বর্তমান সময়ে ন্যায়বিচার চাওয়া একটি কৌশলগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ আল্লাহ তায়ালা এটিকে একটি ফরজ বিধান হিসাবে পালনের আদেশ দিয়েছেন। আমরা দেখার চেষ্টা করবো, কিভাবে ন্যায়বিচার আমাদের জন্মগত স্বভাব ও দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। আমি দেখানোর চেষ্টা করবো, কিছু মানুষ তাদের জীবন ও কর্মের মাধ্যমে কিভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। যদিও তাদের বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন ছিল, কিন্তু কাজের ধরণ প্রায় একই ধরণের ছিল। ম্যালকম এক্স এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র হলেন এক্ষেত্রে সেরা উদাহরণ। কারণ তারা দেখিয়েছেন কীভাবে ধর্ম প্রত্যেক মানুষের সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন–
আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখো। [ সুরা নাহল ১৬ : ৯০ ]
ইবনুল কাইয়্যুম (র:) বলেছেন–
আল্লাহ তায়ালা শরিয়তের মাধ্যমে তার বান্দাদের মধ্যে ন্যায়বিচার এবং জনগণের মধ্যে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন, ফলে এটা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। যে যেভাবেই ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করুক না কেন, তা ধর্মেরই অংশ হবে। [সুত্রঃ আল-উরূক আল-হিকমিয়াহ ১৩]
আর এর কারণ হচ্ছে, পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কুরআন শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, এটা সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত স্বরূপ। হাদীসে এসেছে–
আনাস ইবনে মালিক (রা:) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা:) বলেছেন, “মজলুমদের বদদোয়া থেকে সাবধান থাকো, এমনকি সে যদি কাফেরও হয়, কারণ মজলুম আর আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। [সূত্রঃ মুসনাদে আহমাদ ১২১৪০, হাদিসটি সহীহ]
ইতিহাসবিদ রেভ লুইস বেলডউইন বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমেরিকা অনেকগুলি মহানায়ক পেয়েছে, এর মধ্যে ম্যালকম এক্স ও মার্টিন লুথার কিং অন্যতম। যারা দু’জনই আফ্রো-আমেরিকান বংশোদ্ভূত এবং তাদের উভয়ের ধর্মবিশ্বাস ছিল আলাদা; একজন ছিলেন মুসলিম এবং অন্যজন ছিলেন খ্রিস্টান। তারা উভয়ে তাদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে, আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তাদের ধর্ম আলাদা হলেও তাদের কর্মের পার্থক্য ছিল সামান্যই। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মার্টিন লুথার কিং মরিহাউজ কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন। সত্যিকার অর্থে তিনি প্রায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত কোন সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হননি। অন্যদিকে, ম্যালকম এক্স মিশিগানের ডেট্রয়েটে একটি নাজুক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ও জরাজীর্ণ রাস্তাঘাটের মধ্যেই বেড়ে ওঠেন এবং তাকে জেলখানায়ও থাকতে হয়। উভয়েই মানুষের ন্যায্যতা ও সমতার পক্ষে কথা বলেছেন, যদিও তারা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেননি।
দুইজনের মধ্যে মার্টিন লুথার কিং ছিলেন উদারবাদের আলোকে গ্রহণযোগ্য, কারণ তিনি জাতীয়তাবাদকে কাছে টেনে নিয়েছেন। সে ম্যালকম এক্স থেকে কম র্যাডিক্যাল ছিলেন। রেভ লুইস বেলডউইন বলেন, “তিনি (ম্যালকম এক্স) অধিক রেডিক্যাল ছিলেন মানে হচ্ছে, তিনি অহিংস ছিলেন না; কিন্তু মার্টিন লুথার কিং কখনই অহিংস পথ ত্যাগ করেননি।” যেখানে তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান, যার শুধু সাদা বর্ণের আমেরিকানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার নীতি দরকার ছিল, সেখানে ম্যালকম এক্স নিজেকে একজন আমেরিকান বলে স্বীকারই করেননি। (‘দ্য ব্যালট অর দ্য বুলেট’ বক্তৃতা, এপ্রিল ৩, ১৯৬৪, ক্লিভল্যান্ড, ওএইচ; ম্যালকোল এক্স এর বক্তৃতা, সিএইচ.৩, ১৯৬৫)
