কর্মব্যস্ত দিনগুলোয় করাচির গার্ডেন ইস্ট এলাকার বড় জুতার মার্কেটের পাশের কাওয়াল গলিমুখী রাস্তাগুলোয় হাঁটা দায় হয়ে পড়ে। রাস্তার দু’পাশের ফুটপাতগুলোয় পথচারীদের এতটাই ভিড় লেগে থাকে যে, বিখ্যাত কাওয়ালদের নামে নামকৃত সেখানকার সাইনবোর্ডবিহীন সরু গলিগুলো দেখতে না পাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। এলাকাটিতে বহু কাওয়াল ঘরানা বা পরিবার বর্তমানে বংশানুক্রমে বসবাস করছে যারা দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তানে দেশান্তরিত হয়িছিলেন।
ওই পরিবারগুলো বংশানুক্রমে পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতের এমন এক ধারায় অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে যার সূচনা হয়েছিল সরাসরি সুফি সংগীতসাধকরা এবং কবি আমির খসরুর কাজের অনুপ্রেরণায়। ১৩ শতকে কবি খসরু-র সময় প্রথমে দিল্লির কাওয়াল বচ্চনের বংশের সদস্যরা ওই উদ্দেশ্যে একত্র হয়েছিলেন এবং বহু কাওয়াল সংগীত রচনা ও লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ওই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের পরিবারগুলোই এখন বংশবৃদ্ধি করে নানান জায়গায় ছড়িয়ে গেলেও করাচির কাওয়াল গলিতে অনেকেই এখনো বসবাস করেন। ফরিদ আয়াজ ও আবু মোহাম্মদ, নাজমুদ্দিন সাইফুদ্দিন ও ভ্রাতৃসংঘ, সুবহান নিজামি ও ভ্রাতৃসংঘ, সামি ভ্রাতৃসংঘ, হামজা আকরাম ও ভ্রাতৃসংঘ, তাজ ও শাদ মোহাম্মদ নিয়াজি’রা বর্তমানে পাকিস্তানের কাওয়ালি সংগীত জগতে পরিচিত নাম। তারা একই এলাকায় বাস করেন।
সুবহান নিজামি ১৮ বছর বয়সে নিজের আলাদা কাওয়ালি দল গড়ে তোলেন, করাচির মঈন নিয়াজি কাওয়াল স্ট্রিটের একটি প্রায় পরিত্যক্ত বাড়িতে বসবাস করছেন বর্তমানে। সতর্ক চোখের সদাহাস্য ভদ্রলোক বলেন, এলাকাটিতে আড়াইশ’র মতাে কাওয়াল দল বাস করে। তারা কম-বেশি কাওয়াল বচ্চনের বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত। অবশ্য তাদের মধ্যে কয়েকজনই এক্ষেত্রে নিজেদের নাম উজ্জ্বল করতে পেরেছেন।
সুবহান নিজামি ফাঁকা ফাঁকাভাবে আসবাবপত্রে সাজানাে যে রুমে কথা বলছিলেন সেটিতেই নিজের দল নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করেন। তার পূর্বপুরুষদের ফটোগ্রাফ আর সার্টিফিকেটের মতো দেখতে প্রশংসাপত্রের বাঁধানো ফ্রেম ঘরের দেয়ালের শোভা বাড়াচ্ছিল। সম্প্রতি তোলা একটি ফটোয় বিদেশের একটা প্রেক্ষাপটে নিজের দলের বাকি সদস্যদের সঙ্গে নিজামিকে দেখা গেল। ‘এটি ফ্রান্সে তোলা’- আঙুল উঁচিয়ে ফটোটি দেখিয়ে বললেন তিনি। কিছুদিন আগে সেখানকার একটা কনসার্টে গিয়েছিলেন তারা।
সুবহান নিজামি ২০১১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৬ বার দলের সদস্যদের নিয়ে ফ্রান্সে গেছেন। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও চমৎকার কয়েকটা মঞ্চের কনসার্টে যোগ দিয়েছি আমরা। এটি বেশ অদ্ভুত, জানেন- আমাদের বলা একটি শব্দও সেখানকার কেউ বোঝেন না। কিন্তু আমাদের সাধনার ছন্দ, ভাব তারা অনুভব করতে পারেন। এছাড়া তারা আমাদের কাজের প্রশংসাও করেন। আমরা এমনকি আমাদের সাধনার সময় অনেককে কাঁদতেও দেখেছি।’ ‘এটি আসলেই কাওয়ালির ওপর আমাদের দৃঢ়বিশ্বাসটিকে আরো নিশ্চয়তা দেয়– যে খুঁজতে চায়, জানতে চায় তার ওপর কাওয়ালির প্রভাব অনেক’- যোগ করলেন তিনি।
