ইসলাম সংস্কারের রাজনীতি

ইসলাম সংস্কারের রাজনীতি

বিখ্যাত তাত্ত্বিক ও চিন্তক সাবা মাহমুদ অধ্যাপনা করতেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-র নৃবিজ্ঞান বিভাগে। গত ১০ মার্চ সবাইকে বিস্মিত করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। ওই মৃত্যু এতই আকস্মিক ছিল যে, সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার অসংখ্য গুণগ্রাহীদের শোকের সাগরে ভাসিয়েছে। ক্যানসারের আকস্মিক ছোবলে তিনি হঠাৎ করে দুনিয়া থেকে চলে গেলেও তার কাজ রয়ে গেছে। Anthropology of subject formation, liberalism, and secular modernity; feminist and poststructuralist theory; religion and politics; Islam, the Middle East, and South Asia ইত্যাদি বিষয়ে তার অনুরাগ ছিল। তার প্রকাশিত গ্রন্থ Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject (Princeton University Press, 2005) এবং Talal Asad, Wendy Brown ও Judith Butler প্রমুখ চিন্তকের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেন Is Critique Secular? Blasphemy, Injury, and Free Speech (University of California Press Berkeley, Los Angeles, 2009)। অনুবাদকৃত ওই প্রবন্ধটির শিরোনাম Secularism, Hermeneutics, and Empire: The Politics of Islamic Reformation। এখানে  শিরোনামে পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রবন্ধটির সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মোকাররম হোসাইন

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবহুল কালপর্ব থেকে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানের প্রেক্ষাপটে সেকুলারিজমের [*১] পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান তীব্রতর হয়েছে। চড়া সুরে বাঁধা এসব হাঁক-ডাকের লক্ষ্যবস্তু আসলে ইসলাম, বিশেষ করে ইসলামের ওইসব চর্চা ও বয়ান যেগুলো খামাখাই মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের ধারক-বাহক বলে সন্দেহ করা হয়। বামপন্থী ও উদারপন্থী- উভয় ধারাই মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের ভাগ্যকে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জুড়ে দেয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক মতবাদ ও রাজনৈতিক নীতি হিসেবে। আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে উদ্ভূত ওই যুগলবন্দি বয়ান, বিশেষ করে ‘ইসলামকে তার ভেতর থেকে’ নতুন আকার দান ও রূপান্তর করার পরিকল্পনাগুলো ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে।

ওই প্রবন্ধে দুটো বিষয় পরখ করে দেখবাে। প্রথমত. সেকুলারিজমের ওই বিশেষ মতবাদটি যা ইসলাম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামকে সেকুলার করে গড়ে তোলার ধারণায় ভিত্তি দিয়েছে। দ্বিতীয়ত. যে কৌশলী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলামকে সেকুলারাইজ করার ভবিষ্যৎ ওই পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাও বুঝে নিতে চাই। ঐতিহাসিকভাবে পরিবর্তনশীল ক্যাটাগরি হিসেবে বিচিত্র উদ্ভব বৃত্তান্তসহ সেকুলারিজমের একটা অকাট্য সংজ্ঞা নির্ধারণ অথবা মার্কিন মুল্লুকে বা মুসলিম বিশ্বে এর ঐতিহাসিক রূপান্তর নির্ণয় করা অমার উদ্দেশ্য নয়। আমার লক্ষ্য আরো সীমিত। দেখাতে চাই, সেকুলারিজমের ওই বিশেষ বোঝাপড়াটা যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম নিয়ে সমসাময়িক মার্কিন বয়ানগুলো এবং যে বোঝাপড়া মুসলিম বিশ্ব সংশ্লিষ্ট মার্কিন নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি দ্বারা গভীরভাবে নির্ধারিত।

বিশ্বব্যাপী ইসলামকে নতুন আকার দেয়া ও সংস্কার করার মার্কিন প্রকল্পটি বিবেচনায় নিয়ে আমি আরো ভেবে দেখতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র কতৃক অনুসৃত সাম্প্রতিক আধিপত্যবাদী কৌশলের সঙ্গে সেকুলারিজমের সম্পর্ক কোথায়। দু’বছর ধরে (২০০৫ সালে প্রকাশিত লেখা) ‘সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে (সামরিক) যুদ্ধ’ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে সংবেদনশীলতা তৈরির লক্ষ্যে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধর্ম তাত্ত্বিক প্রচারণা হাতে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মতে, এসব সাধারণ মুসলমান বিপজ্জনকভাবে ইসলামের মৌলবাদী ব্যাখ্যা দ্বারা অনুপ্রাণিত। মূলত এটি হচ্ছে ব্যাপক মুসলিম জনসমষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিচালিত সামরিক অভিযানের এক ভাবাদর্শিক অস্ত্র। তা মুসলিম জনসমষ্টিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ এবং ‘পশ্চিমি মূল্যবোধ’ বলে শিথিল শব্দ চয়নে বলা ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে ইসলামি প্রতিবাদের চরমপন্থী ও মৌলবাদী ধারাগুলোর সদস্য সংগ্রহের উৎস হিসেবে বলা হয়।

