‘জিরো থেকে হিরো’ কথাটির যথার্থতা যদি থেকে থাকে তবে বাস্তবে তার প্রমাণ দিয়েছেন বদিউজ্জামান খান কিরণ। নগরবাসীর বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রয়োজন মেটাতে কাজ করছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন দেশের সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশুদ্ধ পানির শতভাগ বন্দোবস্ত ব্যবস্থা হবে একদিন। একটা কোম্পানির বিক্রয়কর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ব্যবসাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনকারী এই ব্যবসায়ীর সংগ্রামী জীবনের নানান চড়াই উৎরাইয়ের গল্পগুলো আজ আমরা জানব। জবানের পক্ষ থেকে আলাপচারিতায় ছিলেন ইয়াসির আরাফাত।
বিশুদ্ধ পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সেফ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদিউজ্জামান খান কিরণের শৈশব কৈশোর কাটে কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে, মিরপুর উপজেলার নওদাআজমপুর গ্রামে। সেখানেই স্কুলের পড়াশোনা চলছিল কোনরকমে, সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরতে পছন্দ করতেন কিরণ। পড়াশোনায় কোন রকমেই মনযোগী ছিলেন না তিনি। এরপর এক পর্যায়ে জেলা শহরে খালার বাসায় চলে যান। শৈশবর দুরন্ত কিরণ ভাবেন, পড়াশোনাটা এবার ভাল মতো করতে হবে। সে মোতাবেক ১৯৯৪ সালে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৯৭ সালে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কেমিক্যালে ডিপ্লোমা শেষ করেন। ডিপ্লোমা শেষ করে সামান্য বেতনে চাকরি করা অবস্থায়ই মা ও বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসতে হয় তার। সেই সময়গুলোতে কঠিন সংগ্রাম করেছিলেন বলেই আজ তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। স্বীকৃতিস্বরুপ পেয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সদস্য পদ।
বর্তমান ব্যবসাবহর
ঢাকার মিরপুর ১০ নং গোলচত্বরের সন্নিকটে চারতলা ভবনজুড়ে ফ্যাক্টরি ও অফিস। নিচতলায় হচ্ছে পানি উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ, গ্যালনে ভর্তি হয়ে ছোট-বড় ছয়টি পিকআপ ভ্যান ভোর থেকে সারাদিনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। ফ্যাক্টরি, ডেলিভারি ও অফিস মিলে মোট কর্মরত ৬৫ জন। চারতলায় রয়েছে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা। দৈনিক গড়ে ৬০ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি উৎপাদিত হয় সেফ ইন্টারন্যাশনালের ফ্যাক্টরিতে।
এ ছাড়া বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় পানির মেশিন বসিয়েও ভাল আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। এককালীন মেশিনের দাম নেওয়া হয় আর এর সাথে পরবর্তী বছরের সার্ভিসিং বাবদ একটা ফি রয়েছে। কিরণের ব্যবসা শুরু এই পানির মেশিন বসানো দিয়েই। কারো বাসায় পানির মেশিন বসালে সারা বছরে ভাল সার্ভিসিং দিয়ে মন জয় করে নেন কিরণ। এ যাবৎ প্রায় দশ হাজার বাসা/অফিসে ফিল্টার মেশিন বসিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইয়াসির আরাফাত : ব্যবসার শুরুর সময়টা কেমন ছিল?
কিরণ : পড়াশোনা শেষে মার্কেটিংয়ে চাকরি নেই। একটা নতুন প্রোডাক্ট, হোটেল রেস্তোরায় ব্যবহারের জন্য ওয়াশিং পাউডার। ঢাকায় তখনো এটার ব্যবহার চালু হয়নি। আমি এটা চ্যালেঞ্জ আকারে নিয়েছিলাম। চার মাসের মাথায় এক মাসে কোম্পানির ২০ জনের গোটা সেলসটিম যা বিক্রি করেছিল আমি একাই তার চেয়ে বেশি সেল করেছিলাম। পরে সে কোম্পানির পাশেই দাতা এন্টারপ্রাইজেস লিমিটিড নামের একটি কীটনাশক প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ে জয়েন করি। সেখানেও সেল ভাল করায় কোম্পানির হেড অফিসে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়, কোম্পানির এমডি সাহেব নিজে আমাকে কোম্পানির সারাদেশের সেলসটিমের প্রধানের দায়িত্ব দেন।
এরপর জাগো করপোরেশন নামে এক কোম্পানিতে জয়েন করলাম যেখানে কাজ ছিল ফিল্টার বিক্রি করা। কমিশনে কাজ করতাম, ফিল্টার মেশিন বেচতে পারলে টাকা। ওই কোম্পানি ফিল্টার সেল করে সেটআপ দিয়ে আর খোঁজ রাখতো না। কোম্পানি থেকেই এক সময় বলা হয়, যদি নিজেরা সার্ভিসিংয়ের দায়িত্ব নেই তাতে কোম্পানির কোন আপত্তি থাকবে না। ওই কোম্পানি সার্ভিসিংটাকে ঝামেলা মনে করতো। তখনই আসলে শুরু, আমি একজনকে নিয়োগ দিয়ে এই কাজটা যত্ন নিয়ে করতে থাকি। আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানির লাইসেন্স নিয়ে শুরু করি প্রায় দেড় বছর পরে। যখন জাগো করপোরেশন ফিল্টারের ব্যবসা গুটিয়ে নিল তখন থেকে। এরপর নিজেই ফিল্টার সেল করতাম। পরে আরো লোকজন নিতে লাগলাম আস্তে আস্তে। একসময় পানির প্রোডাকশনে গেলাম।
আপনার ব্যবসায়ের বিপণন নীতি নিয়ে কিছু বলুন…
কিরণ : আগের থেকে ব্যবসার প্রতিযোগিতা হাজারগুনে বেড়ে গেছে। পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে তো টেনশন সবার মাঝেই আছে। আগের সময়ে যার সামর্থ্য আছে এমন কাউকে এটা নিয়ে বিস্তারিত বললেই রাজি হয়ে যেতেন। এখন বিষয়টা সবাই জানে, প্রচুর কোম্পানিও হয়েছে। প্রোডাক্ট কোয়ালিটি আর সার্ভিসিংয়ে ভাল করেই মূলত টিকে আছি। মানুষ একজন আরেকজনকে ভাল ফিডব্যাক দেয়, এটা খুব কাজে লাগে।
প্রতিযোগিতা নিয়ে আপনার চিন্তা ভাবনা কী?
