দুনিয়া কাঁপানো ৭টি ফুটবল কেলেঙ্কারি

দুনিয়া কাঁপানো ৭টি ফুটবল কেলেঙ্কারি

‘ফুটবল’। বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় খেলা। সাড়ে চার আউন্সের চর্মগোলকের গোলকধাঁধায় মত্ত থাকে বিশ্ববাসী। প্রাণের খেলা ফুটবল দেখতে বসলে দুনিয়া একপাশে চলে যায়। ফুটবলের সবটাজুড়ে আলোর রোশনাই। আসলেই কি তাই? ফুটবলে অন্ধকার বলে কোন শব্দ কি নেই? আছে! ফুটবলেরও অন্ধকার দিক আছে। ঠিক চাঁদেরও যেমন কলঙ্ক থাকে। ফুটবলের কালো অধ্যায়ের গল্প নেহায়েৎ কম নয়। দুর্নীতি, ঘুষ, ম্যাচ পাতানো, ডোপিং এসব নিয়ে রচিত ফুটবল কেলেঙ্কারিগুলো মনে করিয়ে দেয় অন্ধকারের কথা। জানবো ফুটবল ইতিহাসের তেমনই সাতটি কেলেঙ্কারি সম্পর্কে, যেগুলো ফুটবল দুনিয়াকে রীতিমতো কাঁপিয়ে তুলেছিল–

 

ফিফার ঘুষ কেলেঙ্কারি

‘কাতার বিশ্বকাপ’ ২০২২ বিশ্বকাপ নিয়ে ফুটবলাঙ্গনে জল কম ঘোলা হয়নি। ভোট জালিয়াতি, ঘুষ নিয়ে কাতারকে দায়িত্ব পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে ফিফার বিরুদ্ধে। অস্বীকার করতে চাইলেও অস্বীকার করার জো থাকে না সবক্ষেত্রে। ফিফার কর্মকর্তারা শেষ রক্ষা পাননি। নির্বাচনের আগে ভোট বিক্রির অপচেষ্টার দায়ে বহিষ্কৃত হন ফিফার নির্বাহী কমিটির ছয় সদস্য। ঘুষ, দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে ফিফার অবস্থান এখানেই শেষ নয়। এর আগেও নানান সময়ে প্রশ্ন উঠেছে ফিফার স্বচ্ছতা নিয়ে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে বিশ্বকাপ কেলেঙ্কারি।

• কোথা থেকে সূত্রপাত? ডিসেম্বর ২, ২০১০। ২০১৮ এবং ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হবার দৌঁড়ে প্রতীদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দায়িত্ব পায় রাশিয়া এবং কাতার। রাশিয়ায় ‘১৮র আসর, পরেরটা কাতারে। গোলযোগ বাঁধে মধ্যপ্রাচ্যের কাতারকে নিয়েই। কাতারের আবহাওয়া এমনিতেই উত্তপ্ত। কি কাকতাল, বছর না ঘুরতেই তাদের নিয়ে উত্তাপ বাড়ে বাস্তবিক অর্থেই। অভিযোগ- ভোট কিনে দায়িত্ব নিয়েছে তারা! প্রায় ছ’মাস ধরে চলতে থাকে ঘটনা খুঁটিয়ে দেখা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কাতার ফুটবলের প্রধান, ফিফার সহসভাপতি ‘মোহাম্মদ বিন হাম্মাম’কে। অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তার সাথে যুক্ত হয় আরেকটি অভিযোগ। অসদাচার। হাম্মাককে সকল প্রকার ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি ফিফার গভর্নিং বোর্ড। তাতে ভেস্তে যায় হাম্মামের ফিফা সভাপতি হবার লালিত স্বপ্ন।

