গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের বিনোদনভিত্তিক মিডিয়া ‘মিড ডে’র বিশেষ আয়োজন ‘সিট উইথ হিটলিস্ট’-এর সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান শৈল্পিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় বসেন পারফেকশনিস্ট আমির খান। সাধারণত তিনি সাক্ষাৎকার দেন না। চলচ্চিত্রপাড়ার নিয়মিত অনুষ্ঠানগুলোতেও তিনি বরাবরের মতোই গরহাজির থাকেন, এমনকি নিজের পুরস্কারটিও অন্যদের দিয়ে আনিয়ে থাকেন। মিড ডের সাংবাদিক মায়াংক শেখর-এর নেয়া এমন দুর্লভ ও দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি ‘জবান’-এর জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহমুদা প্রিয়তী
২০১৭ সালের বড় খবর অবশ্যই ‘দঙ্গল’ ও চীনকে নিয়ে ছিল। প্রযোজক সিদ্ধার্থ রায় কাপুরের মতে, চীনে সিনেমাটির অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণ ছিল ভারত উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে পিতা-কন্যার সংবেদনশীল সম্পর্কের সঙ্গে নিজেদের চেতনার মিল খুঁজে পাওয়া। এ বিষয়ে আপনি কি একমত?
আমির খান : সম্প্রতি চীন ও তুরস্কে সফরকালে আমাদের সঙ্গে তাদের আবেগ-অনুভূতির সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর মঙ্গে মিল আমার চোখেও পড়েছে। চীনের সিনেমাহলগুলোয় দঙ্গল নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া বেশ খেয়াল করেছিলাম। ভারতীয় দর্শকের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম। তারা সিনেমাটি দেখে হেসেছেন, কেঁদেছেন আবার একই সঙ্গে তালিও বাজিয়েছেন। দু’জায়গার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখিনি।
চীনের সিনেমা দেখার সময় কি ভারতীয় দর্শকের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বলে মনে হয় আপনার? দু’দেশের চলচ্চিত্র দর্শকের মধ্যকার আবেগকেন্দ্রিক যে মিল ওই ব্যাপারে আপনার মত কী?
আমির খান : বেশ, ‘ক্রোচিং টাইগার হিডেন ড্রাগন’ (২০০০) দেখে প্রথমবারেই বেশ উপভোগ করেছিলাম। সমানে সিটি আর তালি বাজিয়েছিলাম। ছবিটি সম্পর্কে কোনাে অনুমান নিয়ে সেটি দেখতে বসিনি। জ্যাকি চ্যান-এর সিনেমা খুব ভালো লাগতো আমার। কলেজে থাকাকালে প্রথম পুলিশ স্টোরি (১৯৮৫) দেখেছিলাম। সিনেমাটির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। একই সঙ্গে দারুণ হাসি উদ্রেকজনক। তখন থেকেই ওই ধরনের ছবির সঙ্গে একটি ধারাবাহিক ভালাে লাগার সম্পর্ক চলে আসছে আমার।
আরেকটা কথা উঠে এসেছিল এ রকম যে, দঙ্গল সিনেমায় শিশুদের যেভাবে ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা হয়েছে এবং তাদের পিতা বিজয়ী হিসেবে রূপান্তরে বদ্ধপরিকর ছিলেন– ব্যাপারটি চীনের পরিস্থির সঙ্গেও মিলে যায়। তারা যেভাবে তাদের সন্তানদেরও খুবই অল্প বয়স থেকে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাওয়ানোর জন্য কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করান ওই যোগসূত্র বা মিলটি কি আপনার চোখে পড়েছে?
আমির খান : ব্যাপারটিকে কখনো সেভাবে দেখিনি। চীনের দর্শকের প্রতিক্রিয়ার কথা শুনেছি। তারা সম্ভবত সিনেমাটি দেখেছেন এবং সেটি শেষ হওয়ার পর পরই নিজেদের পিতা-মাতার সঙ্গে কথা বলতে অধীর হয়ে গিয়েছিলেন। এটি আসলে খুবই ব্যক্তিগত, মানবীয় একটি যোগসূত্র বা সম্পর্ক- যেটিই বলুন না কেন।
ব্যক্তিগতভাবে কোনো অভিনেতা হিসেবে বৈশ্বিক পরিচিতি পাওয়াটিকে কি আপনি ইন্টারনেটের সুফলে ঘটা বলে মনে করেন?
আমির খান : আমার মনে হয় এটি ‘থ্রি ইডিয়টস’ (২০০৯)-এর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ইন্টারনেটে বেশ বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছিল সেনেমাটি। রাজু (হিরানি) ও ভিনোদ (চোপড়া) সেটি আগেই ধারণা করতে পেরেছিলেন। চীন থেকে কেউ একজন এখানে যোগাযোগ করেছিলেন এবং সেখানে তিন বছর পর সিনেমাটি মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যেই অধিকাংশ মানুষের এটি দেখা হয়ে গিয়েছিল। তারা তখন আমার অভিনীত আরো সিনেমার খোঁজ করে। এখন তো ‘তারে জমিন পার’ (২০০৭), ‘লগন’ (২০০১), ‘রং দে বাসান্তি’ও (২০০৬) দেখা হয়ে গেছে সম্ভবত।
ইন্টারনেটের শক্তিশালী ভূমিকার কথা মাথায় রেখে কোনাে এক সংবাদপত্রে আপনাকে ‘বড় পর্দার মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম! ভবিষ্যতে নেটফ্লিক্স বা ওই ধরনের কোনাে প্ল্যাটফর্মে কি কাজ করবেন আপনি?
