যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বই প্রমাণ করে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে- এমনটা দাবি করেন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এন হাস। তার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি।
অবশ্য এটা মানি, রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার এবং কিছুদিন ধরে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কের এ তিক্ততা ওই ১৯৫০ সাল থেকে এখন সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে। কেউ কেউ বলছেন, ওই তিক্ততা ১৯৬২ সালের কিউবার মিসাইল সংকটকালের তিক্ততাও ছাড়িয়ে গেছে। পারমাণবিক অস্ত্র কৌশলের সংকট এবং এর নিরস্ত্রীকরণের কথা মাথায় রেখে কোনো তৃতীয়শক্তি ওই দ্বন্দ্বে ঘি ঢালতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।
ওই তিক্ততা আরো খারাপ পর্যায়ে যাওয়ার কারণ মূলত এই দু’পক্ষের মধ্যে কোনো যোগাযোগ কখনো তৈরি হয়নি। যা তৈরি হয়েছে তা শুধু অবিশ্বাস। মার্কিনদের কাছে রাশিয়া মানেই কেবল ঘৃণা। আর রাশিয়ানদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র মানেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের এক মুল্লুক।
আমি তো মনে করি, এখন ওই দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সহসাই স্নায়ুযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। কারণ স্নায়ুযুদ্ধে এক ধরনের আদর্শিক অবস্থান দরকার হয়। এটি পুতিনের রাশিয়ার নেই।
রাশিয়ার নতুন কোনো স্নায়ুযুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছাও নেই। যদিও আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছুটা পুতিন অবস্থান নিলে রাশিয়ার উচ্চ শ্রেণি ও জাতীয়তাবাদীদের বিশ্বাস জয় করতে পারেন তবুও রাশিয়া কোনো আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করে না। রাশিয়া যেটিতে বিশ্বাস করে তা হলো রুশ সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এটি তারা কোথাও রপ্তানি করতে চান না।
ক্রেমলিন এখনো বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে রাশিয়ার বগলদাবা করে রাখতে চায় না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান হলো প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। ওইসব জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে রাশিয়া। এছাড়া রাশিয়া বৈশ্বিক মূল্যবোধ যেমন খোদা, পরিবার, দেশ- এসবে বিশ্বাস করাকে সমর্থন জানায় এবং সমাজ ও জাতির জন্য সেবা করাকে উৎসাহ করে।
আমি বিশ্বাস করি, ২০১৬ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার ‘হস্তক্ষেপ’-এর অভিযোগের ২ শতাংশেরও বাস্তবতা নেই। এক রুশ হিসেবে বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রেরই বরং অন্যের দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের বহু প্রমাণ রয়েছে। তারা কাচের ঘরে বসে অন্যের ঘরে ঢিল দেন।
রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমিদের সম্পর্কের ওই টানাপড়েনের দায় খোদ পশ্চিমিদেরই। মার্কিনরা তাদের বহুমুখী দখলদারিত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব জায়গায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ খুঁজে বেড়ায়। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। বিশেষ করে সামাজিক গণমাধ্যমে যেখানে অসহিষ্ণু জনগণ এবং কোথাও ঠাঁই না পাওয়া রাজনীতিবিদরা শেষ আশ্রয় খুঁজে পায়।
অবশ্য মার্কিন ক্ষমতাসীন শ্রেণি তাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেও রাশিয়ার প্রতি অসহিষ্ণুতা থাকবেই। গত দশক ধরেই সারা বিশ্ব পশ্চিমিদের ৫০০ বছরের কর্তৃত্বের শেষযাত্রা দেখছে। এর শুরুটা ষোড়শ শতাব্দীতে যখন ইউরোপ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তার সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করতে শুরু করে। পরের দশকগুলোয় তাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে সামরিক হস্তক্ষেপ করে সারা বিশ্বের অর্থ-বিত্ত দখল করে নিয়েছে।
