টাইগার জিন্দা হ্যায় : দেখালেন মুশফিক

বিস্ময় জাগানিয়া জয়

টাইগার জিন্দা হ্যায় : দেখালেন মুশফিক

• ২১৪ : টি-২০তে বাংলাদেশের বিপক্ষে শ্রীলংকার সর্বোচ্চ ইনিংস
• ‎২১৫ : টি-২০তে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংস
• ‎রান তাড়া করে জয়ের নতুন রেকর্ডও গড়লো বাংলাদেশ
• ‎৩৫ বলে ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে জয়ের নায়ক মুশফিক
• ‎টি-২০তে এটি তার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ
• ‎ম্যান অফ দি ম্যাচ : মুশফিকুর রহিম

নিদাহাস ট্রফিতে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। গত ম্যাচের ভারতের সঙ্গে ভরাডুবির পরও একই দলের ওপর আস্থা রাখার বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশ। টসে জিতে এদিন লংকানদের ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ দলের দলপতি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তার সিদ্ধান্ত যথার্থ প্রমাণ তো দূর, লংকানদের বেদম প্রহারে চোখে-মুখে শর্ষে ফুল দেখেছেন বাংলাদেশের বোলাররা। ফলে শ্রীলংকা গড়ে ২১৪ রানের পাহাড়। এটুকু পড়ে যদি ম্যাচের বাকি অংশ অনুমান করার চেষ্টা করেন তাহলে ভুল করবেন। লিটন-তামিম-মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর অসাধারণ ব্যাটিংয়ে অসাধ্য সাধন করে লংকার মাটিতে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার নিজেদের রেকর্ডটা নতুন করে লিখিয়েছে বাংলাদেশ। অবিস্বরণীয় এ জয়ের শুরুটা হয়েছে লিটন-তামিমের থাবায় আর শেষটা করেছেন মুশফিক লংকান বোলারদের মরণ কামড় দিয়ে। টাইগারদের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত লংকানরা মাঠ ছেড়েছে বিস্ময় নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায়। আর পুরো বিশ্ব আবারও শুনলো প্রায় ব্রাত্য ঘোষিত রিয়াল টাইগার মুশফিকের গর্জন।

পাওয়ার প্লেতেই পথহারা বাংলাদেশ

টসে জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া বাংলাদেশ পথ হারায় পাওয়ার প্লেতেই। গত ম্যাচের আত্মবিশ্বাস এ ম্যাচে লংকান ব্যাটসম্যানদের করে তোলে আরো সাহসী। ফলে ইনিংসের প্রথম ওভার থেকেই চালিয়ে খেলতে থাকেন দুই ওপেনার গুণাথিলাকা ও মেন্ডিস এবং তাদের তাণ্ডবে শুরুতেই দিশেহারা হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। অদ্ভুত যুক্তিতে দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়া তাসকিন আহমেদ একাই পাওয়ার প্লের দুই ওভারে দিয়েছেন ৩৩ রান! পাওয়ার প্লেতে মোস্তাফিজ তার ট্রেডমার্ক ডেলিভারিতে একটি উইকেট পেলেও রান দেয়ায় ছিলেন উদার। এক রুবেলই যা একটু ব্যতিক্রম। বোলারদের উদারতার পূর্ণ ফায়দা তুলে পাওয়ার প্লেতেই শ্রীলংকা তুলে নেয় ৭০ রান।

নখদন্তহীন বোলিং

মাত্রই কিছুদিন আগে মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশের বোলিং যে কোনো দলেরই নিয়েছে কঠিন পরীক্ষা। সেখানে বর্তমান বাংলাদেশ দলের বোলিংকে তুলনা করা যায় শুধু পাড়া-মহল্লার কোনো দলের সঙ্গেই। পরিকল্পনাহীন বোলিং, নেই কোনো লাইন, লেংন্থ- শুধু যেন করার জন্যই বোলিং করে যাওয়া। এর সুফল নিতে অপেক্ষা করছেন না প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরাও। উপল থারাঙ্গা- যার টি-২০ ক্যারিয়ারের স্ট্রাইক রেট ১২১ তিনিও অবলীলায় খেলছেন স্ট্রোক, অসহায়ভাবে বাউন্ডারি লাইন থেকে বল কুড়িয়ে আনছেন ফিল্ডাররা। ২১৩ স্ট্রাইক রেটে ১৫ বলে করেছেন ৩২ রান। শুরুতেই বোলিং নেয়ার অর্থ আপনি নিশ্চয় কোনো পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছেন যার ছিটেফোঁটাও ইনিংসে দেখা যায়নি।