আমির খান : সেখানে এক দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছিলাম, অভিনেতা বা প্রযোজক হিসেবে নয়। কোনো দর্শক হিসেবে সিনেমা অবশ্যই আমার জন্য বেশি পছন্দের– বিশাল পর্দা, ডলবি আটমোস সাউন্ডের সঙ্গে বেশ বৃহৎ, সমৃদ্ধ একটা অভিজ্ঞতা সেটি, একটি ল্যাপটপের পর্দার চেয়ে তো অবশ্যই বেশি। এর মানে এই নয় যে, কখনো নেটফ্লিক্স বা কোনাে টিভি সিরিজে কাজ করবো না। মান যদি চলচ্চিত্রের মতােই ভালাে হয় তাহলে কেন নয়? নেটফ্লিক্স-এর পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে এ রকম কিছু তৈরির জন্য যোগাযোগও করা হয়েছিল। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের বিষয়বস্তুগুলো একটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নেটফ্লিক্স-এ একটি গল্পের সবকিছু একটি সিজনেই বলে শেষ করে দিতে পারবো না। আবার একটি সিজনের গল্পটিও আমাকে কয়েকটি এপিসোডে ভাগ করে দেখাতে হবে। ওই রকম কিছুর প্রস্তাব পেলে কাজ করতে অবশ্যই আগ্রহী আমি। আমি ‘ব্রেকিং বেড’ দেখেছি। আমার প্রিয় এটি। ‘গেইম অফ থ্রোন্স’ আর ‘হাজি অফ কার্ডস’ও আমার ভালো লাগে।
আপনার সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এর একটি বড় দিক এটিও ছিল, বর্তমানে ইন্টারনেটের কারিশমায় যে কেউ কী করে রাতারাতি তারকা বনে যেতে পারে। এ ধরনের তারকাখ্যাতিকে আপনার অভিজ্ঞতার পেয়েছি কীভাবে তুলনা করবেন? এখন যেমন যে কোনাে কিছুই খুব দ্রুত ভাইরাল হয়ে যেতে পারে?
আমির খান : যেসব ভিডিও সাধারণত ভাইরাল হয়ে থাকে এগুলো একেবারেই দেখার মতাে হয়ে থাকে। যেমন- একটি বিড়াল খুব অদ্ভুত কিছু একটি করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষ ইন্টারনেটে প্রকৃত মেধাবীদেরও খুঁজে বের করে নিচ্ছে। এটি সত্যিই অনেক বড় একটি সুযোগ। সিক্রেট সুপারস্টার-এ ছোট শহরের মেয়েটার যেমন নিজেকে প্রকাশের সহজ কোনো সুযোগ মেলেনি তেমনি তার ভেতরে ইচ্ছা আছে, আবেগ আছে। আর ইন্টারনেট আছে বলেই তাকে আর ছোট্ট গণ্ডির ভেতরে চক্কর কেটে বেড়াতে হয়নি।
নব্বইয়ের দশকে যখন বক্স অফিসের আয় নিয়ে তেমন একটা হই চই হতো না এখনকার মতো তখন কীভাবে কোনো অভিনেতাকে তারকা হিসেবে মূল্যায়ন করা হতো?
আমির খান : আমার মনে আছে, সাত বছর বয়স থেকেই ট্রেড গাইড আর নানান বক্স অফিস সংক্রান্ত সংবাদপত্র-ম্যাগাজিন পড়তাম। সেখানে আমরা আমার বাবার সিনেমাগুলোর সার্বিক আয়, প্রশংসা বা সমালোচনা বিষয়ক সব খবর পেতাম। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে বক্স অফিসের বিভিন্ন ধারণা সবাই পেয়ে যেতেন। কেননা সিনেমা তাদের জন্য একটি ব্যবসার মতােই ছিল। বর্তমানে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো বক্স অফিসের আয়ের সংখ্যা তুলে ধরছে। এটিও তাদের নতুন পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি।
যখন বক্স অফিসের আয় নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না তখনকার সময় ছোট কোনাে মফস্বলে নিজেদের তারকাখ্যাতির প্রমাণ কী করে যাচাই করা হতো? মানুষ হঠাৎ করে কোনো তারকার চুলের স্টাইল নকল করা শুরু করে দিয়েছে কি না- সেটি?