ওই বিস্তৃত কর্মযজ্ঞে মার্কিন সরকার সহজাত মৈত্রী খুঁজে পেয়েছে মডারেট বা লিবারাল মুসলিম প্রকরণে। পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিকল্পনাকারীদের মতে, ওইসব মুসলিম ‘পাশ্চাত্য দর্শনজাত সভ্যতা, রাজনীতি ও সমাজ’ [২]–এর প্রতি সবচেয়ে বেশি উদারমনা। বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, এসব নানান মতের মুসলিম সংস্কারক ও বুদ্ধিজীবীরা নিজ নিজ অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মেনে নিয়েই ঐক্যবদ্ধ হন- ব্যাপারটি ঠিক এমন নয়। এসব বুদ্ধিজীবী ও সংস্কারপন্থীর অনেকেই ইরাকে মার্কিন সামরিক দখলদারিতার সমালোচক। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডায় তাদের অংশগ্রহণ খুব সরল ব্যাপার নয়। যে বিষয়টি ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তাদের একত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রে পরিণত করে- অস্বাভাবিক হলেও তা হলাে ধর্ম ব্যাখ্যার এমন এক তত্ত্ব যাতে এসব মুসলিম ভাবুক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যৌথ অংশীদারি ভূমিকা আছে। মার্কিন বিশ্লেষকদের মতে, মূল সমস্যা জঙ্গিবাদ নয়, বরং ধর্ম ব্যাখ্যা। যেহেতু ধর্ম ব্যাখ্যাই ধর্মীয় ব্যক্তিসত্তা নির্মাণ করে সেহেতু ধর্ম ভাষ্য নির্মাণই মানবমুক্তি বা সেকুলার ব্যক্তিসত্তা নির্মাণের চাবিকাঠি। ওই বোঝাপড়ার কারণেই মার্কিন কুশলীরা সেকুলার লিবারাল মুসলিম সংস্কারকদের সঙ্গে একই কোরাসে সুর তুলছেন। এসব সংস্কারকরা বহুদিন ধরে প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশনের ধারায় ইসলামকে নতুন আকার দিতে চেষ্টা করে আসছেন। [৩] তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও সেকুলার লিবারাল মুসলিম এজেন্ডার ঐকতান কেবল কয়েকটি রাজনৈতিক লক্ষ্যের দৈব মিলন হিসেবে বুঝলেই হবে না, বরং বুঝতে হবে আদর্শ সেকুলারিটির জায়গা থেকে এবং এটি কোন ধরনের ধর্মীয় ব্যক্তিসত্তা অনুমোদন করে সেখান থেকে।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প সরলভাবে ধর্মহীন অর্থে সেকুলার ভাবার কোনাে কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে এটি ডানপন্থী ক্রিশ্চিয়ান রাজনীতির স্বার্থ, কর্মসূচি ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমার মতে, সেকুলারিজম যেহেতু একটি রাজনৈতিক শাসনের মডেল হিসেবে ধর্মীয় ব্যক্তিসত্তা রূপান্তর করে একটি সার্বিক আকার দিতে চায় সেহেতু সাম্প্রতিক মার্কিন এ প্রকল্প ইসলামকে সংস্কার করার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তার সেকুলার রূপ প্রদর্শন করে। এভাবে মুসলিম বিশ্বে সমসাময়িক মার্কিন সাম্রজ্যবাদী অভিযানের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে সেকুলারিজম নিজেকে ধর্মের সীমা নির্ধারণী বা জাতিরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিকে ধর্ম থেকে সুরক্ষাকারী কোনাে ব্যাপার হিসেবে প্রকাশ করার চেয়ে বরং সভ্যকরণ চরিত্রটিই প্রকাশ করে। [*৪] এরপর সেকুলারিজমের অনুষঙ্গী নৃবিজ্ঞান দিয়ে সেকুলারিজমের আদর্শ কাঠামোটি পরখ করে দেখতে চাই যেটি সম্প্রতি মুসলিম সংস্কারকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মার্কিন কৌশলগত স্বার্থকে যোজন করার পটভূমি নির্মাণ করেছে। ওই যুথবদ্ধ অবস্থান সমকালীন মুসলিম সমাজের রোগগুলো (পশ্চাৎপদতা, সনাতনবাদ ও গোঁড়ামি) শনাক্ত করার অভিপ্রায় এবং এসব পীড়া দূর করার ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণে একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছায়। ওইসব সমাধানে নিহিত থাকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক পথ্য এবং একটি বিশেষ ধরনের ধর্ম ব্যাখ্যা যেগুলোর উদ্দেশ্য হলাে ‘ধর্মীয়ভাবে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক নীতি’ অনুধাবনে সক্ষম আলোকিত ধর্মীয় ব্যক্তিসত্তা নির্মাণ।