কোন ব্যক্তির ইমেজকে আরও কার্যকরীভাবে ফুটিয়ে তোলার ঝোঁক মানুষের মধ্যে আছে, কার্যকরীভাবে ফুটিয়ে তোলা বলতে আমি বোঝাচ্ছি, আমরা ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ইমেজের যে কোন পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে পারি। মার্টিন লুথার কিং বর্তমানে আমেরিকার একজন কৃষ্ঞাঙ্গ আইকন, অথচ আমেরিকানরা ম্যালকম এক্সকে কোন ধরণের উদযাপনে রাখেনি। যদিও আমরা এটাকে “বর্ণবাদ থেকে মুক্তি” ও স্বপ্নপূরণ হিসাবে ভেবে খুশি থাকি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি যে, এটি একটি রাজনৈতিক শত্রুতা, দরিদ্রের প্রতি শোষণ এবং বস্তুবাদের ধ্বংসাত্মক ব্যাধি। এ অবস্থা জানলে মার্টিন লুথার কিং নিজেও ক্ষুব্ধ হতেন। আবার আমাদের অধিকাংশ সমাজ সংস্কারকগণ মনে করেন, তিনি মৃত্যুর পরে মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছেন।
কিন্তু তিনি আসলে ঠিক কী চেয়েছিলেন সেসব নিয়ে ১৯৬৭ সালের ৮ মে কথা বলছিলেন এনবিসি নিউজের প্রাক্তন রিপোর্টার, স্যান্ডার ভ্যানোকার বলেন, “যারা বর্তমানে লুথার কিং-এর কাজকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন তাদের অনেকেই ষাটের দশকে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারা তার আসল কাজকে মোডিফাই করে নিজেদের উপযোগী করে নিয়েছেন। এখনকার সময়ে আমরা তার বিখ্যাত ভাষণ “আই হ্যাভ এ ড্রিম…” শুনে স্তব্ধ হয়ে যাই, অবশ্যএই ভাষণের বিষয়বস্তুকে উপেক্ষা করে এর কিছু বছর পরেই সেলমা মার্চ এবং ওয়াটস এর দাঙ্গা সংগঠিত হয়। ফলে লুথার কিং এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “তার স্বপ্ন এখন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে”।
ম্যালকম এক্সও মার্টিন লুথার কিং উভয়ে ন্যায্যতার জন্য লড়াই করেছেন, কিন্তু একজনকে ব্যাপকভাবে স্মরণ করা আর অন্যজন শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকে সামান্য পরিসরে উল্লেখিত হন। তারা উভয়ে তাদের ধর্মের অনুগামী ছিলেন এবং ম্যালকম এক্স জানতেন ধর্মের সাথে তার কোন আপস নেই।
ম্যালকম এক্স কখনোই আমেরিকার আইকনে পরিণত হবেন না, কারণ তিনি শ্বেত শাসিত এলাকা ও লিবারেল এলিটদের অস্বীকার করেছিলেন। ম্যালকম এক্স তার অনুপযুক্ত সময়ে বেড়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন সুবিধা বঞ্চিত, তবুও এখন আমাদের দ্বারা তার এসব সঙ্কট ওভারকাম করা সম্ভব। তিনি আইন পাশের মাধ্যমে নামমাত্র সমতা চাননি, তিনি কালো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। শাসকগোষ্ঠীর জন্য এর চেয়ে আর কোন ভয়ঙ্কর বিষয় হতে পারে না যে, একজন ভয়হীন নেতার নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ ন্যায়বিচারের দাবি করবে। আর ইসলাম অনুসারে এটাই ন্যায়বিচার।
মহান আল্লাহপাক বলেন–
হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে (জেনে রেখো) আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত। [ সুরা নিসা ৪:১৩৫ ]
সূরা মায়িদায় আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন–
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত। [ সুরা মায়েদা ৫ : ৮ ]
ইমাম কুরতুবি তার তাফসীরে বলেন–
এই আয়াতে দলীল দেয়া হচ্ছে যে, কাফেরদের তাদের কুফুরি কর্মের জন্য ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
ম্যালকম এক্স আল্লাহ পাকের এই আদেশ যথাযথভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সে অনুসারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রত্যেকের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়। ড. হাতেম ইল-হাজ্জ অনেক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, “যখন ভাল কিছুর জন্য কাজ করবে, তখন ভাববে না কে তোমার সহযোগী, কারণ দ্বীন প্রশ্নে তুমি কখনো কারো সাথে শেষ পর্যন্ত আপস করতে পারবে না।”
