আরব বিশ্বের কণ্ঠস্বর মাহমুদ দারবিশ ও তার আগুনঝরা পঙক্তিমালা

আরব বিশ্বের কণ্ঠস্বর মাহমুদ দারবিশ ও তার আগুনঝরা পঙক্তিমালা

মাহমুদ দারবিশ ১৯৪১ সালে আলবিরওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তার গ্রাম আক্রমণ করলে পরিবার লেবনন পালিয়ে যান তিনি। শেষ পর্যন্ত তার পরিবার উত্তর ইসরায়েলের ‘এসর’ শহরে বসবাস করা শুরু করেন। বন্দরনগরী হাইফা-তে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যাদিদ শহরে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তার কবিতার বই ‘লিভস অফ অলিভ’ প্রকাশ হয়। সাহিত্য চর্চার প্রথম দিকে তিনি ব্যাপকভাবে বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টির সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হন। এ সময়ে তার বিভিন্ন কাজে ফিলিস্তিনি পরিচয়ের পাশাপাশি কমিউনিজমের সঙ্গে জড়িত হওয়ার শক্ত যুক্তি দেখা যায়।

দারবিশ-এর প্রথম দিকের কাজ আরব-ইসরায়েল সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যারা ইসরায়েলিদের অত্যাচারে ঘরহারা ও পরিচয়হীন। ফলে দ্রুতই তিনি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে পড়াশোনার জন্য মস্কো যান। এর এক বছর আগে মিসর ও লেবানন সফর করেন। এ সময় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। এ কারণে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ তাকে পুনরায় ইসরায়েলে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই সময় তিনি সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন এবং পিএলও-র গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। তার সাহিত্যকর্ম রাজনৈতিক ইশতেহারের মতাে ছিল না। পিএলওর অফিশিয়াল বার্তার সঙ্গে তার পার্থক্যও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবুও তার কবিতার প্রতিটি চরণ ছিল নিজ ভূমির দাবিতে ফিলিস্তিনি জনগণের হাহাকারের শক্তিশালী সাহিত্যিক সমর্থক।

দারবিশের সাহিত্য সম্পর্কে বিখ্যাত কবি নওমি শিহাব বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের নিঃশ্বাসের মতাে মাহমুদ দারবিশ। ঘরহারা ও অধিকারের পক্ষে এক উত্তাল সাক্ষী।

১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার খসড়া ঘোষণার মধ্য দিয়ে পিএলওর গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারক হয়ে ওঠেন দারবিশ। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সম্পাদিত হলে ওই চুক্তির বিরোধিতা করে পিএলও থেকে পদত্যাগ করেন এবং নিজের সাহিত্যকর্মে মনোযোগ দেন। ২০০৮ সালে ৬৭ বছর বয়সে টেক্সাসে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার মৃতদেহ রামাল্লায় দাফন করা হয়।

আরব বিশ্বের মজলুম ওই কবির পঙক্তিমালা

কী মূল্য থাকতে পারে একজন মানুষের?
একটা জমিন ছাড়া,
একটা পতাকা ছাড়া,
একটা ঠিকানা ছাড়া,
কী মূল্য থাকতে পারে এসব মানুষের?

আমি আমার সত্তা ছাড়া আর কিছু নিয়েই আলোচনা করতে চাই না। কিন্তু আমার সত্তা আসলে জমাট স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয়।

আমি কাব্যের শক্তিতে বিশ্বাস করি। ওই শক্তি আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা এবং একই সঙ্গে সত্য অনুসন্ধানে আমার উৎসাহ।

আশা না থাকলে আমরা পরাজিত হবো।

নির্বাসন নিছক একটি ভৌগােলিক ধারণার চেয়ে বেশি কিছু। আপনি নির্বাসিত হতে পারেন আপন জন্মভূমিতে,  আপন ঘরে, এমনকি নিজ কামরাতেও।

কারো জন্মস্থান একটিই হয়। কিন্তু তিনি বিভিন্ন স্থানে কয়েকবার মারা যেতে পারেন। নির্বাসন ও কারাবরণ কিংবা জন্মভূমিতে অবরোধ বা শোষণের কারণে তার মৃত্যু ঘটে।

ফিলিস্তিনিরাই একমাত্র জাতি যারা নিশ্চিত থাকে আগামীকালের দিনটি আজকের দিন থেকে খারাপ যাবে। প্রতিটি আগামীই তাদের জন্য দুর্দশার ঘোষণা নিয়েই আসে।

আগ্রাসক ও আগ্রাসনের শিকার দু’পক্ষের দিকে তাকিয়েই হাসে ইতিহাস।

অবশ্যই ইসরায়েলকে পছন্দ করি না এবং এটি করার কোনো কারণও নেই। তাই বলে ইহুদিদের ঘৃণা করি না।

আমি আমার জন্মভূমি তৈরি করেছি, এমনকি আমার রাষ্ট্রও নির্মাণ করেছি আমার নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে।

কবিতা আমার কাছে আধ্যাত্মিকতার দাওয়াই।

আরব-ইসরায়েলিদের সব সময় একটি সংকট থাকে। জাতীয়তাবোধ ও আত্মপরিচয় ঘিরে ওই সংকট আবর্তিত হয়।