• হাম্মামেই সমাপ্তি? হাম্মাম কেবল নাটকের আবহ সঙ্গীত বাজিয়েছেন। সেই সঙ্গীতের জের ধরে বছর দুয়েক পর ২০১৩ সালের ৩০শে এপ্রিল অভিযোগ ওঠে ফিফার সাবেক সভাপতি জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিকোলাস লিয়োজ ও রিকার্ডো টিসেরার বিরুদ্ধে। অভিযোগের বিষয়, অবৈধ অর্থ গ্রহণ। তার পরের সপ্তাহে কনক্যাকাফ অঞ্চলের সাবেক মহাসচিব চাক ব্লেজারকে বহিষ্কার করে ফিফার এথিক্স কমিটি।

• কনক্যাকাফের পথ ধরে… কনক্যাকাফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক যিনি একই সঙ্গে পালন করেছিলেন উত্তর ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান ফুটবলের, তিনি ভেঙেছেন হাঁড়ির আরেকটি খবর। দুর্নীতি এমনকি হতে পারত ২০১৪ বিশ্বকাপেও। মাত্রই আগের আসর আয়োজন করা দক্ষিণ আফ্রিকা চাইছিল ‘১৪তেও আয়োজক হতে। তিনি আরো বলেন, ১৯৯৮-র আসরটা বসার কথা ছিল মরক্কোয় যেটা পরে অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে। তার ভাষ্যে স্পষ্ট হয় টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং নিয়ে ফিফার অনৈতিক কান্ডও। . গল্পের চরিত্ররা… ফিফার কাতার কেলেঙ্কারির গল্পে চরিত্রের অভাব নেই। পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চ্যালা, সকলেরই গল্পে সরব উপস্থিতি। এফবিআইয়ের একেকবারের অভিযানে ধরা পড়তে থাকে নতুন নতুন মুখ, বেরিয়ে আসে নতুন অভিযোগ, গল্প মোড় নেয় নতুন বাঁকে। অভিযোগের শেষ নেই ফিফার বিরুদ্ধে। মার্কিন ব্যাংকে অবৈধ অর্থের লেনদেন, প্রায় ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এইসব চক্রের হোতা হিসেবে। তবে, গেল বছর সুইস পুলিশের জুরিখের এক হোটেল অভিযানে পাল্টে যায় পাশার দান। ফিফা এবং উয়েফা সভাপতির ক্যারিয়ারে পড়ে যায় যতিচিহ্ন।

• ওদের কী হল? সেপ ব্ল্যাটার। মিশেল প্লাতিনি। দুজনকেই মুখোশ মানুষ বলা চলে। ওরা আবার দুটি দেহ একটি প্রাণ। একাত্না যাকে বলে। ১৯৯৯-২০০২। দুইজনের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক আর্থিক সমঝোতা। সমঝোতার অর্থ পাবেন প্লাতিনি, দেবেন ব্ল্যাটার। ২০১১ সালে প্লাতিনি সে টাকা বুঝে পান। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫, আর্থিক অনিয়ম ও বিধি ভঙ্গ করে উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনিকে অর্থ প্রদানের অভিযোগে ব্ল্যাটারের বিরুদ্ধে সুইজারল্যান্ডে শুরু হয় ফৌজদারি তদন্ত। প্রথমে দুজনেই অস্বীকার করেন। পরে আবার স্বীকার করেন ব্ল্যাটার। দুজন একাত্না বলেই হয়ত স্বীকার করেন প্লাতিনিও। দুইজনেই সমর্থন করেছেন আত্মপক্ষ। দিয়েছেন নানান যুক্তি। সেসব ধোপে টেকেনি। ৮ই অক্টোবর প্রথম দফায় ব্ল্যাটার এবং প্লাতিনি দুইজনকেই নিষিদ্ধ করা হয় সাময়িকভাবে। সাথে ফিফার মহাসচিব জেরোম ভালকেকেও দেয়া হয় তিনমাসের বহিষ্কারাদেশ। এর মধ্যে পঞ্চম দফায় ফিফার সভাপতিও নির্বাচিত হন ব্ল্যাটার। ভেবেছিলেন উড়ে যাবে শঙ্কার কালো মেঘ, রাত শেষে ভোর আসবে। কিন্তু না! সব রাত শেষ হয় না। সব ভোরে আলো ফোটে না। দুজন তাই তিনমাস থেকে আটবছরের নিষেধাজ্ঞা পান, জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। . ২০১৫ সালের ২৭শে মে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের ভিত্তিতে জুরিখের হোটেলে যে অভিযান চালায় সুইজারল্যান্ড পুলিশ তার সর্বশেষ পরিণতি ফিফা-উয়েফার দুই সভাপতির কারাবাস। সেদিন অবশ্য আটক হয়েছিলেন ফিফার সাত কর্মকর্তা যাতে ছিলেন দুই সহসভাপতিও। ছয় বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সভাপতি পদের প্রার্থী দক্ষিণ কোরিয়ার চুং মং-জুংকেও। কিন্তু, বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারির দ্রষ্টা তো জেলে থাকা ওই দুই ভদ্রলোকই যারা আসিন ছিলেন ফুটবলের সর্বোচ্চ চূড়ায়।