আমির খান : তখনকার দিনে তারকাখ্যাতি মাপার বিভিন্ন মাপকাঠি ছিল আসলে। চুলের স্টাইলের নকল ওইগুলোর একটি। মিস্টার বচ্চন যখন বিশাল তারকা বনে যান তখনকার কথা মনে আছে আমার। তার মতো করে প্যান্ট বানাতে চেয়েছিলাম। এখন আমার জন্য ব্যাপারটি কেবলই এক তারকা কত মানুষকে হলে টেনে আনতে পারেন সেটিই মুখ্য। এর মানে, মানুষ যদি আপনাকে ও আপনার কাজ ভালােবাসে তাহলে তারা নিশ্চয় আপনার কাজ দেখতে হলে আসতে চাইবেন। এটিই মুখ্য বিষয়। আমরা প্রায়ই কোনো অভিনেতার ব্যবসায়িক সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে তার তারকাখ্যাতির যাচাই করতে চাই। এটি ভুল একটি তরিকা। ‘পিকে’ কিংবা ‘দঙ্গল’-এর সাফল্য অবশ্যই সিনেমা দুটির স্ক্রিপ্ট ও চলচ্চিত্রায়ণের অসাধারণতার জন্য এত বড় সাফল্য পেয়েছিল। আমার জনপ্রিয়তার সঙ্গে এর আসলেই কোনো সম্পর্ক খোঁজাটা বোকামি। আমার জনপ্রিয়তার যাচাই তখনই হতে পারে যখন দর্শকের এমন একটা সিনেমা উপহার দেবো যেটা তারা পারতপক্ষে দেখতে চান না। তখন তারা শুধু আমার নামের জোরেই আসবেন। তাই যদি কোনো অভিনেতার বক্স অফিস আয় নিয়েই মানদণ্ড খাড়া করতে চান আপনারা তাহলে তাদের ফ্লপগুলো কেমন আয় করে সেটির খোঁজ নিয়ে দেখুন।
খানরা তো ২৫ বছরেরও বেশি সময় বলিউডে রাজত্ব করছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সালমান ও শাহরুখের সঙ্গে প্রথম কবে কোথায় দেখা হয়েছিল তা কী মনে আছে আপনার?
আমির খান : সালমানের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল বাবলা-র (পরিচালক আদিত্য ভট্টাচার্য) বাড়িতে। তিনি ‘রাখ’ (১৯৮৯) পরিচালনা করেছিলেন। সেকেন্ড স্ট্যান্ডার্ডে ( সেন্ট এনি’স স্কুলে) আমি আর সালমান একই সঙ্গে একটি বছর একই ক্লাসে ছিলাম। তখন একে অপরকে চিনতাম না আমরা! বাবলার বাড়িতে গিয়েছিলাম ‘প্যারানয়া’ শর্টফিল্ম নিয়ে কথা বলার জন্য, যেটাতে আমিই অভিনেতা, আমিই স্পট বয়, প্রধান প্রযোজক- সবই এক সঙ্গেই ছিলাম। এক মাস লেগেছিল সেটির শুটিংয়ে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। আমার প্রথম অভিনয়ও সেটিই ছিল। সালমান কার্তার রোডে সাইকেল চালাচ্ছিল। বাবলা-কে সেও চিনতো। আমরা তখন বাবলার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করেছিলাম। সালমানও তার অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা জানায় আমাকে। দারুণ মিষ্টি একটা ছেলে ছিল সে। শাহরুখের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎটি বেশ ছোট ছিল। জুহির (চাওলা) সঙ্গে আমার এক সিনেমার সেটে। সেও তখন জুহির সঙ্গে একটা সিনেমায় (রাজু বান গ্যায়া জেন্টলম্যান) কাজ করছিল। তখনো তার প্রথম সিনেমা (দিওয়ানা) মুক্তি পায়নি। শাহরুখও দারুণ মিষ্টি ছিল। আর আমাদের প্রথম সাক্ষাৎটি ছোট হলেও বেশ উষ্ণ ছিল।
এবারে বড় দুই তারকার (সালমান ও শাহরুখ) সিনেমা কোনো রেকর্ড ভাঙা তো দূরের কথা, ভালোমতো ব্যবসা করতে না পারায় এ বছরটিকে যে বলিউডের জন্য সাধারণ গড়পরতার চেয়েও খারাপ মনে করা হচ্ছে- আপনার কী মনে হয় না, ইন্ডাস্ট্রি বাঁচানোর জন্য প্রতি বছর খানদের ওপর একটু বলিউড বেশিই নির্ভর করে থাকে?
আমির খান : খানরা ছাড়াও অনেকেই আছেন যারা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন– অক্ষয় (কুমার), হৃতিক (রোশান), অজয় (দেবগন)…। এ কথা ঠিক, আমরা তিনজন (তিন খান) বেশ দীর্ঘ একটা সময় সাফল্য পেয়ে আসছি। তাই (আমাদের থেকে) এমন আশা রাখাটাও খুবই স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে সিনেমা হিট হয়, মাঝে মধ্যে হয় না। এক সময় বচ্চনজি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। আমাদের কেউই তার মতো তারকাখ্যাতি দেখতে পারবো না কখনো। এক সময় হলে তার আট-আটটি সিনেমা পর পর হিট হয়েছিল। তার নামে হলের সিট আর পপকর্ন-এর প্যাকেট- দুটিই দেদার বিক্রি হতো। যদিও এ রকমটা আরো তারকার ক্ষেত্রেও ঘটার কথা ছিল তবুও এসব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আসলে কোনো তারকা হওয়া অলীক-অবাস্তব একটা ব্যাপার। মানুষ কী জন্য আমার কাজের সঙ্গে নিজেদের আবেগ-অনুভূতির যোগসূত্র খুঁজে পায় এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই।
২০১১ সালের একটা সাক্ষাৎকারে অভিযোগ তুলেছিলেন, তৎকালীন প্রযাজনা প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ লাভ আসবে এ সম্পর্কে আগে থেকেই করা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অভিনেতাদের পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে। ওই সময়ের অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানই আজ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আপনি কি এমনটিই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন?
