সত্তরের দশকে ভারতের পাঞ্জাবের ঝড়খান্ড নামের প্রত্যন্ত এক এলাকার বেশ জনপ্রিয় একজন সুফী গায়িকা ছিলেন, নাম স্বর্ণ নুরা। পাকিস্তান থেকে ভারতে দেশান্তরিক পরিবারের ছোট্ট স্বর্ণ নুরার গানের প্রতি অনুরাগ থাকলেও রক্ষণশীল পরিবারে কোন উৎসাহ তিনি পাননি। একুশ বছর বয়সে কাওয়ালী সঙ্গীতসাধক পরিবারের ছেলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে স্বামীর উৎসাহে সঙ্গীত সাধনায় নিজেও নাম লিখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পুরুষপ্রধান কাওয়ালী গায়কসমাজের মাঝেও নিজের গানের জোরে এতটাই খ্যাতি পান যে পুরুষ কাওয়ালি গায়কদের পাশাপাশি তার কন্ঠের কদরও বাড়ে ভক্তসমাজে, লোকে ভালবেসে তার নাম দের ‘বিবি নুরান’। রক্ষণশীল পাঞ্জাবে সেরকম সময়ে আমৃতসর থেকে জালান্ধারে কাওয়ালী সঙ্গীতের আসর করে নাম কুড়ালেও তিনি কি কোনদিন ভেবেছিলেন, তারই দুই নাতনি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের সাথে সাথে তার নামটাও বিশ্বের দরবারে পরিচিত করাবে?
ভারতের ‘এমটিভি সাউন্ড ট্রিপিন’ নামের নতুন মেধা সন্ধানকারী একটি টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খ্যাতি পেয়ে পাঞ্জাবের ঝাড়খান্ড নামের এক শহর থেকে বর্তমানে বিশ্বের দুয়ারে ভারতীয় সুফি সঙ্গীতের অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী দুই বোন, যারা ভক্তদের কাছে ‘নুরান সিস্টার্স’ নামেই পরিচিত, মূলত ক্লাসিকাল ভারতীয় সঙ্গীতের ‘শাম চোউরাসিয়া ঘরানা’য় সঙ্গীতসাধনা চালিয়ে যাওয়া সফল একটি জুটি। সুফি সঙ্গীতের পূজারী এক প্রত্যন্ত অঞ্চলীয় পরিবার থেকে আজ বলিউডসহ এশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোয় দর্শকবহুল কনসার্টে রাজ করে বেড়ানো এই দুই বোনের শূন্য থেকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছুতে পাড়ি দিতে হয়েছে বেশ দীর্ঘ একটা পথ।
এই নুরান বোনদের দাদীই ছিলেন সত্তরে পাঞ্জাবের বিখ্যাত সেই বিবি নুরান। দুই বোনের শৈশবে সুফি গানের প্রভাব এবং আজ সুফি জগতে তাদের অবস্থানের মূলে বিবি নুরানেরই প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে বলতে হবে। দাদী বিবি নুরানের মৃত্যুর পরে পরিবারের ভরণপোষণের পুরো দায়িত্ব তাদের বাবা ওস্তাদ গুলশান মীরের কাঁধে চলে আসে। দুর্ভাগ্যবশত, পরিবারের কারণে সুফি সঙ্গীত শেখানোকে পেশা হিসেবে নিলে নিজের আর এ জগতে এগোনো হয়নি। পরিবারের সকলের মুখের খাবার জোগাতে সেসময় বংশগতভাবে পাওয়া প্রতিভাই সাহায্য করেছিল তাকে। স্থানীয়ভাবে তার কাছে সুফি সঙ্গীত পাঠ গ্রহণ করা বাচ্চাদের মাঝে একদিন নিজ সন্তান, সাত বছরের সুলতানা এবং পাঁচ বছরের জ্যোতির মধ্যকার সুপ্ত প্রতিভা তার নজর কাড়ে। সেদিন তবলা আর হারমোনিয়ামের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে সুরেলা গলায় দাদীর কাছ থেকে শোনা ‘বুলেট শাহ’র একটি কালাম গাইছিল ছোট ছোট দুই বোন। কোন তাল ভুল না করে রীতিমত পেশাদারি ভঙ্গিতে দুইবোনকে গাইতে দেখে অবাকই হন তাদের পিতা। তারপর থেকে দুবোনের প্রতিভা বিকাশে পিতার চলমান প্রচেষ্টা থাকার পরেও তাদের প্রথম সুযোগ হাতে আসে ২০১০ সালে ইকবাল মাহাল নামের একজন কানাডীয় সঙ্গীত পৃষ্ঠপোষকের মাধ্যমে। সেসময়ে পাঞ্জাবের এক সুফি ওস্তাদের ঘরে অনুশীলনপর্ব থেকে বর্তমান সুফি সঙ্গীত জগতে নুরান বোনদের উজ্জ্বল অবস্থানের পেছনে ইকবাল মাহালের অবদান অনেক। তার সাথে পরিচয়ের পরেই পাঞ্জাবের নকোবর অঞ্চলের বাবা মুরাদ শাহ দরগায় সুফিগীত গেয়ে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা পান। সেসময়ে তাদের গাওয়া ‘আল্লাহ হু’ গানটি ইউটিউবে তাৎক্ষণিক ভাবে সফলতা পেলে পুরো ভারতবর্ষে তাদের নাম ছড়িয়ে যায়। এছাড়াও ‘তেরা রাব তো ভী ভাদ কে দিদার’ এবং ‘মেইন কীনু কীনু দিশান’ গান দুটিও চমৎকার জনপ্রিয় হয়।