মুসলিম বিশ্বে দাতব্য কর্মসূচি (Muslim World Outreach)

সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সঙ্গে যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তদের মতে, বুশ প্রশাসনের ইরাক দখল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচারসহ মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরোধিতার মাত্রা আরো বেগবান করেছে। বাস্তবিকই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মরোক্কো, জর্ডান, মিসর ও তুরস্কের মতাে বিচিত্র দেশগুলয়ে পুনঃপুন পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা গেছে, যু্ক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা আর কখনো এত নিচে নেমে আসেনি। প্রবলভাবে ওই ইঙ্গিতও পাওয়া যায়, মুসলিম বিশ্বে ইসলামি প্রতিরোধ (সংস্কারপন্থী বা জঙ্গিবাদী যাই হােক) বিকশিত হচ্ছে। অবশ্য ৯/১১ কেন্দ্রিক ঘটনাবলির পর বিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দল, জঙ্গি সংগঠন, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক এসব প্রেক্ষাপটে সর্তক হোয়াইট হাউস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনএসসি) আনুষ্ঠানিকভাবে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের (আসন্ন আরাে বরাদ্দসহ) মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ ইন ২০০৩ নামে এক নয়া কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। [৫] ওই প্রকল্পের লক্ষ্য হলাে ‘ইসলামকে তার ভেতর থেকে রূপান্তর’। মার্কিন সরকারের বিবেচনায় মুসলিম দেশগুলােয় মধ্যপন্থী, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জারিত সংগঠনগুলো এবং নানান স্রোত খোঁজে বের করা, চিহ্নিত করা এবং সমর্থন দেয়া। [৬]

ওই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থের বেশির ভাগ সিআইএ এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের বদলে ইউএসএইড (United States Agency for International Development)-এর মাধ্যমে ছাড় দেয়া হয়েছে। [৭] ওইসব অর্থ ব্যয় করা হয় কিছু কর্মসূচির ওপর। যেমন- ইসলাম প্রচারকদের প্রশিক্ষণ, ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা যেগুলো ‘মৌলবাদী মাদ্রাসা শিক্ষা’কে প্রতিস্থাপন করবে [৮], সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কুলে পাঠ্যসূচি সংস্কার করা এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা ও অনুষ্ঠান নির্মাণ (বেতার ও স্যাটেলাইট টিভি কেন্দ্র স্থাপন, ইসলামিক টকশো নির্মাণ ও সম্প্রচার এবং মুসলিম দেশগুলোয় বিদ্যমান গণমাধ্যমের ভেতর ধর্মীয় জনবির্তকগুলাের অবয়ব দেয়া। [৯] ওই বহু স্তরিক প্রকল্পের উদ্দেশ্য একটাই। তা হলো মৌলবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে রোগ নিবারক ও প্রতিষেধক হিসেবে কথিত ‘মডারেট ইসলাম’–এর বিকাশ ঘটানো। ওই বিস্তৃত আদর্শিক প্রকল্পের সঙ্গে কোল্ড ওয়ারের সময় সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ায় কমিউনিজম বিরোধী স্রোতগুলোর কর্মকাণ্ডের সহযোগী হতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল এর সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম আছে। তা হলাে, চলমান ওই অভিযানের একটা প্রকাশ্য ধর্ম তাত্ত্বিক কর্মসূচি আছে। যেমন- পাররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ”কোল্ড ওয়ার সহজ ছিল। ওটা ছিল ঈশ্বরবিহীন এক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু আমাদের এখানে (সাম্প্রতিক মার্কিন কর্মকৌশল) আছে ধর্ম তাত্ত্বিক উপাদান। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি না’ বলে যে মার্কিন প্রত্যয় আছে এর মূলে এটি কুঠারাঘাত করে। ওই বিতর্ককে প্রভাবিত করার কোনাে কর্তৃত্ব কী আমাদের আছে?” [১০] ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতহীনতার ওই ধ্রুপদী উদারনৈতিক উদ্বেগ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর বা বাইরে কোথাও মুসলমানদের সংশোধন করার ওই অভিযান গুরুতর আইনি প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার কোনাে ইঙ্গিত দেখা যায়নি। সমালোচনার এমন অভাবের একটা কারণ হলো, আমার মতে, ইসলাম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর সেকুলার উদারনীতিবাদী ও আমূল সংস্কারপন্থীদের মধ্যে একটা ব্যাপক ঐকমত্য আছে, এমনকি এরূপ আভিযানের ন্যক্কারজনক দিকগুলোর দায় যদি নিতেও হয় তাহলেও। অনেক সেকুলার মুসলমান আছেন যারা সমকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে একটি নেসেসারি ইভল হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের মতে, ওই নেসেসারি ইভল তাদের নিজ দেশে ইসলামের ‘পশ্চাৎপদ শক্তি’গুলোর সঙ্গে সংগ্রামে সাহায্য করবে। যেমন- পাকিস্তানি সেকুলার কর্মী আহমেদ ওমর এভাবেই আমাকে বলেন, ‘আমেরিকানরা এখন মোল্লাদের পেদানি দিচ্ছে। দেখে ভালােই লাগছে। অবশ্য এটি তাদের আরো আগে করা উচিত ছিল। আমেরিকানদের ওইসব উন্মাদ মৌলবাদী আফগান মুজাহিদিনদের কখনো সাহায্য করা উচিত হয়নি। এখন তাদের চেতনা এসেছে। তারা বন্দুক ও টাকা-কড়ি দিয়ে যে সাহায্য আমাদের করবে, আমরা নিশ্চয় তা ব্যাবহার করব।’ [১১]

