মানবিক বুদ্ধিমত্তা মেশিনে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়

মানবিক বুদ্ধিমত্তা মেশিনে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়

বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিবিদরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি উচ্চতর গাণিতিক মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব সত্তার বিকল্প হিসেবে নতুন এক ধরনের প্রজাতি তৈরির চেষ্টা চলছে। একে বলা হয় এআই(AI- Artificial Intelligence) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত শুধু বুঝতে পেরেছি, মানবিক বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি ও সচেতনতা বীজগণিতের ফর্মুলায় চলতে পারে না এবং আমাদের শরীরের ক্রিয়া, প্রজাতির দীর্ঘ বিবর্তন ও এর স্থান নির্দিষ্ট মাইক্রোঅরগানিজমের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যান্টোনিও দামাসিও তার নতুন বই ‘দি স্ট্রেইঞ্জ অর্ডার অফ থিংস’টি ভিত্তি করে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ওয়ার্ল্ডপোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, এটি এক ধরনের আবেগ ও অনুভূতি যার উৎপত্তি এবং বসবাস একই জৈবিক পরিবেশে। তা মানুষের বুদ্ধিমত্তা, বোধশক্তি ও সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতার ব্যবস্থাপক। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি গাণিতিক মানসিকতার মানচিত্র, মানবিক সত্তা বলতে যা বােঝায় তা থেকে ভিন্ন।

দামাসিও বলেন, ‘আমাদের মন দুটি অংশে কাজ করে। একটি অংশ দিয়ে আমরা উপলব্ধি, আন্দোলন, স্মৃতি, যুক্তি, মৌখিক ভাষা ও গাণিতিক ভাষাগুলাে বোঝার চেষ্টা করি। ওই অংশটি সূক্ষ্ম এবং সহজেই গাণিতিক প্রত্যয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ অংশটি হচ্ছে সিন্যাপটিক সিগনাল-এর জগৎ। এটি উন্নত রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় অংশটি আমাদের আবেগ-অনুভূতি সংক্রান্ত। এটি আমাদের জীবিত শরীরের সত্তা। এ অংশটি গাণিতিক ফর্মুলায় প্রকাশ করা যায় না। বর্তমানের রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা ওই দ্বিতীয় অংশের কার্যক্রম সম্পাদন করা সম্ভব নয়।’

বিবর্তনের প্রথম দিকে মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত দুর্ভোগ বা কষ্টের কারণ ছিল না। আনন্দ বা বেদনা- এসব পরবর্তীকালে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বিবর্তনের ধারায় মানুষের বৈশিষ্ট্যে পরিস্ফুটিত হয়। দামাসিও ওই পদ্ধতিকে বলে থাকেন ‘হোমোস্ট্যাসিস’। এর লক্ষ্য হচ্ছে, একটি জীবন্ত জীবদেহের ব্যবস্থাপনা করা যেন এটি শক্তির প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতের চাপ সামলানোর মতাে যথেষ্ট শক্তি তার সংরক্ষণ করে। এটি শুধু মানুষকে টিকিয়েই রাখে না, মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যমী করে।

‘মন’ বিষয়ে দামাসিও-র শেষ কথা হচ্ছে, এটি শুধু নার্ভাস সিস্টেম দ্বারা গঠিত নয়, বরং নার্ভাস সিস্টেমের চেয়ে বেশি আমাদের শরীরের অন্যান্য পুরনো লাইফ সিস্টেম, মেটাবলিজম, অ্যান্ডোক্রিন, ইমিউন ও সার্কুলেটরি সিস্টেমগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। মানুষের মধ্যে নার্ভাস সিস্টেম যুক্ত হয় বিবর্তনের শেষদিকে। ‘মানসিকতা’ বিষয়ক প্রচলিত ধারণার ভিত্তি হচ্ছে, ‘নার্ভাস সিস্টেম’ নিজেই নিজেকে মানসিকতা তৈরি করে। কিন্তু তা স্বাধীন নয়। এটি অন্য জৈবিক সিস্টেমগুলোর দাস। নার্ভাস সিস্টেম একা কাজ করতে পারে না।