আমির খান : ভবিষ্যদ্বাণী করার আমি কে? কিন্তু সেটি অবশ্যই একটা বাজে পদ্ধতি ছিল। এই যেমন ধরুন, দঙ্গল ৩৮৫ কোটি রুপির ব্যবসা করেছিল। আর আমি পরবর্তী ছবি নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি ৪০০ কোটি রুপিতে বিক্রি হয়ে গেছে। কেন? কারণ একটা প্রতিষ্ঠান ওই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে চেয়েছে। তারাও ভেবেছেন আমার পরবর্তী ছবিও ‘দঙ্গাল’-এর মতো কিংবা এর চেয়েও বেশি ব্যবসা করবে। এটি বিশাল বড় একটা অনুমান ধরে নিয়ে মাঠে নামা এবং অবশ্যই তা সুস্থ কিছু হতে পারে না। একটা অনুমান বা আশার ওপর নির্ভর করে কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের এতটা বিনিয়োগ করা উচিত নয়। অর্থটা বিনিয়োগের আগে আপনাকে অবশ্যই নিশ্চয়তা পেতে হবে। আগের সিনেমা যদি ৩৮০ কোটির ব্যবসা করে তো আপনি এতটুকু নিশ্চিত হতে পারেন, পরেরটা ২০০ কোটির মতো ব্যবসা করবে। এ কারণেই নিজের পারিশ্রমিক দিয়ে আমার সিনেমার বাজেট ভারী করাই না। আমার নিয়ম হলো, প্রথমেই কোনো অংক দাবি না করা। প্রথমে বাজেটের পুরো অর্থ সিনেমা তৈরিতে, বাকি সবার পারিশ্রমিক পরিশোধে খরচ করা হয়। এরপর প্রথম ভাগে আসা অর্থে যায় প্রিন্ট ও বিজ্ঞাপন খাতের খরচ মিটিয়ে নিতে। এভাবে যদি সিনেমা মার খায় তো আমি কিছুই পাই না। এতটুকু ঝুঁকি নিতে রাজি। অন্যথায় হারই ভালো।
তাহলে চীনে দঙ্গল ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপির ব্যবসা করলে আপনার নিশ্চয় বেশ বড় একটা অংকের অর্থলাভ হবে?
আমির খান : অবশ্যই এবং আমার ভাগ তখন বুঝেও নেবো। বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানও তখন তাদের অর্থ নিয়ে সুবিধাজনক জায়গায় থাকবে। কোনো সিনেমা ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপির ব্যবসা করলে প্রথমত. সরকার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর কেটে নেবে, এরপর বড় একটা ভাগ যায় হল ও বিভিন্ন প্রদর্শনী খাতে। সবকিছু প্রায় ভারতের মতো হলেও চীনে বাইরের একটা সিনেমা ওই দেশে কত আয় করে, কত দেশের বাইরে নিয়ে আসতে পারবে এ জন্যও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে (সিনেমা খাতে বৈদেশিক অর্থ উপার্জন)। শেষ পর্যন্ত অংকটা ১২ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপরও এটি বেশ ভালাে।
চীনা বক্স অফিস থেকে পাওয়া সাড়ে ১২ শতাংশ দিয়ে অট্টালিকাও কিনে ফেলেছেন নাকি?
আমির খান : আমি টাকার হিসাবে খুব একটা ভালো না। নিজে তেমন বিনিয়োগ করি না। আমার সম্পত্তির পরিমাণও খুব কম। আসলে আমার চিন্তা-ভাবনায় ওইদিকে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে না। খুব একটা ব্যবসামনস্ক মানুষ নই।
চলচ্চিত্র ব্যবসায় তো আপনাকে দারুণ বলতেই হবে। প্রযোজক হিসেবে আপনার শতভাগ সাফল্যের রেকর্ডটি এখন পর্যন্ত অক্ষুণ্ন আছে।
আমির খান : সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে আমার কাজের মধ্যে কোনো ঝামেলা চাই না। তাই যখন ‘ধোবি ঘাট’ (২০১১) বানাতে চেয়েছিলাম তখন কাজটার জন্য ৫ কোটি রুপিই দিয়েছিলাম। কোনো প্রযোজক হিসেবে জানতাম বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনার পরের অল্প কিছু লাভ হবে আমাদের। আপনি যখন বাণিজ্যিকভাবে নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত হয়ে সিনেমা বানাবেন তখনই সৌভাগ্য বয়ে আপনার জন্য সিনেমা। আমিও এটিই করি। আর এটাই নিজের মতো কাজের সুযোগ করে দেয় আমাকে।
প্রতিবারই কীভাবে সম্ভব হয় এটি? বাজেট, অসাধারণ স্ক্রিপ্ট, অসাধারণ কাস্টিং, শুটিং লোকেশন, ক্যামেরার কাজ। আরেকটা নতুন ব্যাপার জেনেছি, সিনেমার প্রথম ভাগটা দর্শক কীভাবে নেয় এ ব্যাপারে সিনেমার টেস্টিংয়ে আপনার জোর দেয়ার কথা। নাম-পরিচয়হীন মানুষ আপনার সিনেমার প্রথম দিকের খানিকটা অংশ বার বার দেখে যা সমালোচনা-পরামর্শ দেয়। এর ওপর ভিত্তি করেই প্রথম এডিটিং করা হয়। এতে কি নিজেদের ক্রিয়েটিভ দলের নিয়ন্ত্রণে প্রভাব পড়ে না? প্রায় যেন সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা থেকে তৈরি সিনেমা… অদ্ভুত… না?
