মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা যখন ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের জন্য চূড়ান্ত এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে ঠিক ওই সময় যদি এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে নেপাল সামরিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী তাহলে বিষয়টি নতুন দিল্লির জন্য চরম হতাশার হয়ে ওঠে। চলতি সপ্তাহে তা-ই হলো। ভারতের জন্য ওই হতাশা রীতিমতো ক্রোধে পরিণত হয়েছে যখন মঙ্গলবার কাঠমান্ডু ছাড়ার আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর শাহিদ খাকন আব্বাসির সঙ্গে নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী এই মর্মেও সম্মত হন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ‘সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করা উচিত এবং এ জন্য তারা উভয়ে কাজ করবেন।
বলা বাহুল্য, সার্কের বর্তমান মৃত দশা ভারতের ইচ্ছাতেই এবং ভারত কোনােভাবেই আঞ্চলিক ওই ফোরামের পুনরুত্থান চায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ভারত ২০১৬ সালের নভেম্বরে সার্কের নির্ধারিত ১৯তম ইসলামাবাদ সম্মেলন থামিয়ে দিয়েছিল এবং ওই থেকে সার্কের সব কার্যক্রমে অঘোষিত অসম্মতি দিয়ে রেখেছে। বস্তুত নতুন দিল্লি চায় সব ‘ক্ষুদ্র প্রতিবেশী’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়া। ফলে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ কার্যত বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে কূটনীতিক দরকষাকষিতে গত এক দশকে নিজ নিজ দেশের স্বার্থে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। উপরন্তু সার্কহীনতার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশজুড়ে অর্থনীতিকেন্দ্রিক করপােরেট স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া সাধারণ জনগণ লাভবান হতে পারে এমন কোনাে আঞ্চলিক ইস্যুও মনােযোগ পাচ্ছে না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর গত ৪ ও ৫ মার্চ সর্বশেষ নেপাল সফর কেবল সার্ক সংশ্লিষ্ট কারণেই ঐতিহাসিক নয়। এমনকি তা এ কারণেও নয় যে, ২৪ বছর আগে বেনজির ভুট্টোর সফরের পর এই প্রথম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ স্তরের কোনাে নেতা শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অংশ হিসেবে নেপাল এলেন, বরং আব্বাসির ওই সফর এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ, অতীতে এরূপ যে ঐতিহ্য ছিল নেপালে নতুন নেতৃত্ব এলে তারা ভারতে সফরের মধ্য দিয়ে কূটনীতিক কার্যক্রম শুরু করতেন সেটি ভেঙে গেল। প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি নেপালের ৪১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে দেশটিতে সফরকারী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন অরেক কোনাে দেশ থেকে আসা সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রথম রাষ্ট্রনেতা। ভারতের অনেকেই নেপালের ওইরূপ দৃশ্য কল্পনা করতেও অভ্যস্ত ছিলেন না এতদিন। কিন্তু কে পি ওলি প্রকৃতই বিস্ময়কর ওই অবস্থার জন্ম দিয়ে নেপাল-ভারত সম্পর্ককে বড় একটা ঝাঁকুনি দিলেন।
ভারতের অনেকেই নেপালের ওইরূপ দৃশ্য কল্পনা করতেও অভ্যস্ত ছিলেন না এতদিন। কিন্তু কে পি ওলি প্রকৃতই বিস্ময়কর ওই অবস্থার জন্ম দিয়ে নেপাল-ভারত সম্পর্ককে বড় একটা ঝাঁকুনি দিলেন
যেহেতু নেপাল বর্তমানে সার্কের চেয়ারম্যান সেহেতু কে পি ওলি তার দেশের আঞ্চলিক গুরুত্ব বাড়াতে সার্ককে সক্রিয় করতে চাইবেন- এটা কিঞ্চিৎ প্রত্যাশিত হলেও ভারতের সঙ্গে ১৯৫০ সালের চুক্তির আলোকে হিমালয়কন্যা নেপাল প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভারতের মুখাপেক্ষী থাকতে বাধ্য। কিন্তু আব্বাসির সঙ্গে ওলির বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ও ছিল যা কাঠমান্ডু থেকে নতুন দিল্লিতে এক ভূমিকম্পতুল্য বার্তা।