বিস্তারিত বলতে গেলে বুদ্ধিমান মন জৈবিকভাবে প্রতিস্থাপিত। এটি মানব মাইক্রোঅর্গানিজমের বিশাল সমুদ্রের মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। যেমন- টোবায়াস রিস ও নিলস গিলম্যান দেখান, কয়েক ব্যক্তি এ বিষয়ে সচেতন যে, কীভাবে এই মাইক্রোঅর্গানিজম এবং তাদের জিন আমাদের দেহের কার্যক্ষমতাটি প্রভাবিত করছে। আমাদের কোষের নিউক্লিয়ায় পাওয়া যায় যেখানে প্রায় ২০ হাজার জিন রয়েছে। কিন্তু মাইক্রোঅর্গানিজম হচ্ছে, অণুজীবের মোট জেনেটিক উপাদান যা আমাদের মধ্যে ও আমাদের সঙ্গে বসবাস করে যেখানে প্রায় ২০ মিলিয়ন জিন রয়েছে। এর প্রতিটিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং কখনো কখনো আমাদের জিনগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে।

লেখকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, আধুনিক সময়ে ডায়েট, সি-সেকশন বার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাইক্রোঅর্গানিজমের শুদ্ধতা নষ্ট করে ফেলছে। মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য ওই অনিচ্ছাকৃত পরিণতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সহস্রাব্দের অধিক বিবর্তন।

মানুষের মাইক্রোঅর্গানিজমের গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, ওই অর্গানিজমগুলো নিয়ে আরো গবেষণা করা লাগবে, পুনরায় পাঠ করা লাগবে। এমনকি এটি পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করাও অসম্ভব কীভাবে কারো মানবিক সত্তার সমাপ্তি ঘটে বা কীভাবে মাইক্রোঅর্গানিজমগুলো কাজ শুরু করে। ফলে একটি অদ্ভুত অস্পষ্টতা থেকেই যায়। আমরা প্রকৃতির চেয়ে বেশি কিছু নয়, এমনকি আমরা হচ্ছি প্রকৃতিরই একটি অংশ।

যদি মানবিক বুদ্ধিমত্তা জীববিদ্যার অংশ হয় তাহলে এটি যন্ত্রে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব নয়। সংশোধনমূলক আবেগ-অনুভূতির অনুপস্থিতি তৈরি করা সম্ভব নয়, এমনকি আমাদের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে। যেমন- এলন মাস্ক একবার সতর্ক বাণী হিসেবে বলেন, একটি উচ্চতর স্বশাসিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মন প্রতারণা করতে পারে বা এর নির্মাতার বিরুদ্ধে চলতে পারে। ওই হিসেবে তিনি একবার দি ওয়ার্ল্ডপোস্ট-কে বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জন্য ভালো কিছু হবে।’

ওই বিবেচনায় নিকোলাস বারগারুয়েন মানুষের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামিং বিষয়ে কিছু নীতি নির্ধারণের চিন্তা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, শেষ পর্যন্ত ‘দাস’ অথবা ‘মালিক’ প্রযুক্তির উত্থান হবে না। কিন্তু মানুষের বর্ধনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের বোধশক্তি ও চেতনার বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং রূপান্তরিত করছে। নিরাপত্তার জন্য তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। তা হলো যেভাবে আমাদের শিশুকে পালন করি সেভাবেই কৃত্তিম বুদ্দিমত্তার রোবটদের গ্রহণ করতে হবে।

মানুষের মনের জৈবিক গঠনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সাপ্তাহিক আয়োজন‌ ‘দি ওয়ার্ল্ডপোস্ট’-এর প্রধান সম্পাদক নাথান গার্ডেলস-এর লেখাটি পত্রিকাটিতে গত ২ মার্চ প্রকাশ করা হয়। ‘জবান-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেয়া হলো