ইংলিশ ক্লাবগুলোর পথ হারানোর কারণ কী

ইংলিশ ক্লাবগুলোর পথ হারানোর কারণ কী

একটু পুরান ঢাকার ইতিহাস দিয়েই লেখাটা শুরু করবো। আজকের যে আর্মেনিটোলা, এক সময় এখানে বাস করতেন আর্মেনি সম্প্রদায়ের মানুষজন। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও মেধার পরিপূর্ণ ব্যবহারে খুব দ্রুত ঢাকার বুকে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছিল তারা। অষ্টাদশ এবং ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে, অতি ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় হবার পরেও অর্মেনিরা হয়ে উঠেছিলো বেশ প্রভাবশালী। কারণ, তাদের ছিল বিত্ত। অষ্টাদশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণের ব্যবসা ছিলো একচেটিয়া। এর উৎপাদন ও বিতরণের জন্য কোম্পানি নিয়োগ দিতো ঠিকাদার। আর পূর্ববঙ্গে লবণের ঠিকাদারি ছিলো আর্মেনিদের একচেটিয়া। বর্তমান ‘বাফা’ যে বাড়িটিতে সেটি ছিলো নিকি পোগজের। এসবই এখন ইতিহাস। আর্মেনিদের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে রয়ে গিয়েছে কিছু কবর, আর অার্মেনি গির্জা। সত্তরের দশকে হ্রাস পেতে থাকে আর্মেনিদের সম্পদ। পরিবর্তনের সে সময়টাতে আর্মেনিরা ঝুঁকে পড়েছিল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আর্মেনি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব এখন শুধু ইতিহাসের পাতাতেই সীমাবদ্ধ।

এবার আসি মুল প্রসঙ্গে। খুব বেশিদিন আগের কথা না যখন ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের আসর ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রাজ করতো ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলো। ২০১২ পূর্ব সময়টাতে একটু ফিরে যান, এমনও দেখা গিয়েছে চার সেমিফাইনালিস্টের তিনটি দলই ইংল্যান্ডের। ২০০৫, ২০০৬, ২০০৮, ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১ ২; ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০১০ বাদ দিলে প্রত্যেক বছরই ইংলিশ কোনো ক্লাবকে দেখা গিয়েছে ফাইনালে। এর মধ্যে ২০০৮ তো ছিলো অল ইংলিশ ফাইনালই। যার শেষ হাসিটা হেসেছিলো স্যার ফার্গুসনের ইউনাইটেড। এর বাইরেও ২০০৫, ২০০৮ এবং ২০১২ সালের ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট উঠেছিলো ইংলিশ কোনো না কোনো ক্লাবের মাথায়। এরপর থেকেই পতনের শুরু। ২০১২ এর পরে এক অ্যাথলেটিকোর মত মাঝারি মানের ক্লাবই যেখানে দুবার ফাইনাল খেলে ফেলেছে সেখানে ইংলিশ কোনো ক্লাবই ফাইনালের মঞ্চে পা রাখতে পারেনি। অথচ, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের এই প্রতিযোগিতায় শীর্ষ দশটি ক্লাবের তিনটি ক্লাবই ইংল্যান্ডের। লিভারপুল পাঁচবার, ইউনাইটেড তিনবার, নটিংহ্যাম ফরেস্ট দুইবার এবং চেলসি একবার করে জিতেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। একাধিকবার ফাইনাল খেলে যে দুটি ক্লাব প্রত্যেকবারই জয়ীর বেশে মাঠ ছেড়েছে নটিংহ্যাম তাদের একটি। অথচ, ২০১২ পরবর্তি সময়ে চ্যাম্পিয়ন ত দূর ইংলিশ কোনো ক্লাবকে ফাইনালেই দেখা যায়নি। মাত্রই গত পরশু রাতে স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ার সাথে হেরে শেষ ষোলো থেকেই বিদায় নিয়েছে এক সময়কার জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। গত রাতে বার্সেলোনার সাথে ৩-০ গোলে হেরে বিদায় নিয়েছে চেলসি। ঘটনার সূত্রপাত যেহেতু ২০১২ থেকে তাই একে আর বিচ্ছিন্ন বলার সুযোগ নেই, বরং একটু গভীরে গিয়ে দেখতে চাই আচমকাই ইংলিশ ক্লাবগুলোর পথ হারানোর কারণ।