কে পি ওলি ও আব্বাসির কূটনীতিক আলোচ্যসূচির আরেকটি বড় দিক ছিল চীনের উদ্যোগে পরিচালিত আন্তর্জাতিক ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচিতে উভয় দেশের উপস্থিতি ও সহযোগিতা আরাে অর্থবহ রূপদানের উপায় অন্বেষণ। ২০১৭ সালের মে মাসে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে ওই কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার জন্য সম্মত হলেও পাকিস্তানের মতো ব্যাপকভিত্তিক নয় এখনো তাদের অংশগ্রহণ।
যেহেতু ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে পাকিস্তান তাদের এলাকায় বিপুল অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাচ্ছে সেহেতু তারা আশা করছে, কে পি ওলি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে নেপালেও চীনের সঙ্গে মিলে একটি নতুন করিডোর গড়ে উঠবে এবং ওই দুই করিডোর দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির একটি বড় প্রভাবক হবে। ওই বিবেচনা থেকেই হয়তো কাঠমান্ডুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ’-এ নেপালের যুক্ত হওয়াকে ‘দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটা বড় ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু ভারত শুরু থেকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে অসম্মতি দিয়ে এসেছে এবং চাইছে তাদের প্রতিবেশীরাও তা-ই করুক। এমনকি এককালে কাশ্মীরের অংশ গিলগিস্ট এলাকা ছুঁয়ে যাওয়ার কারণে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরেরও বিরোধী ভারত। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কনওয়াল শিবাল নেপালের বেল্ট অ্যান্ড রোডে যোগদানকে তার দেশের জন্য একটা ‘বিপদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ‘দি ডিপ্লোম্যাট’-এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায়। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভুটান ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশ ইতোমধ্যে চীনের উদ্যোগে যুক্ত হয়ে পড়েছে। চীন ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত কে পি ওলির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে নেপালও আগামী দিনগুলোয় বেল্ট অ্যান্ড রোডে নিবিড়ভাবে যুক্ত হতে চলেছে বলে ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা যে আঁচ-অনুমান করছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাঠমান্ডু জয় এর পালে হাওয়া জোগালো মাত্র। সর্বশেষ জানুয়ারিতে নেপালের জন্য একটা ইন্টারনেট গেইটওয়ে উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে চীন এক্ষেত্রে নেপালের এতদিনকার ভারত নির্ভরতার অবসান ঘটিয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, অতীতে নেপাল ও পাকিস্তান মিলে চীনকে ‘সার্ক’-এ অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও ভারতের অনাগ্রহে তা সম্ভব হয়নি। তবে আগামীতে নেপাল ও পাকিস্তান যদি অনুরূপ উদ্যোগ নেয় এবং (নতুন) মালদ্বীপ যদি এতে সমর্থন জানায় তাহলে কেবল ভুটান-ভারত-বাংলাদেশের পক্ষে তা রোধ করা কঠিন হবে। আব্বাসির কাঠমান্ডু সফরের মধ্য দিয়ে ওইরূপ একটা আঁচ-অনুমানও সামনে চলে এসেছে।
এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাঠমান্ডু সফরকালে কৌতূহল উদ্দীপক আরেকটি যে দৃশ্য দেখা গেছে তা হলো, প্রধানমন্ত্রী ওলি ও ওলির রাজনৈতিক মিত্র মাওবাদী নেতা প্রচন্ড-এর সঙ্গে তিনি পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করলেও বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেসের কোনাে প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেননি। নেপালি কংগ্রেস সাধারণভাবে ভারত ঘনিষ্ট একটি দল হিসেবে পরিচিত। ভারতের প্রচারমাধ্যমে ওই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া থেকে প্রমাণ হয়, নেপাল ঘিরে আঞ্চলিক রাজনীতির যে নতুন শক্তিপরীক্ষা চলছে এতে কেবল চীন ও ভারতই শরিক নেই, পাকিস্তানও যোগ দিয়েছে।
ভারত কূটনীতিকভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার নীতি নিয়ে সক্রিয় হলেও খোদ নেপালে পাকিস্তানের সর্বশেষ ওই উপস্থিতি এতে নতুন এক উত্তেজক অধ্যায় সংযোজন করলো বটে। আর কে পি ওলিও দেখাতে পারলেন, নেপালে ভারতের অপছন্দের রাজনীতিবিদ হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় তিনি মিত্রহীন নন। বলা বাহুল্য, আব্বাসির নেপাল সফর চীনের জন্যও লাভজনক হয়েছে।