ফিলিস্তিন স্বাধীন হলেই আমি স্বাধীন : মাহমুদ দারবিশ

ফিলিস্তিন স্বাধীন হলেই আমি স্বাধীন : মাহমুদ দারবিশ

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি হিসেবে খ্যাত মাহমুদ দারবিশ ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের আলবিরওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সারা দুনিয়ার সাহিত্য জগতে তাকে আরব বিশ্বের কণ্ঠস্বর বলা হয়ে থাকে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস-এ মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ওই কবির ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে তার গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটির অনুবাদ ‘জবান’-এর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। নিউ ইয়র্কভিত্তিক শিল্প-সাহিত্যের ম্যাগাজিন ‘বোম্ব’-এ  প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মিনহাজ আমান

রাজা শাহেদা : কবে থেকে কবিতা লেখা শুরু করলেন?

মাহমুদ দারবিশ : ছোটবেলা থেকে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলাম, এমনকি খেলাধুলা করার মতাে সক্ষমও ছিলাম না। ফলে আমাকে লেখালিখিতে সময় দেয়া ছাড়া আর করার কিছু ছিল না। এছাড়া বড়দের সঙ্গে সময় কাটাতেও ভালাে লাগত। আমাদের বাড়িতেওেই সময় আমার দাদিসহ প্রতিবেশী বয়ঃবৃদ্ধরা নানান আরবি উপকথা পড়তেন। আমি নানান সময় ওইসব আয়োজনে অংশ নিয়েছি। সেখানে অনেক প্রেমগাথাও থাকতাে। একজন রাজা, কবি, প্রেমিকরা থাকতাে। আমি ওইসব শুনে ধীরে ধীরে কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। অবশ্য কেন হলাম তা জানি না। শুধু জানতাম, কবিতার টুপটাপ ধ্বনি আমাকে বিমোহিত করে। তখনো কবিতার উচ্চমার্গীয় শব্দগুলো বুঝতে পারতাম না। কিন্তু বুঝতে পারলাম ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ওই সমস্যা থেকে মুক্ত হবাে। নাননে অভিজ্ঞতা আমার হৃদয়ে ভাষার প্রতি টান তৈরি করেছে। কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। ভাবতাম, কবি মানেই একটি রহস্যজনক চরিত্র যার নানান অতি মানবীয় শক্তি আছে। ফলে বেশ ছোটবেলা থেকেই আমার লেখালিখি শুরু। অবশ্য বুঝতাম না যা লিখছি তা কবিতা হচ্ছে কি না। মা-বাবা ও শিক্ষকদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি বেশ। আর যেহেতু কবিতা ছাড়া আমার করার কিছু ছিল না সেহেতু চেষ্টা বাড়িয়ে দিতে চাইলাম। তাই লেখালেখি আমার যুদ্ধক্ষেত্র এবং ভাষাটা অস্ত্র হয়ে হাতে ধরা দিল। এসবই তখন আমার কাছে ছিল ছেলেখেলার মতাে। পরে অবশ্য ওই বিষয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু করি।

কখনো গদ্য লিখেছেন?

দারবিশ : আমি গদ্য খুব পছন্দ করি। আমি বিশ্বাস করি, কখনো কখনো একটি গদ্য যে কোনাে কবিতার চেয়ে আপনাকে কাব্যিক ধীরতা উপহার দিতে পারে। কিন্তু সময় বড্ড কম এবং আমার কবিতার কাজ এখনো অসমাপ্ত। ফলে আমার মধ্যে গদ্য বনাম পদ্যের একটি দ্বৈতলড়াই চলতে থাকে। কিন্তু আমার হৃদয়ের পাল্লা বার বার কবিতার দিকেই ঝুঁকে যায়।

কখন থেকে নিজেকে সত্যিকারের কবি হিসেবে ভাবতে শুরু করলেন?

দারবিশ : তা জানি না। তবে মন থেকে যা বেছে নিয়েছি তা হচ্ছে কবিতা। অবাক করা আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, আমার কবি হওয়ার সঙ্গে ইসরায়েলি এক গভর্নরের সম্পর্ক আছে। তখন আমার বেড়ে ওঠার শহর গালিলি-তে সামরিক শাসন চলছিল। বলা যায়, তিনিই আমার কবিতার প্রথম সমালোচক এবং তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন কবিতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

তখন আমার বয়স মাত্র ১২। আমাদের গ্রামে ইসরায়েলি সেনা শাসন ছিল। আমি ক্লাসের ভালাে ছাত্র হওয়ায় ইসরায়েলের বিজয় দিবস উপলক্ষে আমাকে কিছু আবৃত্তি করতে বলা হল। আমি করলাম। ওই কবিতাটি ছিল আসলে এই যে, আরবদের জোর করে ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবস পালন করানো হচ্ছিল। এটি নিয়ে আমার লেখা।

পরের দিন সেখানকার সামরিক গভর্নর আমাকে তলব করে এবং এমন কবিতা লেখার জন্য আমাকে ধমকা-ধমকি করে। যতদূর মনে পড়ে, যা লিখেছিলাম তা সত্য ভেবেই লিখেছিলাম। এতটাই অবুঝ ছিলাম যে, কী বলতে হবে তাও বুঝতে পারিনি। তখন ভেবে খুব অবাক হলাম, সামান্য কবিতাকে এত ভয় পায় বিরাট এই ইসরায়েল! ফলে বুঝতে পারলাম কবিতা কত প্রভাবশালী একটি কর্ম। তাই কবিতা চর্চাকে বিপজ্জনক ভেবেই লেখি।

আপনি একাই ওই গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?

