দেখালেন মাহমুল্লাহ রিয়াদ। কীভাবে ম্যাচ জেতাতে হয় এর নায়কোচিত উদাহরণ সৃষ্টি করলেন তিনি। ১৮ বলে ৪৩ রান করেছেন তো করেছেনই, শেষ সময়টাতে নো বলের জটিলতাকে পানি করে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেন বাংলাদেশ দলের ওই নীরব নায়ক।
• শ্রীলংকাকে ২ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ
• টি২০-তে ১ হাজার রানের কোটা পূর্ণ করলেন মুশফিক
• ম্যান অফ দি ম্যাচ : মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ
শ্রীলংকার স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত নিদাহাস ট্রফির অলিখিত সেমিফাইনালে শ্রীলংকার মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। প্রেমাদাসা-য় অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের দলে ফেরাটা। আবু হায়দার রনির বদলে সাকিব- ওই একটি পরিবর্তন নিয়েই মাঠে নামে বাংলাদেশ। একাদশে একটি মুখের বদল হলেও বদলায়নি বাংলাদেশের টস ভাগ্য। টসে জিতে সাকিবও নিয়েছেন বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত। বোলারদের আঁটসাঁট বোলিংয়ের হাঁস-ফাঁস করা লংকাকে উদ্ধার করেছেন সিরিজজুড়েই ফর্মে থাকা কুশল পেরেরা ও থিসারা পেরেরা। দু’জনের ৯৭ রানের জুটিতে শেষ পর্যন্ত লংকা পায় ১৫৯ রানের লড়াই করার মতো পুঁজি। ওই পুঁজিটি যে যথেষ্ট ছিল নয়, ম্যাচ শেষেই তা স্পষ্ট। আবারও বাঘের থাবার পরাস্ত লংকানরা। এবার নায়ক মাহমুদুল্লাহ। স্নায়ুচাপের শেষ ওভারটায় অসাধারণ ফিনিশিংয়ে দলকে শুধু ফাইনালেই তুলেলেন না, নিশ্চিত করলেন ঘরের মাঠে ফাইনালে লংকানদের দর্শক হয়ে থাকাটাও।
পাওয়ার প্লেতেই পথহারা লংকা
প্রথম ওভারেই বোলিং এসে সাকিব যেন বুঝিয়ে দিলেন এত দিন ঠিক কী মিস করছিল বাংলাদেশ। প্রথম ওভারে দিলেন মাত্র তিন রান। পরের ওভারে এসে চলতি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বোলার রুবেল রানের চাকাটা আলগা করে দিলেও ওই সুবিধাটা কাজে লাগাতে দেননি সাকিব। নিজের দ্বিতীয় ওভারে প্রথম আঘাত হেনেই পথহারা করে দেন লংকানদের। আর সাকিবের তৈরি করা মঞ্চে লংকানদের প্রলয় নাচন নাচিয়ে ছেড়েছেন মোস্তাফিজ। দুই কুশলের এক কুশল মেন্ডিসকে পরাস্ত করলেন দারুণ কৌশলে। সিরিজজুড়ে লেগ সাইডে রান তোলা কুশলকে টানা অফস্ট্যাম্পের ওপর বল করে নিয়ে গেলেন অস্বস্তির চরমে। আর শেষ বলটায় ফেললেন লেগে খেলার টোপ। আর ওই টোপে পা দিয়েই উইকেটটা বিলিয়েই দিয়ে এলেন যেন। বাংলাদেশের কৌশলে