বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমধর্মী ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার অমিয়ভূষণ মজুমদার। তিনি শক্তিশালী লেখক হয়েও ততটা জনপ্রিয়তা পাননি বা জনপ্রিয়তার খায়েশ তার ছিল না, এমনকি তার রচনার সন্ধানও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সাহিত্য তার জীবিকা অর্জনের উপায় ছিল না। জীবিকার জন্য ২১ থেকে ৫৮ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করেছেন ভারতীয় ডাক বিভাগের কেরানি পদে। বরখাস্ত হওয়া, জেলে যাওয়া, এমনকি প্রাণনাশের ঝুঁকি নিয়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন ডাকঘর সংঘে। এর পাশাপাশি পরিণত হয়েছেন জাত লেখক হিসেবে। নকশাল আন্দোলন ছিল তার লেখালেখির অন্যতম উৎসাহদাতা। বৃহস্পতিবার এই মহান লেখকের শততম জন্মবার্ষিকী।
অমিয়ভূষণ ১৯১৮ সালের ২২ মার্চ কোচবিহার (তৎকালীন দেশীয় রাজ্য, বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলা)-এ তার মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অনন্তভূষণ মজুমদার ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার পাকশীর জমিদার। অমিয়ভূষণের মা ছিলেন জ্যোতিরিন্দু দেবী। অমিয়ভূষণের বাবার ঠাকুরদা মথুরাপ্রসাদের ছিল একটি নীলকুঠি এবং এর সংলগ্ন ছিল জমিজায়জা। এখানেই বেড়ে ওঠা হয় ওই সাহিত্যিকের।
অমিয়ভূষণের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে পাকশী রেল কলোনির দিনগুলো। ওই শহরের ডাকঘরে অনেক দিন চাকরি করেছেন তিনি। ওই সময় থেকেই সন্ধ্যা হলে কাগজ-কলম নিয়ে বসা তার অভ্যাস। লিখেই যান আর লেখা শেষে কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলেন। একদিন হঠাৎ তার স্ত্রী বললেন, ‘লেখো তো বটে কিন্তু ছাপে না তো কেউ।’ টেবিলে ছিল ‘পূর্বাশা’ পত্রিকা। আগে সেটি কখনো দেখেননি অমিয়ভূষণ। নতুন লেখাটি পরের দিনই পূর্বাশা-য় পাঠিয়ে দিলেন। ১৫ দিনের মধ্যেই তার কাছে এসে পৌঁছালো এক কপি পত্রিকা। এর সঙ্গে মানি অর্ডারে ১৫ টাকা! অর্থাৎ ‘পাবলিশড’। যাহোক, সদ্য প্রকাশিত গল্পটির নাম ছিল ‘প্রমীলার বিয়ে’।১
অমিয়ভূষণ এরপর ধারাবাহিকভাবে লিখে গেছেন ‘পূর্বাশা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ক্রান্তি’, ‘গণবার্তা’সহ নানান পত্রিকায়।
অতঃপর কোচবিহার। দেশভাগের সময়ে ১৯৪৭ সালের অাগস্টের শুরুতে উত্তরবঙ্গের ওই শহরে বদলি হয়ে যান অমিয়ভূষণ। এটি ছিল এক ধরনের ঘরে ফেরা। কারণ তার স্কুল-কলেজ জীবন কেটেছে ওই শহরেই। ১৯২৭ সালে কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ। এখন তা আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজ। এওই কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে স্নাতক পাস করেন। অতঃপর ডাক বিভাগে চাকরি। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় কোচবিহারেই স্থায়ী হওয়া।২
অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রথম প্রকাশিত রচনা একটি নাটক হলো ‘দি গড অন মাউন্ট সিনাই’। এটি ‘মন্দিরা’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল চল্লিশের দশকে। এরপর ১৯৪৫ সালে রচিত গল্প ‘প্রমীলার বিয়ে’। তার প্রথম উপন্যাস ‘গড় শ্রীখণ্ড’। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়েছিল সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা পত্রিকায় ১৩৬০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে। পরে উপন্যাসটি ১৯৫৭ সালে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নয়নতারা’। এটি ১৯৫৩ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে রচিত হয়। তার অন্যান্য আলোচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘দুখিয়ার কুঠি’, ‘নির্বাস’, ‘মধু সাধু খাঁ’, ‘ফ্রাইডে আইল্যান্ড’, ‘রাজনগর’, ‘বিলাস বিনয় বন্দনা’, ‘মহিষকুড়ার উপকথা’, ‘বিবিক্তা’, ‘চাঁদবেনে’, ‘বিশ্ব মিত্তিরের পৃথিবী’, ‘ডোম আন্তনিও’, ‘তাসিলার মেয়র’, ‘নিউ ক্যালকাটা’, ‘মতি ঘোষ পার্ক’, ‘উত্তর পুরুষ’, ‘মাকচক হরিণ’, ‘ট্র্যাজেডির সন্ধানে’, ‘বিন্দনী’, ‘বিপ্লবের মৃত্যু’, ‘উদ্বাস্তু’, ‘সোঁদাল’, ‘বিপ্লবের মৃত্যু’, ‘দি গড অন মাউন্ট সিনাই’ ইত্যাদি।
নামি-দামি পুরস্কার অমিয়ভূষণ মজুমদার খুব একটা পাননি। তাকে প্রথম সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে কোচবিহারের ‘ত্রিবৃত্ত সংস্থা’ ১৯৭৩ সালে। এছাড়া ১৯৮৪ সালে ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ সাহিত্য পুরস্কার’, ১৯৮৬ সালে রাজনগর উপন্যাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বঙ্কিম পুরস্কার’, ১৯৮৬ সালে ‘রাজনগর’ উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার’, ১৯৯৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘শরৎ মেডেল সম্মান’, ২০০০ সালে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা পুরস্কার’, ২০০১ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাম্মানিক ডিলিট ডিগ্রি’ এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মরণোত্তর ‘সাম্মানিক ডিলিট ডিগ্রি’র সম্মানে ভূষিত হন।
অমিয়ভূষণ মজুমদার লেখালেখির পাশাপাশি ছিলেন বড় মাপের পাঠক, চিন্তক ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন ধ্রুপদী সাহিত্য, বর্তমান সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, সাহিত্যের রাজনীতি, সাহিত্যের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসহ নানান বিষয় নিয়ে।
সমাজতন্ত্র যখন সাহিত্যের ক্ষেত্রে আসে তখন অন্য যে কোনো ধর্মের মতোই উদারতা, মানবিকতা প্রভৃতি বাদ দিয়ে শুধু গোঁড়ামি দূত হিসেবে আনে। ফলে সাহিত্য হয় না- ধর্ম প্রচার হয়, গোঁড়ামি প্রতিষ্ঠা হয়, মানুষের সুরে কথা না বলে রাজনীতির সুরে কথা বলা হয়
কোনো লেখকের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি লেখক। তাই অমিয়ভূষণ মজুমদারের কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি কেন লেখেন? তার লেখালেখির উদ্দেশ্য কী বা লেখার আদৌ কোনো উদ্দেশ্য থাকতে হয় কি না? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘যখন প্রথম লেখা শুরু করি এবং এখন যখন লিখছি- এ দুই আমি এক। কিন্তু ওই দুই আমির মধ্যে তফাৎ হলাে এই যে, প্রথম যখন লিখতে শুরু করি তখন লিখেছি স্বীকৃতির জন্য। আজ লিখি আনন্দের জন্য যে আনন্দ আর কোথাও পাই না। অত্যন্ত দামি মদ খেয়ে মাতাল না হলে যে অনুভূতি হতে পারে, কলম হাতে আমার চরিত্রগুলোর মধ্যে যখন চলতে থাকি তখন আমার ওই অনুভূতি হয়। কখনো মনে হয়, মাথায় একটি পদ্ম আছে যা থেকে মধুস্রাব হচ্ছে এবং ওই মধু অ্যালকোহলের চেয়েও তীব্র আনন্দে আমাকে ভরে তোলে।’৩