আমির খান : না, এটা মোটেও সাধারণ মানুষের চিন্তার ফসল হয়ে যায় না। রাস্তায় নেমে মানুষকে মোটেও জিজ্ঞাসা করি না, কী নিয়ে সিনেমা করা উচিত আমার কিংবা তারা কোনো একটা অংশ কাটতে বললেই তা ছেঁটে ফেলি এ রকমও না ব্যাপারটি। ওই কাজটার চিন্তাটা হচ্ছে, আমাদের কাজে একটা গল্প আছে যেটা আমরা মানুষকে শোনাবো। আমি শুধু এতটুকুই নিশ্চিত করতে চাই, যে গল্প তাদের শোনাচ্ছি তা সহজবোধ্য ও সঠিক। না হলে মানুষ হয়তো অন্য কিছুও বুঝতে পারে। একটা সিনেমা তৈরির সময় গল্পটার ভেতরে আমরা এতটাই ঢুকে যাই যে, সেটি বাইরের কেউ কীভাবে গ্রহণ করবে তা বুঝতে পারাটা আর সম্ভব হয় না আমাদের পক্ষে।
এ রকম কোনো উদাহরণ কি দিতে পারবেন, আপনার কোনো সিনেমার বেলায় যেখানে আপনারা যা বলতে চেয়েছেন আর দর্শকরা যা বুঝেছে এর মাঝে ফারাক ছিল?
আমির খান : দুটি উদাহরণ দিচ্ছি। ‘সরফারাজ’ (১৯৯৯)-এর কথাই ধরুন, এটি পুলিশকে নিয়ে একটা সিনেমা ছিল। পুলিশের কাজ নিয়ে ছিল সেটি। স্ক্রিনিং টেস্টে একের পর এক মন্তব্য আসছিল, ‘পুলিশের কাজ কোথায়? পুলিশি কিছুই তো দেখতে পাইনি আমরা। ওই ব্যক্তি (পুলিশ) তো সারাক্ষণ গজল শোনায় ব্যস্ত!’ আমাদের তো মুখ হাঁ! এটা কীভাবে সম্ভব? এ তো খেরা নাকার দৃশ্য। পুরোপুরি অ্যাকশনের সঙ্গে পুলিশ তার পাও ভাঙলো, হাসপাতালে নিতে হলো তাকে। আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো– সব দৃশ্যই তো ছিল! বকা বনে গেলেও আমরা সিনেমাটায় যে কিছু একটা ঝামেলা আছে তা বুঝতে পেরেছিলাম। আর এ কারণে নতুন তিনটি দৃশ্যও সেখানে যোগ করি আমরা।
আরেকটি উদাহরণ?