ম্যালকম এক্স সৌদি আরব, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ করেন এবং মনে করেন মানুষের মাঝে সমতা বিধান করা অবশ্যই সম্ভব। বৈচিত্র্য, একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ, এমনকি কিছু বিষয় ছিল যা তিনি নিজ দেশে ফিরে আর কখনো দেখেননি, ফলে তিনি সত্যিকার অর্থে ইসলাম গ্রহণ করেন। মার্টিন লুথার কিংয়ের ওপর ম্যালকম এক্স এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ম্যালকম এক্স ১৯৬৫ সালে গুপ্তহত্যার শিকার হন, মার্টিন লুথার কিংও এর কয়েক বছর পরে গুপ্তহত্যার শিকার হন। তারা উভয়ে কথা বলে গেছেন; মানুষ তাদের কথা শুনেছে, তারপর তারা দু’জনেই নীরব হয়ে গেছেন। ‘ন্যায় ও সাম্য’ প্রতিষ্ঠা শাসক শ্রেণীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা উভয়েই তাদের বিশ্বাস দ্বারা শক্তিশালী হয়েছেন, মানুষের মানসিকতার আশ্চর্যজনক পরিবর্তন করেছেন। আফ্রো-আমেরিকানদের মানসিক দৈন্যতা পরিহার করে নিজেরা নিজেদেরকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন, আফ্রো-আমেরিকানদের অধিকার আদায় করেছেন, যেমন এর পূর্বে তাদের ভোট ও সাংবিধানিক কোন অধিকার ছিল না।
‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ খ্যাত ভাষণটি মার্টিন লুথার কিং গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ৫ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে দিয়েছিলেন। আমেরিকান সংস্কৃতিবিদরা এই ভাষণটি শুনে স্তব্ধ হয়ে যান, কিন্তু এই ৫ বছরে কি ঘটেছিল? মার্টিন লুথার কিং সেটাই দেখতে শুরু করেছিলেন যা ম্যালকম এক্স দেখে গিয়েছিলেন এবং তিনি তার মতাদর্শিক জায়গা থেকে শিক্ষা নিতে শুরু করেছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে বড় কিছু অর্জিত হলেও সাংস্কৃতিক পরিসরে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। লুথার কিং পরবর্তীতে ম্যালকাম এক্স এর দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্ন্তদৃষ্টির তারিফ করেন। বিশেষত লস এঞ্জেলস এর বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার পরে।
লুথার কিং পরবর্তীতে ম্যলকাম এক্স এর ভাষাকেও গ্রহণ করেছিলেন, তিনি সংখ্যালঘু এলাকাকে একটি “অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক ব্যবস্থা” হিসাবে অভিহিত করেন। লুথার কিং বলেন, বস্তি ধরে রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাদের কোন ক্ষমতা ও শক্তি নেই তাদের আবদ্ধ করে রাখা। বস্তি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের চেয়ে একটু ভালো অবস্থা যার বাসিন্দাদের উপরে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা যায়, যেকোনো মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন ও অপমানিত করা যায়। লিবারেল গোষ্ঠীর একটা অংশ আছে যারা মার্টিন লুথার কিংকে প্রমোট করে কিন্তু তারা চায় না যে, আপনি তার এই দিকটা নিয়ে চিন্তা করেন যা তাদের লিবারেলগিরির বিরুদ্ধে যায়। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, “আমারা অবশ্যই সেই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হব যে, ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং রিপাবলিকান পার্টি উভয় দ্বারা আমরা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হব।” গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পূর্বে মার্টিন লুথার কিং ডেমোক্রেটিক পার্টি ত্যাগ করেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সাংস্কৃতিক উন্নতির মাধ্যমে আমাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে, আইনের মাধ্যমে নয়।