ওই ভ্রমণগুলো অবশ্যই তাদের জন্য সম্ভাবনার অপার দুয়ার খুলে দিয়েছে। কিন্তু নিজ দেশে তাদের সুযোগ-সম্ভাবনা কতটুকু? তিক্ত হাসলেন দু’ভাই। ‘যা বলবো এতে হয়তো আমাকে ঔদ্ধত্য মনে হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এ দেশে খুব কম মানুষই আমাদের কদর কিংবা সাহায্য করে। অসাধারণ কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই কেবল আমাদের কাজের মহত্ত্ব বোঝে। তারাই আমাদের কাজের প্রচার-প্রসারে অবদান রেখে আসছেন, সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই’- বলেন নিজামি। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের বাইরে ঘুরে ওই ব্যাপারটি বেশি করে টের পেয়েছি আমরা। নিজেদের দেশে প্রাপ্য সম্মানটুকু না পাওয়ার কষ্টটি আসলে খুবই তিক্ত। আমাদের অপ্রতুল যা সম্বল আছে তা নিয়েই ওই সাধনাটিকে এতদূর নিয়ে গিয়েছি শুধু নিজেদের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখতে। কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছি কী, কিছুই না।’
এত অল্প সুযোগ-সম্পত্তি নিয়েও পুরো একটা সংগীত ঘরানা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে যে পরিমাণ চেষ্টা দরকার হয় তা প্রকৃতপক্ষে তুলনাতীত। নিজামির দলের ক্ষেত্রে এ জন্য শতাব্দী ধরে চলে আসা আদি ঘরানার কাওয়ালির ভক্তিমূলক ও ধর্মীয় সীমা অতিক্রম করেও নানান পরীক্ষামূলক কাজ করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তার তাৎক্ষণিক বাস্তবধর্মী উত্তর পাওয়া গেল- ‘আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে শ্রোতার জন্য সংগীত পরিবেশন করা। যখন কেউ তাদের আনন্দ-আয়োজনের জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানান তখন তাদের জন্য নিজেদের সর্বোকৃষ্টটুকু দেয়াটা আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।’
জাগতিক বিনোদন থেকে আত্তীক ভাবের অভিজ্ঞতা নিতে চাওয়া দর্শকের মনোবাসনা পূরণ করার মতো অভিযোজন আর উন্নতির বিশেষ অভ্যাস আছে কাওয়ালদের। এটিকে নিজামি নিজদের সামর্থ্যের জন্য কোনো বাজিই মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘বিশাল লোকসমাগমের সামনে পরিবেশনার অভিজ্ঞতার কারণে এখন মানুষ আমাদের কাছ থেকে কখন কী চায় তা বুঝতে পারি আমরা।’ তিনি বরং পুরো ব্যাপারটিকে আত্তীক মুক্তিদানের সঙ্গে তুলনা করেন- ‘পরিবেশনার সময় যতটা স্বাধীনতা আমাদের দেয়া হয় ততটাই আমরাও মুক্তমনে সাধনা করতে পারি।’
সরু , ঘিঞ্জি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই আরেকটা অনুশীলন কক্ষের দেখা মিললো। সেখানে ছিলেন তাজ ও শাদ মোহাম্মাদ নিয়াজি। তারা ভারতের আলিগড়ের পাশের আতরাউলি এলাকার আতরাউলি ঘরানার কাওয়ালি সংগীতজ্ঞদের বংশোদ্ভূত। মইন নিয়াজি কাওয়াল স্ট্রিটের নামকরণ তাদের বাবার নাম অনুসারেই। তাদের দুই ভাইয়ের বাসস্থান ও সংগীত সাধনার রীতি- দুটিই বাবার সংগীত সংক্রান্ত অর্জনের ফসল। ঘরের দেয়ালে মইন নিয়াজি ও তার দলের ফটোগ্রাফ ঝুলছিল। দু’জন এরপর একটি ভক্তিমূলক গান ‘মান কুন্তো মাওলা’ গাওয়া শুরু করলেন। আমাদের জন্য একটি অসাধারণ সন্ধ্যার শুরু ছিল সেখানেই।
‘আমাদের পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে ওই সাধনা করে আসছে। দেশ ভাগের সময় ভারত থেকে করাচিতে আসার মধ্যে আমরা কিছুদিন লাহোরেও ছিলাম’- তাজ নিয়াজি বলেন। তিনি বলেন, ‘ওই জনরার উন্নতিতে আমাদের প্রচেষ্টা ও উপসনার একগ্রতা এতটাই যে, ভারতের পর এই পাকিস্তানেও নিজেদের নাম কায়েম করতে পেরেছি আমরা।’ সিন্ধি সরকার তার বাবার নামেই ১৯৯৩ সালে রাস্তাটির নামকরণ করায় সম্মান জানান এব এ ব্যাপারে নিজেদের গর্ব প্রকাশে কুণ্ঠা করলেন না তিনি। ‘এমনটি আর কোনাে দেশের ইতিহাসে ঘটেনি’- বললেন তিনি।