মুসলিম ওয়ার্লড আউটরিচ প্রকল্প যে ধারার মুসলানদের রূপান্তর করতে চায় সেটিকে প্রথা অনুসারী (Traditionalist) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে র‌্যান্ড করপোরেশনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি রিসার্চ ডিভিশন কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে। [১২] র‌্যান্ড প্রতিবেদন- ‘সিভিল ডেমক্রেটিক ইসলাম : পার্টনারস, রিসোর্সেস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস’–এ বলা হয়েছে, ইসলামি জঙ্গি দলগুলো (‘মৌলবাদী’ হিসেবে উল্লেখিত) ৯/১১ থেকেই পাশ্চাত্যের মনোযোগ আকর্ষণ করলেও মার্কিন কৌশলগত স্বার্থ ও ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’–এর প্রতি দীর্ঘমেয়াদি হুমকিটা আসে ‘প্রথাগত ইসলাম’ (Traditional Islam) থেকে। আর ওই ইসলামের অনুসারীরা বিশ্ব জনসংখ্যার এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। [১৩] ওই প্রতিবেদন অনুসারে প্রথা অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, কোরআন আল্লাহর কথা এবং তাদের ‘লক্ষ্য হলো গোঁড়া আদর্শ, মূল্যবোধ ও রংক্ষণশীল আচরণগুলো সংরক্ষণ করা’। [১৪] ওই কাজগুলো তারা করেন ইসলামি আচারগুলো (পাঁচবেলা নামাজ, রোজা, পর্দা বা হিজাব ইত্যাদি) আন্তরিকভাবে পালন করার মাধ্যমে এবং প্রতিদিনকার বিষয়-আশয়ের ব্যাপারে পথনির্দেশ খুঁজে পেতে কোরআন, হাদিস ও ফেকাহ শাস্ত্রের দারস্থ হয়ে। প্রতিবেদনটি এও স্বীকার করে, ঐশী বাণী ও আইনি উৎসগুলোর ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে বহুমুখী। অনেকে ‘ফেকাহ শাস্ত্রের অক্ষরের সঙ্গে লেগে থাকেন’ এবং অন্যরা ফেকাহ শাস্ত্রে যেসব বিবেচনা আছে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে ও নতুনভাবে সূত্রবদ্ধ করতে আগ্রহী। যাহোক, ওই প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এভাবে পথনির্দেশ সন্ধান করা ‘কার্যকরণিকভাবে পশ্চাৎপদতা ও অনুন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। এর পরিণতি সব সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার প্রজনন ভূমি।’ [১৫]

