মানুষ সুন্দরের পূজারী। সুন্দরের স্তুতি গাইতে ক্লান্তি ভর করে না। বিশ্বে যা কিছু সুন্দর চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। সভ্যতার অাধুনিকায়নে নারীরা বাস্তবিক অর্থেই এগিয়ে যাচ্ছে। রূপে, গুণে সর্বত্র রাখছে সাফল্যের ছাপ। ক্রীড়াঙ্গনেও নারীরা পিছিয়ে নেই কোন অংশে। কেউ কেউ অাছেন স্রেফ রূপ দিয়েই ভোলাতে পারতেন ভুবন। তবে রূপের অহং নিয়ে পড়ে থাকাদের দলে তারা নন। তারা ভয়ংকর সুন্দর। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের এমন আটজন নারীকে নিয়ে এই আয়োজন, যারা সৌন্দর্য্য আর সাফল্যের আভিজাত্যে নিজেদের নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
★ ৮. ক্যারোলিন ওজনিয়াকি (টেনিস)
ড্যানিশ গ্ল্যামার গার্ল ওজনিয়াকির জন্ম ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই। টেনিস র্যাকেট হাতে কোর্টের সঙ্গে সখ্যতা ২০০৫ সাল থেকে। কোন গ্র্যান্ডস্লাম না জিতেও র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ওঠা একমাত্র নারী টেনিস খেলোয়াড় ক্যারোলিন। তার চেহারার ঔজ্জ্বল্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে চূড়ায় বসিয়েছে কর্তৃপক্ষ সেটি ভাবার জো নেই। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে টানা দুইবার খেলেছেন ইউএস ওপেনের ফাইনাল। প্রথমবার সুপার মম কিম ক্লাইস্টার্সের কাছে হার, ২০১০ এ হেরেছেন হেভিওয়েট সেরেনা উইলিয়ামসের কাছে। দারুণ প্লেয়িং স্টাইলের পাশাপাশি অনন্য সুন্দর চেহারার অধিকারিণী ওজনিয়াকি টেনিসে শীর্ষে ওঠা তার দেশের প্রথম নারী। এত পাওয়ার মাঝে না পাওয়ার হাহাকার ছিল একটি গ্র্যান্ডস্লাম শিরোপা।
চলতি বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে উঁচিয়ে ধরেন প্রথম গ্র্যান্ডস্লাম, দিয়েছেন নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ। ওজনিয়াকির সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়েছিল আইরিশ গলফার ররি ম্যাকলরয়। ২০১৪ সালে ররি-ক্যারোলিন সেরেছিল এমনকি বাগদানও। কিন্তু, তাদের সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। সুন্দরী তরুণীকে নিজের করে পেতে এবার তার সঙ্গে বাগদান সেরেছেন আমেরিকান বাস্কেটবল তারকা ডেভিড লি। গতবছর ভালোবাসা দিবসে দুজনের সম্পর্ক সোশ্যাল মিডিয়ায় উন্মোচন করেন ওজনিয়াকি স্বয়ং, ইন অ্যা রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে।
★ ৭. মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন (সাঁতার)
‘আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান’
সুকান্তের কবিতার লাইনের মত আমেরিকান সাঁতারু মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন পথে প্রান্তরে তুফান না ছোটালেও ঝড় তুলেছেন পুলে। আঠারোতম জন্মদিনের ক’দিন পরই গলায় ঝুলিয়েছেন পাঁচটি অলিম্পিক পদক, যার চারটিই সোনা। লন্ডনে ২০১২ অলিম্পিকের আসরে নিজের আবহনী সুর বাজিয়েছিলেন মিসি। ১০০, ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক, ৪*১০০ মিটার মিডে জিতেছেন স্বর্ণপদক। ৪*২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে সোনার মেডেল দখলে রেখেছেন সর্বশেষ ‘১৬ রিও অলিম্পিকেও। নারী সাঁতারের ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকের ওয়ার্ল্ড আর ১০০ ও ২০০ মিটারের মার্কিন রেকর্ডটা ১৯৯৫ সালের ১০ই মে জন্ম নেওয়া ক্যালিফোর্নিয়ান এই জলকন্যার দখলে।
