পুতিনকে পশ্চিমে নির্মম ও নিষ্ঠুর রাজনীতিবিদ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ মতে যদি ধরেই নেন ওই কঠিন হৃদয়ের বাইরে তার অস্তিত্ব নেই তাহলে তা ভুল হবে। পরাশক্তিধর রাশিয়াকে যখন তিনি শাসন করেন তখন হয়তো অনেক ব্যাপারে কঠোর হতেই হয়। উপায়ান্ত থাকে না হয়তো অথবা এমন ভাব-ভঙ্গিতেই নিজেকে হাজির করতে চান। সবার সামনে নিজের আসল রূপটাই হাজির করেন। কিন্তু এর বাইরেও আরো সত্য রয়ে গেছে।
‘দি কোল্ড ওয়ার: হাও দি এনার্জি ট্রেইড স্লিপড ফ্রম আমেরিকান গ্রাসপ’-এর লেখক মারিন কাতুসা বলেন, ‘পুতিন পশ্চিমি রাজনীতিকদের মতো নন। তিনি বিশ্বাস করেন তার লক্ষ্য হচ্ছে সর্বশক্তিমান দেশ হিসেবে রাশিয়ার যে দাপট ছিল ওই অতীত স্বর্ণ যুগ ফিরিয়ে আনা।
পুতিন সম্পর্কে অনেক কিছু জানলেও যেসব বিষয় কখনো ঘাঁটাঘাঁটি হয় না এমন কিছু বিশেষ তথ্য আজ আমরা জানবো–
১. আভিজাত্যের অভাববোধ নেই
পুতিনের জন্ম ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর সেইন্ট পিটার্সবার্গ (আগের লেনিনগার্ড) শহরের একটি সাধারণ পরিবারে। তার নিজ ভাষ্য মতে, ‘আমি এসেছি একটা সাধারণ পরিবার থেকে।এক সাধারণ গড়পরতা মানুষের মতো বসবাস করেছি।’ তার মা ছিলেন কারখানার শ্রমিক ও বাবা যুদ্ধাহত নৌবাহিনীর সেনা (দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ)।
২. যুদ্ধাহত পিতার সন্তান
১৯৩০ সালে পুতিনের বাবা সোভিয়েত নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। প্রথমে তিনি সাবমেরিন বহরের একটি সাধারণ দায়িত্বে থাকলেও পরে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মানদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পুতিনের ভাষ্য মতে, ‘আমার বাবাকে ডেমলিশন ব্যাটালিয়নে পাঠানো হয়েছিল।’ একটি অপারেশনে পুতিনের বাবা নিজেদের যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করে ফেলে। ফলে তার বাহিনী খাদ্যাভাবে পড়ে এবং জার্মান সৈনিকরা তাদের কোণঠাসা করে ফেলে। তাদের বেঁচে ফেরার কোনো সুযোগই ছিল না। ২৮ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন বেঁচে ফেরেন। তাদের মধ্যে পুতিনের বাবা একজন। জার্মান গ্রেনেড বিস্ফোরণে পুতিনের বাবা তার পা হারাতে বসেছিলেন। পুরো পা না হারালেও বাকি জীবন পঙ্গুত্ব বরণ করে কাটাতে হয় তাকে।
৩. পোকামাকড়ের ঘরে আড়াই বছর
লেনিনগ্রাদ অবরোধের কালে তার ৬ সদস্যের পুরো পরিবার একটা সাধারণ দালানের পাঁচ তলায় ছোট ২০০ বর্গফুটের পোকামাকড়ে ভরা ঘরে চাপাচাপি করে বসবাস করত। ছোট্ট পুতিন তখন সারা দিন ছোট একটা লাঠি নিয়ে ইঁদুর তাড়া করতেন।
৪. লেনিন ও স্টালিনের বাবুর্চি দাদার নাতি
পুতিনের ওপর পুতিনের দাদা স্পিরিডন ইভানোভিচ-এর বেশ প্রভাব ছিল। পুতিনের দাদা ছিলেন দক্ষ রাঁধুনি। তিনি লেনিন এবং পরে স্টালিন-এর বাবুর্চির কাজ করেছেন। কাতুসা তার বই ‘দি কোল্ডার ওয়ার’-এ লেখেন, ‘তার দাদা দু’স্বৈরাচারের মধ্যেই বেঁচে ছিলেন। তা করতে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাতুরতার প্রয়োজন ছিল এবং ওই সামর্থ্য তার দাদার ছিল। দাদা তার রাজনৈতিক জ্ঞান নাতির কাছে পৌঁছে দেন। পুতিন অধীর আগ্রহে থাকতেন ওইসব শুনতে।’
৫. খামখেয়ালি শৈশব
পুতিন শৈশব থেকেই স্কুল বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়ে থাকতেন। ছাত্র জীবনে একবার তার প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে যান। পরে স্থানীয় পঞ্চায়েতে তার বিচার করা হয়।
৬. দীর্ঘ সংসারে ইতি
পুতিন বিয়ে করেন ১৯৮৩ সালে। কিন্তু তাদের ৩১ বছরের সংসার শেষ হয়ে যায় ২০১৪ সালে বিচ্ছেদের মাধ্যমে। তার স্ত্রী লুদমিলা পুতিন ছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ ও বিমানবালা। সাধারণত এজেন্টরা নিজের গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টি গোপন রাখলেও পুতিন এক্ষেত্রে তার স্ত্রীকে জানিয়ে দেন, তিনি কেজিবি এজেন্ট।
৭. ৩১ বছরের সংসারে ৩২ ও ৩৩ বছরের দুই কন্যা