কিরণ : গাড়িগুলোতে ব্র্যান্ডিং করেছি, আরো কিছু মিডিয়ায় প্রচার প্রচারণা করি। আমি মূলত ভাল সার্ভিস দিয়েই অন্যদের থেকে আলাদা থাকি।
এমন কোন সমস্যায় পড়েছিলেন, যখন নিজেকে অসহায় মনে হয়েছিল?
কিরণ : এই এলাকায় যখন প্রথম শুরু করি, মহল্লার কিছু লোক আমাকে নানান ভাবে ঝামেলা শুরু করল। টাকাপয়সা নিতে চায়, মাঝেমধ্যেই ঝামেলা করতে থাকে। পরে অবশ্য প্রসাশনের সাহায্যে সে সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। এখন আল্লাহর রহমতে এলাকার মানুষের সাথে সম্পর্ক খুবই ভাল। এখানকার মসজিদ মাদ্রাসা থেকে মহল্লাবাসী সবাই আমাকে খুব ভালবাসে।
কোন বিষয়গুলো চাকুরি বা অন্যান্য পেশা থেকে একজন ব্যবসায়ীর জীবনকে আলাদা করে বলে মনে করেন?
বদিউজ্জামান খান কিরণ : ব্যবসায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায়। চাকরিতে অন্যের অধীনতায় কাজ করতে হয়। আমার মনে হয়, চাকরি থেকে ব্যবসাকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। চাকরি করলেও কাজ করতে হয়, নিজের প্রতিষ্ঠান হলেও কাজ করতে হয়, তবে নিজের হলে কাজের প্রতি আলাদা তাড়না কাজ করে। নিজের প্রতিষ্ঠান আসলে একটা গাছের মতোন, যত্ন নিলে আজ হোক কাল হোক ফল দিবেই।
প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সাথে সম্পর্ক কেমন?
কিরণ : আমার কোম্পানির সামর্থ্য যতো বেড়েছে আমি স্টাফের সুযোগ সুবিধা ততো বাড়িয়েছি। চলতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে বেতন দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। ছুটির ব্যাপারে আমরা সবচাইতে আলাদা, সরকারি ছুটির চাইতে বেশি সময় ছুটি পায় আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। খাবার দাবারের মান নিয়েও আমরা আগের চাইতে অনেক বেশি সচেতন হয়েছি। যেহেতু কিছু ভাল মানুষকে আমি স্টাফ হিসেবে পেয়েছি, সেজন্য আমি এদের সাথে বন্ধুর মতো থাকতে চাই। বিপদে আপদে সব সময়।
ঢাকায় ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি সরবরাহে অব্যবস্থাপনার কারণেই কি গ্যালনজাত পানির ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়, কিংবা বাসায় ফিল্টার পানির যে মেশিন বসানো হয় সেসবেরও তো দরকার ছিল না যদি সরকারি সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থাপনা ভাল হতো।
কিরণ : এরকম বলার সুযোগ নেই। আসলে নিউ ইয়র্ক, লন্ডনের সাথে ঢাকার তুলনা করে লাভ নেই। যেমন নিউ ইয়র্কের মেয়র অফিস পুরো শহরবাসীর জন্য ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন গ্যালন সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে থাকে। আর আমাদের এখানে পানির ক্ষেত্রে না কোন খাতেই সরকারি ব্যবস্থাপনা এতটা তৎপর নয়।
ঢাকার পথে যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী, যেহেতু প্রচুর ক্লায়েন্ট ভিজিটে যেতে হয় শুনলাম, গাড়িতে বসা সময়টাতে কী করেন?