কয়েক দশক ধরে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পশ্চিমির কর্তৃত্বশালী অবস্থানকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে চলেছে রাশিয়া ও গণচীন। কিন্তু যখন সোভিয়েত-এর ভেতর থেকেই পতন হলো তখন যুক্তরাষ্ট্র একক কর্তৃত্বশালী হিসেবে হাজির হয় এবং ভয়ঙ্কর ‘স্টেটাস ক্যু’র জন্ম দেয়। পরে তারা একধাপ এগিয়ে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ভুল করে ২০০১ সালে ইরাক হামলা করে বসে। পরিণতিতে আসে ২০০৮ সালের ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক সংকট। তা আসলে একবিংশ শতকের পুঁজিবাদের সংকট প্রকাশ করে।
একই সময় আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা বেশ ক’বছর ধরে সর্বোচ্চ। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্যালিস্টিক মিসাইল চুক্তি ১৯৭২ একতরফাভাবে রদ করে দেয়। এমনকি তাদের প্রচলিত বাহিনীগুলোর সক্ষমতাও বাড়ানোর উদ্যোগ হাতে নিয়েছে এবং পারমাণবিক অস্ত্রগুলোর আধুনিকীকরণের ঘোষণাও দিয়েছে।
রাশিয়া, গণচীন সর্বোপরি বাকি দুনিয়া এ মুহূর্তে আমেরিকার ওই কর্তৃত্ব আবার ফিরে আসুক তা চায় না। পুতিন বেশকিছু আধুনিক অস্ত্র কৌশলের কথা বলে ওই বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। পুতিনের ওই ঘোষণাকে আমি মনে করি, মার্কিন কর্তৃত্বকে ‘স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুৎসাহিত’ করার কৌশল। এটি আসলে মার্কিন প্রশাসনের কাছে প্রেরিত এক বার্তা যে, তারা আগের অবস্থানে চাইলেও ফিরে আসতে পারবে না, এমনকি সোভিয়েতের মতো নিজের নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গ করতে চাইলেও নয়।
আমার সহকর্মীসহ আমরা ভেবে দেখেছি, আমেরিকা যদি একতরফা যুদ্ধেও যায় তাহলে রাশিয়া, গণচীন এবং আরো কিছু উঠতি পরাশক্তিদের সঙ্গে তাদের ওই লড়াই শুভ হবে না। বর্তমানের সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক ভারসাম্য এখন পশ্চিমিদের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
আসল কথা হলো, যদি কোরো স্নায়ুযুদ্ধ ঘটে তাহলে তা একতরফা হলেও পুরো মানব জাতির জন্য ভয়াবহ দুর্যোগ বয়ে আনবে। আমি মনে করি, পরাশক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যকার বিবাদ আলোচনা করে চুকিয়ে নেয়া উচিত। তা হতে পারে সামরিক বা নাগরিক যোগাযোগের নানান চ্যানেলের মধ্য দিয়ে। এছাড়া আমাদের আরো কূটনৈতিক, আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত অভিজ্ঞতার আদান-প্রদানের সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের একে অন্যকে অপশক্তি হিসেবে চিত্রায়িত করা বন্ধ করতে হবে।
নিঃসন্দেহে দিনের পর দিন বিপজ্জনক এক অধ্যায়ের দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই তাহলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হবো। বৈশ্বিক নানান সমস্যা সমাধানেও আমরা একে অন্যকে সাহায্য করবো। এছাড়া যাতে ছোট দেশগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে আরো উন্নতর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে ওই সুযোগ থাকাও জরুরি।
পশ্চিমি নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ব্যবস্থা আজ ধসে পড়েছে। এখন একটি সুশান্তির পৃথিবী প্রতিষ্ঠায় সবার সমান অবদানে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা হাজির করতে হবে।
সার্জেই কারাগানোভ মূলত মস্কোর ন্যাশনাল রিসার্চ ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস অ্যান্ড ফরেন অ্যাফেয়ার্স অনুষদের ডিন ও রাশিয়ার কাউন্সিল অন ফরেন অ্যান্ড ডিফেন্স পলিসির অনারারি চেয়ারম্যান। লেখাটি প্রকাশ করা হয় ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’-এ