শ্রীলংকার স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শ্রীলংকাকেই দর্শক বানিয়ে খেলতে নামলো বাংলাদেশ-ভারত। দুই ভায়রার অমর কীর্তি হাথুরের দলের ওই বিভীষিকার কারণ। এদিন টসে জিতে বাংলাদেশকে প্রথমে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণে প্রথম থেকেই বাংলাদেশকে চেপে ধরেন ভারতের বোলাররা। শেষ পর্যন্ত সাব্বিরের সময়োচিত ৭৭ ও মেহেদীর ১৯ রানের ক্যামিওর ওপর ভরসা করে বাংলাদেশ স্কোর বোর্ডে জমা করে ১৬৬ রান। ওই স্কোরটাকেই যখন প্রায় যথেষ্ট প্রমাণিত করে ফেলেছিলেন বোলাররা তখন পুরো টুর্নামেন্টেই অসাধারণ বোলিং করা রুবেল যেন নিজেই ম্যাচটি তুলে দিয়ে এলেন ভারতের হাতে, শেষ দুই ওভারে যখন লাগে ৩৪ রান তখন তিনি একাই ২২ দিলেন। নিভে গেল বাংলাদেশের জয়ের আশার প্রদীপও। শেষ বলে ৫ রান, এমন সমীকরণে সৌম্যকে স্তব্ধ করে ভারতের অসাধারণ এক জয় এনে দিলেন কার্তিক। আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়লেন চোখে অশ্রু নিয়ে।
বিশ্ব কাপের ওই ম্যাচ ডাকাতির পর এশিয়া কাপের ফাইনালে হার, বেঙ্গালুরু-তে মুশফিককাণ্ড- এমনিতেই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই এখন বারুদে ঠাসা এক প্যাকেজ। সেটি যখন হয় ফাইনাল তখন উত্তেজনার পারদ কতটা চওড়া থাকে সেটি বোধ করি না বললেও চলে। শেষ বলে নিষ্পত্তি হওয়াটাই বলে দিচ্ছে ম্যাচটি কতটা উত্তেজনাকর ছিল। আফসোস একটাই, আরো একবার সম্ভাবনা জাগিয়ে হলো না ভারতবধ। নিহাদাস নিজেদের করে নিল শর্মা অ্যান্ড কোং।
ব্যর্থ তামিম, শিখলেন না লিটন-সৌম্য
পাওয়ার প্লেতেই ভারতের হাতে ম্যাচ তুলে দেয়ার অলিখিত মিশন নিয়েই যেন নেমেছিল বাংলাদেশ। শর্মার নেয়া সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণের দায় যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। আগের দুই ম্যাচে ব্যর্থ লিটন প্রথম কয়েকটা বল দেখে-শুনে খেললেও ধৈর্য রাখতে পারলেন না। এক প্রকার বিলিয়েই দিয়ে এলেন যেন নিজের উইকেটটি। টিকলেন না দলের অন্যতম ভরসা তামিমও। চাহাল জুজু-কে পাত্তা না দেয়ার প্রয়াশে ছয় হাঁকাতে গিয়ে ফিরলেন ১৫ রানেই। আর সৌম্য? বাদ দিন, আগেই তো বলেছি, তার দলে থাকাটা বাংলাদেশের চেয়ে প্রতিপক্ষের জন্য বেশি স্বস্তিদায়ক। পরিস্থিতি যেমনই হোক, অযাচিত শট খেলে দলের বিপদে ফেলে আসার জন্য যদি কোনো পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে তিনি রেকর্ড গড়তেন সেটি পাওয়ার ক্ষেত্রে।
চাহাল চালে পথহারা বাংলাদেশ
চাহালেই যেন হায়াত শেষ বাংলাদেশের ইনিংসের। সৌম্যের কথা বাদই দিন, বাংলাদেশের মূল দুই ভরসা তামিম-মুশফিককে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে ম্যাচের লাগামটা টেনে নিলেন নিজেদের দিকে। অবশ্য প্রশ্ন থাকে এখানে চাহালের নাজাকাত, নাকি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধৈর্যের অভাব- ঠিক কোনটি বাংলাদেশের বড় ইনিংস গড়ার তামান্নাকে ফানা করেছে? সকালের সূর্যই নাকি বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে। কথাটার সত্যতা প্রমাণের দায় নিলেন মাহমুদুল্লাহ। হ্যাঁ, যে রানটি নেয়ার খোয়াব সাব্বির দেখছিলেন সেটি হয়তো সঠিক ছিল না। কিন্তু স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে রিয়াদ যদি একটিবার চেষ্টাও করতেন তাহলে হয়তো পৌঁছে যেতেন ক্রিজে। কারণ বোলার ও কিপার- দু’জনের হাতই ছিল পিচ্ছিল। শেষ ৫ ওভারের জন্য সাব্বির-সাকিবে ভরসা রেখেই যেন বিদায় নিলেন আগের ম্যাচগুলোয় বাংলাদেশের জেতানোর মূল নায়করা। ৪ ওভারের স্পেলে ১৮ রানে ৩ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের মূল সর্বনাশটা করেছেন ওই লেগ স্পিনারই।
