। লড়ে গেছেন অনেকদিন, শেষ রক্ষা হয়নি। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ ৬৯ বছর বয়সে চলে যান না ফেরার দেশে।

স্কুল জীবনে বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ভাব সম্প্রসারণে পড়েছি ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’। হেনরিক জোহান্স ক্রুইফের ক্ষেত্রে সেটা বাস্তব, কিংবদন্তিদের দৈহিক প্রস্থান ঘটে কেবল।