লংকানরা কতটা বিভ্রান্ত ছিল তা বোঝা গেছে থারাঙ্গার রান আউটেই। সেখানেই শেষ না করে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে সানাকাকে পাঠালেন প্যাভিলিয়নে। ওই মোস্তাফিজকেই তো চিনতো বাংলাদেশ। এই মোস্তাফিজের প্রত্যাশাতেই কেটেছে এতটা দিন। কুশল ফেরানোর ওভারটা ছিল উইকেট মেডেন। পরের ওভারে দিয়েছেন মাত্র চার রান। এমন সাকিব-মোস্তাফিজে লংকার কি সাধ্য রান তোলার? তাই পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে উঠলো মাত্র ৩৫ রান। উইকেট? ৪টি? বহুদিন পর বোলিংয়ে সোনালি শুরু করলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের কৌশলের পাল্টা জবাব কুশলের ব্যাটে
৩৫ রানে চার উইকেট হারিয়ে পাওয়ার প্লে শেষ করা লংকানদের জীবন দুবির্ষহ করে তোলেন মেহেদী। ইনিংসের অষ্টম ওভারে দলীয় ৪১ রানের মাথায় জীবনকে তুলে নিয়ে। সেখান থেকেই লংকার ঘুড়ে দাঁড়ানোর শুরু। একপাশে কুশল পেরেরা, অন্যপাশে থিসারা পেরেরা- লংকানদের মূল ভরসা দুই পেরেরাতেই শেষ পর্যন্ত পথ খুঁজে পায় লংকান ইনিংস। সৌম্যের বলে আউট হওয়ার আগে কুশল করেন ৬১ রান। আর শেষ ওভারে আউট হওয়ার আগে থিসারা করেন ৫৮ রান। টি২০-তে এটাই তার প্রথম অর্ধশতক। দু’জনের ৯৭ রানের জুটিটাই শেষ পর্যন্ত লংকানদের এনে দিয়েছে লড়াই করার পুঁজি। তাদের এই পাল্টা প্রতিরোধ শুরু হয় যায় কৌশলে পরাস্ত হয়ে পথ হারিয়েছিল শ্রীলংকা ওই মোস্তাফিজের ওপর চওড়া হওয়ার মধ্য দিয়েই। প্রথম দুই ওভারে মাত্র ৪ রান দেয়া মোস্তাফিজ তার স্পেল শেষ করেছেন ৪ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে।
প্রশ্নবিদ্ধ বোলিং সিলেকশন
৪১ রানেই ৫ উইকেট হারানো লংকানদের যখন আরো শক্তভাবে চেপে ধরার কথা তখন সাকিব হাঁটলেন ভিন্নপথে। স্পেশালিস্ট বোলার নাজমুলকে তো বোলিংয়ে আনেননিই, দারুণ শুরু করার পর নিজেও শেষ করেননি ৪ ওভারের কোটা। পরিকল্পনাটা ঠিক কী ছিল সেটি জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সাকিবের বয়ান পর্যন্ত। কিন্তু পুরো বিষয়টাই বিস্ময়কর ঠেকেছে বিশ্লেষকদের কাছে।
সৌম্য জুয়ায় বাজিমাত
ইনিংসের ১৮তম ওভারটি করার জন্য সৌম্যকে বেছে নেয়া ছিল চরম একটি জুয়া। ১৩ রান দিলেও জুয়াটি সাকিব জিতেছেনই বলা যায়। দারুণ খেলতে থাকা কুশল-কে ফিরিয়ে দেয়ার পরের বলেই প্রায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন থিসারা-কেও। কিন্তু সাব্বিরে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাচ ছেড়ে বলটিকে ছয়ে পরিণত করলে সৌম্য-সাকিবকে হতাশা উপহার দিয়ে নিজের প্রথম অর্ধশতকটি তুলে নেন ওই অল রাউন্ডার।