মেলিসা জানেত্তি ফ্র্যাঙ্কলিন। ২০১১ সালে সাংহাইতে অনুষ্ঠিত সাঁতারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপে ৩ সোনা জিতে জাত চেনান নিজের। ওই আসরে আরো একটি করে রূপা এবং তামাসহ মোট পদক পাঁচটি। তারপর ‘১২র অলিম্পিক। তারপর ফের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ। ২০১৩ বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়নশীপে ছয়টি সোনা জিতে বনে যান এক আসরে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণজয়ী নারী সাঁতারু। পেছনে ফেলেন স্বদেশী ট্রেসি কালকিন্স আর অস্ট্রেলিয়ার লিবি ট্রিকেটের জেতা ৫ স্বর্ণের রেকর্ডকে। ২০১৪ সালে পড়েছেন ইঞ্জুরিতে। কিছুটা শ্লথ হয়েছে গতি, নুইয়ে যাননি। যাননি যে তার প্রমাণ মিসি দিয়েছেন পরের বছর কাজান চ্যাম্পিয়নশীপে দুই গোল্ডসমেত চার পদক গলায় ঝুলিয়ে।
সুইমিংপুল আর মার্কিনিরা যেন একই সূত্রে গাঁথা।
মিসি তার প্রতিভার জন্য ধন্যবাদ দেন স্রষ্টাকে। পথনির্দেশনা পেতে স্মরণ করেন সবসময়। নিজেও তরুণী, হতে চান খেলোয়াড় হতে আগ্রহী সকল তরুণীর রোল মডেল। এমন অনুসারীকে তো দু’হাত ভরেই দেবেন স্রষ্টা!
★ ৬. মিতালি রাজ (ক্রিকেট)
শচীন টেন্ডুলকারের সাথে কারো তুলনা করা মানে বিশাল কিছু। ভারতীয়দের কাছে মাস্টার ব্লাস্টারের অবস্থান কোথায় সেটি না বললেও চলে। ক্রিকেট এবং শচীন, যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। ভারতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ‘মিতালি দুরাই রাজ’ এর সৌভাগ্য তিনি ক্রিকেট খেলছেন, তারচেয়ে বেশি সৌভাগ্য তাকে ‘লেডি টেন্ডুলকার’ বলে ডাকা হয়! এতটুকুনই যথেষ্ট মিতালির বিশেষত্বের প্রমাণ দিতে। মিতালি, দ্য আউটস্ট্যান্ডিং ওয়ান, যাকে নিয়ে সিনেমা বানাতে চলেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভায়াকমএইটিন মোশন পিকচার্স।
রাজস্থানের যোধপুরে দুরাই- লীলা রাজ দম্পতির ঘরে ১৯৮২ সালের ৩রা ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া মিতালির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ১৯৯৯ সালে, বিপক্ষ আয়ারল্যান্ড। ১৭ বছর বয়সে প্রথমবার ভারতের নীল জার্সি গায়ে চাপালেও ডাক পড়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সে! ১৯৯৭ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলে ডাক পেলেও চূড়ান্ত স্কোয়াডে ঠাঁই হয়নি। অবশ্য, দলে ঢোকার পর আর পিছু ফিরতে হয়নি ভারতীয় এই সুন্দরিকে।
মিতালি রাজ। শচীনের মতোই তার নখদর্পণে রেকর্ডের সমাহার। ২০১৭ বিশ্বকাপে টানা সাত ফিফটির রেকর্ড প্রথম ভারতীয় এবং সবমিলিয়ে পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বআসরে হাজার রান করা ইন্ডিয়ান কাপ্তানের দখলে। এতেই শেষ নয়, ভারতের হয়ে টানা ১০৯ ম্যাচে মাঠে নামা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মিতালি টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টুয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। দলপতি তো এমনই হওয়া চাই, যাকে দেখে নিজেদের সেরাটা দিতে আগ্রহী হবে তরুণীরা। আর তিনি যদি হন পদ্মশ্রী (২০১৫ সালে ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের পঞ্চম সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মশ্রী’ পান মিতালি রাজ) প্রাপ্ত নারী, তাহলে তাকে অনুসরণ করা যায় চোখ বুজেই।