ওই ধরনের বিচার-বিবেচনা সত্ত্বেও র‌্যান্ড প্রতিবেদন তাদের বয়ানে সবত্র স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, সমাজ-রাজনৈতিক ইসুতে প্রথা অনুসারীরা ‘সাধারণভাবে সহিংসতা ও সন্ত্রাস প্রশ্রয় দেন না’– এমন ধারণা তাদের ‘মৌলিকভাবে মধ্যপন্থী অবস্থান’ নির্দেশ করে। তারা ‘প্রায়ই কার্যকরভাবে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের কথা বলে।’ তাদের কয়েক নেতা ‘সামাজিক অনেক ইসুতেই অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অবস্থান’ নেন। যেমন- নারীদের অবস্থা, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং ইসলামি ফেকাহ-র সংস্কার। [১৬] প্রতিবেদনটিতে এটিও পরিষ্কার, প্রথা অনুসারীরা যদিও রাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাশা করে তবুও ধর্ম অনুরাগী সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে রাষ্ট্র ক্ষমতা জব্দ করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের লক্ষ্য হলাে বিশাল মুসলিম জনগণের সামাজিক প্রথা, মূল্যবোধ ও জীবন যাপন তৃণমূল কর্মতৎপরতার মাধ্যমে রূপান্তর করা। প্রতিবেদনটি স্বীকার করে, ওই প্রথা অনুসারীরাই দাতব্য সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাপাখানা, মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা। তারাই গ্রহণ করেন সামাজিক ও উন্নয়নধর্মী নানান কর্মসূচি। এই প্রতিবেদন যেটি বলতে ব্যর্থ হয়েছে তা হলাে, ওই সংগঠনগুলোই মুসলিম বিশ্বে সুশীল সমাজের মেরুদণ্ডের জোগানদাতা, বিশেষ করে যখন উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো সত্তরের দশক থেকেই ক্রমবর্ধমান হারে গৃহীত নব্য উদার অর্থনৈতিক কর্মপন্থার চাপে সমাজসেবার কার্যক্রম থেকে সরে এসেছে।

এমন নানান প্রবণতা প্রথা অনুসারীদের মধ্যে পাওয়া সত্ত্বে, মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের উন্নয়নে তাদের সঙ্গে কোনাে মৈত্রী স্থাপনের সম্ভাবনা র‌্যান্ড করপোরেশন দৃঢ়ভাবে নাকচ করে দেয় র‌্যান্ড প্রতিবেদন ওই প্রত্যাখ্যানের দুটি প্রথমিক কারণ হাজির করে- প্রথমত. মুসলিম দেশ ও সম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি ও মৌলবাদী সমালোচনা আছে এতে প্রথা অনুসারীদের সায় আছে; দ্বিতীয়ত. ঐশী বাণীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেটি পাশ্চাত্যের এনলাইটেনমেন্ট ব্যঞ্জনার সঙ্গে অসঙ্গত। [১৭] র‌্যান্ড প্রতিবেদন- মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ কর্মসূচির মতােই মৌলবাদী কিংবা জঙ্গিদের প্রতি মনঃসংযোগ না করে বরং ওই প্রথা অনুসারীদের প্রতি মন দেয়। র‌্যান্ড প্রতিবেদনের যুক্তি হচ্ছে প্রথা অনুসারীদের বাস্তবিক অবস্থান অতটুকু অসহনীয় নয় যতটুকু অসহনীয় তাদের বিশ্বাস, মনোভঙ্গি ও চিন্তার ধরন।[১৮] এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ- এক. কোরআনের ঐশ্বরিকতায় তাদের বিশ্বাস এবং কোরআনকে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করা। দুই. হজরত মুহম্মদ (সা.)-কে তার সময়ের ইতিহাসের উৎপাদন হিসেবে বিবেচনা না করে তার জীবনে আধুনিক অস্তিত্বের সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় সন্ধান করা এবং (৩) [ইসলামিক] বিচার ব্যবস্থাকে অপরিণত ও বৈপরীত্যের ধারক হিসেবে তিরস্কার না করা।

লক্ষণীয় যে, বাস্তব রাজনৈতিক (realpolitik) এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারক পলিসি থিংক ট্যাংক যথেষ্ট প্রচেষ্টা দেয় প্রথা অনুসারী ধারার নৈতিক যুক্তিবাদিতায় ধর্ম তাত্ত্বিক খুঁত ও ব্যাখ্যাগত ত্রুটি বিশ্লেষণে। সম্ভবত আরো বিস্ময়কর যে, র‌্যান্ড করপোরেশন মনে করে, প্রথা অনুসারী মুসলিম ব্যক্তিসত্তা কেবল অপরিণতই নয়, বরং বিপদজ্জনক, এমনকি জঙ্গি বা মৌলবাদীদের থেকেও বেশি। র‌্যান্ড প্রতিবেদনের রচয়িতারা ভাবেন, ঐশী গ্রন্থ, আইনগত কর্তৃত্ব এবং নবুয়তি উদাহরণ এসবের প্রতি প্রথা অনুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গি সভ্যায়ন (civilizing) প্রকল্পের পথে একটা বাধা। যেহেতু র‌্যান্ড প্রতিবেদন সমাপ্তি টানে- ‘আধুনিক গণতন্ত্র আলোকসম্পাত মূল্যবোধের ওপর দাঁড়ায় সেহেতু প্রথা অনুসরণ (traditionalism) ওইসব মূল্যবোধগুলোর প্রতিপক্ষ… প্রথা অনুসরণ সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃষ্টিশীল সমস্যার সমাধান, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সেকুলারিজম– এসব আধুনিক গণতান্ত্রিক মনােভঙ্গির প্রাথমিক শর্তগুলোর বিপরীত প্রান্তে দাঁড়ায়।’[১৯]