অসাধারণ রানিং বিটুউইন দি উইকেটের বিপরীতে অসহায় ফিল্ডিং
৯৭ রানের জুটিতে দুই পেরেরা এককে দুই, দুইকে তিন-এ পরিণত করেছেন বহুবার। এমনকি যেখান থেকে রানই হয় না সেখান থেকেও সিঙ্গল বের করে নিয়েছেন দু’জন। বিপরীতে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা ছিলেন শ্লথ এবং থ্রো ইন ছিল হতাশাজনক।
শিখলেন না লিটন-সাব্বির, তামিম-মুশফিকে আশার আলো
গত ম্যাচের ব্যর্থতা থেকে যে বিন্দুবিসর্গও শেখেননি লিটন দাস এর প্রমাণ দিলেন ইনিংসের শুরুতেই। ওই লংকার বিপক্ষেই ঝড় তুলে আলোচনায় আসার পর থেকেই যেন উল্টোরথে যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। গত ম্যাচে অহেতুক উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে উইকেট বিলানোর পর এবার লংকাকে নিজের উইকেটটি উপহার দিয়েছেন হাফ হার্টেড একটি শট খেলে। এর আগেও বহুবার সাব্বিরকে তিনে তুলে এনে তাকে অতুলনীয় প্রমাণের প্রচেষ্টা বার বার ব্যর্থ হলেও এবার ওই পথেই হেঁটেছে বাংলাদেশ। ফল? জিজ্ঞাসা করে লজ্জা না দেয়াই ভালো। বরং মিনহাজুল আবেদীনকে ওই প্রশ্নটা করা এখন আবশ্যক যে, সাব্বিরে তিনি কী এমন দেখেছেন যা দৃশ্যমানই হচ্ছে না? শেষ পর্যন্ত ওই তামিম-মুশফিকই নিরাপদে পার করেছেন পাওয়ার প্লের বাকি সময়টা।
বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের প্রদর্শনী
টুর্নামেন্টের শুরু থেকে আলোচনায় ছিল তামিমতত্ত্বের বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের ক্রিকেট। সেটি কীভাবে খেলতে হয় এর এক চমৎকার প্রদর্শনীই যেন দেখা গেছে তামিম-মুশফিকের ৬৪ রানের জুটিতে। সিঙ্গল-ডাবলসের সঙ্গে বাজে বলে বাউন্ডারি বের করে ম্যাচটিকে বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই সহজ করে তুলছিলেন দেশসেরা ওই দুই ব্যাটসম্যান। কিন্তু পেরেরার চমৎকার ক্যাচে পরিণত হয়ে মুশফিক প্যাভিলিয়নের পথ ধরলে ভাঙে ওই জুটি। এরপরের ওভারে টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম অর্ধশতক তুলে নিয়েই যেন অধৈর্য হয়ে গেলেন তামিম। গুনাথিলাকা-কে অহেতুক বেরিয়ে এসে মারতে গিয়ে কিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে অপমৃত্যু ঘটালেন সম্ভাবনাময় ইনিংসটির। আর তার আউটের সঙ্গে সঙ্গেই যেন সমাপ্তি ঘটলো বাংলাদেশি ব্র্যান্ডেরও।
আহ সৌম্য! বাহ সৌম্য!