অমানিশায় আর্ষ হয়ে জ্বললেন শুধু সাব্বিরই
আচমকাই ব্যাটিং ভুলে যাওয়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র উজ্জ্বল ছিলেন আগের ম্যাচগুলোয় নিজেকে হারিয়ে খোঁজা সাব্বির রহমান। বহু আলোচনা সমালোচনার পরও ম্যানেজমেন্ট এদিনও তিন নম্বরে ভরসা খুঁজে সাব্বিরেই। শেষ পর্যন্ত শেষ পরীক্ষাতেই আস্থার প্রতিদান দিলেন তিনি। কাট, স্কুপ, পুল, ড্রাইভে জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন শংকরদের। ৭টি চার, ৪টি ছক্কায় করা ৭৭টি নিঃসন্দেহে তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস।
১৮ ওভার ২ বলে আউট হওয়ার আগে দলটিকে নিয়ে যান ১৫০ রানের কাছাকাছি। যেটিকে কাজে লাগিয়ে ৭ বলের ঝড়ে ১৯ রান করে মিরাজ দলকে পৌঁছে দেন ১৬৬ রানে। সব সমালোচনার জবাবে নিজের পাশাপাশি অর্ধশতক করিয়ে ছেড়েছিলেন শংকরকেও। দুই রানের জন্য রক্ষা পেলেও ম্যাচটি বাংলাদেশের পক্ষে আসলে শংকরের কাছে সাব্বির থাকতেন দুঃস্বপ্নের এক নাম হয়েই।
৫০-৫০ পাওয়ার প্লে
ছয় ওভারের চারটিই করলেন স্পিনাররা। এক সাকিব বাদে ব্যর্থ মেহেদী ও নাজমুল। মেহেদীর ক্যামিওর জবাব ব্যাট হাতেই যেন ফেরত দিলেন ধাওয়ান-শর্মা। ক্ষমা পাননি নাগিন নাচের উদ্ভাবক নাজমুলও। এরপরও পাওয়ার প্লেটাকে ৫০-৫০ বলার কারণ, ওই ৬ ওভারেই বাংলাদেশ তুলে নিয়েছে ধাওয়ান ও রায়নার কাঙ্ক্ষিত দুটি উইকেট। গতিতে বিভ্রান্ত করে বদলি ফিল্ডার আরিফুলের চমৎকার ক্যাচে পরিণত করে শিখরকে সাকিব পরিণত করলেন নিজের প্রথম শিকারে। দ্বিতীয় উইকেটটিতে রুবেলের চেয়ে বেশি অবদান রায়নার। অহেতুক ওয়াইড, বলে বলে ব্যাট চালিয়ে মুশফিকের গ্লাভস বন্দি হয়ে কোনো রান করার আগেই প্যাভিলিয়নে রেস্টে চলে যান রায়না। তবে ওই উইকেটের পেছনে মুশফিকের অবদানও কম না। আম্পায়ার ওয়াইডের সংকেত দিলেও প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেটি চ্যালেঞ্জ করেন মুশফিক। এতেই দেখা যায়, মুশফিকের হাতে জমা পড়ার আগে ব্যাটে হালকা চুমু খেয়েছে ব্যাট। এ দুটি উইকেট বাদ দিলে পাওয়ার প্লে পুরোটাই শর্মাময়।
শর্মা সরণিতে লক্ষ্যের পথে ভারত : অতঃপর নাগিনের দংশন
ধাওয়ান-রায়নার বিদায়ের পর ম্যাচ জেতানোর পুরো দায়টাই যেন বর্তায় ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক রোহিত শর্মার ওপর। শুরুতেই ঝড় তোলা শর্মা সময়ের দাবি মেনে সংযত কিন্তু আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে এগিয়ে নিতে থাকেন ভারতকে। কিন্তু যাত্রাপথের মধ্যিখানেই তাকে দংশন করেন নাগিন নাচের জন্য বিখ্যাত নাজমুল। মাঝের ওভারগুলোয় চেপে ধরা বোলিংয়ের জবাব বাউন্ডারিতেই খুঁজছিলেন শর্মা। শেষ পর্যন্ত সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। প্রেমাদাসা আরো প্রেমময় হওয়ার আগেই নাগিন নাজমুলের দংশনে সমাপ্তি ঘটলো শর্মার ৫৬ রানের ইনিংসটির।
আবারও ওই ফিল্ডিং ব্যর্থতা
লংকার বিপক্ষে ম্যাচে বোলারদের চেপে ধরা রাশ আলগা করে দিয়েছিল শ্লথ ফিল্ডিং ও বাজে থ্রো ইন। উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ভারতের বিপক্ষেও। একাধিকবার ভারতের ব্যাটসম্যানরা মধ্যক্রিজে থেকেও বেঁচে গিয়েছেন বাজে থ্রো ইন-এর কল্যাণে। যতটি সুযোগ এসেছিল এর দুটিও যদি কাজে লাগাতে পারতো বাংলাদেশ তাহলে অনেক আগেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ভারত। ক্যাচিংয়ে উন্নতি হলেও গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ের দৈন্যদশা যেন কাটছেই না।
