একাই লড়লেন মুশফিক

একাই লড়লেন মুশফিক

• তৃতীয় বাংলাদেশি হিসাবে টানা দুই টি টোয়েন্টিতে অর্ধ শতক পেলেন মুশফিক, আগের ম্যাচেও করেছিলেন ৭২ রান
• ‎১৭৬ এর জবাবে ১৫৯ রানেই থেমে গেলো বাংলাদেশ
• ‎ম্যাচ সেরা : রোহিত শর্মা

নিদাহাস ট্রফিতে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। আগের দু ম্যাচে উদারহস্তে রান বিলানো তাসকিন আহমেদকে বিশ্রামে রেখে আবু হায়দারকে একাদশে অন্তর্ভুক্ত করে মাঠে নামে টাইগাররা। টসে জিতে বেঙ্গল টাইগার মাহমুদুল্লাহ ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান ভারতকে। তাসকিনের বদলে দলে আসা রনি শুভ সূচনা এনে দিলেও সে ধারাটা আর ধরে রাখতে পারেননি বাকিরা। যার ফলে ভারতও পেয়ে যায় ভরসা করার মতো স্কোর।

ভারতের ১৭৬ এর জবাবে একাই বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন গত ম্যাচে ইতিহাস গড়ার নায়ক মুশফিক। কিন্তু এবার আর পারলেন না। বাকিদের ব্যর্থতায় বৃথা গেলো তার চোখ ধাধানো ৭২ রানের ইনিংসটি। পনেরো ওভার পর্যন্ত খেলা ৫০-৫০ অবস্থায় থাকলেও দিনটি নিজেদের করে নিতে পারলো না বাংলাদেশ, পারলো না অনভিজ্ঞ ভারতীয় বোলিং লাইন আপের ফায়দা নিয়ে ম্যাচটি নিজেদের করে নিতে। শেষ পর্যন্ত ব্যাটসম্যানদের ব্যার্থতায় ললাটে জুটলো ১৭ রানের হার।

৫০-৫০ পাওয়ার প্লে

তাসকিনের বদলে দলে আসা রনিকে দিয়ে বোলিং শুরু করে বাংলাদেশ। বলতেই হয় প্রথম ওভারটা চমৎকার বোলিং করেছেন এ তরুণ। বাকি পাঁচ ওভারে চারজন আলাদা বোলার ব্যবহার করেছেন রিয়াদ। ভারতের দুই ওপেনারের অতীত বিবেচনায় বেশ ভালোই করেছে বাংলাদেশের বোলাররা। ছন্দে থাকা ধাওয়ান এবং ওডিআইতে দু দুটো ডাবল সেঞ্চুরির মালিক রোহিত শর্মা ক্রিজে থাকলেও প্রথম ছয় ওভারে আসে ৪৯ রান। বহুদিন পর মনে হলো বাংলাদেশের বোলিংয়ে কোনো একটা পরিকল্পনা ছিল। হতাশার বিষয় ছিল যেটি, তা হলো ওভারে একটি লুজ বল দিয়ে চাপটা আলগা করে দেয়া। নতুবা, শুরুটা আরো ভালো হতে পারত নিঃসন্দেহে।

আলগা বলের আক্ষেপ, ভুগতে থাকা ভারতের রানের পাহাড়

রনির প্রথম ওভার থেকেই ভারতের ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখার একটা চেষ্টা দৃশ্যমান ছিলো বাংলাদেশের বোলারদের বোলিংয়ে। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে প্রত্যেক ওভারেই নিদেনপক্ষে একটা হলেও লুজ বল দেয়ার প্রবণতা চাপের রাখার প্রচেষ্টাকে তো নস্যাৎ করেছেই সাথে, ভারতকেও সাহায্য করেছে কাঙ্খিত সংগ্রহ গড়তে। কলম্বের প্রেমাদাসা যার কাছে প্রহসন ঠেকছিলো সেই রোহিত শর্মা নিয়েছেন পুরো ফায়দাটা। প্রথম ম্যাচ থেকেই রানখরায় ভুগতে থাকা ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক ইনিংস শেষ করেছেন ৮৯ রান করে। শুরুর দিকে অনেক সময় ঝুকি নিয়েই রান বাড়ানোর চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে লুজ বল দেয়ার প্রবণতা ভারতের জন্য কতটা আশির্বাদ হয়ে এসেছিলো সেটা তো দিন শেষেই স্পষ্ট।