 

২. কুখ্যাত ক্যালসিওপলি কেলেঙ্কারি, ২০০৬

জিয়ানলুইজি বুফন। ফুটবলাকাশের জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা। তার খেলোয়াড়ি দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, নেই পেশাদারিত্ব নিয়ে। জুভেন্তাসের ভক্তকূল তাকে মনে রাখবে আজীবন। শুধু খেলা দিয়ে নয়। দলের প্রতি তার দায়িত্ববোধের কারণে। ২০০৬ সালে তুরিনের বুড়িরা যখন ক্লাবের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়ের জন্ম দিয়ে অবনমিত হয় ‘সিরি বি’তে তখনও তিনি দল ছেড়ে যাননি। ইতালিয়ান সিরি এ। ইউরোপের অন্যতম বড় এবং বিখ্যাত লিগ। এখানকার ক্লাবগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। জুভেন্তাস, এসি মিলান ক্লাব ফুটবলের বড় নাম। সেই তাদের বিরুদ্ধে ওঠে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাচ ফিক্স করা হয় বিপক্ষ দলকে টাকা খাইয়ে। এখানে রথ ছুটেছে উল্টোদিকে। প্রমাণ মিলে রেফারিকে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে ম্যাচ পাতানোর। শুধু মিলান বা জুভ নয়, এতে শামিল ছিল ফিওরেন্তিনা, ল্যাজ্জিও, রেজিনাসহ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগের কিছু ক্লাব। সরাসরি সম্পৃক্ততা মেলে এসব ক্লাবের কর্মকর্তাদের। মজার কিংবা দুঃখের ব্যাপার হল চিহ্নিত ঘটনার কিছু ঘটেছিল আশি ও নব্বইয়ের দশকে। যদিও বেশিরভাগ ঘটে ২০০১, ২০০৪ এর মৌসুমে।