অমিয়ভূষণদের সময়টি ছিল উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তাল সময়। তখন সমাজতন্ত্রের ছাপ ছিল তৎকালীন সাহিত্য পাড়ায়ও। অমিয়ভূষণও ছিলেন নকশাল আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত। তবুও ‘সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য বলে কোনো সাহিত্য হতে পারে কি না’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য- এ সংজ্ঞাটি একটু গোলমেলে। আমরা কি ক্রিশ্চিয়ান সাহিত্য, ইসলামি সাহিত্য বা হিন্দু সাহিত্যকে সংজ্ঞা হিসেবে ধরে নেবো? তা যদি ধরে না নিই তাহলে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য সংজ্ঞাটিও ব্যবহার করা ঠিক হবে না। কেননা এসব ফর্মুলায় ওই বস্তুই ধরা পড়বে যা এসব ধর্মের গোঁড়ামি ধরে রাখে। সমাজতন্ত্র যখন সাহিত্যের ক্ষেত্রে আসে তখন অন্য যে কোনো ধর্মের মতোই উদারতা, মানবিকতা প্রভৃতি বাদ দিয়ে শুধু গোঁড়ামি দূত হিসেবে আনে। এতে সাহিত্য হয় না- ধর্ম প্রচার হয়, গোঁড়ামি প্রতিষ্ঠা হয়, মানুষের সুরে কথা না বলে রাজনীতির সুরে কথা বলা হয়।’ ৩
অমিয়ভূষণের মনে এক পর্যায়ে সম্ভবত এমন ধারণা জন্মেছিল যে, দলবাজি দিয়ে সাহিত্য হয় না। ফলে যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সাহিত্যে কোনো দলীয় রাজনীতির প্রভাবে আপনি কি বিশ্বাস করেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তা টেকে না। দশ বছর টেকে। যারা করেছে, টেকেনি। সিপিএম, সিপিআই মানিককে নিয়ে এত নাচানাচি করেছে, তা আর উঠতে পারেনি। পেরেছে কি?’৪
মার্কসবাদের ওই উত্তাল সময়ে সব কিছুই মাপা হতো মার্কসবাদের রঙিন ফিতায়। ফলে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সমালোচনা, বিশেষত মার্কসবাদী সমালোচনার মানদণ্ড কী হওয়া উচিত- পলিটিকাল ডগমা, না জীবনবোধ? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ডগমা দিয়ে সাহিত্য বিচার করে অর্ধশিক্ষিত মানুষ। অন্তত মার্কস ও লেনিন তা করেননি। আমার মনে হয়, আধুনিক বা সমকালীন নন্দনতত্ত্ব নিয়ে যেসব বই মস্কো থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ওইসব বইয়ের ব্যাপারে তারা খোঁজও রাখেন না। এটি গালি নয়, দুঃখ। ভালো সমালোচনা, বুদ্ধিমান গুণ গ্রহীতা সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আমি অন্তত জানি, সাহিত্য ও যাবতীয় কারুশিল্প, এমনকি নন্দনতত্ত্বে ধরন, রূপ-রস, প্রকরণ- সবই জীবন থেকে নেয়া। জীবনবোধ কথাটি অর্ধেক বলা কথা। জীবনে প্রবুদ্ধ, উন্নততর বা সুন্দরতর করার বাসনা বোধহয় অনুপ্রেরণার কাজ করে। আগেই বলেছি, স্টেটাস ক্যু থেকে ডায়নামিজম-এর সাহায্যে এগিয়ে যেতে চান সাহিত্যিক। এ জন্য কোনো ধরাবাঁধা সময়ে সমাজের কাছে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন না।’৫
বাংলা সাহিত্যের রাজনীতিতে নিরেট মার্কসবাদী প্রভাবের বাইরেও বিভিন্ন সময় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলন। এসব নিয়েও কথা বলেছেন অমিয়ভূষণ। হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখক বলেছেন, ‘হাংরি আন্দোলন কি একটি আন্দোলন? আরে, লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার তো অ্যাংরি আন্দোলন ছিল। ইংল্যান্ডে হয়েছিল। আমাদের দেশ কি যুদ্ধের ওই ধাক্কা খেয়েছে? দেখেছে, আমার প্রতিবেশী ছাতু হয়ে গেল? দেখেছে, প্রাণ দিলাম যুদ্ধে। অথচ ওই পুরনো ব্যক্তিই বসে আছেন ক্ষমতা আঁকড়ে? তাই এটি অ্যাংরি নয়, নো বডি ইজ অ্যাংরি। হাংরি শব্দটার অর্থ কী? হাংরি ফর সেক্স? আরে ছ্যা ছ্যা, ছ্যা, ছ্যা। শ্লীলতা-আশ্লীলতা আর হাংরিনেস এক জিনিস নয়।’৬