পুতিনের দুই কন্যা রয়েছেন। বড় কন্যা মারিয়ার বয়স ৩৩ ও ক্যাটরিনার ৩২ বছর। তাদের কাউকেই জনসম্মুখে খুব একটা দেখা যায় না। দু’জনই সেইন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পুতিনের পরিবারের কোনো ছবিও সর্বসমক্ষে ছড়িয়ে পড়েনি। রাশিয়ার জনগণ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনো বিশেষ আগ্রহী হয়নি। কাতুসার মতে, রাশিয়ানরা তাদের নেতার গোপনীয়তায় বিশ্বাস করেন।
৮. চৌকস পুতিন
মাত্র ১২ বছর বয়সে পুতিন বক্সিংয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন এবং পরে জুডো, কারাতে ও সামবো নামে সোভিয়েত একটি মার্শাল আর্টে প্রশিক্ষণ নেন। ছোটবেলায় সমবয়সীদের থেকে কিছুটা ক্ষীণকায় ছিলেন। এটি পুষিয়ে নিতে তিনি বহুবিধ শারীরিকবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনে মনযোগী হন।
৯. হিউম্যান রিলেশনে স্পেশালিস্ট পুতিন
পুতিন এক সময় বুঝতে পারেন ওইসব দক্ষতা থাকলেও এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলে সামাজিক মর্যাদা আসবে না। যখন তিনি জানতে পারলেন দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি-তে যোগ দেয়ার অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে আইন শিক্ষা তখন আগ্রহী হয়ে ওঠেন আইন শিক্ষায়। ১৯৭০ সালে লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন এবং ৫ বছর পর আইনবিদ হিসেবে ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ২২ বছর বয়সে কেজিবিতে যোগ দেন এবং ১৬ বছর এর সঙ্গে থেকে তিনি হয়ে ওঠেন- তার ভাষ্য মতে, ‘হিউম্যান রিলেশনে স্পেশালিস্ট’।
১০. জার্মান ভাষায় দখল
পুতিন জার্মান ভাষায় বাকপটু ছিলেন। ওই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে পূর্ব জার্মানিতে গুপ্তচর হিসেবে পাঠানো হয় ১৯৮৫ সালে। সেখানে তিনি ৫ বছর কর্মরত ছিলেন। কাতুসা বলেন, ‘পুতিন ছিলেন মানুষকে পড়া এবং নিজের কাজে ব্যবহার করতে ওস্তাদ। রাশিয়ার রাজনীতির শীর্ষে উঠতে এটি ছিল অপরিহার্য গুণ।’
১১. পিএইচডিধারী পুতিন
বার্লিনের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয় ১৯৮৯ সালে এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই পুতিনের গুপ্তচর হিসেবে কাজ শেষ হয়। তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তার পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল, ‘রাশিয়ার অর্থনৈতিক সফলতা জ্বালানি সম্পদের (energy resources) ওপর নির্ভরশীল।’
১২. চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী সত্তা
পুতিনকে ১৯৯৯ সালে বোরিস ইয়েসিন তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। পুতিন তখন বলেন, ‘আমি যদি রাশিয়াকে ঝরে পড়া থেকে বাঁচাতে পারি তাহলে এটা গর্ব করার মতো কিছুই হবে।’ পরে তিনি দু’বার রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৮ সালে আবার প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে আসেন। ২০১২ সালে আবারও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। অন্যদিকে সম্প্রতি ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
১৩. হিসাব-নিকাশে টনটাইট
পুতিন সব সবময় প্রচণ্ড হিসাব-নিকাশ করে কাজ করেন। আমরা কথ্য ভাষায় এটিকে বলি ‘হিসাব নিকাশে টনটাইট’। কাতুসা সতর্কতা জানিয়ে বলেন, ‘পুতিন কোনো কাজ করার সময় স্বদেশের লাভ-ক্ষতি হওয়ার হিসাব-নিকাশ আগে করে নেন। এ কারণে তাকে অযথা খোঁচানো উচিত নয়।’
১৪. মিডিয়া বিদ্বেষী পুতিন
পুতিনের রাশিয়ায় অনেক সাংবাদিকের ভয়ঙ্কর ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয়। ‘দি গার্ডিয়ান’-এর পিটার প্রিস্টন লেখেন, ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পুতিনের কাছে কোনো অর্থবহ ব্যাপার নয়। আপনি তদন্ত করবেন? আপনি প্রতিবেদন করবেন? তো আপনি মরবেন।’
১৫. বিটলসভক্ত পুতিন
পুতিনের প্রিয় ব্যান্ড ‘দি বিটলস’। এতে তার প্রিয় শিল্পী পল ম্যাকার্টনি ও প্রিয় গান ‘ইয়েস্টারডে’।