বুফনের ক্লাব জুভেন্টাসের বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়

২০০৬ সালের ওই ঘটনা নাড়িয়ে দেয় গোটা ফুটবল জগতকে। পুলিশি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু ক্লাব কিংবা ক্লাবের নির্বাহীরা নন, এর পেছনে হাত ছিল ইতালির একাধিক মাফিয়ারও। সেই মৌসুমে মিলানকে ১৫ পয়েন্ট জরিমানা করে ছেড়ে দিলেও অন্য দলগুলোর ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। ফিওরেন্তিনা, ল্যাজ্জিও, রেজিনাকে নামিয়ে দেয়া হয় সিরি বি বা দ্বিতীয় বিভাগে। বাকি রইলো জুভেন্তাস যারা টানা দুই সিজন লিগ টাইটেল জয়ী। তাদের প্রতি কতটা নমনীয় হবে ইতালিয়ান বোর্ড? জুভদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের পাল্লা ভারি, অভিযোগগুলোও গুরুতর। ১৯৮০ সালে ‘কোপা ইতালিয়া’ টুর্নামেন্টের এক ম্যাচে তাদের দলের একজন তারকা বাজিকরদের কাছে থেকে টাকা খেয়ে ওই ম্যাচে খেলেননি ভুয়া অসুখের বাহানায়। ওই ম্যাচ বাদে আরো কয়েকটি ম্যাচে তার এমন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকার সত্যতা পাওয়া যায়। তিনি আর কেউ নন! উয়েফার সাবেক সভাপতি, তিনবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী মিশেল প্লাতিনি। এতসব অভিযোগের পর জুভেন্তাসকে নামিয়ে দেয়া হয় তৃতীয় বিভাগে। কিন্তু, নতুন মৌসুম শুরু হলে তাদের দেখা যায় দ্বিতীয় বিভাগে! শুরু হয় আরেক বিতর্ক। . মিশেল প্লাতিনি তার ক্ষমতার ব্যবহারে জুভদের যেমন উঠিয়ে এনেছেন সিরি বিতে, তেমনি অনবরত চাপ প্রয়োগে অভিযুক্তের তালিকা থেকে মুছিয়েছেন নিজের নামটা। ইতালির প্রশাসন সঠিক ব্যবস্থা নেয়নি মাফিয়াদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের জবাব নেই। ‘ক্যালসিওপলি কেলেঙ্কারি’ খ্যাত ইতালির ফুটবলের নিকৃষ্ট এই ঘটনার বিতর্ক তাই পুরোপুরিভাবে পিছু আজো ছাড়েনি।

 

৩. নাইজেরিয়ার বয়স জালিয়াতি-২০০৯

এইজ ফ্রড বা বয়স জালিয়াতি ফুটবলের পুরনো সমস্যা। ২০১৪ সালে ব্যাপারটি নতুন করে আলোচনায় আসে ইতালির ক্লাব ল্যাজ্জিও ১৭ বছর বয়সী ক্যামেরুনিয়ান মিডফিল্ডার জোসেফ মিনালাকে সাইন করানোর পর। আফ্রিকার আরেক দেশে সেনেগালের মিডিয়া মিনালা সম্পর্কে যে তথ্য দেয় তাতে চোখ স্রেফ কপালে উঠেই ক্ষ্যান্ত থাকবে না নিশ্চিত। তাদের মতে, মিনালার বয়স ১৭ নয়, ৪১! যদিও প্লেয়ার এবং ক্লাব উভয়েই তা অস্বীকার করে। একটা দিক অবশ্য তারা কেউই অস্বীকার করে না তা হল, আফ্রিকান ফুটবলে বয়স জালিয়াতি নতুন কিছু নয়।

নাইজেরিয়ার ১৫ জন খেলোয়াড়ই ফিফা অনুর্ধ্ব-১৭ থেকে বয়সের জালিয়াতির কারণে বাদ পড়ে

নাইজেরিয়া। আফ্রিকান সুপার ঈগল খ্যাত দলটি রীতিমত পরাশক্তি। তাদের জায়ান্ট কিলারও বলা যায়। তাদের ভালো গুণের বিপরীতে বদঅভ্যাসও দুনিয়াজোড়া আলোচিত, সমালোচিত। বয়স কারচুপিতে তারা কয়েক কাঠি সরেস বাকিদের চেয়ে। ১৯৮৮ সালে নাইজেরিয়াকে এই বয়স জালিয়াতির অভিযোগে সব ধরণের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে ফিফা। কী ছিল কারণ? সে বছরের অলিম্পিকে অংশ নিতে আসা নাইজেরীয় ফুটবল দলের তিনজন প্লেয়ারের বয়সে খুঁত ছিল। এর আগের বিভিন্ন টুর্নামেন্টের জন্মতারিখ আর অলিম্পিকে সাবমিট করা জন্মতারিখের মধ্যে অমিল খুঁজে পায় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এতেই তারা ক্ষান্ত দেয়নি। সবচেয়ে বড় জালিয়াতিটি করে ২০০৯ সালের অনুর্ধ্ব-১৭ যুব বিশ্বকাপে। সেবারের আসরে ফিফা প্রত্যেক খেলোয়াড়ের বয়স পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়, যার খড়গে কাটা পড়ে নাইজেরিয়ার ১৫জন ফুটবলারের নাম!