নকশালবাদও তৈরি করেছিল সাহিত্যের আরকটি ধারা। নকশাল নিয়ে অমিয়ভূষণের মন্তব্য, ‘নকশালদের ব্যাপারটি অন্য। তারা অন্যের পাতে খেতে চান না। তারা যেমন ভাঙতে চেয়েছিলেন তেমনি তাদের সাহিত্যের ট্রাডিশনটিই আলাদা। একটি মজার জিনিস কী- তারা পড়ামোনা করেন, ইন্টেলেকচুয়াল চিন্তা করেন। ইন্টেলকচুয়াল চিন্তা কোনদিকে নিয়ে গেছে এ কথা বলছি না।’৬
‘কৃত্তিবাস’ নিয়ে অমিয়ভূষণ বলেছেন, ‘কৃত্তিবাস ওই পুরনো বাঙালি কবির নামই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই কৃত্তিবাস-এর আধুনিক লেখকদের শিল্প ও কাব্যের ঐতিহ্যে বিশ্বাস আছে।’৩
সাহিত্য শেখা বা লেখার জন্য এখনো সাহিত্য আড্ডার প্রচলন রয়েছে। অবশ্য সাহিত্যিক তৈরি করতে এসব আড্ডা কতটুকু ভূমিকা রাখে তা তর্ক সাপেক্ষ। অমিয়ভূষণ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতায় বলেছেন, ‘আমি চিরকাল নিঃসঙ্গ। আর তোমাদের কলকাতার সাহিত্যের আড্ডা সব সময়ে নিন্দা, পরচর্চা নিয়েই চলতো। আমি বলি, নিন্দায় ডেকো না। এতে আমি নেই। আমি যাবো না।’৭
কবিতায় আমাদের দেশ এখনো এলিয়ট যুগে পড়ে আছে। সুনীলের কবিতা আগেও পড়তাম, এখনো পড়ি। তা বাংলা কবিতা তো দু’রকম- শূন্য মাঠে ক্ষুধার্থ মানুষ আর ভিখিরির যৌবন
সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ফর্ম, না কনটেন্ট- কোনদিকটায় বেশি গুরুত্ব দিতে হয় প্রশ্নের জবাবটি একটু কৌতুক করে দিয়েছিলেন অমিয়ভূষণ। বলেছিলেন, ‘রসগোল্লার খোসা, না শাঁস- কোনটি তোমার কাছে প্রিয়?’৮
আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের। অমিয়ভূষণের কাছে বিষয়টি ‘আধুনিকতার একটিই অর্থ’। পুরনো ধ্যান-ধারণায় বন্দি না থাকা। আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক, ইকোনমি, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে নবীন আবিষ্কারের মানসিক শরিক হওয়া। এসব থেকেই সাহিত্যে আধুনিকতা আসে। তাই বলে সংবাদপত্রের গুজব অনুসারে রচনা নয়।’৮
কোনো ভালো লেখক, নাকি ভালো পাঠকও হয়ে থাকেন। তবে অমিয়ভূষণ বাংলার চেয়ে বেশি পড়েছেন বিদেশি সাহিত্য। বাংলায় শীর্ষেন্দু, সুনীল, শ্যামল, সমরেশ, মানিক, বিভূতি, তারাশংকর পড়েছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিম দ্বারা তিনি ছিলেন অধিক প্রভাবিত। তার কাছে সেরা লেখক ব্যাসদেব। কবিতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘কবিতা খুব ভালো লাগে। এত ভালো লাগে যে, তা প্রায় মুখস্থ হয়ে যায়। বড় বড় ইংরেজি কবিতা আমার মুখস্থ।’১২ বাংলা কবিতায় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে শক্তির ব্যাপারে তার মন্তব্য ছিল, ‘বুঝি না। আমি খুব দুঃখিত তার সংবেদন আমার হৃদয়ে এসে পৌঁছায় না। এত বড় এক কবিকে বুঝতে পারি না। ওই অক্ষমতা আমার।’৯
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অমিয়ভূষণ এত বড় লেখক হয়েও কখনো কবিতা লিখেননি। এর কারণ হিসাবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘অনেক ইংরেজি, ইউরোপিয়ান (অনুবাদ), আমেরিকান কবিতা পড়ার পর বুঝতে পারি, বাংলা ভাষাটিকে বাংলা কবিতার ভাষায় পরিণত করে বাংলায় কবিতা একজনই লিখেছেন। আমি কবিতা লিখতে গেলেই তারই অনুকরণ করতে হতো। এর চেয়ে তার কবিতা পড়া ভালো। কলেজে পড়ার সময় ইংরেজিতে কবিতা দু’চারটি লিখেছি। পরে দেখলাম, আমার পক্ষে কীটস হওয়া সম্ভব নয়। তাই ছেড়ে দিলাম। অরু-তরু বা মাইকেলের মতো বৃথা চেষ্টা করিনি’।’১০
