দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে চীন-ভারতের নতুন সমীকরণ

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে চীন-ভারতের নতুন সমীকরণ

সারা দুনিয়ায় বাণিজ্যিক পরাশক্তি আকারে চীন তার অবস্থান জানান দিয়েছে ইতোমধ্যে। ওই ধারাবাহিকতায় চীন তার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও প্রভাব বাড়াতে ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়ে আসছে। বৈশ্বিক রাজনীতির বর্তমান সমীকরণ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও চীনের বড় প্রতিবেশী ভারতও এই দক্ষিণ এশিয়ায় আলাদাভাবে প্রভাববলয় জারি রাখতে বেশ তৎপর। চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিটিকে টেক্কা দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিতে ভারত কি কোনো অংশে পিছিয়ে পড়ছে? ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়া এ নিয়ে তথ্য-উপাত্তসহ বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘জবান’-এর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি অনুবাদ করে দেয়া হলো-

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ধারাবাহিক প্রভাব বৃদ্ধি মোদি সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তার সব প্রতিবেশী দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।

যেখানে ভারত তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে নানার সহায়তা দেয়ার নীতি নিয়েছে সেখানে চীন তার পুঁজিবাদী উপায়ে ওই অঞ্চলে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে নিজের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। চীন নিজের স্বার্থ রক্ষা ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই নানান উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

চীন ওই ক্রমবদ্ধমান প্রভাব ঠেকাতে কোনো নতুন কৌশলের আশ্রয় নিতে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। ফলে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে আগে যে আর্থিক সহায়তা দিত তা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এছাড়া যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে ওই অঞ্চলে প্রভাব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভারত সরকার নেপাল ও ভুটানকে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। নেপালে ওই অর্থ সহায়তা ৭৩ শতাংশ বেড়ে এবার ৬৫০ কোটিতে উঠে এসেছে। তা গত বছরে ছিল মাত্র ৩৭৫ কোটি রুপি।

নেপালের চেয়ে ভারতের আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তিতে এগিয়ে ভুটান। ভুটানকে ওই অর্থবছরে প্রায় ১ হাজার ৮১৩ কোটি রুপি সহায়তা দেয়ার কথা রয়েছে। ওই সহায়তার অধীন রয়েছে ৫ বছর মেয়াদী নির্মাণাধীন হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্টসহ নানান পরিকল্পনা।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির ভাষ্য মতে, ‘চীন আমাদের প্রতিবেশী সব দেশে তার অবকাঠামোগত প্রজেক্টগুলোয় তাদের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে চীনের ওই প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পরিবর্তিত নীতি অনুযায়ী নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে।’

অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভুটান ও নেপালে আমাদের বরাদ্দকৃত অর্থ অবশ্যই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করবে এবং আমাদের মধ্যকার পরামর্শ ও সুসম্পর্ক সব স্বার্থ সুরক্ষায় কাজে দেবে।

কিছুদিন ধরে নেপালে চীনের দৃশ্যমান প্রভাব বাড়াতে ভারত ওই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রতিবেদন প্রকাশিত তথ্য মতে, ‘ভারত ও নেপালের মধ্যকার সাংস্কৃতিক এবং সভ্যতার সম্পর্ক অনেক পুরনো। এছাড়া নানান সেক্টরে ওই দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান।’

এদিকে ভুটানে ভারতের আর্থিক সহায়তা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ভুটানের সঙ্গে চীনের উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও ভারত এতে ততটা উদ্বিগ্ন নয়। কারণ ভুটানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্ব রয়েছে এবং নানান সময় ভুটানে ভারতীয় সামরিক সহযোগিতাও তারা নিয়েছে।

২০১৭ সালে দোকলাম নিয়ে যখন চীন-ভারত মুখোমুখি তখন পেছন থেকে ভারতকে সমর্থন জানিয়েছিল ভুটান। আর দোকলাম নিয়ে চীন ও ভুটান সম্পর্কের টানাপড়েন বেশ পুরনো।

 

১৯৪৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী ওই বিষয়টি ২০০৭ সালে নবায়ন করা হয় যেখানে ভুটানের পররাষ্ট্র বিষয়ক সব সিদ্ধান্ত ভারতের পরামর্শক্রমে করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া ভুটানের সঙ্গে চীনসহ পাঁচটি পরাশক্তির কারো সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি যেখানে চীন-ভুটানের সীমান্তবর্তী দেশ।

এদিকে নেপালে চীনের দৃষ্টি মূলত হিমালয়ের দেশে ভারতের প্রভাব কমিয়ে আনার জায়গায়। শুধু তা নয়, নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি যে কোনো সময় ভারতের স্বার্থে আঘাত হানতে পারে বলেও অনেক বিশ্লেষকের ধারণা।