কিরণ : গাড়িতে সাধারণত ক্লায়েন্ট ডিটেইলস দেখি বা সেসব বিষয় নিয়ে ফোনের যত আলাপ দরকারি থাকে সেগুলো সারি। দীর্ঘক্ষণ হলে তখন নিজের গাওয়া রেকর্ড করা গান শুনি।
নতুন কোন ব্যবসায় বিনিয়োগের কথা ভাবছেন?
কিরণ : ভাল মানের কফিশপ দেওয়ার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে। এখনো এটা নিয়ে কাজ শুরু করিনি।
তরুণরা যারা ব্যবসা করতে আগ্রহী তাদের প্রতি যদি কিছু বলার থাকে…
কিরণ : প্রচুর পরিশ্রমের বাইরে একটা জিনিশ কাজে লাগে সেটা হলো সততার সাথে লেগে থাকা।
ব্যবসার বাইরে আর কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে চান?
কিরণ : ব্যবসার পাশাপাশি আমি আমার এলাকার লোকজনের জন্য কিছু করতে পারলে নিজের কাছে ভাল লাগে। যেখানে আমি জন্মেছি সেখানকার মানুষের জন্য সব সময়ই সাধ্যমতো কিছু করার চেষ্টা করি। যদিও আমার সামর্থ্য খুবই কম। ঢাকায় কারখানার এলাকায় স্থানীয় মসজিদ মাদ্রাসায় কোন কাজ হলে সাধ্যমতো শরিক থাকার চেষ্টা করি।
আপনার বিশেষ আগ্রহের জায়গা অভিনয় ও গান, সেসব নিয়ে কিছু বলুন।
কিরণ : টিভি নাটক ‘স্বরণের জানালায়’তে অভিনয় করেছি আমি, এছাড়াও তিনটা মঞ্চনাটকে কাজ করা হয়েছিল। আর ‘জুম আল্ট্রা’, ‘রানার বাইক’, ‘আইফোন’সহ বেশ কয়েকটি টিভিসিতেও কাজ করেছি। আর গানের ব্যাপারটি হচ্ছে, শখের বশেই বলা যায় এখন। ভবিষ্যতে সময় সুযোগ হলে গান রিলিজ করবো।
ভ্রমণে সবচাইতে পছন্দের জায়গা কোনটি?
কিরণ : রাঙ্গামাটির শুভলং ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার পথে একটা রাস্তা আছে যেখানে আমার বারবার যেতে মন চায়। এর বাইরে আমি দুবাই, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটান, কাতার, মালয়েশিয়াসহ বেশ কিছু যায়গায় ব্যবসার কাজে ও ঘুরতে গিয়েছি।
প্রিয় সিনেমা কোনটি?
কিরণ : তামিল সিনেমা ‘বাহুবলী’ ভাল লেগেছিল, ইতিহাস নির্ভর সিনেমাই ভাল লাগে বেশি।
শৈশব বা কৈশোরের স্মৃতি থেকে কিছু বলুন…
কিরণ : শৈশবের মজার ঘটনা প্রচুর। প্রত্যেকেরই শৈশবের বৈচিত্র থাকে তবে আমারটা আলাদা কোন জায়গায় বলি, মাঠে মাঠে ঘোরাঘুরি করতাম প্রচুর। ধান লাগানো, গম বোনা, মাছ ধরা থেকে শুরু করে এমন কিছু নাই যে করিনি। আমার দাদা তো আফসোস করে বলতেন, “সবাই পড়ালেখা করলেও কিরণটার পড়াশোনা হবে না। ও মাঠে মাঠেই থাকবে।”
একদিন ঝড়ে আমকুড়াতে গিয়ে এতো আম পেয়েছিলাম যে আনতে পারতেছিলাম না, পরে মাকে খবর দিলে মা বাগানে আসে এবং আমার কুড়ানো আম বাড়িতে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। পরে আব্বা বাড়ি এসে মাকে বাগানে যাওয়ার অপরাধে মারধর করে। আমি প্রচুর আম কুড়াতে পেরে ব্যাপক খুশি হলেও পরে তখনই সব মাটি হয়ে যায় যখন মাকে আমার জন্য মার খেতে হয়।
আরেকদিন মাঠে মজুরদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি, একটা পানির নালায় দেখলাম প্রচুর পুঁটি মাছ ভাসছে। মাছের ঝাঁকে রোদের বিকিরণে ঝলমলে অবস্থা দেখে অভিভূত হয়ে যাই আমি। সেদিন প্রায় ১২ কেজি পুঁটি মাছ ধরেছিলাম, কাছে একটা গামছা ছিল আর একটা বড় ডালা ম্যানেজ করেছিলাম, তবুও এতো মাছ! যে বাড়িতে আনতেই অসুবিধা হয়েছিল। আমরা মাঝে মাঝে রাতে মাছ ধরতাম, একরাতে এতো পরিমাণ মাছ ধরেছিলাম যে বাড়িতে সব মাছ আনতেও পারিনি।