‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’…
‘কতজনই এলো গেল কতজনই আসবে, কফি হাউসটা তবু থেকে যায়’…
দুটি লাইনের স্রষ্টা ভিন্ন দুই ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর গৌরী প্রসন্ন মজুমদার- দুই কিংবদন্তিকে অভিন্ন ফ্রেমে নিয়ে আসায় প্রশ্ন উঁকি মারাটা অতি স্বাভাবিক। তাদের এক ফ্রেমে অবশ্য আমি আনিনি। ‘তামিম ইকবাল খান’ নামক আরেক বঙ্গ সন্তান এনেছেন তার দৃঢ়তা, দুর্দম্যতা, সাহসিকতায়। অভিষেকের পর এক যুগ পেরিয়েছে, ওপেনিংয়ে যোগ্য সঙ্গীর অভাব কুরে কুরে নিশ্চয়ই খায় তাকে। তিনি তামিম বলেই হয়তো সেটি ডাউন দি উইকেটে এসে উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যান নিজের মতো করে, একা। দেশের সার্ভিস দেয়ার সময় আশপাশের আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের খেলাটাই খেলে যাচ্ছেন তিনি। কখনো নিজেকে ভেঙে, কখনো গড়ে।
তামিম ১৯৮৯ সালের ২০ মার্চ ইকবাল খান-নুসরাত খান দম্পতির ঘরে জন্মেছেন। চট্রগ্রামের সম্ভ্রান্ত খান পরিবারে জন্ম তার। জন্মের পর একটা সময় বুঝতে শিখেছেন চাচা ও বড় ভাইয়ের প্রিয় সবুজ প্রান্তরে তিনিও গা এলিয়ে দিতে চান। অগ্রজের হাতে হাত রেখে মাঠ চেনা, মাথায় চাচার আশীর্বাদে সাহসী হওয়া। একটা সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্ট্রাইক রেট শব্দটি শুনতে বড্ড বিলাসী ঠেকতো। মাটি কামড়ে কয়টা রান করতে পারলে তা নিয়ে হই চই বাধার ওই সোনালি শৈশবে তামিম ইকবাল কী ভাবতেন তা তখন কেবল তিনিই জানতেন। বড় হয়ে সবাইকে তা জানানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। লংকান ব্যাটসম্যান সনাৎ জয়াসুরিয়াকে আদর্শ মানেন। বাঁহাতি ওই তারকা ওপেনার ছিলেন ধুন্ধুমার। তামিম কেন তার ব্যতিক্রম হবেন? তাই ক্যারিয়ারের সকালে নরম সূর্যের আঁচে পেয়ে গেছেন ‘দুম দুম’ তকমা। সকালের সূর্য দিনের পূর্বাভাস দেয় না বলে ‘দুম দুম’ তামিম খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না।
লাল-সবুজ প্রথমবার গায়ে চাপান ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। মাত্র দুই ম্যাচ খেলেই ডাক পড়ে নবম বিশ্ব কাপের আসরে। এর আগের বছর শ্রীলংকায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্ব কাপ খেলে এসেছেন। মাত্র এক বছর আগের যুবক পরের বছর উত্তপ্ত কড়াইয়ে। পুড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। পুড়েছেনও। কিন্তু ছাই হয়ে উড়ে যাননি। লোহা পুড়ে সোনা হয়, তিনিও পোক্ত হয়েছেন। বিশ্ব আসরে ভারতবধ মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান সৈনিক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন, জানান দিয়েছেন অস্তিত্ব। তামিমকে ভারতীয় পেসার জহির খান ভুলবেন না কখনো। কচি এক বালকের ডরহীন চাহনি, ঔদ্ধত্যপনায় তুলাধুনা হওয়াটা এক অভিজ্ঞজনের কাছে মোটেই মধুর নয়। ওইসব নিয়ে ভাবতে তামিমের বয়েই গেছে! ৫৩ বলে ৫১ রানের ওই ইনিংসের রথে চেপে বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে যে ভ্রমণ শুরু করেছেন তা আজও অব্যাহত। মাঝে রানওয়েতে যাত্রাবিরতি নিচ্ছেন। প্রতি স্টপেজে রাখছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।
চট্রগ্রাম বিভাগীয় দলের হয়ে খেলা শুরু করা তামিম ইকবালের টেস্ট অভিষেক হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। অভিষেকেই অনন্য। দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৫৩ ও ৮৪ রান করে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান। এরপর সময় কেটেছে ক্যালেন্ডারে ২০১১। ইংল্যান্ডের লর্ডসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্ট শতক। অনার্স বোর্ডে নাম। এরপর ম্যানচেস্টার। ব্যাক টু সেঞ্চুরি। এখানেও প্রথম তিনি। কাজের স্বীকৃতি পেতে দেরি হয়নি। উইজডেন সাময়িকীর বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব মিলে যায়। ২০১২ সালে এশিয়া কাপ। শুরুর আগে তামিমকে ঘিরে বিতর্ক দানা বাঁধে। দলে নেই তিনি। বোর্ডপ্রধান চাচা আকরাম খানের পদত্যাগ। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দলে ফের। চাচার জোরে খেলেন কথাটা বাতাসে আরো ভারী হতে থাকে। কিন্তু তিনি তামিম। ভিন্ন ধাতুতে গড়া একজন। ততদিনে দুম দুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেকটা। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন। ওই সিরিজে টানা চার ম্যাচে চার ফিফটি- চার আঙুল দেখিয়ে সেলিব্রেশনে উপেক্ষার সমুচিত জবাব।
তামিমের রেকর্ডের ভাণ্ডরটা বেশ সমৃদ্ধ। তিন ফরমাটেই দেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিন ফরমাটেই শতক, টি২০-তে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। মমিনুলের আগে টাইগারদের মধ্যে টেস্টে দ্রুততম হাজার রান। কত কী, কত কী! গত কয়েক বছরে তামিমের প্রতিটি জন্মদিনের ঠিক আগে আগে টিম বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে একেকটি গল্প। কোনোটি হাহাকারের, কোনোটি উল্লাসে ফেটে পড়ার। ২০১৫ সালের ১৮ মার্চ বিশ্ব কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে বিতর্কিত পরাজয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল। ২০১৬ সালে দুই সতীর্থ তাসকিন-সানীর নিষেধাজ্ঞা। বন্ধুর পথ পেরোলে শেষটায় আলোর রেখা দেখা দেবেই। ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে উদিত হয় নতুন সূর্যের। শততম টেস্ট ম্যাচে জয়। লংকাবধের ওই ম্যাচ তামিম কেবল অংশ নেয়া ১১ জনের একজন হয়ে থাকেননি- প্রথম ইনিংসে ৪৯, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২ রান নিয়ে তৈরি করেছেন শক্ত ভীত যাতে দাঁড়িয়ে বাঘরা উড়িয়েছেন বিজয় কেতন। এবার আবার বেদনার বিষে নীল হয়েছেন। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালের ওই পরাজয় যদি আজ জন্মদিনের আনন্দে ভুলতে পারেন খানিক।
তামিম ইকবাল খান কখনো স্বভাবজাত, কখনো স্বভাববিরুদ্ধ। ডাউন দি উইকেটের প্রতি পদক্ষেপে সীমানা ছাড়া করেছেন উৎকণ্ঠা, অালিঙ্গন করেছেন ভালোবাসার।
‘যা কিছু মহান কীর্তি বাংলার ওপেনে হয়েছে চিরঅম্লান অর্ধেক তার করিয়াছে অনেকে, বাকিটা তামিম ইকবাল খান’
শুভ ২৯তম জন্মদিন অদম্য হিরো…