আপনি যদি ফুটবলের নিয়মিত অনুসারী হন ক্লাস অফ ‘৯২ এর নাম অবশ্যই আপনার পরিচিত। স্যার ফার্গুসনের সেই দলটি, যাদেরকে স্মরণ করা হবে অনন্তকাল। কিংবা, আর্সেন ওয়েনগারের দ্য ইনভিন্সিবল, একমাত্র দল হিসাবে অপরাজিত অবস্থায় প্রিমিয়ার লিগ শেষ করেছিলো যারা। এই দুটি ক্লাবের অন্দের ঢু মেরেই খোঁজার চেষ্টা করবো আচমকাই পথহারা ইংলিশ ক্লাবগুলোর বেহাল দশার হেতু।

তার আগে একটু দেখে নেই বর্তমান হালত নিয়ে এখনকার কোচরা যে অজুহাত দিচ্ছেন সেদিকটায়। অন্যান্য লিগের মধ্যপথে বিরতি থাকলেও ইংলিশ লিগে সেটি নেই। শিরোপার প্রতিদ্বন্দিতাও হয় একাধিক ক্লাবের মধ্যে। সুতরাং, খেলোয়াড়রা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে ক্লান্ত থাকে, যার প্রভাব পড়ে লিগের মধ্য পথে বিরতি পাওয়া অন্যান্য লিগের দলগুলোক সাথে। প্রাপ্ত বিরতিকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য দলগুলো যেখানে পুনর্দ্যোমে শুরু করার সুযোগ পায়, সেখানে ইংলিশ ক্লাবগুলোর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত খেলোয়াড়রা আর পেরে ওঠে না তাদের সাথে। এ যুক্তিটা কি অাদৌ মানবার মতো? কারণ, তাই যদি হতো তাহলে এই ২০১২ পর্যন্ত ইংলিশ ক্লাবগুলো সফল হলো কি করে?

এ বিষয়টায় স্পষ্ট হবার জন্য একটু ঢুঁ মারবো দুটি ক্লাবের অন্দরে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং আর্সেনাল। স্যার ফার্গুসনের দলটি যারা ব্রিটিশ রাজ তো বটেই শাসন করেছিলো গোটা ইউরোপই। তিনি কিভাবে পেরেছিলেন? আর্মেনিদের রাজ করার জন্য ছিলো বিত্ত, স্যার ফার্গি কি দিয়ে রাজ করেছিলেন? একটু লক্ষ্য করুন, ইউনাইটেডের যে দলটা পুরো ইউরোপ কাঁপিয়েছিলো তাদের অধিকাংশের উঠে আসা ইউনাইটেডের একাডেমি থেকে। এর বাইরের যে কোনো তারকা ছিলো না তা না, তবে দলের নিউক্লিয়াস যারা তারা প্রত্যেকেই একাডেমির খেলোয়াড় হবার কারণে দলীয় রসায়নটা ছিলো চমৎকার। বড় তারকাদের প্রতি না ঝুঁকে তরুণ প্রতিভাগুলোকেই ক্লাবের দর্শন, খেলার ধরণের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে এই অসাধ্যকে সাধন করেছিলেন স্যার ফার্গুসন। এটাই ছিলো তার বিত্ত। এবং তার আমলে ইউনাইটেড শুধু শিরোপাই এনেছে এমন না, বরং খেলেছে চোখ ধাঁধানো ফুটবল। আজকের যে বিশ্বসেরা রোনালদো তাকেও কিন্তু স্যার অ্যালেক্স ইউনাইটেডে নিয়ে গিয়েছিলেন আনকোরা অবস্থাতেই। এবং ক্লাস অফ ‘৯২ এর নিউক্লিয়াসদের অধিকাংশই ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ডেভিলসদের জার্সি গায়েই।