১৭-১৯ তিন ওভারের আক্ষেপ

ইনিংসের মাঝপথ জুড়ে লুজ বলের ছড়াছড়ি থাকলেও ম্যাচের লাগামটা ভারত নিজেদের দিকে টেনে নেয় ১৭-১৯ এই তিন ওভারেই। মোস্তাফিজ আর রনির করা এই তিন ওভারের লাগাম ছাড়া বোলিং ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের ছিটকে পরার অন্যতম প্রধাণ কারণ। এই পিচে, যেখানে ১৬০+ রানই চ্যালেঞ্জিং স্কোর সেখানে তাদের উদারতার বদৌলতে ভারতের সংগ্রহ দাড়ালো ১৭৬ এ। শেষ ওভারে রুবেলে রক্ষা পাওয়ায় রানটা আর বাড়েনি। নতুবা যে গতিতে এগোচ্ছিলো ভারত ১৯০ এর কাছাকাছি কিছু আশা করতেই পারত।

অসাধারণ রুবেল

পুরো ইনিংসে বাংলাদেশ দলের হাইলাইটস বলতে রুবেলের বোলিং। রানে থাকা ধাওয়ানের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলা থেকে শুরু করে শর্ট বলে কার্তিককে পরাস্ত করা, অসাধারণ বললেও কম হয়। মোস্তাফিজ আর রনির শেষ তিন ওভারে যখন রানের গতি বাড়ছিলো ঝড়ের বেগে, তখন শেষ ওভারটায় রুবেল করলেন চোখে লেগে থাকার মতো বোলিং। ইয়র্কার, গতি, বাউন্সের অসাধারণ সমন্বয়ে প্রায় পুরোটা ইনিংসই পরীক্ষা নিয়েছেন ভারতের ব্যাটসম্যানদের। যার পুরষ্কার স্বরুপ পেয়েছেন দুটি উইকেটও। তবে, বোবা পরিসংখ্যান সবসময় সঠিক তথ্য দেয় না। যেমন এত কিছু বলার পরেও বোঝানো যাচ্ছে না কতটা অসাধারণ ছিলেন তিনি। লঙ্কা সফরের পুরোটা সময় ধরেই বাংলাদেশের যে খেলোয়াড় ধারাবাহিকতার অসাধারণ নজির দেখিয়ে যাচ্ছেন রুবেল তাদের অন্যতম। আজকের ম্যাচের ফল যদি বাংলাদেশের অনুকুলে আসতো তাহলে রুবেলের শেষ ওভারটার জিকির হতে বাধ্য। কারণ, তার এ ওভারটিই ভারতের ২০০র স্বপ্নে লাগাম টেনেছে।

সুন্দরের রুপে পুড়লো বাংলাদেশ

পাওয়ার প্লে তে বাংলাদেশের ব্যাটিংটাকে ব্যাখ্যা করা যায় মাত্র একটি বাক্যেই। সুন্দরের রুপে পুড়লো বাংলাদেশ। গত ম্যাচ জয়ে অন্যতম দুই পার্শ্বনায়ক লিটন-তামিমসহ সৌম্য সরকার সুন্দরের সৌন্দ্যর্যে মুগ্ধ হয়ে এক প্রকার বিলিয়েই দিয়ে এসেছেন নিজেদের উইকেট। অহেতুক উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে স্ট্যাম্পিংএর শিকার হয়েছেন লিটন। শুরু থেকেই চমৎকার খেলতে থাকা তামিমও যেন আচমকাই মুগ্ধ হলেন সুন্দরে। নতুবা, তার মত একজন ব্যাটসম্যান সুইপ খেলতে গিয়ে ওইভাবে আউট হবেন, এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর। আউট হবার আগে যেভাবে ব্যাট করছিলেন তাতে তার ব্যাটেই আরো একবার ভারত বধের স্বপ্ন দেখছিলো বাংলাদেশ। বিশেষ করে ঠাকুরের ওপর যেভাবে চওড়া হয়েছিলেন, তাতে বড় কিছু আশা অন্যায়ও ছিলো না। সৌম্যকে নিয়ে কোনো শব্দ অপচয় করতে চাই না। তার বোধ নিয়ে বোদ্ধারা যত শব্দ খরচ করেছে তার কিয়দাংশও যদি তিনি বোধ করতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার নিয়ে চিন্তায় প্রেসার বাড়তো না টিম ম্যানেজমেন্ট এর।

পনেরো ওভার পর্যন্ত ৫০-৫০ সম্ভাবনা; হন্তারক আবারো সুন্দর

ইনিংসের পনেরোতম ওভার পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই ম্যাচে ছিলো বাংলাদেশ। শেষ পাঁচ ওভারে পাঁচ উইকেট হাতে নিয়ে লাগতো ৬১ রান। ক্রিজে দুই সেট ব্যাটসম্যান মুশফিক এবং সাব্বির। এর মধ্যে সাব্বিরের গায়ে তো লেগে আছে টি টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট এর তকমাই। অপর দিকে ভারতে অনভিজ্ঞ বোলিং লাইন-আপ। সুতরাং, আশার সুতো বুনতে দোষ ছিলো না বাংলাদেশ সমর্থকদের। কিন্তু, আবারো সেই সুন্দরেই পথ হারানোর গল্প। পনেরোতম ওভারটি করতে এসে দিলেন মাত্র চার রান। আর সেখান থেকেই ৫০-৫০ তে থাকা ম্যাচটি হেলে পড়ে ভারতের দিকে। এরপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আস্কিং রেটের সাথে আর পাল্লা দিতে পারেনি বাংলাদেশ।

