মুগ্ধতা রেখে যাওয়া জাদুকর

শুভ জন্মদিন রোনালদিনহো

মুগ্ধতা রেখে যাওয়া জাদুকর

সে ছিলো এক মোহের নাম
মুগ্ধতার নিয়ত স্রষ্টা
সে ছিলো এক অজানা আবেগ
অনন্ত হতাশা….

১৯৮০ সালের পোর্তো এলেগ্রেতে একটি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। বাবা ছিলেন শিপইয়ার্ডের এক শ্রমিক আর মা নার্স। মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি বিশ্বকে জানান দিয়েছিলেন, যে ফুটবল বিশ্ব পেতে যাচ্ছে এক নতুন রাজা। রোনালদো দ্য অ্যাসেস মোরেইরা, যাকে ফুটবল বিশ্ব চেনে রোনালদিনহো নামেই। অনেকের কাছে শুধুই রনি।

বার্সার প্রতি বিরাগ আছে, কিন্তু দিনহোর জাদুতে মুগ্ধ হননি, ধরণীর বুকে এমন আদমি বিরল। নতুবা, চির প্রতিদ্বন্দী হবার পরেও বার্নাব্যুবাসীই বা কেন উঠে দাড়িয়ে সম্মান জানাতে যাবে প্রতিপক্ষের মূল তারকাকে? হ্যাঁ, এটাই রোনালদিনহো, যিনি কোনো দলের না, যিনি শুধুই ফুটবলের।

আপনি যদি ফুটবল নামক গোলকচর্মের, যা নিয়তই অব্যক্ত সব অনুভুতির জন্ম দেয় তার ভক্ত হয়ে থাকেন, তবে চোখ বুজেই বলে দিতে পারবেন কোন সে ভদ্দর যে একজন কট্টর মাদ্রিদ ভক্তকেও সব কিছু ভুলে গিয়ে তার স্তুতি স্তাবকে পরিণত করতে পারেন। এমন একজনই ছিলেন, একজনই থাকবেন ; রোনালদিনহো। ফুটবলের সবচেয়ে খেয়ালি রাজাদের অন্যতম, ফুটবলের সবচেয়ে বড় হতাশা।

Image: Facebook profile of Ronaldinho

নিজের উপর নির্দয় না হলে আজকে তিনিই হতেন ফুটবলের অবিসংবাদিত সম্রাট। বাড়িয়ে বললাম? আপনি যদি সেই ভাগ্যবানদের একজন হন; যিনি এ জাদুকরের পায়ের জাদুতে অবশ্য মুহুর্তগুলো সরাসরি উপভোগ করেছেন, চোখ বুজেই আমার সাথে একমত হবেন। প্রতিপক্ষও হতবুদ্ধ হয়ে বিপক্ষ তারকার মোহে মোহাচ্ছন্ন; এমন দৃশ্যটি খুব বিরল। দিনহো নিজ রাজত্ব কালে এমন সব মুহুর্তের জন্ম দিয়েছেন অনায়াসেই। পরম শত্রুর ঘর বার্নাব্যুতে সমবেতদের বাধ্য করেছেন দাড়িয়ে সম্মান জানাতে। দিনহো বার্সা বা ব্রাজিলের নন, তিনি ফুটবলের।

জাদুটা শুরু হয়েছিলো ২০০২ বিশ্বকাপে। ইংরেজদের শ্বাসটান উঠিয়ে দেয়া সে অবিশ্বাস্য ফ্রি কিক দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন সব আলো। শেষটাও হলো আরেক বিশ্বকাপে। যে বিশ্বকাপটি হবার কথা ছিলো শুধুই তার। হলো না, পুরো জাহান যখন প্রস্তুত ফুটবলের একক সম্রাটকে বরণ করে নিতে তখনই দিনহো পথ হারালেন। নৈশ জীবনের অহর্নিশ টান পা দুটো ভারি করে তুলতে শুরু করলো, ত্যাগ করলেন নিজ ঘর বার্সা। ক্যাম্প ন্যু ছাড়ার সময় আর সব কিছুর সাথে জাদুর প্যান্ডোরা বাক্সটাও রেখে এসেছিলেন বোধয়। বার্সার সে দিনহো আচমকাই স্মৃতি হয়ে গেলো।

নিজের রাজত্বকালে জিতেছেন সব কিছুই। তাই দিনহোর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আক্ষেপ নাও থাকতে পারে। আক্ষেপটা ফুটবলের। আর কারো পা যা অমন করে সবুজ গালিচায় ফুল ফোটাতে পারে নি। আমরা এখন যে সকল ড্রিবলিং দেখে আহা বলে তালি দেই, দিনহোর সামনে তা কিছুই ছিলো না। তার মত করে চিন্তায় ধাক্কা কোনো দিন কেউ দিতে পারবে বলেও বিশ্বাস করি না।

মুগ্ধতার পারদ এতটাই উচুতে নিয়ে গিয়েছিলেন যে প্রায়শ প্রতিপক্ষের রক্ষণ তারকারই অসহায় চোখে চেয়ে দেখতেন তার ক্যারিশমা। কখনো দু পায়ের ফাঁক গলিয়ে বল নিয়ে দৌড় দিচ্ছেন তো, কখনো পায়ের নিচ দিয়ে মাটি কামড়ানো ফ্রি কিকে হাসিমুখে কতল করছেন প্রতিপক্ষকে। নিষ্পাপ সে হাসির বিষে নীল হয়ে যে কত দল পথ হাড়িয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। আজকের যে বিশ্ব শাসন করা বার্সাকে আমরা দেখছি, তার মূল কারিগর ছিলেন এই ব্রাজিলিয়ানই।

Image: Facebook profile of Ronaldinho

রিয়ালের বিপক্ষে প্রথম যে হ্যাট্রিকটি দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের শিরেনাম হলেন লিও মেসি; সেদিন যতটা মেসিময় ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিলো দিনহোর। প্রায় একাই প্রলয় নাচন নাচিয়ে ছেড়েছিলেন রিয়ালের রক্ষণভাগের। তাই ৩-৩ এ ড্র হবার পরও রিয়াল সমর্থকদের চোখে মুখে হতাশার বদলে ছিলো দিনহো জাদুতে মুগ্ধ হবার রেশ। এমনটা আগেও কেউ পারেনি, সামনেও কেউ পারবে না।

শীর্ষ পর্যায়ে তার রাজ করা সময়কালটা খুব অল্পদিনের। তাতেই যা করেছেন, ফুটবল আজীবন মনে রাখতে বাধ্য। প্রশ্নটা এখানে যে ঠিক কোন চোখে ফুটবল বিশ্ব দেখবে তাকে? সর্বকালের অন্যতম সেরাদের একজন হিসেবে? নাকি ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হিসেবে?