‘সমালোচনামূলক চিন্তা ও সৃষ্টিশীল সমস্যার সমাধান’-এ পরিভাষার নিচে একটি সন্দেহ থাকে। তথাকথিত প্রথা অনুসরণ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মার্কিন নীতি ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ রচনা করার যুক্তি-তর্ক পরিবেশন করে থাকে। ওই সমস্যার প্রতি নজর দিতে পররাষ্ট্র দপ্তর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেকুলার ধর্ম তত্ত্বের মাধ্যমে ইসলাম সংস্কার করে যেন উদার রাজনৈতিক শাসনের সেকুলার মডেলের সঙ্গে ইসলামকে উপযোগী করা যায়।[২০] তাই ওই ভাবাদর্শিক সংস্কারের যুদ্ধটি একটি সেকুলার রূপ নিয়েছে, বিশেষ করে যদি আমরা এটিকে ধর্মের বিলোপ অর্থে না বুঝে ধর্মের পুনর্বিন্যাস অর্থে বুঝি। এভাবে সেকুলারিজম একই সঙ্গে একটা বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নির্দেশক হয়ে ওঠে।

নোট : অনুবাদকের নোটগুলো * চিহ্ন যুক্ত করে দেয়া হয়েছে মূল লেখকের নোট থেকে পৃথকভাবে বােঝার জন্য।

*১. সেকুলার ও সেক্যুলারিজম শব্দ দুটির বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার না করে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে। একটি কৈফিয়ত দেয়া দরকার। সেকুলারিজম একটি ইউরিপিয়ান প্রপঞ্চ। ইউরোপে সেকুলারিজম একই সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন দর্শন নির্দেশ করে। একটি আরেকটির থেকে পৃথক কোনাে ব্যাপার নয়। ফলে একই শব্দ দিয়ে দিটি ভাবই বােঝানো সম্ভব। প্রথিতযশা নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ তার Formation of the Secular: Christianity, Islam, Modernity (Stanford, Calif.: Stanford University Press, 2003) বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইউরোপে তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ‘আলোকসম্পাত’ পর্বে ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশনের প্রতাপে সেকুলার রাষ্ট্রের সঙ্গে নমনশীল একটি রূপ লাভ করেছে। সেখানে একই ব্যক্তির চৈতন্যে সেকুলার জাতি-রাষ্ট্র-নাগরিকতা ও ক্রিশ্চিয়ান ধর্মে নিষ্ঠতা বিরাজ করে কোনাে দ্বন্দ্ব ছাড়াই। কিন্তু বাঙাল অঞ্চলে সেকুলারিজম অনেকটা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং কিছুটা ইউরোপ থেকে ধার নেয়া। ফলে এটি রাজনৈতিক দর্শন কিংবা জীবন দর্শন- কোনােটিতেই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। কেউ কেউ এটিকে ধর্মহীন দর্শন (রাজনৈতিকই হোক বা জীবন দর্শনই হোক) হিসেবে বােঝেন। আবার সেকুলার অনেক রাজনীতিবিদকে দেখা গেছে সর্বদা টুপি পরে থাকতে। তাদের অনেকে আন্তরিকভাবে ধর্ম-কর্মও পালন করেন। অনেক সেকুলার আবার নাস্তিকতার দর্শন লালন করেন। বাংলা ভাষায় সেকুলারিজমের প্রকৃত ভাব নিদের্শক কোনাে শব্দই তৈরি হয়নি। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা,’ ‘লোকায়ত’ কিংবা ‘ইহজাগতিকতা’- এ শব্দগুলো দিয়ে সেকুলারিজমের প্রকৃত ভাব ধরা যায় না। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি নিছকই রাজনৈতিক ভাববাহী। অন্যদিকে ‘লোকায়ত’ বা ‘ইহজাগতিকতা’ কেবল জীবন দর্শন নির্দেশ করে। এসব কারণে অত্র প্রবন্ধের অনুবাদে সেকুলার বা সেকুলারিজম শব্দগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে।