এবার আসুন আর্সেনালে। ইউনাইটেডের মতো ইউরোপ রাজ করতে না পারলেও ইউরোপিয় ক্লাবগুলোর মধ্যে আর্সেনাল ছিলো এক সমীহা জাগানো নাম। এর পেছনেও রয়েছে একাডেমি এবং দলীয় রসায়নের মেলবন্ধন। দ্য ইনভিন্সিভল ২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে হেরে গিয়েছিলো দিনহো ম্যাজিকের কাছে। সেদিনটি নিজেদের করে নিতে পারলে হয়তো আজকে ধুঁকতে থাকা আর্সেনালের ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে। ওয়েনগার দায়িত্ব নেয়ার সময় দলের অধিনায়ক টনি অ্যাডামস ছিলেন গানার্সদের একাডেমির প্রোডাক্ট। এছাড়া ছিলেন অ্যাশলে কোলসহ আরো অনেকে। এবং এ দলটির বেশিভাগ খেলোয়াড়ই একসাথে খেলেছে ৮-১০ বছর।

স্যার ফার্গুসনের বিদায়ের পর ইউরোপে নিজেদের অবস্থান জানান দিতেই খাবি খাচ্ছে ইউনাইটেড, আর ওয়েনগার থাকাবস্থাতেও আর্সেনালের অবস্থা ত্রাহি মধূসদন। ইউনাইটেড যেখানে উপহার দিয়েছে বাট ব্রাদার্স, স্কোলস, বেকহ্যামদের মতো তারকাদের এখন তার কাছাকাছি মানের খেলোয়াড়ের যোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছে তিনবারের ইউরোপ সেরারা। আর আর্সেনাল দিচ্ছে অ্যালেক্স আইওবি, কোকোলিন বা জোয়েল ক্যাম্পবেলদের মতো খেলোয়াড়দের, যারা ইনভিন্সিবল দলটির কোনো খেলোয়াড়ের সমমানের তো দূর, কাছাকাছি মানেরও না। যার পরিণতিতে ক্লাবগুলোকে ঝুঁকতে হচ্ছে বাইরের খেলোয়াড়দের দিকে। এতে না সৃষ্টি হচ্ছে দলীয় রসায়ন, না আসছে সাফল্য।

ইনভিন্সিবলস

আপনি সিটির দিকেই লক্ষ্য করুন। পেট্রো ডলারে বাজার অস্থির করে তুললেও সাফল্যের খাতা কিন্তু শূণ্য। চেলসি একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে বটে, কিন্তু নেই কোনো ধারাবাহিকতা। সুতরাং, একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ক্লান্তি বা লিগের মধ্য পথে বিরতি না থাকাটা অজুহাত বৈ কিছুই না। রাতারাতি সাফল্যের নেশায় বুদ হয়ে যেনতেন অবস্থায় কিছু তারকা একাট্টা করে দিয়ে তাৎক্ষণিক সাফল্য চাওয়াটাই হয়ে দাড়িয়েছে কাল।

এক্ষেত্রে শতাব্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই ক্লাব রিয়াল আর বার্সাকে দেখুন একটু। বার্সার মূল ভরসার কেন্দ্র যারা, তাদের বেশিভাগই লা মেসিয়ার খেলোয়াড়। আর রিয়ালের সাফল্য আসছে বেশ কবছর ধরে একসাথে খেলা তারকারা, যাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই জমে গিয়েছে জমাট রসায়ন, তাদের এবং কাস্তিয়ার খেলোয়াড়দের যৌথ প্রচেষ্টায়।

সুতরাং, ক্লান্তি বা বিরতি না বরং দলীয় দর্শন থেকে সরে যাওয়া এবং তাৎক্ষণিক সাফল্যের জন্য দলকে দলে পরিণত হবার জন্য পর্যাপ্ত সময় না দেয়াটাই কাল হয়ে দাড়াচ্ছে ইংলিশ ক্লাবগুলোর ক্ষেত্রে। সময়টা অনুধাবনের। সহজ সত্যটা অনুধাবনে যদি পেট্রো ডলারের মালিকেরা বুঝতে অক্ষম হন, তাহলে ইংলিশ ক্লাবগুলোর হালতও হবে আর্মেনিয়দের মতো, স্মৃতির পাতায়। হবেই বা বলছি কেন? নটিংহ্যাম ফরেস্ট এর হালত তো ইতোমধ্যেই পরিণত হয়েছে সেই আর্মেনিয় গির্জার মতো। যা, এক উজ্জল ইতিহাসই শুধু মনে করিয়ে দিতে পারে, বাস্তবে এখন যা মূল্যহীন।