★ ৫. হোপ সোলো (ফুটবল)
হোপ শব্দের বাংলা অর্থ ‘আশা’। সোলো শব্দের মানে ‘একা’। হোপ সোলোকে একত্রে বাংলা করলে মোটামুটি এমন দাঁড়ায়- একা দেবার আশা! কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক হোপ সোলোর বিরুদ্ধে ওয়ান টু ওয়ান গোল দেবার আগেও সবাইকে দু’বার ভাবাতে বাধ্য করতেন ২০১৫ সালে দেশকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া ৩৭ বছর বয়সী এই তারকা।
ফুটবল খেলা ভালবাসে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। আমেরিকানরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাদের প্রধান খেলা হয়ত ফুটবল নয়, কিন্তু অন্যান্য খেলার চেয়ে মার্কিন মুলুকে ফুটবলের আবেদন এতটুকু কম নয়। পুরুষ দলের পাশাপাশি জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে নেই নারীরাও। পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক, পরিবর্তনের পালে হাওয়া দিতে সামনে থেকেই অবদান রেখেছেন ২০০৮ ও ২০১২ অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রকে সোনার মেডেল পাইয়ে দেয়া হোপ এমিলি সোলো। ২০০০-২০১৬, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অর্জনের পাল্লা বেশ ভারী। ২০১১ সালে পেয়েছেন বর্ষসেরা গোলরক্ষকের খেতাব, হাতে গলিয়েছেন বিশ্বকাপের গোল্ডেন গ্লোভ। এসবে সুন্দরী সোলোকে বর্ণনা করা কঠিন। সৌন্দর্য তার মাঠের বাইরে, তেকাঠির নিচে রুদ্ররূপে হৃদপিন্ড কাঁপে স্ট্রাইকারদের!
সোলো দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ২০২ ম্যাচে যা উইমেন সকারে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, তার দখলে আছে টানা ৮২ ম্যাচে গোল না খাবার রেকর্ড! হ্যাঁ, ৮২ ম্যাচই। ২০০৫- ২০০৯ পর্যন্ত ফরাসি ক্লাব অলিম্পিক লিওতে কাটালেও লিও ছাড়া কোথাও থিতু হননি তিনি। ফ্রান্স, সুইডেন এবং নিজ মূলুক মিলিয়ে প্রায় আটটি ক্লাবের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন নারী ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক! নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। তবে, তার সমন্ধে সবচাইতে অবাক ও মজার তথ্য এটি নয়। গোলরক্ষক হিসেবে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছানো সোলো ক্যারিয়ার শুরু করেন ফরোয়ার্ড হিসেবে! এই ভূমিকাতেই ১৯৯৬, ৯৭, ৯৮ টানা তিনবছর স্কুল দলকে লীগ জিতিয়েছেন। কিপিং গ্লাভস হাতে গলানোর আগে স্কুল দলের গোলকিপারদের হাত গলিয়ে জাল ছুঁইয়ে হোপ সোলো গোলানন্দে মেতেছেন ১০৯ বার! তার জন্যেই হয়ত প্রবাদটি- ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’…
★ ৪. মারিয়া শারাপোভা (টেনিস)
মারিয়া শারাপোভা। টেনিস কোর্টের দুরন্ত এক তরুণীর নাম, র্যাকেট হাতে যিনি বিমুগ্ধ করেন সবাইকে। আবেদনময়ী দেহশৈলী, দুরন্ত শারীরিক ভাষা, কেতাদুরস্ত লাইফ স্টাইলের সাথে শৈল্পিক ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড আর রিভার্সের দারুণ সমন্বয়ে হয়ে উঠেছেন টেনিস নামক খেলাটির আদর্শ বিজ্ঞাপন। তাকে শুধু ভালোবাসতে পারেন তার খেলায় বিমোহিত হয়েই। এরসাথে যখন মিলিত হয় চেহারার মাধুর্য আর ঠোঁটের মায়াবী হাসি,তখন তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কি? ২০০৫ ও ২০০৭ সালে তখনকার জনপ্রিয় সার্চইঞ্জিন ইয়াহুতে সবচেয়ে বেশিবার খোঁজ করা নামটি মারিয়া শারাপোভা! এতেই বোঝা যায়, তিনি অনুসারীদের কতটা প্রিয়!
১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল রাশিয়ার ন্যাগান শহরে ইউরি শারাপোভ-ইয়েলিনা শারাপোভ দম্পতি। কোল আলো করে জন্ম নেন মারিয়া ইয়ুরেভনা শারাপোভা। ডাক নাম ‘মাশা’। বয়স যখন চার, বাবার বন্ধু সাবেক নাম্বার ওয়ান ইয়েভগনি কাফেলনিকভের বাবা অ্যালেকজান্ডার কাফেলনিকভ মাশাকে উপহার দেন একটি টেনিস র্যাকেট। যেন এটির অপেক্ষাতেই প্রহর গুণেছে সে! স্থানীয় টেনিস কোর্টে শুরু ধারাপাত দীক্ষা, হাতেখড়ি যাকে বলে। কিছুদিন পর সান্নিধ্য পান রাশিয়ার নামি কোচ ইউরি ইউতকিনের। তিনি সুপ্ত প্রতিভার আঁচ করেছিলেন, ছোট্ট শারাপোভাকে পাঠিয়ে দেন কিংবদন্তি মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার ‘টেনিস কমপ্লেক্সে’। রত্ন চিনতে নাভ্রাতিলোভারও দেরি হয়নি। মাশার নতুন ঠিকানা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিক বোলেত্তেইরি টেনিস একাডেমি’। আন্দ্রে আগাসী-মনিকা সেলেসের মত তারকারা উঠে এসেছেন টেনিসের ‘গ্রেট ওয়াইড হোপ’ খ্যাত একাডেমিটি থেকে। সময়টা ১৯৯৪। বাবার হাত ধরে পাড়ি জমান ফ্লোরিডায়। মেয়ের উজ্জল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ইউরি দেশ ছেড়েছেন বটে, কিন্তু ছিল না পর্যাপ্ত সঞ্চয়। অর্থাভাবে মেয়ের খেলাধুলায় যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে তাই তিনি নেন থালাবাসন ধোয়ার চাকুরি।
বাবার ত্যাগ, শ্রম বিফলে যেতে দেননি শারাপোভা। ২০০৪ সালে সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে প্রথম গ্র্যান্ডস্লাম জয়। বয়স তখন সবে ১৭। ২০০৫ সালে প্রথমবার উঠেন র্যাংকিংয়ের শীর্ষে। ততদিনে কষ্টের দিনগুলি পেছনে ফেলে নতুন সূর্যের আঁচ গায়ে মেখেছেন মাশা। তারপর ২০০৬ এ ইউএস ওপেন, দুইবছর পর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে নিজের আসনটা পাকা করে নেন শৈশব থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনিং আর স্ট্যাম্প সংগ্রহের শখকে লালন করা শারাপোভা। সফলদের ক্যারিয়ার থামিয়ে দিতে ইঞ্জুরি বরাবরই চেষ্টারত থাকে। মাশার বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটবে কেন? ২০০৭ সালে হানা দেয় কাঁধের ইঞ্জুরি। নতুন করে মাথাচাড়া দেয় অজি ওপেন জয়ের পর। এতটাই যে, কোর্টে নামতে পারেননি পাক্কা ১ বছর। কিন্তু, হাঁটতে শেখার আগেই যিনি শিখে গেছেন ব্যাট ধরা তার কাছে এসব তুঁড়িতে উড়িয়ে দেওয়া ব্যাপার। তিনি ফিরেছেন। ২০১২ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে পূর্ণ করেছেন আরাধ্য ক্যারিয়ারস্লাম (চারটি গ্র্যান্ডস্লামের সবকটি জিতলে তাকে ক্যারিয়ারস্লাম বলে)। ২০১৪ সালে জিতেছেন ২য় ফ্রেঞ্চ ওপেন, যা কি না মাশার পঞ্চম ও এখন পর্যন্ত সর্বশেষ গ্র্যান্ডস্লাম।
চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। রুশ সুন্দরীরও আছে। ২০১৬ সালে নিষিদ্ধ হন ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে! নিষিদ্ধ ড্রাগ মেলডেনিয়াম সেবনে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েন তিনি। হতে পারতেন এমনকি আজীবন নিষিদ্ধ! ‘ডাক্তারের পরামর্শে ১৫ বছর বয়স থেকে অ্যাজমার মেডিসিন হিসেবে সেবন করে আসছেন এটি’ আত্নপক্ষ সমর্থন করে বলা কথার সত্যতা মিলেছে বলেই বেঁচে গেছেন তিনি। একসময় যার খেলার খরচ যোগাতে বাবাকে মাজতে হয়েছে থালাবাসন সেই শারাপোভাই ১১ বছর ধরে ছিলেন সর্বোচ্চ উপার্জিত নারী ক্রীড়াবিদ। বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পোর্শে এবং লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড কোলে হানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তিনি। নিউইয়র্কে নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে (সুগারপোভা) খুলেছেন ক্যান্ডি ব্যবসা।