২. ঠিক ওই ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে র‌্যান্ড করপোরেশনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিভিশন কর্তৃক প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। দেখুন Cheryl Benard, Civil and Democratic Islam: Parners, Resources, Strategies (Pitsburg: Rand Corporation, 2003), পৃষ্ঠা : ৪। রিপোর্টটি ডাউনলোড করতে লগ ইন করতে পারেন : http://www.rand.org/pubs/monograph_reports/MR1716/

৩. বস্তুত লিবারাল ইসলামের জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখালেখি করেন যেসব পণ্ডিত তাদের অনেকেই মডেল হিসেবে প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশনকে বিবেচনা করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লুথারস অফ ইসলাম হিসেবে খ্যাত।

*৪. খ্রিস্টীয় ‘সভ্য’ ইউরোপ জগতের অন্যসব ‘অসভ্য’দের সভ্য ও শৃঙ্খলা অনুবর্তী করার উপনিবেশবাদী ওই পুরনো লজিক। সভ্যতা প্রকল্পের ভেতর দিয়ে জগৎজুড়ে কীভাবে দখলদারিতা, লুণ্ঠন, শোষণ, শাসনের ওপর ইউরোপ পুষ্ট হয়েছে এর ইতিহাস সবার জানা। মুসলমানরা এখনো সেকুলার হয়নি। এখনো আদিম ধর্মের নিগঢ়ে বাঁধা। তো তাদের সভ্য করতে হলে সেকুলার প্রকল্প নিতে হবে। একই উপনিবেশিক লজিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।

৫. David Kaplan, ”Hearts, Minds and Dollars: In an Unseen Front in the War on Terrorism, America Is Spending Millions … to Change the Very Face of Islam,” U.S. News and Workd Report, April 05, 2005, পাওয়া যাবে, www.usnews.com/usnews/news/articles/050425/25roots.html (০৯ নভেম্বর ২০০৫’এ অভিগমন)। আরো দেখুন White House’s National Strategy for Combating Terrorism (February 2003)। এটি মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিল। দেখুন : www.whitehouse.gov/news/releases/2003/02/counter_terrorism/couter_terrorism_strategy.pdf

৬. Kaplan, “Hearts, Minds and Dollars.”

৭. ৯/১১-পরবর্তী তিন বছর ইউএসএআইডি (USAID) কর্তৃক ব্যয় তিনগুণ বেড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম বিশ্বে পরিচালিত প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করা হয়েছে (Kaplan, “Heartts, Minds, and Dollars”)।

৮. সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচি শুরু হয়েছিল পাকিস্তানে ইউএসএআইডি-র অধীন পাকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতায় একটা মডেল মাদ্রাসা প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করতে। এতে সম্ভবত অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এক হাজারেরও বেশি স্কুল। একই ধরনের প্রোগ্রাম ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’য় চালু করা হয়েছিল আরো পরিমিত মাত্রায় (Kaplan, “Hearts, Minds, and Dollars”)।

৯. ৯/১১-পরবর্তী আমেরিকার সরকার Radio SawaAl-Hurra নামে স্যাটেলাইট টিভি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে এবং ইসলামের উদারনৈতিক ব্যাখ্যা বলতে তারা যা বােঝে তা উচ্চকিত করতে। অধিকন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর আলজাজিরা এবং আল অ্যারাবিয়া-র মতাে বিদ্যমান টিভি নেটওয়ার্কগুলোর অনুষ্ঠানসূচিতেও (বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানসূচি) প্রভাবিত করতে চেয়েছে প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। দেখুন Smantha Shapiro, “The War inside the Arab News Room,” New York Times Magazine, ২ জানুয়ারি ২০০৫। Steven Weisman-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমেরিকার ব্যাপক চাপে কাতার সরকার আলজাজিরা টিভি স্টেশনের জন্য আর্থিক ভর্তুকি ক্রমহৃাস করা এবং এটিকে বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। “Under Pressure, Qatar May Sell Jazeera Station,” New York Times, ৩০ জানুয়ারি ২০০৫।

১০. Kaplan, “Hearts, Minds, and Dollars”

১১. আহমেদ ওমর (করাচি, পাকিস্তান) থেকে ২০০৪ সালের ২০ ডিসেম্বর এই লেখকের নেয়া একটি সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত।