লেখকরা কষ্টে থাকেন বা কষ্টই লেখককে লেখকে পরিণত করে- এমন ধারণা বহুল প্রচলিত। বিভূতিভূষণের জীবনে বিষয়টি কেমন ছিল? এর উত্তরে অমিয়ভূষণ বলেছেন, ‘নাহ! ফ্রাস্ট্রেশন অনেক উপকার করেছে আমার। ওই ফ্রাস্টেশন থেকেই এক কোটি ব্রাত্যজনের মুখপাত্র হয়েছি। ওই ফ্রাস্ট্রেশন থেকে পেয়েছি ট্রমা। ট্রমা বোঝেন? ভেতরের ব্যথা। ওই ট্রমা আমাকে দিবাস্বপ্ন তৈরি করতে শিখিয়েছে।’১১
ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, গভীর কোনো অনুভূতি- এসবের প্রতিক্রিয়া আপনার লেখক হওয়ার পেছনে প্রভাব কতটা? এ প্রশ্নের জবাবে অমিয়ভূষণ বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস কী জানেন? মানুষ যে লেখে, শিল্পী যে আঁকেন- এসবের পেছনে ট্রমা আছে। একটি ট্রমা অফ বার্থ। ফ্রয়েড-ট্রয়েড এখানে ফেল করে গেছেন। দিস ট্রমা অফ বার্থ, সাম মে রিমেম্বার, সাম রিকলেক্ট। একটি অসহ্য ব্যথা- একটি সুন্দর জায়গায় ছিলাম। খাবার জোটাতে চেষ্টা করতে হতো না। শরীর পুষ্ট হচ্ছিল অজান্তে। পরম শান্তিতে বেড়ে উঠেছিলাম। কনশাস বাট নট অ্যাক্টিভ- তা থেকে চ্যুত হলাম। দ্যাট ইজ টি গ্রেটেস্ট ট্রমা ইন মাই লাইফ। এটিই আমার থিয়োরি।’৮
লেখকদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নারীর উৎসাহ, অবহেলা, প্রেম। অমিয়ভূষণের কাছে বিষয়টি ছিল- ‘আমার তো মনে হয় নারীরা যদি তাদের ও তাদের সন্তানদের প্রয়োজনে আমাদের না লাগান তাহলে আমরা মারামারি বোমাবাজি করে মরবো, না হয় ভয়ে (মৃত্যুভয় ইনক্লুডেড) সন্ন্যাসী হয়ে যাবো। রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারেও ঠিক বলেছে- ‘কদম্ব প্রথম যখন দেখলে তখনই ভৃত্য বলে চিনলে কেমন করে?’ কিংবা ‘তোমার দিকে চাহিয়া চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নেই।’ কথায় বলে, পুরুষশাসিত সমাজ। ওই সমাজ চলে কার চোখ, ঠোঁট আর পায়ের দিকে চেয়ে? পুরুষের ওপর পুরুষ যত অত্যাচার করেন, নারীর ওপর ততটা করেন না; নারীর ওপর নারী যতটা অত্যাচার করেন, পুরুষ ততটা করেন না। যদি বলি নারীই জীবন তাহলে পুরুষ তার মিন্স টু অ্যান এন্ড?’৮
নারী প্রসঙ্গের সঙ্গে চলে আসে প্রেম প্রসঙ্গ। ‘প্রেম বিষয়ে আপনার ধারণা কী?’ এ প্রশ্নের জবাবে অমিয়ভূষণ বলেন, ‘সাংখ্যকার কপিল বলতেন, এভরিথিং ম্যাটারিয়াল। এমনকি মন- এও মাটির তৈরি। কিন্তু এতে তো কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু যখন কোনো জিনিসে পুরুষ প্রবেশ করে তখন আলো জ্বলে উঠবে। তেমনই প্রেম হলো আলো। সেখানে কোনো দাহ নেই, ঘর্ষণে উৎপন্ন একখণ্ড লাইট।’১২
শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, অশ্লীলতার প্রসঙ্গ বা তর্ক-বিতর্ক সম্ভবত পৃথিবীর সব সাহিত্যেই কমবেশি হয়েছে। লেখক অমিয়ভূষণের মত হচ্ছে, ‘অশ্লীলতা হচ্ছে অশ্রী, কুশ্রী- ইসব। যা আসে না তাকে জোর করে আনা। অভিজ্ঞান শকুন্তলম। এর কোনটি অশ্লীল? মানে যদি বোঝেন তাহলে অশ্লীল নয়। শিবলিঙ্গ কি অশ্লীল? এর চেয়ে অশ্লীল কী ভাবতে পারেন? সামনে গিয়ে বলেন, বাবা বাঁচাও। হে জীবন, হে মরণ। জীবনে তুমি আছ, মরণেও তুমি আছ। তাহলে অশ্লীলতা কাকে বলে? অশ্লীলতা পাঠকের মনে। আমি যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ লেখা লিখতে পারি তাহলে অশ্লীলতা কি থাকে? এই যে আমাদের খাজুরাহোর মন্দির তা কি অশ্লীল? আমরা গিয়ে যাদ দাঁড়াই তাহলে তো অশ্লীল মনে হবে? মহাভারত অত বড় যে, মহাভারত একদিক দিয়ে দেখতে গেলে এর চেয়ে অশ্লীল আর কিছু নেই। এক মেয়েকে পাঁচজন বিয়ে করেছে। রাজা মরে যাচ্ছে অশ্লীলতা করতে করতে। মহাভারতকে কি অশ্লীল বলবে? জীবনের পক্ষে যা ক্ষতিকর তা-ই অশ্লীল। জীবন মানে বেঁচে থাকা।’১৩