এ প্রসঙ্গে নাইজেরিয়ান ব্লগার জর্জ ওমেনিয়া বলেন, “এটা এখানে খুব সাধারণ ব্যাপার। যে কেউই কোন ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে নামমাত্র খরচে ভিন্ন নাম, জন্মস্থানসহ সম্পূর্ণ নতুন পাসপোর্ট তৈরি করতে পারে, তাও মাত্র কয়েক ঘন্টায়।”

 

৪. বুন্দেসলিগা ম্যাচ ফিক্সিং, ২০০৫

২০০৫ সাল। খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ, তদন্তের পর বেরিয়ে আসে জার্মান ফুটবলাঙ্গনে ফিক্সিংয়ের ঘটনা। কোন খেলোয়াড় নয়, এতে মূল চরিত্র রূপায়িত করেছেন কয়েকজন রেফারি। এরা জার্মানির দ্বিতীয় বিভাগ বা বুন্দেসলিগা টু, ডিএফবি পোকাল কাপ এবং থার্ড ডিভিশনের খেলায় জুয়াড়িদের সাথে মিলে ম্যাচ পাতিয়েছেন।

চারটি পাতানো ম্যাচ খেলাতে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে শাস্তির মুখোখি হন রেফারি রবার্ট হোয়েজার

জার্মানরা ফুটবলে অন্তঃপ্রাণ। তাদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিতর্কে চুপ থাকেনি প্রশাসন। অভিযুক্ত রেফারি রবার্ট হোয়েজারকে আজীবন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি দেওয়া হয় দুইবছরের কারাদণ্ড। জব্দ করা চিহ্নিত চার ম্যাচের জন্য নেওয়া অর্থ। হোয়েজারকে গ্রেপ্তার করা হয় মূলত তার চারজন সহকর্মীর সন্দেহের আবহে করা অভিযোগের ভিত্তিতে। জিজ্ঞাসাবাদে হোয়েজার নিজের অপরাধ মেনে নেন এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের নাম পুলিশের কাছে বলেন। এরই প্রেক্ষিতে গ্রেফতার করা হয় বুন্দেসলিগার দল হার্থা বার্লিনের তিন ফুটবলাকে যারা পোকাল কাপে তৃতীয় বিভাগের একটি দলের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিক্সিং করেছে। তাদের একজন ৭৬ মিনিটে বদলি হিসেবে নেমে ৮০ মিনিটে আত্নঘাতী গোল দেয় যাতে বার্লিন পিছিয়ে যায় ৩-২ গোলে। শেষপর্যন্ত ওই ব্যবধানে ম্যাচও হারে হার্থা। বুন্দেসলিগার কোন দল এই কেলেঙ্কারিতে না জড়ালেও এটি জার্মান মিডিয়ার দৃষ্টি ভালোভাবেই আকর্ষণ করে। যার ফলে পরের বছরই শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপ থেকে মনোযোগ সরে যায় সকলের, সৃষ্টি হয় বিব্রতকর অবস্থার।

 

৫. ইংলিশ ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারি, ২০১৩

ডোপিংয়ের মতই ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে ইংল্যান্ডে খুব বেশি চর্চা হয় না। ২০১৩ সালে যখন ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সবচাইতে বড় ‘ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারি’ প্রকাশ করা হয় দেশটির জনগণ তখন রীতিমত অবাক হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সান এবং ডেইলি টেলিগ্রাফের অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক জুয়াড়ি চক্রের সাথে জড়িত থাকায় ছয়জন ফুটবলারকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিডিং এফসি, পোর্থসমাউথে খেলা ‘স্যাম সোজী’ গ্রেপ্তার হওয়াদের একজন। তিনি বলেন, “আমরা ফুটবলারদের ক্যাশ পেমেন্ট দিয়ে বুক করে নিতাম। আমাদের মূল লক্ষ্য থাকত চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা ফুটবলারদের প্রতি।”

নিজের প্রসঙ্গে তিনি জানান, “আমি একটি ম্যাচে লালকার্ড পাবার জন্য ৭০, ০০০ পাউন্ড নিয়েছি। হলুদ কার্ড খাবার জন্য চ্যাম্পিয়নশিপের প্লেয়ারদের দেয়া হত ৩০, ০০০ পাউন্ড।” তিনি এও বলেন, ২০১৪ বিশ্বকাপে ফিক্সিং করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন প্রিমিয়ার লীগে ঢুকতে।

১৮ মাসের জেল খাটতে হয় ফুটবলার মাইকেল বোয়াটেংকে

টেলিগ্রাফের পৃথক আরেকটি অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় সাতজন বাজিকরকে যারা সিঙ্গাপুরে একটি গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিল। তারা মূলত ইংল্যান্ডের দুটি ম্যাচকে নিশানা বানিয়েছিল। জুয়াড়িদের ভাষ্যমতে, তাদের চোখ এশিয়ার বাজারে যেখান থেকে প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব। তাছাড়া ইংলিশ ফুটবলের দলগুলোর এশিয়ায় ব্যাপক পরিচিতি। তারা এজন্যে এমনকি ইউরোপের নির্দিষ্ট দল এবং রেফারি কেনার ছক কষছিল যাতে ম্যাচ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ফল চাওয়া অনুযায়ী হয়। ওই জুয়াড়ি এটা প্রমাণ করার জন্যে যে তিনি মিথ্যা বলেননি, পরের দিনের একটি ম্যাচ সম্পর্কে আগাম নানান পূর্বাভাস দেন। কে কত গোল করবে, কোন প্লেয়ারটা কত মিনিটে হলুদ কার্ড খাবে তা বলে দেন! . তদন্তের পর সিঙ্গাপুরের দুই ব্যবসায়ীকে পাঁচ বছরের জেল দেয়া হয় ‘এফসি উইম্বলডন ও ডেগহ্যাম রেডব্রিজের’ মধ্যকার ম্যাচ পাতানোর চেষ্টায়। এছাড়াও, ফুটবলার মাইকেল বোয়াটেংকে ১৮ মাসের কারাবাস দেয় ইংল্যান্ডের আদালত। সর্বপ্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জনের একজন ছিলেন সাবেক ইপিএল স্ট্রাইকার ডিজে ক্যাম্পবেল। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি কোন শাস্তি পাননি।

 

৬. ইউরোপিয়ান বেটিং স্ক্যান্ডাল, ২০০৯

উয়েফা এটিকে আখ্যা দিয়েছে ‘ইউরোপের সর্বকালের সবচেয়ে বড় ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি’ হিসেবে। ভুল বলেনি কিছু। জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, তুরস্ক, হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, বসনিয়া, অস্ট্রিয়ার প্রায় দুই শতাধিক ম্যাচের ফল নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল জুয়াড়িরা। এছাড়াও, ইউরোপা লিগের বাছাই পর্বের একডজন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের তিনটে ম্যাচে নজর দিয়েছিল ওরা। এমন কুখ্যাত অপচেষ্টাকে বিগেস্ট ছাড়া অন্য আখ্যাদেবার কথা মাথায় আসার কথাও নয়।