১২. র‌্যান্ড করপোরেশন একটি নামকরা রক্ষণশীল থিংক ট্যাংক। এর বোর্ড মেম্বার ও ডিরেক্টরদের মধ্যে আছেন ডোনাল্ড রামসফেল্ড, ডিক চেনি ও কন্ডোলিৎসা রাইসদের মতাে ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর র‌্যান্ড করপোরেশন (Rand Corporation) প্রথমত. প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Douglas Aircraft Company-র সঙ্গে US Air Force-এর চুক্তির অধীন। এরপর এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ– এসব অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি যেদিক মোড় নিয়েছে সেটি নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। র‌্যান্ড করপোরেশন অতি সম্প্রতি রাজ্য ও রাষ্ট্রের জেলখানাগুলো বেসরকারিকরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতাে অভ্যন্তরীণ ইসুগুলোতেও তৎপর হয়ে উঠেছে।

১৩. শেরিল বেনার্ড, Civil Democratic Islam. তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওই র‌্যান্ড প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ প্রকল্পটি যে বছর হাতে নেয়া হয়েছিল ওই বছরেই। আর ওই প্রকল্পটিকে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাড় পাওয়া সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য তৈরি জাতীয় কৌশলপত্রের ফল হিসেবে ব্যাপকভাবে ভাবা হয়।

১৪. Benard, C ivil Demoratic Islam, পৃষ্ঠা : ৪। প্রথা অনুসারী (traditionalist) প্রত্যয়টি র‌্যান্ড করপোরেশনের আবিষ্কার নয়। মৌলবাদী ইসলাম ও প্রথা অনুসারী ইসলাম- এ বিভাজন ইসলামের জ্ঞানচর্চার ধারায় একটি বিষয় হিসেবে হাজির আছে এবং প্রায়ই ইসলামি তৎপরতার রাজনৈতিক ও শান্তিবাদী (quietist) আঙ্গিকগুলো চিহ্নিত করে। আমার মত হচ্ছে, ওই রকম সহজ বিভাজন রাজনৈতিক ইসলামের ধারণাটিকে একটি সমস্যা আকারে উপস্থাপন করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে না। অধিকন্তু ওই বিভাজন যে জটিল উপায়ে ইসলামি আন্দোলনগুলো তাদের নৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে পরিবর্তন করে দিয়েছে এটিকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। এ বিষয়ে দেখুন, আমার বই Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject (Princeton, N.J.: Princeton Press 2005)।

১৫. Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা : ৩২ ও ৩৪।

১৬. Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা : ৪-৬, ২৯ ও ৩০।

১৭. প্রতিবেদনটির যুক্তি হলাে, ‘এমন কিছু জটিল ইসু আছে যেগুলোয় প্রথা অনুসারীরা অন্য যে কোনাে গোষ্ঠীর চেয়ে মৌলবাদীদের খুবই নিকটতর। ওই বিষয়গুলো হলাে শরিয়া বাস্তবায়ন, পাশ্চাত্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, জেন্ডার সম্পর্ক ও নারীর মর্যাদা এবং আদর্শ রাজনৈতিক শৃঙ্খলা, এমনকি সংস্কারপন্থী প্রথা অনুসারীরাও সামাজিক ও জীবন যাপনের প্রশ্নে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক আধুনিকতার সঙ্গে অনেক সাযুজ্যমান (Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা : ৩০)। প্রথা অনুসারীরারা মৌলবাদী ও জঙ্গিদের কাছাকাছি–প্রতিবেদনটির এ উপসংহার কোনাে পর্যবেক্ষণ করা সাক্ষ্য-প্রমাণের (empirical evidence) ওপর স্থাপিত নয়।

১৮. উদাহরণস্বরূপ- র‌্যান্ড প্রতিবেদন ওইসব প্রথাগত মুসলিমদের সমালোচনা করে যারা (শরিয়া কর্তৃক অনুমোদিত) বহু বিয়ের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও বহু বিয়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা প্রাসঙ্গিক কোরআনের আয়াত ও ফেকাহ ভাষ্যের শরণাপন্ন হন। র‌্যান্ড প্রতিবেদন ওই মুসলিমদের এ অবস্থানকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করে যে অবস্থানের বুনিয়াদ বাস্তবিক (substantive) নয়, বরং পদ্ধতিগত। প্রতিবেদনটির মত হলাে, মুসলমানদের সনাতন (canonical) উৎসগুলো সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা উচিত। কারণ ওই উৎসগুলো এ যুগের প্রশ্ন ও সমস্যার কোনাে সমাধান দেয় না (Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা : ১৬-১৭)।

১৯. Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা : ৩৩।

২০. কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদ করে বলবেন, শাসনরীতির আদর্শ হিসেবে উদারনীতিবাদ ও সাম্রাজ্য পরস্পর বিপরীত। এটি সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে উদারনীতিবাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের ওপর একটা ভুল উপলব্ধি। এই বিষয়ে দেখুন Uday Singh Mehta, Liberalism and Empire: A Study in Nineteenth-Century British Liberal Thought (Chicago: University of Chicago Press, 1999)।