দারবিশ : হ্যাঁ। কারণ আমি একাই ছিলাম। ১২ বছরের শিশুর ডাক পড়েছে গভর্নরের কাছে, তার ওপর দায় কবিতা লেখার- চিন্তা করা যায়!

আরবি সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত কবি হিসেবে আপনার কবিতায় কাব্যিকতার ব্যাপারে নতুনত্ব উঠে এসেছে। এটি কেমন ব্যাপার এবং কীভাবে ঘটে?

দারবিশ : কবিতায় নতুনত্ব থাকলে তা শুধুই কাব্যিক গঠনের পরিবর্তন। একক ছন্দের বাইরে কবিতা লেখার যে অপ্রচলিত ঘরানা তৈরি হয়েছে সেটির শুরুর দিকের কবিদের আমি একজন।

এই ধরনের কাব্যিক পরিবর্তন আনার পেছনে কী অনুপ্রেরণা কাজ করেছে বলে মনে করেন? এই ধরনের পরিবর্তন আরবি কবিতাকে কী উপহার দিয়েছে?

দারবিশ : ১৯৪৮ সালের পর থেকে আমরা এমন এক ফিলিস্তিনে বাস করছি যেটি আসলে ইসরায়েলের কাছে হেরে যাওয়ার এক ছবি। খুবই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ফলে আমাদের মনের অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে পুরনাে ধাঁচের কবিতা দিয়ে নিজের মনের ভাব বােঝানোর কায়দা কমে আসতে শুরু করেছিল। ফলে হৃদয়ের আসল ভাবনা প্রকাশে কবিতার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সময়ের দাবি ছিল। তাই সেটি সময়ের সঙ্গেই ঘটে যায়। এ জন্য কবিতার নতুনত্ব আসাটা সুচিন্তিত কোনাে ব্যাপার ছিল না।

কিন্তু এক্ষেত্রে ওই রমকটি ঘটলাে না কেন?

দারবিশ : তখন আমাদের সমাজে রাজনৈতিক পরিবর্তনের দুটি ধারা পাশাপাশি চলছিল। রক্ষণশীল কয়েক মানুষ ছিল। ১৯৪৮ সালের পর থেকে যা ঘটেছে সেসব তাদের জীবনে তেমন প্রভাব ফেলেনি। তারা নানান সময় ইসরায়েলি প্রশাসনকে সাহায্য করেছে। তাদের বিজয় দিবস নিজেদের মতাে করে উদযাপন করেছে। ফলে তাদের কয়েক কবি প্রচলিত ধারায় কবিতা লেখতেন। কিন্তু আধুনিক কবিরা বিদ্রোহ করে প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন ধারায় কবিতা লেখা শুরু করনে।

আপনার কবি হওয়ার ধারা কীভাবে ব্যাখা করবেন?

দারবিশ : কীভাবে কী হয়েছি, পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার নয়। যখন কবিতা নিয়ে বসি তখন জানি, কী করতে যাচ্ছি; জানি, কীভাবে সামনের পথ মাড়াতে হয়। কিন্তু সেটি কীভাবে করি বা করছি তা নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়।

আপনি একবার বলেছিলেন, কবিতা পরিবর্তনের হাতিয়ার। এ কথাটি নাকি সত্য নয়। তাহলে আপনি কী মনে করেন, ফিলিস্তিনের লড়াইয়ে আপনার অবদান আছে?

দারবিশ : শুরুর দিকে আমার কবিতা ফিলিস্তিন পরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। কোনো কবি তার জাতির ভাষাগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি যে কোনাে মানুষকে অন্তর্গতভাবে শক্তিমান করে তুলতে পারেন, করে তুলতে পারেন আরো মানবিক এবং সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তবে আমার কবিতা পড়া হয় বেশ আনন্দে অথবা একেবারে শোকাবিহ্বল দিনে। আমার যেসব কবিতা আবার গান হয়েছে সেখানেও আছে না পাওয়ার বেদনা, পরাজিতের আর্তি। তবে জানি না, আমার কবিতা সমগ্র আরবি সাহিত্যে কী পরিমাণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

কতদিন ধরে রামাল্লায় আছেন- চার বা পাঁচ বছর?

দারবিশ : পাঁচ বছর।

নিজের মধ্যে কীরূপ পরিবর্তন দেখেন?