মারিয়া শারাপোভার গল্পটা রূপকথার মতোন। উত্থান পতন, নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন। এসবকিছুই করেছেন মলাটবদ্ধ। ২৯টি ডব্লিউটিএ টাইটেল জেতা মাশা গতবছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করেছেন নিজের আত্নজীবনী- ‘আনস্টপেবল : মাই লাইফ সো ফার’।
★ ৩. ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা (পোলভল্ট)
পোলভল্ট খেলাটি তেমন পরিচিত নয় আমাদের কাছে। তাই বলে ইসিনবায়েভা অপরিচিতা নন। ইন্টারনেট আর অলিম্পিকের বদৌলতে পোলভল্টের রাণীকে সবারই চেনা হয়ে গেছে। ২০০৪ এথেন্স ও ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী রুশ অ্যাথলেটের সাফল্যের মুকুটে আছে আরো পাঁচটি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপ টাইটেল। পোলভল্টের বিশ্ব আর অলিম্পিক দুটো রেকর্ডেরই অধিকারীনী তিনি। সবমিলিয়ে তিনি কতটি বিশ্বরেকর্ডের মালিক, জানেন? ২৮টি! এমনি এমনি তাকে সর্বকালের সেরা নারী পোলভল্টার বলা হয় না।
অথচ কি আশ্চর্য, সেই ইসিনবায়েভাই হতে চেয়েছিলেন জিমন্যাকতটি বিশ্বরেকর্ডের মালিক, জানেন? ২৮টি! এমনি এমনি তাকে সর্বকালের সেরা নারী পোলভল্টার বলা হয় নাস্ট! মাত্র ৫ বছর বয়স থেকে শুরু করেন জিমন্যাস্টিকস, এরপর চালিয়ে যান দশবছর। ইতিহাস অপেক্ষায় তাকে নিয়ে ভিন্ন গল্প লিখবে বলে, তার সাধ্যি কি পোল থেকে দূরে থাকে? ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইনডোর টুর্নামেন্টে ৫ মিটার লাফিয়ে তাক লাগান সবাইকে। এর আগে যে কেউই লাফাতে পারেনি ৫ মিটার! সে রেকর্ডটা বেশিদিন টিকেনি। টিকতে দেননি ইসিনবায়েভা স্বয়ং। সে বছরের মে’তে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে ভেঙ্গে দেন মাত্র তিন মাস আগের রেকর্ড। ৫ দশমিক শূন্য ছয় মিটার লাফিয়ে রচেন নতুন মহাকাব্য। অর্জনের মূল্য পেতে বিলম্ব হয়নি এতটুকু। স্প্যানিশ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে খেলাধুলা বিষয়ক সম্মান ‘প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন এই চিরসবুজ তারকা।
১৯৮২ সালের ৩রা জুন রাশিয়ায় জন্ম নেওয়া ইয়েলেনা গ্যাঝিয়েভনা ইসিনবায়েভা ২০০৪ এবং ‘০৮ এর পর পদক জিতেছেন। ২০১২র লন্ডন অলিম্পিকে যদিও সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাম্রমাল্যেই। ২০১৬তে খেলেননি অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের রাশান অ্যাথলেটদের বিরুদ্ধে ডোপ নেওয়ার দায়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায়। তাই, সোনালি কন্যার গ্রেটেস্ট শোয়ের শেষ যাত্রা হলো সাদামাটায়। রিওতে দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরতে না পারায় ২০১৬ সালেই অবসর নিয়ে নেন ৫ দশমিক শূন্য ছয় মিটারের রেকর্ড আজ অব্দি অক্ষত রাখা ইয়েলেনা। নিজ প্রজন্মের অন্যতম সেরা নারী ক্রীড়াবিদ যুক্ত আছেন ‘চ্যাম্পিয়ন্স ফর পিস’ নামক ক্লাবের সঙ্গে, যেখানকার ৫৪ সদস্যের প্রত্যেকে নামকরা একেকজন অ্যথলেট।
★ ২. অানা কুর্নিকোভা (টেনিস)
১৯৫৪ সালের হাঙ্গেরি ফুটবল দলকে বলা হয় বিশ্বকাপ না জেতা সর্বকালের সেরা দল। বিশ্বকাপটাই জেতা হয়নি তাদের। অথচ মানুষের হৃদয় জিতেছেন। সম্মান, ভালবাসা, নিন্দুকের প্রসংসা সব পেয়েছেন। এ বছর বিশ্বকাপের বছর। বসছে রাশিয়ায়। রুশ সুন্দরী অানা কুর্নিকোভার সাথে হাঙ্গেরি দলটা খুব যায়! টেনিসে কোন গ্র্যান্ডস্লাম না জিতেও ভক্তদের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন ক্যারিয়ারজুড়েই। সেরা সময়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশিবার খোঁজাদের একজন ছিলেন তিনি। এভাবে দেদারসে খোঁজার রহস্য কি স্রেফ গ্ল্যামার? মোটেই না!
অানা সার্গেয়েভনা কুর্নিকোভা। ১৯৯৫-২০০৭, একযুগের পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রায় ১৩০টির কাছাকাছি সিঙ্গেল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ফাইনালেই খেলতে পেরেছেন মাত্র চারবার, শিরোপা দুটি! গ্র্যান্ডস্লামে সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৯৭ সালের উইম্বলডন সেমিফাইনাল। সে যাই বলুন, তাকে চেহারা দিয়েই মনে রেখেছে মানুষ। এমনটিই ভাবছেন নিশ্চয়ই? টেনিসে তিনটে বিভাগ। একক, দ্বৈত, মিশ্র দ্বৈত। কুর্নিকোভা নিজের শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন দ্বৈতে অর্থাৎ ডাবলসে! ডাবলসের কিংবদন্তি নারী লাটভিয়ান তারকা লারিসা নিইল্যান্ডের সাথে খেলেছেন শুরুর দিকে। ফাইনাল পর্যন্ত সবটাই ঠিকঠাক, কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠলে যেন অদ্ভুত হাওয়ায় দিক হারাতো তাদের উড়ন্ত ঘুঁড়ি। তারপর জুটি বাঁধেন নারী দ্বৈতের অারেক সফল খেলোয়াড় মার্টিনা হিঙ্গিসের সাথে। ব্যস, অক্সিজেন পেয়ে যান। ১৯৯৯ এবং ২০০২ সালে এই জুটি উঁচিয়ে ধরে পরম অারাধ্য গ্র্যান্ডস্লাম। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ওই দুটি শিরোপা ছাড়াও ডব্লিউটিএ (উইমেন্স টেনিস অ্যাসোসিয়েশন)’র অারো ১৪টি ডাবলস টাইটেল অর্জনের ঝুলিতে পুরে নেন অনেক ঘাটের জল খেয়ে স্প্যানিশ গায়ক ও গীতিকার এনরিক ইগলেসিয়াসের সঙ্গে সংসার পাতা কুর্নিকোভা। কেবল ডাবলেই নয়, মিক্স ডাবলে গ্র্যান্ডস্লাম টাইটেল না পেলেও খেলেছেন ইউএস এবং অস্ট্রেলিয়ান ওপেন।
গেল ডিসেম্বরে নিকোলাস ও লুসি নামের জমজ পুত্র-কন্যার জননী হওয়া অানার একক টেনিসে সেরা র্যাংকিং অষ্টম হলেও ২০০০ সালে দ্বৈতে পেয়েছেন শীর্ষারোহণের স্বাদ। ১৯৯৯র অজি ওপেন জিতে হিঙ্গিসের সাথে জিতে নিয়েছেন ডব্লিউটিএর বেস্ট টিম খেতাব। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ, ইতালিয়ান জুনিয়র টুর্নামেন্ট জয় করে বিশ্বকে তাক লাগানো কুর্নিকোভা ‘৯৬ সালে নির্বাচিত হন সেরা উদীয়মান হিসেবে। তারপর যতদিন ছিলেন কোর্টে ততদিন মুগ্ধ করে রেখেছিলেন সবাইকে। দুধে অালতা গায়ে, প্রতিভার বিচ্ছুরণে।
.
★ ১. বেটি কাথবার্ট ( ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড)
অবসরের পর ফেরাটা সবার জন্য শাপেবর হয় কি? উত্তরটা অতি সোজা। ‘না’! ফিরতে পারলেও সেটাকে স্মরণীয় করে রাখতে পারেন ক‘জন, যাতে ঢাকা পড়ে যায় ফের ফেরার কানাঘুষা? গোল্ডেন গার্ল খ্যাত অজি দৌঁড়বিদ ‘এলিজাবেথ এলিস কাথবার্ট’ পেরেছেন। ইঞ্জুরির কারণে ১৯৬০ সালে অবসর নেন। মাত্র ১৮ মাস পর আবার ফিরে আসেন। জিতেছেন ১৯৬৪ অলিম্পিকের ৪০০ মিটারের সোনার পদক। তাকে কি একটি পদক দিয়েই মনে রাখবে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষক ইভেন্টের মানুষজন? বিশেষত্ব আছে বেটির। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকে অভিষেক। ঘরের মাঠ, অলিম্পিক খেলা কোচের অধীনে নিজেকে তৈরি করা। এতকিছুর পরও মাত্র ১৮ বছরের কিশোরীর কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা থাকার কথা নয়। আবার সেই কিশোরীই যখন ১৯৫৩ সালে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপে রেকর্ড করে আসেন তখন প্রত্যাশার পারদ উঁচুতেই চড়ে। প্রত্যাশা পূরণ করেছেন কাথবার্ট, প্রত্যাশা ছাপিয়ে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ৪*১০০ মিটার রিলের দলগত ইভেন্টে স্বর্ণপদক নিলে জুটে যায় স্বর্ণকন্যার তকমা।
স্বর্ণকন্যার পাশাপাশি রেকর্ডকন্যা বললেও ভুল হবে না কাথের ক্ষেত্রে। যতগুলো ইভেন্টে দৌঁড়েছেন, নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন প্রত্যেকটায়। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়েছেন ৬০ মিটার, ১০০, ২০০, ২২০ ও ৪৪০ ইয়ার্ডে। সমানতালে অবদান রেখে দৌঁড়েছেন ৪*১০০, ২০০ ও ২২০ মিটারের দলগত ইভেন্টেও। অস্ট্রেলিয়ান সরকার চেহারা দেখে তো আর তাকে ‘জাতীয় রত্ন’ ঘোষণা দেয়নি। একজন অ্যাথলেটের সম্ভবত এরপর চাওয়ার কিছু বাকি থাকে না। তবে দেশ জানে তার অসামান্য জীবনে এসব অতি নগণ্য। তাই ১৯৯৪ সালে স্পোর্টস অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেম, ২০০০ সালে অ্যাথলেটিক্স অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেমে স্বীকৃতির মাধ্যমে তাকে চূড়ান্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
কাথবার্টের বিচিত্র জীবনের সূচনা জন্ম থেকেই। লিসলি- মারিয়ন দম্পতির ঘরে ১৯৩৮ সালের ২০ এপ্রিল জন্ম নেয় জমজ কন্যাসন্তান। ছোটবোন ম্যারি মিজ এর চেয়ে ২০ মিনিটের বড় কাথবার্ট। ২০ এপ্রিল, ২০ মিনিট! কাকতাল! এরপর জীবনে কাকতাল তেমন না এলেও ১৯৬৯ সালে শরীরে বাসা বাঁধে নানান রোগ। এসব রোগবালাইকে তুঁড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু এখানে সাফল্য মেলেনি। জীবন সংগ্রামে ১৬ বছর বয়সে চুকিয়েছেন বিদ্যালয়ের পাঠ। সময় দিয়েছেন পারিবারিক নার্সারিতে। খেলা ছাড়ার পরও নার্সারিতেই কেটেছে বেলা। ২০১৭-র ৬ আগস্ট বেলা শেষের গান শুনিয়ে ৭৯ বছর বয়সে সর্বকালের অন্যতম সেরা অজি নারী দৌঁড়বিদ ত্যাগ করেছেন মহাকালের মায়া; প্রায় চারযুগ ধরে ধমনীজুড়ে বয়ে বেড়ানো রোগ নিয়ে, নিজের অমর ক্রীড়াজীবনের স্মৃতি নিয়ে।