এরপরে পাঞ্জাবের ঘর ছেড়ে মাত্র ২০ এবং ১৭ বছরের দুই বোন পাড়ি জমান স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে। মুম্বাইয়ের এমটিভি নামক চ্যানেলের ‘এমটিভি সাউন্ড ট্রিপিং’ অনুষ্ঠানে ‘টুং টুং’ এবং পরবর্তীতে ‘কোক স্টুডিও’তে গেয়ে বলিউডের বিখ্যাত সঙ্গীত আয়োজকদের নজর কাড়েন তারা। সেসময়ে তাদের গাওয়া ‘আল্লাহ হু’, ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’, ‘জুগনি’, জাগজিৎ সিং’ এর ‘লং দা লাশকারা’, ‘মিট্টি দা বাউয়াহ’ গানগুলো ভারতের সুফি ঘরানার সঙ্গীতের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছিল।
ইন্টারনেট এবং টিভি জগতের প্রমুখ জনপ্রিয়তা তাদের বলিউডে নিয়ে আসে। ইমতিয়াজ আলীর ‘হাইওয়ে’ সিনেমায় এ আর রহমানের সঙ্গীতায়োজনে ২০১৪ সালে বলিউডে অভিষেক ঘটে নুরান সিস্টার্সের। সফলতা এবং জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অস্কার জেতা এ আর রহমানের সুদৃষ্টি কাড়েন সুলতানা এবং জ্যোতি। ‘কোক স্টুডিও’র জনপ্রিয়তার ধারা এখানেও অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে ‘সিং ইজ ব্লিং’, ‘দাম লাগাকে হাইসা’, ‘তানু ওয়েডস মানু:রিটার্নস’, ‘পাইয়াম পুলি’; ২০১৬ সালে ‘সুলতান’, ‘মির্জা’, ‘দাঙ্গাল’; ২০১৭ সালে আবারো এ আর রহমানের আয়োজনে ‘হ্যারি মেট সাজাল’ ছবিতে গান দুজনে। এ বছর ‘কারিব কারিব সিংগেল’, ‘বোগান’, ‘টাইগার জিন্দা হ্যা’ তে গান গান তারা।
বলিউডে নিজেদের স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি দেশে এবং বিদেশে নিয়মিত কনসার্ট করে যাচ্ছেন দুই বোন। কনসার্ট এবং নিয়মিত সঙ্গীতচর্চায় তাদের সঙ্গীতায়োজনে থাকেন পিতা গুলশান মীর। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় থাকেন তাদের ছোট ভাই।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত দুই বোন বরাবরই নিজেদের পেশাদার জীবনে তাদের পরিবারের সমর্থনের কথা বলে এসেছেন। আর্মি অফিসারের সাথে বিবাববন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সুলতানার শ্বশুরবাড়িতেও সংজ্ঞীতসাধনার রেওয়াজ আছে। ছোট বোন জ্যোতি নুরান ২০১৪ সালে কুনাল পাসিকে বিয়ে করেন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোল্ক ফেস্টে প্রথমবারের মত বাংলাদেশে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুলতানা এবং নুরান। তাদের ‘টুং টুং’, ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ সহ তাদের পাঞ্জাবী কাওয়ালী ভঙ্গিতে গাওয়া সুফি গানগুলো এদেশের শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। দর্শক শ্রোতাদের উচ্ছসিত সাড়া এবং ভালবাসা পাবার পর ২০১৭ এর লোকসঙ্গীত উৎসবেও দ্বিতীয়বারের মত নিজেদের প্রতিভার চিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন তাদের বাংলাদেশি ভক্তদের হৃদয়ে।
পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত এক এলাকা থেকে নিজেদের প্রতিভা, মেধা এবং কঠোর পরিশ্রমের কারণে বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল স্থান করে নেয়া এই দুই বোনকে নিয়ে পাঞ্জাববাসীদের গর্বের শেষ নেই। তাদের নিয়ে পাঞ্জাবের স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্রের শেষ নেই। নিজেদের দাদীর গৌরব বজায় রেখে এখন শুধু পাঞ্জাবেই না, পুরো ভারতবর্ষে সুফি সঙ্গীতে রাজ করছেন নুরান সিস্টার্স। আকাশের ওপার থেকে বিবি নুরান নিশ্চয় আশির্বাদের চাদর মেলে আছেন দুই উজ্জ্বল বোনের উপরে।