আমির খান : ‘তারে জমিন পার’ সিনেমার পুরো চিন্তাটা ছিল, প্রত্যেককেই সমাজে গ্রহণ করে নিতে হবে। প্রত্যেক শিশুরই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। তাই বলে তাদের আপনি পরস্পরের থেকে পৃথক করে রাখতে পারেন না। আমরা বলতে চেয়েছিলাম, স্পেশাল স্কুলগুলোর আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। সব শিশুর একই স্কুলে পড়াশোনা করা উচিত। অথচ আমরা প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম এ রকম- ‘তো আপনারা বলছেন যে, ইশান একটা স্পেশাল শিশু। তাই তার স্পেশাল স্কুলে পড়া উচিত!’ আমরা একদম এর উল্টোটা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তখনই আমরা বুঝতে পেরছিলাম, একটা ভুল বোঝাবুঝি রয়ে গিয়েছিল। এর কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারিনি- এ ভুলটা কেন হলো? এখন যদি আপনার মনে পড়ে, সিনেমার টাইটেল ট্র্যাকটির দৃশ্যায়ন হয়েছিল একটা স্পেশাল স্কুলে। আমি যেখানে পড়াতাম। সেদিন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া দিবস ছিল। স্লো-মোশনে শিশু নাচছিল, মা-বাবা তাদের সন্তানদের আদরে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন। আমার দু’চোখে জল ছিল। ঠিক এ সময়ে গানটা শুরু হয়। এরপর পর্দায় ইশানকে দেখা যায়। মন খারাপ করে সাধারণ একটা বোর্ডিং স্কুলে একা বসে থাকে ইশান। মা-বাবা তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। কারণ তার বড় ভাইয়ের একটা টেনিস ম্যাচ ছিল। ভাই কীভাবে খেললো, খেলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাবার মন কীভাবে খারাপ হলো- এসব দেখানো হলো। এখন আমার এক বন্ধু আমিন হাজি- ‘লহান’-এ যে বোবার চরিত্রে অভিনয় করেছিল। সে বলেছিল মূল সমস্যাটা এখানেই থাকতে পারে। ‘তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ শিশুরা স্পেশাল স্কুলে বেশি ভালোবাসা, বেশি মনোযোগ পাচ্ছে। আর এরপরের দৃশ্যেই দেখানো হচ্ছে সাধারণ বোর্ডিংয়ে থাকা বিষণ্ন ইশানকে। দেখে মনে হচ্ছে, তোমরা বলতে চাইছ, তারও স্পেশাল স্কুলেই থাকা উচিত, সাধারণ কোথাও না।’ প্রথমে তার সঙ্গে একমত হইনি। কারণ অবশ্যই এ রকম কিছু বোঝাতে চাইনি। যাই হোক, মেনে নিই তার পরামর্শ এবং কাজে লাগাই। তাই আমার মুখ থেকে ইশানের বিষণ্ন মুখ দেখানো বাদ দিয়ে আমরা সরাসরি তার বড় ভাইয়ের কাছে চলে যাই যে টেনিসটা ঠিকমতো খেলতে পারছিল না সেদিন। এরপর আমরা ইশানকে পর্দায় আনি। ওই ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই সমস্যাটার সমাধান করে ফেলি। তারপর আর কেউ সিনেমার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। এখন আমার আনন্দের জল ভরা চোখের পর ইশানের বিষণ্ন মুখ দেখিয়ে অবচেতনে হয়তো এটা বোঝাতে চেয়েছি, আমার চরিত্রটির (নিকুম্ব) ও ইশানের বয়সে ডিস্লেক্সিয়ায় ভোগার কারণে একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে আমার পদ্ধতিটি কাজ করেনি। আর আমি ওই ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ থেকেই এ রকম টেস্ট স্ক্রিনিং করাই।
আপনার প্রথম বড় সিনেমার সময় থেকেই সিনেমার প্রথম কাট সাধারণ জনতাকে দেখিয়ে মূল্যায়ন করান আপনি?
আমির খান : হ্যাঁ। কখনো কখনো ওই মূল্যায়নে ভালো হয়, মাঝে মধ্যে ওইসবের কোনো মানেই থাকে না। তাছাড়া প্রথম দিকে করা অনেক কাজই পরের পোস্ট প্রডাকশনের মধ্য দিয়ে যায়। আমি আপনাকে বড় একটি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রায়ই লোকে এই অভিযোগ তোলে, এক পর্যায়ে গিয়ে প্রায় প্রতিটা সিনেমাই বেশ বোরিং হয়ে যায়। ‘দ্বিতীয় ভাগে গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো সিনেমাটাই বোরিং হয়ে গিয়েছিল’ বা এ রকম কিছু। এখন বেশির ভাগ লোকেই আপনাকে গানটা ছেঁটে দিতে বলবে। কিন্তু এটা মোটেও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সিনেমার ওই মুহূর্তে গানটার প্রয়োজনীয়তা আপনি অনুভব করতে পারবেন হয়তো। কিন্তু সমস্যাটার মূল হয়তো এরও আগে লুকিয়ে আছে। আপনার গল্প বলায় কোথাও ভুল আছে। সেটি কী এবং কোথায় তা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। এটা ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগের উপসর্গ নিয়ে বলার মতো। রোগটা কি সারানো সম্ভব? না, সম্ভব নয়।
