বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সংকট

রায়ান স্মিথ’র বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সংকট

পরিসংখ্যান বলে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বাজেটের ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ ছিল সামরিক বাহিনীর ব্যয় মেটাতে। তবুও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তার সীমান্তে ভূমি, সমুদ্র ও আকাশপথে মিয়ানমারের ক্রমাগত সীমা লঙ্ঘনের জবাবে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দেশের ভূখণ্ডের অটুট সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জনগণের আত্মবিশ্বাস রক্ষায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ ধরনের অবনতির অবশ্য একটি প্রচ্ছন্ন বার্তা আছে। সেটি হলাে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তার রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেয়ার মতাে যথেষ্ট সুসজ্জিত নয়। কারণ বাংলাদেশের জন্ম থেকেই ওই বাহিনীর জবাবদিহির তেমন জায়গা সৃষ্টি হয়নি, বরং অনেক কিছুই তারা দখল করেছে যেসব তাদের রক্ষা করার কথা ছিল।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সিলসিলাটা এসেছে মূলত বৃটিশ সেনাবাহিনী এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে, এমনকি অসামরিক শাসনের মুখোমুখি হওয়ার শিক্ষাটিও সেখানের। বাংলাদেশের ৪৬ বছরের ইতিহাসের ১৫ বছরই সেনাবাহিনীর শাসনে ছিল।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১২তম সংশোধনীর আলোকে যখন ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতাে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয় তখন এ জন্য গণভোটের আয়োজনও হয়েছিল। এরপরও আজ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাথায় রেখেই রাষ্ট্রপ্রধানকে নানান সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রতিটি দলেই কিছু সাবেক সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা থাকেন যারা তাদের নেতানেত্রীকে সেনাবাহিনী বিষয়ে যে কোনাে সিদ্ধান্তে নিরুৎসাহিত করেন।

উন্নয়নশীল অনেক রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র থাকলেও প্রতিরক্ষা বিষয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না। বাংলাদেশও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। ঐতিহাসিক কারণেও সামরিক বাহিনী নিয়ে তত প্রশ্ন ওঠে না। এসব বিষয়ে গোপনীয়তার দোহাই দিয়েই এসব বাহিনী ঘিরে অস্বচ্ছতার জন্ম হয়েছে। ওই বাহিনীর লোকজন নিজেদের বাকি বেসামরিক জনগণ থেকে আলাদা। কারণ তারা দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করেন। সংসদেও ওই বাহিনী প্রশ্নে নীরবতা দেখা যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওই বাহিনীর এক ধরনের দ্বিচারিতা দেখা যায়। যে কোনাে বেসামরিক বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কাজ করে। কিন্তু খোদ সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে সংবিধান অমান্য করে ক্ষমতা নিয়ে নেয়- মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক দুটি দলের মুখোমুখি অবস্থানে ওই পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

ওই বাহিনী জাতি সংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নানান সময় কাজ করেছে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও তাদের বিশেষ ভূমিকা লক্ষণীয়। এছাড়া তাদের নানান রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বেসামরিক সরকারের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংসদে সেনাবাহিনীর জবাবদিহি প্রশ্নে।

সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকেই মূলত প্রধান নীতিগুলো গৃহীত ও পরিচালিত হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও ওই বাহিনীর ওপর দায়িত্ব আছে। যাই হোক, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ওই মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা দৃশ্যত একেবারেই কম।