প্রবীণ লেখক হিসেবে অমিয়ভূষণের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সাম্প্রতিক কালের লেখাপত্র সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘খুব ভালো নয়। বেশির ভাগই ক্লিশ ধরনের। অবশ্য লেখাপত্র খুবই কম পড়ি। এদিক থেকে দেখলে সুনীল গাঙ্গুলী আট-দশ পাতা পড়েছি। শীর্ষেন্দুর লেখা হয়তো একটি গল্প পড়েছি। কাজেই তাদের সম্পর্কে ভালো-মন্দ বলাটি অনধিকার হয়। …তবে ওই জীবনানন্দ, এলিয়ট লিখেছিলেন। একটি ধারা চলে আসছে। ওই যে মার্কিস্ট ধারা সুভাষদের লেখায়, এখন একই ধারা চলছে। আরেকটা ধারা চলছে- জীবনে কিছু নেই, জীবন পঙ্কিল, ক্লেদাক্ত। আর একটি গ্রস জিনিস আছে। তা হচ্ছে বুদ্ধ দেবের ওই ভিখারি যৌবনের মতো। মানে, তারা যোনি, ভ্রূণ- এসব ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না। … জীবনকে প্রতিষ্ঠা করো কবিতায়- এটিই তো দেখলাম এতক্ষণ। যন্ত্রণা নিশ্চয় থাকবে। ভ্যান গগ-এ যন্ত্রণা নেই? কিন্তু স্ট্রাগল থাকবে। …এখন সবাই নিজেদের কাল ও সময়টিকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন। এখন ভিশনের পার্থক্য না থাকলে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হয় না। এখনকার লেখকরা সব কিছু খুব উপর থেকে দেখেন। লিখছেন খবরের কাগজের মুখ চেয়ে। এতে অবশ্য সত্যিকারের লেখকদেরই ফিল্ড করে দিচ্ছেন তারা।’১৪
বাংলা কবিতা নিয়ে অমিয়ভূষণের মন্তব্য- ‘কবিতায় আমাদের দেশ এখনো এলিয়ট যুগে পড়ে আছে। সুনীলের কবিতা আগেও পড়তাম, এখনো পড়ি। তা বাংলা কবিতা তো দু’রকম- শূন্য মাঠে ক্ষুধার্থ মানুষ আর ভিখিরির যৌবন।’১৫
বাংলা সাহিত্য শক্তিশালী সমালোচক ও সমালোচনা নেয়ার মতো পেশাদারিত্ব লেখক-পাঠক বা প্রতিষ্ঠান- কারো মধ্যেই দেখা যায় না। ‘সাহিত্যে সমালোচকের ভূমিকা কী’ প্রশ্নে অমিয়ভূষণ বলেছিলেন, ‘যে দেশে ভালো সমালোচক নেই ওই দেশে ভালো সাহিত্যও হয় না। ভালো সমালোচক মানে হচ্ছে ফার্স্ট রিডার। তিনি প্রথমে বুঝতে পারলেন তিনিই তো বলছেন- আরে এই দেখো, এই দেখো। সেটি দেখার পর পাঠক চেষ্টা করেন বুঝতে, তার চোখ দিয়ে দেখতে। আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে বেশি অভাব সমালোচকের। কোচবিহারে বিক্রি হতো আগে ‘এক টাকায় দশ রসগোল্লা’। এটি কী? সাহিত্য। ওটা কী? এটিও সাহিত্য। আমাদের দেশে যদি সমালোচক থাকতেন তাহলে মানুষ বুঝতো কোনটি উপন্যাস আর কোনটি উপন্যাস নয়। অধিকাংশ মানুষই জানে না, কোনটি উপন্যাস আর কোনটি নয়। মোটা বাঁধানো একটি বই… কারাগারে বন্দিরা আছে, তারা কী খায়, কী অভাব- সেটিই উপন্যাস।’১৬
অন্তত বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান মানেই লেখককে গাইড দেয়ার প্রবণতা। তাই অমিয়ভূষণের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সংবাদ-সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের পোষমানা লেখকগোষ্ঠীর নাম বিরাট প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে এমন করে বার বার পাঠকের সামনে তুলে ধরে যে, মনে হয় এই সময়ে তারা ছাড়া আর কোনো লেখক নেই। এসব ব্যাপারে আপনার মতামত, মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতির ধব্জাধারী ওইসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শুনতে চাই। জবাবে অমিয়ভূষণ বলেছিলেন, ‘সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে এখনো হয়নি। এ ব্যাপারটি মার্কসবাদীদের কাণ্ড। যেহেতু একটি জাতির সংস্কৃতি লেখকদের কাছে ন্যস্ত থাকে সেহেতু লেখকদের জোরজার করে সংস্কৃতি-বিচ্যুতি করার চেষ্টায় তারা এমন সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। স্বৈরশাসকরা এ ব্যাপারে তাদের পথেই চলে। মার্কসবাদী ও ফ্যাসিবাদী সমাজে লেখকদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। লেখকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে ওইসব প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে এখনো তা হয়ে ওঠেনি। চেষ্টার ত্রুটি নেই। কখনো বলা হয় জনসাধারণের জন্য লিখতে হবে, কখনো জাতীয় স্বার্থে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে। কলকাতার যে প্রতিষ্ঠান তা তো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এটিকে অনায়েসে উপেক্ষা করা চলে। এটি মনে রাখলেই হলো যে, সাহিত্যের বাজার নেই। বাজারে সাহিত্যের মূল্য বিচার হয় না। পুরস্কার ইত্যাদিতেও সাহিত্যের বিচার হয় না।’১৭
সাহিত্যের পাশাপাশি লেখক অমিয়ভূষণ নানান সময়ে ধর্ম প্রসঙ্গেও আলাপচারিতায় যুক্ত হয়েছেন। ধর্মের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘রিলিজিয়ন এত বড় একটা জিনিস, এটিকে বাদ দিয়ে কি মানুষকে বোঝা যায়? যদি বলো, তুমি নাস্তিক, সেটিও একটা রিলিজিয়ন। যদি বলো, আমি মার্কসিস্ট- এটিও রিলিজিয়ন। এ জন্য তুমি প্রাণ দিতে পারো। রিলিজিয়ন বিভিন্ন স্কুলের আছে। কেউ যদি বলেন, ‘আই অ্যাম নট অ্যা পার্ট অফ রিলিজিয়ন তাহলে সেটিও রিলিজিয়ন। রিলিজিয়ন হচ্ছে নির্দিষ্ট বিশ্বাস।’১৬
অমিয়ভূষণ কখনো সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে রাজনীতি নিয়ে ভেবেছেন, কথাও বলেছেন। উপমহাদেশের মানুষ ইসলামে আদৃত হওয়ার ঘটনায় তিনি ইতিহাসের আলোকে এভাবে দেখছেন, ‘আমাদের চোল সম্রাট গিয়ে বিজয়রাজকে বন্দি না করলে বিজয় ধ্বংস হতেন না। এর প্রতিশোধ নিতে বিজয়রাজ সিংহল আক্রমণ করলেন এবং দুটি পাওয়ার নষ্ট হয়ে গেল। ওই আক্রান্ত হওয়ার সময় একমাত্র আরব বণিকরা ছাড়া বিজয়কে কেউ সাহায্য করেননি। চোল সম্রাটের প্রতি ঘৃণা, হেট্রেড অফ দিজ ইনভেডার্স-অ্যাদ্দিন হিন্দু, বৌদ্ধ যাদের ভালোবাসতাম, বুকে রাখতাম, যাদের মনে হতো আইডিয়াল তারা এ রকম? বিজয়ের জাতিসত্তার ওই অভিমান থেকেই এসব দেশে ইসলাম ধর্ম আদৃত হতে শুরু করে। কারণ মানুষের জাতিসত্তায় আঘাত করলে মানুষ ভোলে না। থাউজেন্ডস অফ ইয়ারস তা জেনারেশনস মনে রাখে।’১৮
১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে তার মন্তব্য- ‘দেশভাগ সম্পর্কে আমার ইতিহাস নির্ভর মত এই যে, তা অনিবার্য ছিল।’১৮
সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুই বাংলা এক করার দাবি অনেকবার উঠেছে। অমিয়ভূষণের মতে- তা ‘কখনো হবে না। হওয়ারও নয়। তোমরা অনেক কিছু জানো না। আমরা জানি। দুই বাংলা এক কখনো হওয়ার নয়। আর হলে মুশকিল আছে। সেসব কে সামলাবে?’ ঋত্বিক ঘটক ছিলেন ওই দাবির অন্যতম প্রবক্তা। তার সম্পর্কে অমিয়ভূষণ বলেছেন, ‘খুব বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। বলতে পারেন একমাত্র বাঙালি চলচ্চিত্রকার। তার সঙ্গে তুলনা চলে কেবল রামকিঙ্করের। ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্প’ দেখেছেন? কিন্তু এটিই তার পাগলামি ছিল। দুই বাংলা এক কখনো হবে নাকি? কখনো নয়। বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। তা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না।’১৯