তাজ নিয়াজি জানান, এছাড়া অবশ্য গর্ব করার মতাে আর কিছু নেই। পাকিস্তানে নিজেদের কাজে সুযোগ স্বল্পতার কথাও বললেন। এর মধ্যেও এত প্রতিযোগিতার জন্য ওই সুযোগটুকু পাওয়াও পাওয়া মুশকিল। তার পুরনো ঘরানার রেওয়াজের বিপরীতে নতুন নতুন কাওয়ালি দলগুলোর নতুন কাজের প্রতি মানুষের ক্রমবৃদ্ধিশীল আগ্রহ তাদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে পারিবারিকভাবে ঐতিহ্যবাহী কাওয়ালি গায়কদের জন্য এমন একটি পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে যে, মানুষকে আকর্ষণ নিজেদের দিকে ফেরাতে পূর্বপুরুষদের অর্জন সম্পর্কে ঢোল পেটাতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত. কাওয়ালি ধারায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটছে। এরপরও মূল সারাংশ ঠিক আগের মতোই রাখতে হচ্ছে যাতে শ্রোতা উপভোগ করে।
নিয়াজির জন্য ওইসব অভিজ্ঞতা খুব সহজ কিছু নয়। পুরো পাকিস্তান ঘুরে একটু সুযোগ লাভের আশায় তাকে ও তার দলকে কতটা খাটতে হয়েছে এ সম্পর্কে জানালেন তিনি- ‘আমরা বেশির ভাগ সময় সুফি সমাবেশগুলোতেই পরিবেশনা করি। কেননা কাওয়ালির অনুপ্রেরণাও সেখান থেকেই এসেছে। এরপরও অল্প কিছু সমাবেশের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যগুলোর কাছে পৌঁছাতে পারছেন না তারা। ‘আমরা এখন প্রাইভেট কিছু অনুষ্ঠানেও সংগীত পরিবেশন করি’ বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিনি যোগ করলেন, ‘অবশ্য আমরা যতটা চাই তত সংখ্যক সুযোগ সেখানেও পাওয়া যায় না।’
ওই সীমাবদ্ধতার শেষ রূপটা বেশ জটিল। ‘প্রচুর কষ্ট করতে হয়ে আমাদের ওই সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য। কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া দীর্ঘ একটা সময় চলতে থাকলে নিজেদের অল্প কিছু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে’- বললেন নিয়াজি। একটু থেমে তিনি বললেন, ‘কীকিভাবে যে মাঝে মধ্যে বংশের ঐতিহ্যও কারো কাঁধের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়! এটা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই (পেশা হিসেবে), এমনকি আমরা যদি অন্য কিছু করতে চাই তাহলেও আমাদের বংশের নাম খারাপ হবে।’
নিয়াজি মতে, ওইসব সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে সরকারের তহবিল গঠন ও কাওয়াল ঘরানাগুলোকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মধ্যে। তিনি বলেন ‘অন্তত এখনকার চেয়ে যদি আর্থিক অবস্থা ভালো হয় আমাদের তাহলেই আরো ভালো পরিবেশনা উপহার দিতে পারবো আমরা। ভারতের অবস্থাই দেখুন, সেখানকার শিল্পীরা কত আনন্দে আছেন। মাঝে মধ্যে সত্যিই দেশে নিজেদের অপয়া মনে হয়।’
দিনে দালানের ছাদের ওপর থেকে দেখতে পুরো কাওয়াল এলাকাটিতে ঈশ্বর বিস্মৃত অপরিচ্ছন্ন এক উদাসীন জনবসতি বলে মনে হয়। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই পুরো এলাকায় সত্যি বলতেই যেন প্রাণ ফিরে পায় কাওয়ালি সংগীত সাধনা। তবলা ও হারমোনিয়ামের বাজনা আর প্রশংসার করতালির সঙ্গে সঙ্গে ঘরগুলো থেকে স্বর্গের সুরেলা আধ্যাত্মিক ধ্বনি ভেসে আসতে লাগে। ‘রাতে রাস্তাগুলো জেগে ওঠে, বিশেষ করে রমজান মাসে। আপনার দেখে মনে হবে, কেউ মনে হয় ঘুমাই না’- নবীন এক কাওয়াল বললেন। ‘করাচির এক কোণের মানুষকে এক সঙ্গে এমন সাধনামগ্ন হয়ে উঠতে দেখাটি সত্যি অপূর্ব’- শান্ত হাসির সঙ্গে বললেন তিনি।
দৈনিক ‘ডন’-এর বিশেষ সাময়িকী ‘হেরাল্ড ‘-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে