সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত চীন তার ক্ষমতার জোর বাড়াচ্ছে। ফলে এশিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যুগ যুগ ধরে চলা একপক্ষীয় ক্ষমতার খুঁটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। তাই ওই দুই পরাশক্তির মুখোমুখি অবস্থান এ মহাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।
গত সপ্তাহে ১১টি দেশ (জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ) একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করে যেটিকে বিশেষজ্ঞরা আমেরিকার নেতৃত্বে চীন বিরোধী নতুন জোট হিসেবেই দেখছিলেন। কিন্তু পরে খোদ যুক্তরাষ্ট্র ওই চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসলে ট্রাম্পের দেশকে ছাড়াই ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ওই ঘটনাটি এশিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্ব যে নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে এর প্রতিফলন।
এদিকে চীন বনাম আমেরিকার দুনিয়ার সবচেয়ে জনবহুল মহাদেশ কেন্দ্র করে নানান চেষ্টা ওই মহাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপটিকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন এনে দিচ্ছে।
আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা এখনো এশিয়ায় বেশ প্রভাব রাখছে। অন্যদিকে চীন তার সামরিক ও অর্থনৈতিক নানান সুবিধা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের মিত্র ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়াকে পর্যন্ত বাগে এনে পুরো এশিয়ার বিন্যাস বদলে দিচ্ছে।
ওই বিন্যাসের পরিবর্তন আরো ত্বরান্বিত করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ভারসাম্যহীন পররাষ্ট্রনীতি ও নানান ব্যবসায়িক চুক্তির স্বাক্ষরে অসম্মতি এশিয়ার দেশগুলোর নতুন মিত্রের খোঁজ করতে বাধ্য করছে।
গত সপ্তাহের ট্রাম্পের অস্বাক্ষরিত বাণিজ্যিক ওই চুক্তিটিই বলে দিচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান কীভাবে মার্কিনমুখী হয়ে পড়ছে। ওই চুক্তি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ নামক চুক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। এ চুক্তিটিও ট্রাম্পের কারণে সম্পন্ন হয়নি।
এই মুহূর্তে এশিয়ার সব দেশ চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাড়াচ্ছে। হয় আমেরিকা, নয় চীন- এ ধরনের ভারসাম্যহীন নীতির কারণে চীনের ব্যবসা বাড়ছে।
এশিয়ার জাতীয় নেতারা জানেন, তাদের দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি অনেকটাই বেইজিংয়ের ওপর নির্ভর করছে। এছাড়া চীন দেখিয়েছে, তারা কীভাবে বন্ধুদের দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং অন্যদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নানান চাপ সৃষ্টি করে।
ক্ষমতার প্রভাব ও সামরিক সরঞ্জামাদি বিক্রির ক্ষেত্রে এখনো আমেরিকা ব্যাপক প্রভাবশালী। ফলে যেসব দেশ আমেরিকা থেকে অস্ত্র কিনছে তারা তাদের সামরিক ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আমেরিকার আদেশ-উপদেশ আমলে নিতে বাধ্য থাকে। তাই ওই ভারসাম্যহীনতা এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক সম্পর্কেও প্রতিফলিত হচ্ছে। এর শুরুটা মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে।
এশিয়ার ২০টির বেশি দেশ নতুন ফ্যাসাদে আটকে গেছে- তারা চীনের বেশুমার পুঁজির পক্ষে যাবে, নাকি যুক্তরাষ্টের নিরাপত্তার পক্ষে! ফলে তাদের নীতি বেইজিং, নাকি ওয়াশিংটন- এ দুইয়ে আটকে আছে নানানভাবে।
‘তারা কোনো পক্ষ নিতে রাজি নয়’ বলে মনে করেন ব্রুকিংস ইনস্টউটিশন-এর এশিয়া বিশেষজ্ঞ তানভি মদন।
তারা যে কোনো একটি দেশ বেছে নেয়ার পরিবর্তে দু’দেশের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার নীতি নিয়েছে যেখানে আবার নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে ওই দুই দেশ চীন-আমেরিকাকে কোনো প্রকার উত্তপ্তও করা হবে না।
এর ফল স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের পরিণতি থেকে আলাদা হবে যখন সমগ্র ইউরোপ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে এশিয়ার ক্ষেত্রে ওই দলের সংখ্যা অনেক হবে। উদাহরণস্বরূপ- চীন বিরোধী, চীনের বন্ধু ও চীনের সঙ্গে সমঝোতাকারী।
ওই নীতিতে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয় এবং আগামী দিনের ‘চীন বনাম আমেরিকা বিশ্ব’ পরিস্থিতিতে কীভাবে কোন দেশ টিকে থাকবে এর একটি মডেলও হাজির করা যাবে।
অবশ্য চীনের প্রভাবে বিশ্ব ব্যবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। তবে জাপান বার বার তার নিজস্ব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে চীনকে জানান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক ক্ষমতাশালী হতে আরো কত কাঠখড় পোড়াতে হবে চীনকে।
চীনকে পাল্লা দিতে জাপান তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপান তার অর্থনীতি এবং নানান চেষ্টা দিয়ে স্বাধীন সামরিক শক্তি ও কূটনৈতিক তোড়জোড় বাড়িয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেকে হাজির রাখছে।
জাপান এক্ষেত্রে তার বিরাট অর্থনীতি নিয়ে চীনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যদিও এশিয়ার বাকি দেশগুলো জাপানের মত বৃহৎ অর্থনীতির দেশ নয় তবুও তারা এক্ষেত্রে জাপানের পাশে দাঁড়াতে পারে। সরাসরি আমেরিকার শত্রুভাবাপন্ন না হয়ে কীভাবে টিকে থাকতে হয় এর নমুনা জাপান।
এই মুহূর্তে চীনের জন্য বেশকিছু খারাপ খবর আছে। চীনের এক সময়ের বন্ধু উত্তর কোরিয়া উদার হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বোমা ও মিসাইলগুলোও নানান সময় বেইজিংকে বিব্রত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি চীনের প্রতিযোগী জাপানকে তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতেও কাজ করেছে উত্তর আমেরিকা। এছাড়া উত্তর কোরিয়া অর্ধশতাব্দীকালের বন্ধু চীনকে ছেড়ে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করতেও প্রস্তুত। ফলে বেইজিং যদি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ঠিকঠাক রাখতে না পারে তাহলে এশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চীনকে অনেক বিপত্তির মুখোমুখি হতে হবে।
শ্রীলংকাকে এতদিন এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্ব দিয়ে কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে সেখানে উন্নয়নের নতুন ঢেউ এশিয়া পর্যবেক্ষকদের নজর কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগের সাবমেরিন যখন শ্রীলংকার বন্দরে হাজির হয় তখন থেকে। এটি চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা থেকে সামরিক শক্তিতে পদার্পণের ক্ষেত্রেও আলোচিত একটি নজির।
পুরো এশিয়ায় চীনের অবকাঠামোগত নানান প্রকল্প সবদিকে চোখে পড়ছে, বিশেষ করে কৌশলগত এলাকা ও ট্রানজিট করিডোরগুলোয়। এসব প্রকল্পের অনেকটিই সম্মিলিত হলেও শেষমেশ চীনের হাতেই সফল হয়। ডিসেম্বরে বন্দর নির্মাণের খরচ পরিশোধ করতে না পারায় শ্রীলংকা চীনকে ওই বন্দর ৯৯ বছরের লিজে দিয়ে দেয়।
ইয়েল আইন স্কুলের এশিয়ার নিরাপত্তা গবেষক মিরা র্যাপ হুপার বলেন, ‘চীন তার অবারিত শ্রম সুবিধা, পুঁজি ও প্রকল্পে কাজ করার সক্ষমতার যথাযোগ্য ব্যবহার করছে।’ চীনের প্রভাব মূলত সেসব দেশেই ব্যাপক যেখানে মার্কিন রাডারের প্রভাব কম বলে তিনি মনে করেন।