ঠিক একইভাবে আপনার হয়তো দ্বিতীয় ভাগে এসে একঘেয়ে লাগতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যাটা হয়তো সিনেমার প্রথম ভাগেই রয়ে গেছে। আপনাকে তখন তা খুঁজে বের করতে হবে। হয় আপনি স্ক্রিপ্টে মনোযোগ দেননি অথবা মূল প্লটের পারিপার্শিক বিষয়গুলো অবহেলিত রয়ে গেছে। আর স্ক্রিপ্টের কী কোথায় ঠিক করতে হবে সেটিও খুব সাবধানতার সঙ্গে বুঝতে হবে আপনাকে। তাই একটা সিনেমা মোটেও সর্বসম্মতিক্রমে বানানো হয় না। ‘রাজা হিন্দুস্তানি’ নিয়ে টেস্ট স্ক্রিনিংয়ে দর্শকের কাছ থেকে বেশ বাজে প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম আমরা। ধার্মেশ (দর্শন)-এর তো ‘ওহ ভগবান, আমরা শেষ!’ ধরনের অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তখন তাকে বলেছিলাম, আমার মতে, তোমার কিছুই পরিবর্তন করা উচিত নয়। এ কারণে ব্যাপারটা এখানেই আপনাকে জানতে হবে কোথায় পরিবর্তন দরকার, কোথায় নয়।
‘রাজা হিন্দুস্তানি’ আপনারা কাকে কাকে দেখিয়েছিলেন? মালাবার হিলসের কাউকে নয় নিশ্চয়। তারা এমনিতেও খারাপই বলতো। কারণ সিনেমাটা খুবই গম্ভীর হার্ডকোর ঘরানার ছিল।
আমির খান : বেশ, আমরা সিনেমাটি হার্ডকোরপ্রিয় ভারতীয় দর্শককেই দেখিয়েছিলাম। ধার্মেশ-এর পরিবারে বিয়ের একটা অনুষ্ঠান চলছিল। তো পাঞ্জাব, এলাহাবাদ ও আরো জায়গা থেকে অনেকেই এসেছিলেন তার বাড়িতে।
আমার এক গিটারিস্ট বন্ধু যে কি না অমিত ত্রিবেদির আথে সংগীতায়োজনে কাজ করার সময় আপনার পঞ্চগনির বাড়িতে ১০ দিন থেকেছিল। তার কাছ থেকে আরেকটা ব্যাপারে শুনেছি যে, গান ও সংগীতায়োজনের ব্যাপারে আপনি বেশ কড়া। কোনো হিন্দি চিত্রপরিচালকের জন্য তার সিনেমার এসব বিষয়েও জ্ঞান রাখাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমির খান : গান বা সংগীতায়োজনে কোনো প্রশিক্ষণ তো নেই আমার। আর আমার করা সব সিনেমার ওই ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িতও হই না যদি না সিনেমার প্রযোজক বা পরিচালক নিজে থেকেই আমাকে বিষয়টার সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য বলেন। মানসুরের (খান) সঙ্গে ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’ বা ‘কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক’-এ কাজ করার সময় পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে বেশ ভালোভাবে জড়িত ছিলাম এখন যেমনটা নিজের প্রযোজিত সিনেমার ক্ষেত্রে থাকি।
জড়িত থাকা বলতে কি পরামর্শ দেয়া বোঝাচ্ছেন?
আমির খান : তাদের স্কোর শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাই। কী অনুভব করলাম তা সংগীতায়োজককে বোঝানোর চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে কী চাই তা বোঝাতে হয়তো অবচেতনে কড়া ব্যবহার করে ফেলি। কখনো কখনো টেকনিক্যাল কাজেও লেগে যাই। কিছু পরামর্শ দেয়ার মতো বেসিক জ্ঞান আছে আমার। যেমন- ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এর ‘মে কিউ হু’ (আমিরের গাওয়া) গানটা ফালসেটো মোডে কম্পোজ করা হচ্ছিল যেটা শুনে ঠিক মনে হচ্ছিল না। অমিতকে ব্যাপারটা পরিবর্তন করতে বলি। সে আমার পরামর্শ শুনেছিল। আরেকটা গান ‘মে নাচদি ফিরা’ ইতিমধ্যেই ফালসেটো মোডে করা হয়ে গিয়েছিল। একই সিনেমার দু’দুটা গুরুত্বপূর্ণ গানের ক্ষেত্রে একই জিনিস তো ব্যবহার করা যায় না।
আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনের বিজ্ঞান নিয়ে আজ অনেক কিছু বললেন। চলচ্চিত্র নির্মাণকে শিল্পের সঙ্গে কীভাবে মেলাবেন (দর্শক সারি থেকে মোহান বসুর প্রশ্ন)।
আমির খান : আপনার প্রশ্নটাকে আরেকটু গুছিয়ে বলছি। এটা চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ক কোনো বিজ্ঞান নয়, এটা সর্বজনীন পর্যায়ের যোগাযোগ বিষয়ক। কারণ চলচ্চিত্র যদি সর্বজনীন পর্যায়ে গৃহীত হওয়ার জন্য না বানানো হয় তাহলে আপনার বলা এসব বিজ্ঞান বা নিয়ম-কানুনের ধার সেটি ধারবে না। আপনি যখন সর্বস্তরের মানুষের কাছে আপনার বার্তাটি পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন তখন আপনাকে অবশ্যই সবার জীবনে থাকা সাধারণ মেলবন্ধন ধরেই এগোতে হবে।
আমার শুরুটা অবশ্য এভাবে হয় না। স্ক্রিপ্ট শোনার সময় কোনো দর্শকের ভূমিকা পালন করি। এটা অনেকটা সিনেমা দেখার মতোই। আর তখন ওই গল্পটার সঙ্গে আত্মীকভাবে মিশে যেতে চাইবো। যেমন- ‘দিল্লি বেলি’র স্ক্রিপ্ট শোনার পর হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে কোনো বিজ্ঞান নিয়ে ভাবছিলাম না। সেটি তখন হয় যখন পরিচালক ও লেখকের সঙ্গে স্ক্রিপ্টে কাজ করা শুরু করি এবং ভেবে দেখি, আমরা সিনেমাটির মূল ভাব অনেক আগেই বুঝিয়ে দিচ্ছি না তো? দিল্লি বেলির শুরুটা কীভাবে হবে? “শিট হ্যাপেনস!”