দর্শন ও সাহিত্যের সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে অমিয়ভূষণ বলেছেন, ‘দর্শন দিয়ে যা বলা যায় না, সাহিত্যে তা প্রকাশ করা যায়। তাই অত বড় দার্শনিক ব্যাসদেব মহাভারতের আশ্রয় নিয়েছিলেন।’২০
কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিকরা চাইতেন বাংলা সাহিত্য কলকাতায় বন্দি হয়ে থাক। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অমিয়ভূষণ বললেন, ‘কী সাহিত্য, কী জীবনে- বাংলা মানেই কলকাতা নয়। এ কথা পরিষ্কার করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ম্যাপ খুললেই দেখতে পাবে কলকাতা পশ্চিম বাংলার একটি শহর। পশ্চিম বাংলা কলকাতার অন্তর্গত কোনো পাড়া নয়। কলকাতার লোকসংখ্যা যদি এক কোটিও হয় তাহলে কলকাতার বাইরে আমরা চার কোটি থাকি- আমরাও তো বাঙালি। মজা দেখেন, রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ছেলে। তার লেখায় কলকাতা প্রায় অনুপস্থিত। তিনি যেন কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি জীবন ও মন অন্তত কলকাতায় যতটুকু, কলকাতার বাইরেও এর চেয়ে কম নয়। ওই অদ্ভুত উপায়টিই হচ্ছে মনীষা বা প্রতিভা। কলকাতাটি বাংলার চেয়ে বড় করে দেখা ঠিক হবে না।’২১
পরিশেষে ‘বাংলা সাহিত্যের পাঠক কি কমে যাচ্ছে’ প্রশ্নের জবাবে অমিয়ভূষণ বলেছিলেন, ‘কোনকালে সাহিত্যের পাঠক বেশি ছিল হে? মিডিয়া যা গেলায় তা কি সাহিত্য পদবাচ্য কিছু? আমি একাডেমি, বঙ্কিম- এসব পাওয়ার আগে ক’জন আমার নাম জানতেন? কিন্তু প্রকৃত পাঠক ছিল যারা খুঁটিয়ে আমার লেখা পড়তেন তারা আজ মিডিয়া আমার নাম ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক বাড়াতে পেরেছে কি? কোনোকালেই পাঠক, প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা আহামরি ছিল না। আর তা না হওয়াই মঙ্গল। যারা পড়ার তারা ঠিকই খুঁটে খুঁটে পড়ে ফেলবেন। চর্যাপদ ক’জন পড়েছেন এক সময়?’২২
এবারের শততম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যাশা- অমিয়ভূষণ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন আগামী দিনের লেখক-সাহিত্যিকদের।
সূত্র—
১. আজকাল : ২০ জানুয়ারি ১৯৯৩
২. আনন্দবাজার : ১৮ মার্চ ২০১৮
৩. ক্ষুধার্ত, তৃতীয় সংকলন : অরুণেশ ঘোষ, ১৯৭৫
৪. সাপ্তাহিক ত্রিবৃত্ত : ২৮ জুন ১৯৮৬
৫. মনন ১ : ১ অক্টোবর ১৯৮৬
৬. নবার্ক : নভেম্বর ১৯৮৬
৭. যুগান্তর : ১ জানুয়ারি ১৯৯৫
৮. উত্তরাধিকার ৫ : ১ অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৯৫
৯. সংবাদ প্রতিদিন : ২৬ নভেম্বর ১৯৯৫
১০. কবিতীর্থ : আশ্বিন ১৪০৫
১১. সংবাদ প্রতিদিন : ২৬ নভেম্বর ১৯৯৫
১২. কবিতা পাক্ষিক ১৯২-১৯৩ : ২৭ জানুয়ারি ২০০১
১৩. পূর্বদেশ ১৩ বর্ষ : শারদ সংকলন ১৪০২
১৪. এই সময় : জুলাই ১৯৮১
১৫. আজকাল : ২০ জানুয়ারি ১৯৯৩
১৬. উত্তরাধিকার ৪ : ১ অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৯৪
১৭. বিজ্ঞান পর্ব ১০ : অক্টোবর ১৯৮২
১৮. বোবাযুদ্ধ ৩৬ : জানুয়ারি ১৯৯৪
১৯. যুগান্তর : ১ জানুয়ারি ১৯৯৫
২০. সাহিত্যপত্র নবলিপি ১১ : ৩ মার্চ ১৯৯০
২১. দৈনিক উত্তরবঙ্গ সংবাদ : ২৮ জানুয়ারি ১৯৮৪
২২. কবিতা পাক্ষিক ১৯২-১৯৩ : ২৭ জানুয়ারি ২০০১