“ফ্রম সিভিল রাইটস টু হিউম্যান রাইটস : মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এন্ড দ্য স্ট্রাগল ফর ইকোনোমিক জাস্টিস” বইয়ের লেখক থমাস জ্যাকসন, যিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ বিভাগ থেকে লুথার কিং-এর ভাষণ শুনেছেন। জ্যাকসন বলেন, “১৯৬৪ সালের শুরুর দিকে তিনি দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।” জ্যাকসন আরও বলেন, “এছাড়াও একজন নাগরিক অধিকার আদায়ের নেতা হিসাবে লুথার কিং আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।” লেখক জ্যাকসন বলেন, “ম্যালকম এক্স এই কথা শুনেছিলেন এবং তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, “লুথার কিং এর যতো কথা শুনেছি, এটা তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ।” যখন লুথার কিং ১৯৬৭ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধের নিন্দা করেন, ডেমোক্র্যাটরা তাকে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে গণ্য করেছিল। এটা তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, ফলে তিনি নিজেকে বর্ণবাদ, বস্তুবাদও সামরিকতন্ত্রবাদ বিরোধী মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। এরপর থেকে তিনি তার সমর্থকদের হারান এবং গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পূর্বে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।প্রায় ১৬৮টি সংবাদপত্র এ ঘটনার নিন্দা জানায়। এমনকি তৎকালীন ডেমোক্র্যাটিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনও লুথার কিং-এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। সেটা কী যা এই লোকটিকে এমন হতভাগা করে দিয়েছিল?
জনসন এক ভাষণে লুথার কিংকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমরা তাকে ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন দিয়েছি, ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন দিয়েছি, আমরা তাকে দারিদ্রতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ দিয়েছি, সে আর কী চায়?”
এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, কারাগারের বাসিন্দারা এবং শহরের সংখ্যালঘু লোকেরা বিভিন্ন বর্ণের লোকদের সাথে বসবাস করবে। এটা আফ্রো-আমেরিকান মানুষের মধ্যকার ভিন্ন সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার জন্য লিবারেল শ্রেণীর হিসাব করা কৌশল মাত্র। ম্যালকাম এক্স এবং লুথার কিং শুধুমাত্র গুপ্তহত্যার স্বীকার হননি বা এর মধ্য দিয়ে তারা হারিয়ে যাননি বরং এর মধ্য দিয়ে আমরা নাগরিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরির এক মহান উচ্চতায় পৌঁছে গেছি।
রাসুল (সা:) বলেছেন–
হে মানুষেরা! তোমরা জেনে রাখো, তোমাদের আল্লাহ একজন এবং তোমাদের পিতা (আদম) একজন। একজন আরব একজন অনারব থেকে উত্তম নয়, একজন অনারব একজন আরব থেকে উত্তম নয়; একজন সাদা মানুষ একজন কালো মানুষ থেকে উত্তম নয় এবং একজন কালো মানুষ একজন সাদা মানুষ থেকে উত্তম নয়- ধার্মিকতা ব্যতীত। [ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত, ২২৩৯১; আল-সিলসিলাত আল-শাহিদ, ২৭০০]
ম্যালকম এক্স এর লক্ষ্য ছিল আফ্রো-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন। তিনি বলেছিলেন, “আজকের তোমাদের এই দুরবস্থার জন্য তোমরা দায়ী নও ঠিকই কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের নিজেদের মুক্তি চাও তবে তুমি প্রথমে নিজে নিজেকেই মুক্ত কর। যে তোমার এই দুরবস্থা করেছে সে নিজে কখনো তোমাকে সেখান থেকে মুক্তি দিবে না।”
ম্যালকাম এক্স কখনো নিজেকে বিক্রি করে দেননি, রাজনীতির নোংরা খেলা খেলেননি কিংবা নিজের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি। মার্টিন লুথার কিং ও ম্যালকম এক্স উভয়েই যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে নিশ্চিত করে বলা যায়– নোয়াম চমস্কি, ক্রিস হেজেস, রালফ নাদের ও ড. নর্মান ফিঙ্কেলস্টেইনের মতো লিবারেল শ্রেণির লোকদের সমালোচনার মুখোমুখি হতেন।
মার্টিন লুথার কিং-এর কর্ম বিবেচনা করতে গিয়ে “ভীতুরা জিজ্ঞেস করে, এটা কি নিরাপদ? যুক্তিবাদিরা জিজ্ঞাসা করে, এটাকে কি রাজনীতি বলা যাবে? দাম্ভিকরা জিজ্ঞাসা করে, এটা কতটুকু জনপ্রিয়তা পাওয়ার যোগ্য? কিন্তু চিন্তাশক্তিসম্পন্ন লোক জানতে চায়, এটা ঠিক ছিল কি না?”