আপনি সব সময় একটা সূত্র ধরে কাজ করেন, তাই না?
আমির খান : হ্যাঁ। সিনেমার শুরু ও শেষে প্রকাশিত মূলে ভাব দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সিনেমা হয়তো অতটা সমাজ সম্পর্কিত হবে না। কিন্তু সেটিরও কিছু না কিছু বক্তব্য থাকে। হ্যাঁ, আমাদের সিনেমাটির কি যথেষ্ট স্পষ্ট একটা সূচনা আছে? আমরা কি এটা আরো সূক্ষ্ম করতে চাই? আমাদের শেষ বক্তব্যটি কি ঠিক করা হয়েছে ঠিকমতো? এমনটা অনেক সময় দেখা যায়, একটা সিনেমা আপনি দেখেই যাচ্ছেন। কিন্তু সিনেমা যে কোনদিকে যাচ্ছে তা আর বুঝতে পারছেন না। ঠিক ওই সময়েই লোকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
‘লগান’-এ শুরুর সংলাপটি ছিল ‘বৃষ্টি হচ্ছে না। তোমরা এবারে খাজনা দিতে পারবে না।’ এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে ব্যাখা করবেন?
আমির খান : লহানে গোরা বলেছিলেন, ‘লগান মাফ করে দেবো যদি তোমরা আমাদের ক্রিকেটে হারাতে পারো।’ আমার চরিত্র তখন বলেছিল, ‘শর্ত মঞ্জুর!’ যে মুহূর্তে সে কথাটা বললো তখন সিনেমার মূল লক্ষ্যও পেশ করা হয়ে গিয়েছিল। এখন কোনো দর্শক হিসেবে জানতাম, তারা তো হেরে যাবে ক্রিকেটে। এই সিনেমার ক্ষেত্রে লক্ষ্য প্রকাশ থেকে লক্ষ্য অর্জনে পৌঁছানোর ওই সফরটাই ছিল উত্তেজনাকর, কঠিন, প্রচুর বাধা সংকুল যেটা সিনেমার উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিছু সময় সিনেমার মূল প্লট একঘেয়ে লাগতে শুরু হয়। কিন্তু পার্শ্বকাহিনীগুলোর কাজ তখনই। কারণ তখন যদি পার্শ্বকাহিনী কৌতূহল উদ্দীপক না হয় তাহলে দর্শক বিরক্তি ও একঘেয়েমিতে ভুগবে। কেননা সিনেমার মূল কথা, মূল লক্ষ্য তিনি আগেই জেনে গেছেন। সিনেমা তার জন্য সেখানেই শেষ। মোটামুটিভাবে এগুলোই বিনোদন জগতের সর্বজনীন প্রচারের বেসিক নিয়ম-কানুন।
আবেগীয় সম্পর্ক বা মনস্তাত্ত্বিক মেলবন্ধনের ওপর বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন আপনি, এটা কী আপনার সব সিনেমাতেই খতিয়ে দেখেন (দর্শক সারি থেকে সুনীল দেধিয়া)।
আমির খান : প্রতিটিতে। আমি যখন আবেগীয় সম্পর্কের কথা বলি তখন এর মানে কান্নাকাটি বোঝাই না। অবশ্য বেশির ভাগ লোকে তা-ই ভাবে। বলতে চাই যে, সিনেমাগুলোয় এমন কিছু আবেগ-অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা হয় যেগুলো আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে, মানসিক চাপে রাখবে- যে রকম থ্রিলার সিনেমাগুলোয় করা হয় অথবা এটি ভয়েরও হতে পারে যখন সিনেমাটি হ-র-র জনরার হবে। তাই প্রতিটা সিনেমার প্রতিটা গল্পই যেন দর্শকের সঙ্গে আবেগীয় একটা পর্যায়ে সম্পর্কীয় থাকে- এটা আমার জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আর্ট ফিল্ম ও প্রচলিত ধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্যকে আমার পরিচিত এক চলচ্চিত্র নির্মাতা এভাবে বলেছিলেন, পরেরটির ক্ষেত্রে দর্শক আগের থেকেই বুঝতে পারে কি ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রথমটির বেলায় সেটি সম্ভব নয়। সত্যি বলতে, দর্শকের ওই ধারণাও থাকে না, একটা আর্ট ফিল্ম দেখতে গেলে তার শেষে তেমন কিছু আদৌ ঘটবে কি না।
আমির খান : আমার মনে হয়, প্রচলিত বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে কাহিনী কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা সিনেমার প্রতিটা ধাপেই যদি বুঝে যান পরবর্তী মুহূর্তে কী ঘটতে যাচ্ছে তাহলে একঘেয়েমি বা অনাগ্রহ চলে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা আপনি নিজেকে ওই কাহিনী জানার জন্য উৎসাহিত করতে পারবেন না যেটা আর্ট ফিল্মগুলোয় সাধারণত হয় না বিচিত্র সব গল্পের কারণে। একটা সিনেমায় দর্শকের চমকে দেয়াটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।