হায় টি টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট

শেষ চার ওভারের ভারতের অনভিজ্ঞ বোলিং লাইন আপের ওপর চড়াও হয়ে যে ম্যাচটা বাংলাদেশের অনুকুলে আনা যেত সেটি চোখে আঙ্গুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছেন মুশফিক। কিন্তু টি টোয়েন্টি ব্যাটিংটা ঐই সময় যার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত ছিলো সেই সাব্বির দিলেন নিদারুন ব্যার্থতার পরিচয়। ঠাকুরের বলে বোল্ড হয়ে সমাপ্তি টেনে দিলেন বাংলাদেশের শেষ আশাটুকুর। ২৩ বলে ২৭ রান করেছেন বটে, কিন্তু এমন অনভিজ্ঞ একটি বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে এতবড় সুযোগ পাওয়ার পরেও সেটি হাতছাড়া করার দায় এড়াতে পারেন না তিনি।

অনন্য মুশফিক, অসাধারণ মুশফিক

দ্য রিয়েল টাইগার, একাই বুক চিতিয়ে লড়লেন ভারতের বোলারদের বিপক্ষে। ড্রাইভ, স্কুপ, ডাউন দ্য ট্র্যাকে গিয়ে মারা ছয় কি ছিলো না ইনিংসটিতে? নিখুঁত একটি ইনিংস খেলার পরেও সঙ্গীর অভাবে হারের যন্ত্রণা নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছে বাংলাদেশের এই লিটল মাস্টারকে। এতদিন টি টোয়েন্টি খেলতে পারেন না বলে যে অপবাদটা ছিলো তা পরিহাসে পরিণত করলেন এই দুই ইনিংসে। দু ইনিংসে একবারও আউট তো হনইনি, হতে পারেন এমনটাও মনে হয়নি একবারও। আর দুটো ইনিংসই ছিলো শতভাগ নিখুঁত, এতেই বোঝা যায় ব্যাট হাতে কেমন ফর্মে আছেন তিনি।  সিরাজকে ডাউন দ্য ট্র্যাকে গিয়ে মারা ছয়টা দেখেছেন তো বিসিবি প্রধান? তিনি তো আবার মুশফিকের ছয় মারার সক্ষমতা সম্পর্কে বেখবর।

একাদশ নির্বাচনে একটি ভুল, ম্যাচ হেরে তার খেসারত দান

প্রথম ম্যাচ শেষেই জবান বলেছিলো টি-টোয়েন্টিতে মেহেদীকে অল-রাউন্ডার হিসাবে খেলানো ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি ব্যাটিং পারেন অবশ্যই, তবে সেটি টি-টোয়েন্টির উপযুক্ত নয়। সাব্বির আউট হবার পর পুরো দায়িত্বটাই এসে পড়ে মুশফিকের একার ওপর। হ্যাঁ, নিখাদ কোনো ব্যাটসম্যান থাকলে ম্যাচটা অবশ্যই জিততো এমনটা বলা সম্ভব না, কিন্তু ক্নান্ত মুশফিকের বদলে ফ্রেশ একজন ব্যাটসম্যান অন্তত চেষ্টাটা করতে পারতো। কারণ, শেষ তিন ওভারেও যে আস্কিং রেট ছিল তা এ যুগে তাড়া করা অলিক কিছু না।

লঙ্কা ম্যাচ শেষে তামিম যে স্মার্ট ক্রিকেটের ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলেন, সেটি খেলতে পারলে এ ম্যাচটাও হাসিমুখেই শেষ করতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু, এক মুশফিক বাদে বাকিরা যা খেললেন তাকে স্মার্ট বলার জো নেই। এখনো আশার মৃত্যু ঘটেনি। লঙ্কানদের ওপর আরেকবার থাবা বসাতে পারলে সম্ভাবনা থাকছে ফাইনাল খেলার। সেটি যদি তামিমের স্মার্ট ক্রিকেটের সংজ্ঞা মেনে হয় তবে তাই সই, কিন্তু সেটা তামিমকেও করে দেখাতে হবে। কারণ, আজকের হারের পেছনে তার অসময়ে আনস্মার্ট শটটার দায়ও কম না, যেমন কম না রিয়াদের অমন সময়ে খেলা ঐই অযাচিত শটটির।