ডট বলে অনীহা ও উদারহস্তে বাউন্ডারি বিলানো

টি-২০ উইকেট নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডট বলা করার ক্ষমতাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় উইকেটের চেয়ে দুটি বেশি ডট বলই ব্যবধান গড়ে দেয় ম্যাচের। আর ওই ডট বল করতেই যত অনীহা বাংলাদেশ দলের বোলারদের। ডট বলে অনীহা থাকলেও বাউন্ডারি খাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বোলারদের নৈপুণ্য প্রশংসাযোগ্য! তাসকিন, মোস্তাফিজ, রুবেল, নাজমুল ও মেহেদীর করা ডট বলের সংখ্যা যথাক্রমে ৬, ৬, ৮, ১ ও ৭টি অর্থাৎ মাত্র ২৮ বল। আর তারা বাউন্ডারি হজম করেছেন যথাক্রমে ৫, ৬, ৮, ১ ও ৪টি। এতেই বোঝা যায় ২১৪ রানের পাহাড়ে কী করে চড়েছেন লংকানরা।

অমানিশায় একটুকরো আলো মাহমুদুল্লাহ

বোলারদের উদারতায় উপায়ন্ত না দেখে নিজেই বল হাতে তুলে নেন মাহমুদুল্লাহ। ছন্দে থাকা মেন্ডিস তাকে স্বাগত জানান ছক্কা মেরেই। এতে দমে না গিয়ে তারটিসহ একই ওভারে দুটি উইকেট তুলে নিয়ে লংকানদের লাগামহীন রানের গতিতে রাশ টানেন তিনি। একই ওভারে তার দেয়া জোড়া ধাক্কার সুফল নিয়ে পরের ওভারেই একটি উইকেট তুলে নেন তাসকিন। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি ক্যাচই ধরেছেন সাব্বির রহমান।

দলের মূল বোলার মোস্তাফিজই যখন ৩টি উইকেট নিতে খরচ করেন ৪৮ রান তখন বাকিদের কাছে কিছু প্রত্যাশাও তো পাপ।

কার্যকর পরিকল্পনা ও পাওয়ার প্লেতে পারফেক্ট জওয়াব

ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন এনে সৌম্যের বিদলে লিটনকে নামানো হয় তামিমের সঙ্গে ইনিংস সূচনা করতে। তামিমকে নিয়ে তিনি শুধু সূচনাই নয়, অপ্রত্যাশিত রকমের শুভ সূচনা এনে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। স্ট্রাইক রোটেট করার অক্ষমতা পুষিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ সব শটে- কী পেস, কী স্পিন! প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সমান নির্দয় ছিলেন তিনি। পুল, হুক, ডাইন দি ট্র্যাকে গিয়ে মারা অসাধারণ সব ৬- কী ছিল না তার ইনিংসে? প্রদীপের বলে লাইন মিস করে এলবি হওয়ার আগে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন উড়ন্ত সূচনা। তামিম ক্রিজে থাকা অবস্থায় সাকিব-মুশফিক ছাড়া কেউ নিজের দিকে এভাবে পুরোটা আলো আগে কখনো কেড়ে নিতে পেরেছেন বলে মনে পড়ে না। তার ওই ঝড় তামিমের যোগ্য সঙ্গে বাংলাদেশ পাওয়ার প্লেতেই তুলে ৭৪ রান! লিটন আউট হওয়ার আগে ২টি চার, ৫টি ছয়ে ১৯ বলে করেন ৪৩ রান।