একজন মানুষ হিসাবে আমাদেরও এই অভ্যাস আছে, আমাদের উচিৎ প্রত্যেকদিন নিজেকে জিজ্ঞেস করা, “আমরা যা করছি তা ঠিক কি না”-সেটা তুমি এক্টিভিস্ট হও, ছাত্র হও বা পিতা-মাতা যা-ই হও না কেন। আমরা কী করতে পারি… এর উত্তর তুমিই গবেষণা করে বের কর যে, তুমি কি করতে চাও। মাঝে মাঝে আমরা মনে করে থাকি আমরা ভাল কিছু করছি, কারণ আমাদের লক্ষ্য থাকে দুর্বল। অজ্ঞাতসারে আমরা ভালো প্রতিফলন পাবো মনে করে আশায় থাকি। “মৃত ব্যাক্তি ৩টি বিষয় অর্জন করে, তার পরিবার, তার সম্পদ ও তার কর্মফল। এর মধ্যে দুটোই রেখে যেতে হয়, শুধুমাত্র একটি সাথে যায়। তার পরিবার ও সম্পদ রেখে যেতে হয় কিন্তু তার কর্মফল সাথে থাকে”। [বুখারি ও মুসলিম]
এই ইস্যু থেকে লুথার কিং ও ম্যালকাম এক্স-এর আরেকটি দক্ষতা আমরা আমাদের নিজেদেরকে উন্নতির জন্য কাজে লাগাতে পারি, তা হচ্ছে দ্রুত ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো। আমরা একমুখী শ্রমিক আন্দোলন দেখেছি, অভিবাসন বিরোধী আন্দোলন এবং যেখানেই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন হয়েছে তা দেখেছি, তাই নয় কি? আমরা খুব সামান্যই জানি যে, তারা কীভাবে সব বাধা অতিক্রম করেছে কিন্তু প্রকৃত এক্টিভিস্টরা দেখেছে যে, “বর্ণবাদের সঙ্কট, অর্থনৈতিক শোষণের সঙ্কট এবং সবাই যুদ্ধে পতিত হওয়ার নির্মম ভয়াবহতা। এসব হচ্ছে শয়তানের কর্ম, যা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত”। মার্টিন লুথার কিং- এর এই সঠিক উপলব্ধি ইসলামের উপলব্ধির সাথেও মিলে যায়। আমাদের উচিৎ নিজেদেরকে ক্রিটিকাল থিংকিং-এর মাধম্যে নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা, ব্যাপক পরিসরে বলতে গেলে কোন বিষয় উপলব্ধি করতে হলে প্রথমে সে ব্যাপারে পর্যালোচনার দৃষ্টিভঙ্গিতে নেয়া। যখন আমরা ন্যায্যতার জন্য লড়াই করব; তা সকল ভাই-বোনদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি প্রদানের লক্ষ্যে করবো। ম্যালকম এক্স একবার বলেছিলেন, “আমাদের প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য আরও বেশি আলোর দিশারী হওয়া দরকার। যে আলো আমাদের বুঝতে শেখায়, ভালবাসতে শেখায়, ধৈর্য ধরতে শেখায় এবং আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে শেখায়।”
লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত ইংরেজি সাইট মুসলিম ম্যাটারস ডটওআরজি থেকে নেয়া। অনুবাদ করেছেন নাঈম আহমাদ।