এই মুহূর্তে স্বশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সামরিক যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে ৬ সদস্যের কমিটির শলাপরামর্শ করতে হয়। তারা হলেন তিন বাহিনীর তিন প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব। ফলে ওই বাহিনীতে যে কোনাে পরিবর্তন-পরিবর্ধন আনতে সামরিক-বেসামরিক বোর সিদ্ধান্ত আমলে নিয়ে করাটাও দুরূহ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট এ দেশের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়, বরং ২০৩০ সালের লক্ষ্য অনুযায়ী বেশি করে আয়ের দিকেই নজর তাদের। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নানান চর্চায় গুরুত্ব না দিয়ে ওই বাজেট করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা প্রকিউরমেন্ট নীতি-নির্ধারণ, বাজেট ও প্রকিউরমেন্টের সাধারণ চর্চার খাপ খায় না। সামরিক বাজেট ও প্রকিউরমেন্ট এ দেশের প্রতিরক্ষা লক্ষ্য-নীতি গ্রহণ করবে, ফোর্সেস গোল ২০৩০ নয়। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ নানান ক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারণের শূন্যস্থান থেকেই হয়।

দুর্বল মনিটরিং, নিয়ন্ত্রণ ও হিসাবরক্ষণ নানান দুর্নীতি এবং অপচয় সৃষ্টি করছে। অনেক সময় সংসদ, জাতীয় হিসাবরক্ষক ও দুদক এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বাঁধার সম্মুখীনও হয়ে থাকে। অসততা, অকার্যকারিতা ওই অর্থে না থাকলেও নানান দামি সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার উদ্দেশ্যও স্পষ্ট থাকে না।

বাংলাদেশ সামরিক বাজেটের পরিমাণের বাইরে বিস্তারিত সামরিক ব্যয়ের খোঁজ থাকে না। অনেক সময় ওই পরিমাণটাও অস্পষ্ট থাকে, কখনো বদলে যায়। এমনকি ওই ব্যয়ের পরিমাণটি কী বাজেটের অন্তর্গত অথবা না- তাও জানা যায় না। এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের খবরও পত্রিকায় আসে না। আমদানিকারকের কোনাে হদিস থাকে না অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতােই।

‘সিপ্রি’র (SIPRI) তথ্য থেকে জানা গেছে, এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসার, বিশেষ করে অস্ত্রের প্রকিউরমেন্টে বেশ অপচয় ও দুর্নীতি হয়। ফলে বাজেটের বাইরেও সেনাবাহিনীর খরচ মূলত ব্যবসায়িক, জাতীয় নিরাপত্তাকেন্দ্রিক নয়।

পাকিস্তানের সামরিক ব্যবসায়ের নীতির মতো এ দেশে সেনা কল্যাণ সংস্থার অধীনে দুগ্ধ ফার্ম, আইস্ক্রিম ফ্যাক্টরি আছে। বিবিসির মতে, সামরিক বাহিনী খাবার, টেক্সটাইল, পাটকল, পোশাক কারখানা, ইলেকট্রনিকস, আবাসন ব্যবসা, জাহাজ নির্মাণ এবং ভ্রমণ ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। সামরিক বাহিনীর অধীন দুটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও আনসার ভিডিপি ব্যাংক আছে। এখান থেকে সামরিক অফিসারদের নানান অঙ্কের ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। বিবিসির অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ভবন নির্মাণ ও সেতু নির্মাণ থেকেও নানান আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে।

২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের আংশিক কারণ ছিল, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অফিসারদের দুর্নীতি বিষয়ে অসন্তোষ।’

বাংলাদেশের কয়েক ব্যবসায়ী এটি স্বীকার করেছেন, সামরিক বাহিনীর অধীন পরিচালিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা করা যায় না। এর চেয়েও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরশাদের সরকারের অধীন থাকা সামরিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বেসামরিক সরকারের সময় বেশি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।

যাহোক, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে বহুবিধ পরিবর্তন এসেছে। এতে তারা এসব ব্যবসায়ে নিজেদের জড়িয়ে রাখবেন, নাকি জাতীয় নিরাপত্তা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করবে- এসব নিয়ে কথা বলার এখন আর সময় নেই।

অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক রায়ান স্মিথ-এর লেখাটি ভারতীয় ম্যাগাজিন ‘ডিপ্লোম্যাট’-এর অনলাইনে গত ১০ মার্চ প্রকাশ করা হয়