মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা-র লেখাটি বারগ্রুরেন ইনস্টিটিউট ও ওয়াশিংটন পোস্ট -এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত
১৯৭৮ সাল থেকে চীনের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা অন্য যে কোনাে দেশের একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বেশ আলাদা। কারণ ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতাবদলে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। সর্বোচ্চ ১০ বছর ক্ষমতাসীন থাকার নিয়মের অধীন তিনবার ক্ষমতা বদল হয়েছে সেখানে। এছাড়া পার্টির অধীন নতুন নেতা তৈরির কাজও হতো পুরোদমে যাতে মিসর, জিম্বাবুয়ে, লিবিয়া, এঙ্গোলা-র মতো দশকের পর দশক একজনের হাতে দেশ যেন জিম্মি না হয়।
প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদের বিধান উঠিয়ে দিয়ে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উপরোক্ত সব চর্চার দরজা বন্ধ করে দিলেন। মনে হচ্ছে, আগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরশাসনকে নিজের জন্য আরো পোক্ত করে জিনপিং আজীবন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করেছেন। সংবিধানে চেয়ারম্যান মাওয়ের পাশাপাশি ‘শি জিনপিংয়ের চিন্তা’ স্থাপনের মধ্য দিয়ে জিনপিং নিজেকে পূজনীয় পর্যায়ের নেয়ার সব আয়োজন ধীরে ধীরে করে রেখেছিলেন।
ব্যক্তিক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বজায় রাখা যে কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থা জিন্দা রাখার জন্য সবচেয়ে জরুরি- হোক সেটি গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক। কারণ কোটি কোটি মানুষের দেশ পরিচালনা একজনের পক্ষে মহাজ্ঞানী হলেও দৃশ্যত অসম্ভব। যথাযথ উত্তরাধিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একটি দুর্বলতা। ফলে হস্তান্তরের কোনাে নিয়ম সেখানে হাজির-নাজির না থাকায় হস্তান্তরের জন্য ওই ক্ষমতার ধ্বংস হওয়া অথবা সেই স্বৈরাচারের মৃত্যু হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
ওইসব ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে চীন এগিয়ে ছিল। ধরেন, রাশিয়ার পুতিনের কাল হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হলাে। তাহলে বৃহৎ ওই রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্যে শূন্যস্থান তৈরি হবে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল একে অন্যের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে, দেশের ভবিষ্যৎ হবে অনিশ্চিত। কিন্তু সামান্য কোনাে ধরনের হস্তান্তরের ব্যাপার যদি সেখানে থাকত নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে নতুন চিন্তা ও নতুন প্রজন্ম দেশটিকে উন্নত নীতির দিকে নিয়ে যেতে পারতাে এবং আগের নেতৃত্বের কাছে দায়বদ্ধ থাকতাে।
চীন যেসব নীতি তাদের ব্যবস্থায় এনেছিল তা ছিল তাদের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর বেদনাদায়ক স্মৃতি থেকে করা। চীনের নেতৃত্বের বদনাম শতাব্দী ধরেই চলছে বলা যায়। কিন্তু তারা দেখলেন, ওই কর্তৃত্বশালী সরকারের মুখোমুখি যদি স্বাধীন আদালত, পরিচালনার ক্ষমতা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং কিছু ক্ষেত্রে ভোটাভুটির ব্যবস্থা থাকে তাহলে ওই কর্তৃত্ববাদী সরকার ভালােই কাজ করতে পারে। এটি মূলত সিঙ্গাপুরের চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের পেছনের কারিগর লি কুয়ান ইউয়ের ভাবনা। অতীতের যেসব ব্যর্থ শাসক চীন পেয়েছে তারা নানান সময় তাদের অশেষ ক্ষমতার দাপটে দেশটিকে বিভিন্ন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ট্যাং রাজবংশের কথা।