ছোট ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য চীন একটি উল্লেখযোগ্য মডেল বলেই মনে করেন অনেকে। এমনকি যেখানে মার্কিন প্রভাব ব্যাপক সেখানেও চীন তার খেলা দেখাতে পিছপা হয়নি। যেমন- পাকিস্তান। এখন সে তার প্রভাব এশিয়ার সীমানা গলিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ছোট ও গরিব দেশগুলো ধনী দেশগুলোর তুলনায় কম প্রভাবশালী হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ঘিরে গণতন্ত্র প্রশ্নে নানান সংকট দেখা দিতে পারে। এরপরও বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সফলতা তাকে আরো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রস্তুত করতে পারে। চীন তার পুঁজি ও বাণিজ্য দিয়ে ভারতের সব প্রতিবেশীকে নিজের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে চীনের গোপন লক্ষ্য মূলত চীনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর আগেই ভারত ঘিরে ফেলা। এতে চীনের বিরুদ্ধে যাওয়ার আগেই ভারত তার প্রতিবেশী তৈরিতে নজর না দিলে সে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রনেতাই এখন পক্ষ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ফিলিপিন্স-এর রাষ্ট্রপতি দুতের্তে তাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে।
২০১৬ সালের পর থেকে দুতের্তে আওয়াজ দেন আমেরিকার সঙ্গে ৬৫ বছরের সম্পর্কে পরিসমাপ্তি টানতে পারেন। এরপর পরই চীনে সফর করে চীনের সঙ্গ উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং পরে বারাক ওবামাকে নিয়ে নানান সময় কটূক্তি করে পক্ষ পরিবর্তনের আওয়াজও দেন তিনি।
ওইসবের পরও দু’পক্ষই দুতের্তে-কে ছাড় দেয়। যুক্তরাষ্ট্র যেমন দুতের্তে-র দেশে নিরাপত্তার স্বার্থে নানান বিপত্তি কমাতে এগিয়ে আসে তেমনি চীন ফিলিপিন্সের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ ও বিনিয়োগ চুক্তি বিষয়ে কথা বলার প্রস্তাবও করে।
ওই ধরনের ঘটনাই পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলছে যেখানে চীনের এ রকম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বেইজিং ভেবেছিল, তারা ছোট দেশগুলোয় তাদের প্রভাব চরম পর্যায়ে রাখতে পারবে। অন্যদিকে ওয়াশিংটন ভেবেছিল, তারা সব দেশে চীন বিরোধী শক্তিদের পাশে রাখবে। কিন্তু ওই দুইয়ের মাঝখানে সব দেশ মধ্যমপন্থা বেছে নিয়েছে।
অন্যদিকে ভিয়েতনাম যাদের চীন বিরোধিতার লম্বা ইতিহাস আছে তারা একই সঙ্গে চীন ও মার্কিন প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করেই এগোচ্ছে। ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে বারাক ওবামা ভেবে ছিলেন, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হবে। অথচ এখন পর্যন্ত ভিয়েতনামে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রপ্তানি করে রাশিয়া।
ওইসব কারেণে বোঝা যায়, যেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব উঠিয়ে নিচ্ছে সেখানেই চীন তার লাল পতাকা পুঁতে দিচ্ছে। র্যাপ হুপার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে চীনা প্রভাবের দিকেও নজর দেয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ রক্ষায় তারা সর্বোচ্চ মিত্র হিসেবে আছে। কিন্তু চীনের পুঁজি থেকে মুখ ফেরাতে তাদের নানান সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ফলে এসব এখন নতুন পরীক্ষা হিসেবে হাজির হয়েছে।
ওই সমীকরণের আরেকটি ভবিষ্যৎ হতে পারে- এসব দেশ দুটি পরাশক্তি থেকেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন করতে পারে। ফলে সামনে এশিয়ায় ওই দুই পরাশক্তির পক্ষে কাউকে শত্রু কিংবা মিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন হবে।
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ ম্যাক্স ফিশার-এর বিশ্লেষণ অবলম্বনে