থিসারা-সৌম্য যুগলবন্দিতে পথহারা বাংলাদেশ

থিসারার ৫০তম শিকারে পরিণত হয়ে তামিম যখন প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন তখনো ম্যাচটি থেকে ছিটকে যায়নি বাংলাদেশ। ওই ছিটকে দেয়ার কাজটি একপ্রান্ত থেকে শ্রীলংকার হয়ে করছিলেন থিসেরা, অন্যপ্রান্তে বাংলাদেশের জন্য কাজটি কঠিন করে তুলছিলেন বর্তমান লংকান কোচ হাথুরুর প্রিয় শিষ্য সৌম্য। তার ব্যাটিং দেখে যেমন নবিশ মনে হচ্ছিল তেমনি মনে হচ্ছিল ২১৪ না, ১০০ বা এর আশপাশের কোনো স্কোর তাড়া করতে নেমেছে বাংলাদেশ। মাঝে মধ্যে কিছু আউট দলের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। সৌম্যর উইকেটিও ছিল ঠিক তেমনি। ২২ বলে ২৪ করে তিনি ফিরে যাওয়াটা বিপদের বদলে বাংলাদেশের জন্য হয়ে এসেছিল স্রষ্টার ইনায়াত হয়েই।

ভায়রায় ভরসা

সৌম্যর বিদায়ের পর জুটি বাঁধেন ক্রিকেট বিশ্বের আলোচিত ভায়রা জুটি মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ। শুরু থেকেই ছন্দে থাকা মুশফিককে চমৎকার সঙ্গ দেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। দু’জনের ৪২ রানের জুটি পথে ফেরায় বাংলাদেশকে। এটি সত্য, সৌম্য ও মুশফিকের ৫১ রানের জুটি দিন শেষে কার্যকর প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু সৌম্যর শ্লথ ব্যাটিং ম্যাচ থেকে ছিটকে দিচ্ছিল বাংলাদেশকে। মাহমুদুল্লাহর ১১ বলের ছোট্ট কিন্তু ২০ রানের ক্যামিওই বাংলাদেশকে ফেরায় কক্ষপথে।

বাহ! সাব্বির

মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক যখন ম্যাচটিকে হাতে এনে দিয়েছে প্রায় তখন ক্রিজে আসেন টি-২০ স্পেশালিস্ট সাব্বির রহমান। রান আউট হওয়াটা দোষের কিছু নয় বা পাপের পর্যায়েও পড়ে না। কিন্তু যে ভঙ্গিমায় তিনি আউট হলেন সেটি চরম অপেশাদারিত্বের পরিচয়। এটি ঠিক, ওইটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা দুরূহ। কিন্তু বিনা চেষ্টাতেই হাল ছেড়ে দেয়াটা ছিল চরম দৃষ্টিকটু ও অপেশাদার আচরণের বহিঃপ্রকাশ।

অনন্য মুশফিক

সাব্বিরের আউটের পর পুরো বাংলাদেশই চেয়ে ছিল বগুড়ার ওই সন্তানের দিকে। না, নিরাশ করেননি তিনি। বরং একক প্রচেষ্টায় যেভাবে বাংলাদেশকে জিতিয়ে আনলেন এতে কোনো প্রশংসাসূচক শব্দই যথাযথ মনে হচ্ছে না তার ইনিংসের মাহত্ম্য বয়ানে। ক্র্যাম্প নিয়েও যেভাবে বুক চিতিয়ে লড়লেন এটিকেই বলে রিয়াল টাইগার। ফার্নান্দোর বলে মাঠ ছাড়া করা ৬টা ছিটকে যেতে বসা ম্যাচটি আবার এনে দেয় বাংলাদেশের হাতে। শেষ ওভারের প্রয়োজন ৯ রান। লংকান অধিনায়ক বেছে নিলেন নিজের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র থিসেরাকে। মুশফিকের দিনে কি-ই বা করার আছে থিসারার? প্রথম বলে ২, এরপরের বলেই অসাধারণ এক চারে ম্যাচটি করে নিলেন বাংলাদেশের। তারপরের বলে দুই নিয়ে নিশ্চিত করলেন আর যাই হোক, ম্যাচটি হারছে না বাংলাদেশ। চতুর্থ বলে সিঙ্গল নিয়ে অবিশ্বাস্য জয়ের পর তার নাগিন নাচ ফ্রেমে বাঁধা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

ম্যাচের মধ্যবিরতির সময়ও কেউ যা ভাবেননি সেটাই করে দেখালো বাংলাদেশ। কলম্বোয় লংকান বোলারদেরই করুণার পাত্রে পরিণত করে ছিনিয়ে আনা এ জয় শুধুই একটা জয় নয়, এটা ছিল টাইগারদের ওই গর্জন যা শোনার জন্য সবকিছু ভুলে টিভির সামনে বসে যায় পুরো বাংলাদেশ।

শাবাশ মুশফিক
শাবাশ টাইগার বাহিনী