চীনের সবচেয়ে ব্যর্থ শাসকের নাম মাও জে দং। দেশটিকে বৈদেশিক দখলদার থেকে মুক্ত করেই দুটি বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিলেন মাও। এর একটি হলাে, পঞ্চাশের দশকের দিকে নেয়া ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ এবং অন্যটি ষাটেরর দশকের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। দ্বিতীয় পদক্ষেপ চীনের এক প্রজন্মকে পিছিয়ে দিয়েছে এবং এলিটদের দিয়েছে ঘা। ওই অভিজ্ঞতা থেকেই সম্মিলিত নেতৃত্বের ভাবনায় আসে চীন। দেং জিয়াওপিং এবং আরো সিনিয়র নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, একক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা দেয়া যাবে না তিনি যতই চমকদার নেতা হোন।
চীন বিষয়ে নানান অস্বচ্ছতা আমাদের জানতে দিচ্ছে না, শি জিনপিং আসলে কেনই বা এসব করছেন, কী তার নিয়ত। তবে ধারণা করা যায়, শি কোনােভাবে জানতে পেরেছেন, স্থানীয় অনেক মন্ত্রী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন যা কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আরেকটি কারণ হতে পারে, শিয়ের মতো আর যারা জিয়াং জেমিন-এর হাত ধরে কমিউনিস্ট নেতাদের পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তাদের চোখ এখন ক্ষমতার দিকে।
আরেকটি কারণ হতে পারে সময়ের তালে তাল রাখা। পূর্ব ইউরোপের মতাে সেখানের মানুষ অনেক দিন স্বৈরাচারী সরকারের অধীন থেকে তাদের মনে দাগ কেটে গেছে। ফলে তারা আবার ওই অসীম ক্ষমতার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। পার্টির উচ্চপদস্থ এক নেতা বলেছেন, ‘কেউ চীনকে কখনােই বুঝতে পারবেন না যদি তিনি না বােঝেন ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ চীনের জন্য কতটা ক্ষতিকর ছিল।’ ওই সময়ের অনেক এলিটকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা আজ বয়োবৃদ্ধ। এছাড়া মাওয়ের ওই কাজের কোনাে মূল্যায়ন করতে চৈনিক তরুণদের শেখায়নি সরকার। তারা শুধু ‘ইস্ট ইজ রেড’-এর মতো রক্ত গরম করা স্লেগান শোনেন এবং ঐক্য ও শান্তির সেদিনগুলো কল্পনায় আঁকেন।
চীনের ওই ক্ষমতার মেয়াদ উঠিয়ে দেয়াটাই প্রমাণ করে সাংবিধানিক সরকার কতটা দরকারি। চীনের সংবিধান লিখেছেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। ফলে ওই সংবিধান তাদের আটকাতে পারেনি। উল্টোদিকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোয় শক্তিশালী সংবিধান আছে। এর সঙ্গে আছে স্বাধীন আদালত। ফলে তারা অসীম ক্ষমতা আদায় করতে চাইলেও নানান রাজনৈতিক খেলা দেখাতে হয় এবং অনেক সময় আদায় করতে ব্যর্থ হন।
উদাহরণস্বরূপ- কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলভারো উরিব ২০০৯ সালে তৃতীয়বারের মতাে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য দেনদরবার করলে আদালত তাকে কোণঠাসা করে দেন। আদালত বলেন, এভাবে ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধিকরণ অবৈধ। তিনি হয়তাে কলম্বিয়ার জন্য ভালাে কাজ করেছেন। কিন্তু তার চেয়ে ভালাে করেছে ওই দেশের শাসন ব্যবস্থা যা প্রেসিডেন্টকেও ছাড় দেয় না। এছাড়া ইকুয়েডর-এর কর্তৃত্ববাদী সরকার রাফায়েল কোরে-কেও নামতে বাধ্য করা হয়। সেখানে এখন লেনিন মোরেনো আসায় গণতন্ত্রের সুবাতাস পাচ্ছে ইকুয়েডর।
চীনের ওই সরকার কতটা কী করবে তা দেখা এখনো বাকি। যতদূর বো গেছে, চীনের যারা মুক্ত, স্বচ্ছ ও উদার সমাজ গঠন করতে চান তারা শিয়ের ওই উদ্যোগে আশাহত হয়েছেন। শি আসলে দেশের চেয়ে পার্টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর বিগ ডাটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নজরদারি করে আসছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন সামাজিক ক্রেডিট ব্যবস্থা। মনে হচ্ছে, একুশ শতকে কীভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কায়েম করতে হয় এর সব কায়দা আমাদের সামনে হাজির করবেন শি জিনপিং।