এমন মোস্তাফিজকেই তো চায় বাংলাদেশ
শেষ তিন ওভারে যখন ৩৫ রান লাগে তখন সাকিব বেছে নিলেন নিজের সেরা অস্ত্র মোস্তাফিজকে। আর তিনি যা করলেন, কোন শব্দে ব্যাখ্যা করবেন সেটিকে? শংকরকে চোখে শর্ষে ফুল দেখিয়ে টানা ৪টি ডট আদায় করে নিলেন ফিজ। তার ওই ঝাঁঝেই যেন পথ হারালো ভারত। পড়িমড়ি করে ছুটে একটি লেগ বাই আদায় করে পান্ডেকে দিলেন স্ট্রাইক। ছন্দে থাকা ফিজে যেখানে চোখে আঁধার দেখেন কোহলিও সেখানে পান্ডের কী সাধ্য মোস্তাফিজের সাওয়ালের জওয়াব দেওয়ার? লং অনে সাব্বিরকে ক্যাচ প্র্যাকটিস করিয়েই যেন বিদায় নিতে বাধ্য হলেন তিনি।
অনন্য রুবেল-ভিলেইন রুবেল
পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে একেক সময় একেকজন জ্বলে উঠলেও বল হাতে পুরো নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশের হাইলাইটস যেন রুবেলের বোলিংই। গত ম্যাচেই শেষ ওভারে অসাধারণ বোলিং করে লংকাকে যেমন বেঁধে রেখেছিলেন ধরাছোঁয়ার মধ্যে তেমনি এ ম্যাচের শুরুতেই দু’বার আঘাত হেনে টলিয়ে দেন ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। প্রথমেই অভিজ্ঞ রায়না, এরপর বিপজ্জনক হয়ে উঠতে থাকা রাহুলকে নিজের রুদ্রমূর্তি দেখিয়ে দেন ওই পেসার। মোস্তাফিজের ওই অসাধারণ ওভারের পর যখন জয় দেখছে বাংলাদেশ তখনই দিনেশ কার্তিকের কারিশমায় পথ হারালেন রুবেল, হতাশার অনলে পুরলে পুরলো বাংলাদেশ। ২টি ছয় আর ২টি চারসহ ২২ রান দিয়ে ম্যাচটি তুলে দিলেন ভারতের হাতে। নায়ক হওয়ার সব আশা জাগিয়ে পরিণত হলেন ভিলেইনে।
কাজে এলো না শেষ ওভারের জুয়া
আগেই মোস্তাফিজ-রুবেল-সাকিব-নাজমুলরা বোলিংয়ের কোটা শেষ করে ফেলায় সাকিবের হাতে অপশন বলতে ছিল মেহেদী আর সৌম্য। প্রথম ওভারেই ১৭ দেয়া মেহেদীর বদলে সাকিব খেললেন সৌম্যকে নিয়ে জুয়া। পঞ্চম বলে শংকরকে ফিরিয়ে দিয়ে জুয়াটা প্রায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ বলে ৫ রানে সমীকরণ। ওই কঠিন অবস্থায় আর পারলেন না মাথা ঠাণ্ড রাখতে। হাফভলিকে কাভার দিয়ে সীমানা ছাড়া করে কার্তিক শুধু সৌম্যকেই নয়, কাঁদালেন পুরো বাংলাদেশকেই।
হার-জিত খেলারই অংশ। যেভাবে টাইগাররা বুক চিতিয়ে লড়েছে এতে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করেই মাঠ ছাড়া যায়। কিন্তু এ প্রবোধে কোনো কাজ হচ্ছে না। মোস্তাফিজের অমন অসাধারণ ওভারের পর রুবেল বোলিং- ব্যাখ্যাতীত। পুরো টুর্নামেন্টে কীর্তি মুছে দেয়ার জন্য ওই ওভারটিই যথেষ্ট। জীবনটাই এমন- নায়ক থেকে ক্ষণিকের ভুলে মুহূর্তেই পরিণত হওয়া খলনায়কে। যত ব্যাখ্যাই করুন, ভারতবধ এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অন্যতম কাঙ্ক্ষিত একটি দৃশ্য। এত কাছে এসেও খেলাটা ভারতের হাতে তুলে দেয়ার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না বাংলাদেশের অন্যতম অভিজ্ঞ ওই বোলার।
আর সাকিবের দোষ দেবেন? সঠিক সময়ে সঠিক বোলিং পরিবর্তনে ম্যাচে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনিই। রুবেলের ওই ওভারের ২২ না এলে রাতটা হতো বাংলাদেশেরই। ডেথ ওভারগুলোয় নিয়মিত বোলিং করা রুবেল যে একদম কাঙ্ক্ষিত সময়েই অনাকাঙ্ক্ষিত বোলিং করবেন এটি কে-ই বা ভেবেছিলেন?
এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে, এবার ভারতের বিপক্ষে- ফাইনালের শেষ ওভারটা যেন এক প্রকার পরিহাসেই পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য।