তিনি যখন ক্রিজে নামেন তখন ৬ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন মাত্র ৫৫ রান, হাতে ৬ উইকেট। সেখান থেকে ম্যাচ লংকানদের হাতে তুলে দেয়ার পূর্ণ কৃতিত্বই পাবেন হাথুরুর প্রিয় শিষ্য। দেশের সমর্থকদের কাছে যেমনই হন, হাথুরুর প্রিয় যে তিনি সব সময়ই থাকবেন তা লিখেই দেয়া যায়।
ভায়রাতেই ভরসা
আগের ম্যাচের জয়ের নায়ক ছিলেন মুশফিক। এবার একে একে তামিম-মুশফিক-সাকিবদের বিদায়ে দায়িত্বটা এসে পড়ে মুশফিকের ভায়রা আগের ম্যাচগুলোয় ব্যর্থ মাহমুদুল্লাহর ওপর। উদানার শেষ ওভারের অসাধারণ বোলিংয়ে ম্যাচটা জেতা যখন অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল তখনই যেন জানান দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আনসাং হিরো তখনো ক্রিজে। শেষ ৪ বলে ১২ রানের কঠিন সমীকরণ মেলালেন একটি ৪, ২ এবং পুরো কলম্বোকে স্তব্ধ করে দেয়া অসাধারণ এক ফ্লিকে। অসহায় উদানা যেন তিক্তভাবেই উপভোগ করলেন চোখে লেগে থাকার মতো ছয়টি। হাতছাড়া হতে বসা ম্যাচটি জিতিয়ে আরো একবার মাহমুদুল্লাহ চেনালেন নিজেকে। সন্দেহ নেই, দুঃস্বপ্নে বহুদিন বাংলাদেশের বিখ্যাত ভায়রা জুটিকে দেখবেন হাথুরু। দু’জনকেই বাতিল ঘোষণার জবাব যে, লংকার মাটিতে লংকাকেই দর্শক বানিয়ে দেবেন তা বোধহয় তিনি কখনোই ভাবেননি। ১৮ বলে ৩টি চার আর ২টি ছয়ে অপরাজিত ৪৩- কোন শব্দটি ব্যবহার করবেন ওই ইনিংসটির প্রশংসা করার জন্য? কোনো শব্দই যে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না, বিশেষ করে শেষ ওভারের চরম উত্তেজনার পরও যে রকম ঠাণ্ড মাথায় ম্যাচটি শেষ করে এলেন- অসাধারণ, অসাধারণ!
খোদ ক্রিকেট দুনিয়ার কর্তা প্রতিষ্ঠান আইসিসিও মাহমুদুল্লাহর তারিফ করে টুইটারে পোস্ট দিয়েছে।
WHAT. A. FINISH!
Mahmadullah, take a bow! 12 off four needed, and he does it in three!
Bangladesh are in the Tri-Series final. #SLvBAN ➡️ SCORECARD https://t.co/te2uNri0kK pic.twitter.com/huKZoPK1f0
— ICC (@ICC) March 16, 2018
শেষের আগের নাটক
শেষ ওভারে দুটি বাউন্সারের পরও আম্পায়ারের নো বল কল করা না নিয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন সাকিব। এক পর্যায়ে ব্যাটসম্যানদের মাঠ ছাড়াই আহ্বান জানান বাংলাদেশ অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত খালেদ মাহমুদ-এর মধ্যস্থতায় মাহমুদুল্লাহ ক্রিজে ফিরে ম্যাচটি শেষ করে এলেও উত্তেজনা যে বিদ্যমান ছিল তা দেখা গেছে ম্যাচ শেষেও। মাঠেই তর্কে জড়িয়ে পড়েন নুরুল হাসান ও কুশল মেন্ডিস। শেষ পর্যন্ত তামিম-ওয়ালশদের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও একটা জিনিস ইতিবাচক ছিল- অনেকে সাকিবের আচরণ নিয়ে আপত্তি তুলতে পারেন। কিন্তু এমন সময় তার ওই আচরণ জয়ের জন্য মরিয়া বাংলাদেশের চরিত্রই ফুটিয়ে তুলেছে। এর আগে ভারতের বিপক্ষে ওই ডাকাতি হওয়া ম্যাচে চুপ থাকলেও এবার সাকিব বুঝিয়ে দিলেন, চুপ থাকার দিন শেষ। বাংলাদেশও শিখে গেছে প্রতিবাদ করতে।
নাগিন নাচে দংশিত লংকা
হয়তো বল হাতে ভূমিকা রাখার তেমন সুযোগ পাননি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে নাজমুল হাসান অপু অমর হয়ে থাকবেন তার নাগিন নাচের জন্য। প্রথম দিকে উইকেট পাওয়ার পর অপু ওই ভঙ্গিমায় উদযাপন করলেও আজ পুরো বাংলাদেশ যেভাবে মাঠের মধ্যখানে নাগিন নাচ নাচলো তা যে লংকানদের কাছে সাপের দংশনের মতােই অসহনীয় ঠেকেছে এটি চোখ বুজেই বলে দেয়া যায়।