২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাছাই পর্বের ম্যাচে মেসিডোনিয়ান ক্লাব এফকে পোবেডা এবং আর্মেনিয়ান ক্লাব এফসি পাইয়োনিকের ড্র হওয়া ম্যাচ থেকেই মূলত ইনভেস্টিগেশনের প্রারম্ভ। ফোন টেপের মাধম্যে ধরা পড়ে ম্যাচ পাতানোর পূর্ব পরিকল্পনা। উয়েফার গভর্নিং কমিটি পোবেডাকে আট বছরের জন্য সবধরনের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা দেয়। ২০১৭ সালে শেষ হয় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ। একই সাথে ফিক্সিংয়ের সমন্বয়কারী ক্লাবের তৎকালীন অধিনায়ক নিকোল দ্রাবেভেস্কি ও ক্লাব প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার যাব্রকেনেককে আজীবন নিষিদ্ধ করে।

ইউয়েফার গভর্নিং কমিটি পোবেডাকে আট বছরের জন্য সবধরণের ফুটবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে

এছাড়াও, জার্মানিতে গ্রেপ্তার করা হয় ১৫ জনকে, সুইজারল্যান্ডে দুইজনকে নগদ অর্থ এবং সম্পত্তির দলিলসমেত ধরে পুলিশ। সর্বমোট ১৬৮টি ম্যাচের তদন্ত করা হলেও ঠিক কতটা নিখুঁতভাবে হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কেননা, উয়েফা সেসব ম্যাচের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

 

৭. মেক্সিকোর চিকেন গেইট ড্রাগ স্ক্যান্ডাল, ২০১১

যুব বিশ্বকাপ। দেশব্যাপি যুবকদের উত্থানের গল্প লিখেছে যুগে যুগে। আগামীর তারকারা তাদের আবহনী সঙ্গীত শুনিয়ে যান এখানেই। এ মঞ্চ নিজেদের চেনানোর। ২০১১ সালের অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে মেক্সিকান যুবারা বিশ্বদরবারে নিজেদের চিনিয়েছিল, তবে চেনানোর কায়দাটা বিতর্কিত। পাঁচজন ফুটবলার ডোপ টেস্টে পজিটিভ! ‘চিকেন গেইট’ ড্রাগ স্ক্যান্ডাল নামে পরিচিতি পেয়েছে যা।

গোল্ডকাপ শুরুর পূর্বে ডোপ টেস্ট নিয়ে মিডিয়ার রিপোর্টে উঠে আসে পাঁচজন ফুটবলারের নিষিদ্ধ পদার্থ ‘ক্লিনবুটেরল’ নেয়ার প্রমাণ। ডোপ টেস্টে পজিটিভ হবার পর ফুটবলাররা নিজেদের পক্ষে সাফাই গান। তাদের মতে, ড্রাগ তারা নেননি। খাদ্য তালিকায় থাকা চিকেনে এটি মেশানো ছিল। তারা নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেন এই বলে, মুরগি ও গবাদি পশুর দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি ঘটাতে ক্লিনবুটেরল ব্যবহার করা হয়।

তারপরও পাঁচজন প্লেয়ার আপিল করেননি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। সে আসরে মেক্সিকোর শিরোপা জয়ে ভূমিকা রেখে নিজেদের প্রমাণ করেন তারা। যে দলে ছিলেন সময়ের দুই পরিচিত মুখ হাভিয়ের হার্নান্দেজ এবং জিওভান্নি দস সান্তোস।

মেক্সিকোর ফুটবলাররা ডোপ টেস্টে পজিটিভ হবার পর ফিফা সকল প্লেয়ারদের উপর পরীক্ষা চালায়। অবাক করা ব্যাপার, তাতে প্রায় শতাধিক খেলোয়াড় পজিটিভ হয়। ফিফার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিস্মিত কন্ঠে জানান, বিশ বছরের পেশাদারি জীবনে এমনটা এর আগে দেখেননি তিনি! এরপর কেটে গেছে সাত বছর। এই দীর্ঘ সময়ে এখনো অজানা মেক্সিকান ওই পাঁচজন খেলোয়াড় ইচ্ছাকৃতভাবে ক্লিনবুটেরল গ্রহণ করেছে নাকি আসলেই খাবারেই তা ছিল।