ওলি সব সময়ই চীনপন্থী রাজনীতিক হিসেবেই পরিচিত। ফলে এবারের নির্বাচনে জিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার প্রয়াস নিয়েছেন তিনি। তাই ভারতের সঙ্গে নেপালের একতরফা সম্পর্কে বিরাট বিপত্তি আসছে বলেই মনে হচ্ছে। এছাড়া সব সুযোগ কাজে লাগানোর ঘোষণা দিয়ে চীনের সঙ্গে দেনদরবারের বিষয়টি তিনি আরো জোরালোভাবে পরিষ্কার করলেন।

চীনের সাহায্যে আড়াই বিলিয়ন ডলারের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আগের সরকারের আমলে থেমে গিয়েছিল। এটি নিয়ে আবারও চিন্তা-ভাবনা করার কথাও বলেছেন নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

চীনেও ওই বিষয়টিতে আশার পাল্লা বেশ ভারী। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরে যাওয়ার আগে বেইজিংয়ের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করা হয়েছিল। তা ভারতের সঙ্গে নেপালের ভারসাম্যহীন সম্পর্কে নতুন মাত্রা এনে দেয়।

এক স্বাক্ষাৎকারে ওলি মত দেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ভালো। এছাড়া আছে উন্মুক্ত সীমান্ত। আমরা ওই যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতেও আগ্রহী। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নেপালের প্রতিবেশী দেশ একটি নয়- দুটি। ফলে একটি দেশের ওপর এভাবে আমাদের নির্ভরতা বাড়ুক তা আমরা চাই না।’

এ মাসের শুরুতে নেপালের উন্নয়নের স্বার্থে চীন ৪৮ বিলিয়ন রুপি দেবে। একই সঙ্গে ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত টাটোপানি সীমান্ত রক্ষায় ওই অর্থ ব্যয় হবে। উল্লেখ্য, টাটোপানি সীমান্তই চীন-নেপালের বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুটি দেশের মধ্যে ট্রেন স্থাপনের পরিকল্পনাও বেশ এগিয়ে এসেছে বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত নেপালে চীনের ২২টি প্রকল্প কার্যাধীন। বাংলাদেশেও নিজেদের প্রভাব বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে চীন। বিদ্যুৎ প্রকল্প, সমুদ্রবন্দর ও রেলপথ নির্মাণে বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিনিয়োগ ও চুক্তির পরিমাণ

চীন ওই ধরনের বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয় যখন ভারত তার বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে যেখানে ভারত মনে করে, বাংলাদেশে তার প্রভাব অপরিবর্তনীয়।

আরো ২৫টি প্রকল্পে সহায়তা করবে চীন। এর মধ্যে আছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎপ্লান্ট ও গভীর সমুদ্রবন্দর যাতে চীন-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্কে উন্নয়নের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা সম্পর্কিত চুক্তি করা যায়। ওই নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় থাকবে প্রশিক্ষণসহ প্রযুক্তিগত নানান উন্নয়ন।

অন্যদিকে ৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তার মাধ্যমে চীন ছয়টি রেলপথ প্রকল্পের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যার একটি আবার ভারত সীমান্ত ঘেঁষে।

চীন তার বহুল প্রতীক্ষিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর আওতায় ভারতের পার্শ্ববর্তী সব দেশ নিজের প্রভাবের আওতায় এনে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট’-এর মতে, মালদ্বীপসহ আটটি দেশকে নানান ঋণ দিয়ে চীন তার পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। এটি তার ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের পরিকল্পনায় সাহায্য করবে।

এদিকে চীনের কৌশল খুবই সহজ। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় উচ্চ সুদে ঋণ দিয়ে নানান অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার প্রকল্প হাত নেয় তারা। তবে এক সময় ওই ঋণ অফেরতযোগ্য পর্যায়ে চলে গেলে চীন প্রকল্পগুলো আগের মূল্যে ইজারা নিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

অন্যদিকে শ্রীলংকা একটি ভালো উদাহরণ। সেখানের একটি সমুদ্রবন্দর ‘হাম্বানটোটা’ স্থাপনের কাজে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ঋন সহায়তা দেয় চীন। পরে ওই বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজে নিয়ে নেয় চীন।

আমেরিকার প্রভাবান্বিত অঞ্চলে চীনের প্রভাব বেড়ে যাওয়া ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ। এছাড়া মার্কিন গণমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ আশঙ্কা প্রকাশ করে, যে কোনো সময় আমেরিকা-ভারত প্রভাব গুরুত্বহীন হিসেবে দেখা দিতে পারে।

যেখানে এতদিন এশিয়ায় একমাত্র প্রভাবশালী দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র সেখানে চীনের ক্রমবৃদ্ধিমান প্রভাব আসলে আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করবে বলেই সবার ধারণা।

ট্রাম্পের অস্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতি ইতোমধ্যে এশিয়ার দেশগুলোকে বিকল্প ভাবতে বাধ্য করছে। এই মুহূর্তে এশিয়ার সব দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আমেরিকার চেয়ে চীনের সঙ্গে বেশি। এ ধরনের ভারসাম্যহীনতা আমেরিকার প্রভাব কমাতে কাজে লাগাতে পারে চীন।