দারবিশ : ভালোবাসার কবিতা বেশ লিখেছি। আমার কবিতার প্রথম খণ্ডটিই ভালােবাসার কবিতা। এসব ফিলিস্তিনের বাইরে বসে লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার এখানেই ভালােবাসার কবিতা লেখতে হবে যাতে লোকে বােঝে- ফিলিস্তিনের প্রত্যাবর্তন নিয়ে লিখি না, প্রেমের কবিতাও লিখি।

প্রেম নিয়ে লেখা আসলে একটি পরিবর্তনের পক্ষ নেয়া। ফিলিস্তিনি কবিরা মেটাফিজিকাল বিষয়াদি নিয়ে তেমন লেখেন না। কারণ তাদের মাথায় গেঁথে আছে অত্যাচার, দখলদারিত্ব, আন্দোলন, স্বাধীনতা ইত্যাদি। ফলে সেখানে প্রেম নিয়ে লেখা মানে মানব মনের নতুন দিকে আলোকিত করা।

যখন ফিলিস্তিনে ছিলাম তখন সরাসরি ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনাে কবিতা লেখিনি। তবে লিখেছি ‘স্টেট অফ সিজ’। এখানে আন্দোলনের মাত্রা ফুটে উঠেছে প্রকৃতি প্রেমের মধ্য দিয়ে। কবিতা দিয়ে সৈন্যের বেয়ােনেটের মুখোমুখি এভাবেই দাঁড়াতে হয়। জিত হবেই যার হওয়ার কথা, যতই দখলদারি চলুক, হোক রক্তপাত।

আপনি যখন ফিলিস্তিনে বসে কোনাে কবিতা পড়েন আবার আরবের অন্য কোথাও বসে পড়েন তখন কোনাে তফাত টের পান?

দারবিশ : আমার কাছে মনে হয়, আরব বললে চারপাশটা বেশ বড় লাগে। কিন্তু ফিলিস্তিনে এসব উদযাপনের কোনাে সুযোগ নেই। ফলে সেখানে এমন অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্যে কবিতা মানুষের কাছাকাছি আসতে পারে না। কিন্তু আরব বিশ্বে ঘটনাটি আলাদা। এ জন্য কাউকে দোষ দিচ্ছি না। লেবাননের বৈরুতে ২৫ হাজার মানুষের সামনে কবিতা পড়েছি। অথচ ফিলিস্তিনে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতেও বাধা পেতে হয়। তাই এত মানুষকে এক সঙ্গে কবিতার কাছাকাছি আনা আসলেই খুব কঠিন। এর উপর এসব করার সুযোগই কতটা দেবে ইসরায়েলি সৈন্যরা।

আচ্ছা, কবিদের জন্য কোথায় থাকা সহজ? প্যারিস, নাকি রামাল্লার মতাে নীরব-নিথর গ্রামে?

দারবিশ : অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের জন্য আমার রামাল্লা ভালাে। যদিও লেখালিখির জন্য গ্রাম কিছুটা মনােযোগ নষ্ট করে দেয় তবুও লেখার জন্য সবচেয়ে ছোট জায়গাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী। আমার বাসায় যে রুমে লেখি সেটি সবচেয়ে ছোট।

কখনো রামাল্লা ছাড়ার আশঙ্কা নিজের মধ্যে অনুভব করেন?

দারবিশ : নিজেকেও মাঝে মধ্যে এই প্রশ্ন করি। আমার এখানে থাকার প্রধানতম কারণ আমার নীতি। যখন প্রথমবার ফিলিস্তিন ছাড়ি তখন প্রতিমুহূর্তে নানান হতাশা-সন্দেহ আমাকে চেপে ধরেছিল। প্রতিনিয়ত নিজেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, এভাবে চলে যাওয়া কি ঠিক? তাই একই ভুল আর করিনি। নির্বাসনের পর আবার যখন দেশে ফিরে আসার সুযোগ পেলাম তখন ফিরে এলাম। অবশ্য আমার কাছে ব্যাপারটি স্পষ্ট ছিল না যে, এই ফিরে আসার হাকিকত কী! কারণ ফিলিস্তিন স্বাধীনতার জন্য যেসব উপায়ে হাঁটছে তা দিয়ে স্বাধীনতার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা। ফিলিস্তিন স্বাধীন হলেই মাহমুদ দারবিশ স্বাধীন। শর্ত আরোপ করার মধ্য দিয়ে কোনােভাবেই স্বাধীন হওয়া যায় না। এসব লেখা সহজ। কিন্তু বুঝতে বেশ কঠিন। একটি স্বাধীন দেশ বেশিদিন আলোচনায় থাকে না। অথচ কোনাে দেশের যতদিন স্বাধীনতার লড়াই থাকে ততদিন আলোচনা, সহানুভূতি-সহমর্মিতা থাকে।

আলাপ করতে করতে দুপুরের সূর্য হেলতে থাকলাে। ইসরায়েলি দানবীয় ট্যাংকগুলো রাস্তার বুকে থেমে থেমে চলা শুরু করেছে। আমাদের কানতক পৌঁছালো ওই আওয়াজ। বোঝা গেল জরুরি অবস্থা ঘোষণার পূর্ব সংকেত। আর মাহমুদ দারবিশ তার ঘরে ফেরার ডাকে সারা দিয়ে চললেন।