অন্ধকার জগতের অনবদ্য চিত্রায়ণ : নার্কোস

অন্ধকার জগতের অনবদ্য চিত্রায়ণ : নার্কোস

দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। অসহায় চোখে তাকিয়ে ডিইএ-র দুই এজেন্ট স্টিভ মার্ফি ও হাভিয়ের পেনা এবং সার্চ ব্লকের সদস্যরা। মাদক সম্রাট পাবলো এস্কোবার-এর বিপক্ষে পাওয়া সহস্র পাতার দালিলিক প্রমাণ রক্ষার্থে বেছে নেয়া হয়েছিল ‘প্যালেস অফ জাস্টিস’-এর ভবনটি। পাবলো এস্কোবার কাগজ নয়, পুরো ভবনই উড়িয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিল নিজের শক্তি।

নেটফ্লিক্স অরিজিনাল সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘নার্কোস’-এর একটি দৃশ্য এটি। ট্রেলার রিলিজ হওয়ার পর থেকেই এটি রয়েছে দর্শক আগ্রহের চূড়ান্তসীমায়।

সিরিয়ালের নাম : নার্কোস
ক্রিয়েটর : ক্রিস ব্যানক্রেটো
ডাগ মিরো

সিজন : ৩
এপিসোড : ৩০
রানিং টাইম : ৪৩-৬০ মিনিট
অরিজিনাল ডেট অঢ রিলিজ : ২৮ অগাস্ট ২০১৫
আইএমডিবি রেটিং : ৮.৯
এজ রেটিং : ১৮+

প্লট : নার্কোস মূলত আশির দশকে উত্থান হওয়া ড্রাগ কার্টেল তথা মাদক পাচারকারীদের সত্যিকার কাহিনী অবলম্বনে তৈরি ডকুমেন্টারি সিরিজ। ডকুমেন্টারি সিরিজ হলেও এর গল্প বলার ধরন, চরিত্রের চমৎকার উপস্থাপন, অসাধারণ লোকেশন, সেট ও ডিরেকশন অন্য ১০টি সিরিয়াল থেকে নার্কোস-কে করেছে আলাদা। নার্কোস-এর প্রথম সিজনের ১০টি পর্ব সাজানো হয়েছে মাদক সম্রাটখ্যাত পাবলো এস্কোবারের উত্থান ও তার তৈরি জেল ‘লা কাতেরদাল’ থেকে পলায়নের কাহিনী নিয়ে।

এজেন্ট স্টিভ মার্ফি ও হাভিয়ের পেনা

কলম্বিয়ায় ড্রাগ কিং পাবলো এস্কোবার-কে ধরার বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাওয়া ডিইএ এজেন্ট। এজেন্ট মার্ফি গল্প বলার ছলে বয়ান করে গেছেন সাধারণ এক স্মাগলার থেকে পাবলোর পাবলো হয়ে ওঠার কাহিনী। মূলত অবৈধ উপায়ে ট্রাকে করে নিষিদ্ধ দ্রব্য পাচার করাই ছিল তার ব্যবসা ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না মাতেও মরেনো ওরফে ‘ককরোচ’-এর সঙ্গে তার দেখা হয়। ওই চিলিয়ান অান্ডারগ্রাউন্ড কেমিস্টই প্রথম পাবলোকে বুদ্ধি দেয় কোকেন-এর রাজ্যে পা রাখতে। মাতেও-র বুদ্ধি আর পাবলোর ইনভেস্টমেন্টে গড়ে ওঠে একাধিক ল্যাব। পাবলো-র মেডেইন কার্টেলের অন্যতম সদস্য কার্লোসের সহায়তায় কলম্বিয়ায় তৈরি করা কোকেন অবাধে পাচার হওয়া শুরু করে আমেরিকায়। পাচারের মাত্রা ও কোকেন নিয়ে সৃষ্ট ভায়োলেন্স আমেরিকা সরকারকে বাধ্য করে এদিকে নজর ফেরাতে। এ জন্যই বিশেষ মিশন দিয়ে পাঠানো হয় এজেন্ট স্টিভ মার্ফিকে। আর গল্পের শুরুটা এখানেই।

পাবলোকে মাদক জগতের অলিগলি চেনায় এই মাতেও মরেনো ওরফে ‘ককরোচ’

মার্ফি কলম্বিয়া পৌঁছানোর আগে থেকেই ডিইএ মুখোমুখি ছিল আরেক সমস্যার- এম১৯ স্বাধীনতাকামী বামপন্থী একটি বিদ্রোহী গ্রুপ। তারা অপহরণ করে বসে মেডেইন কার্টেলের অন্যতম সদস্য ওচোয়া ব্রাদার্সের বোন মার্তা-কে। আর এর সুযোগ নিয়ে পাবলো বনে যায় মেডেইন কার্টেলের স্বঘোষিত রাজা। সে গঠন করে প্যারা গ্রুপ ‘ডেথ টু কিডনাপারস’। মার্তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে পাবলো দাবি করেন নিঃশর্ত আনুগত্য। আর মার্তাকে উদ্ধারের সময় দর্শক প্রথম স্বাদ পায় পাবলোর নৃশংসতার। পাবলো দিনের পর দিন হয়ে উঠতে থাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। খোয়াবিদা ওই আদমির তামান্না ছিল কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার। সাংবাদিক ভেলেরিয়া ভেলেজ ও মধ্যস্থতাকারী ফার্নান্দো ডুশের সহায়তায় মনোনয়নও বাগিয়ে নেয় সে। নিবার্চিত য়ে কংগ্রেসম্যান হিসেবে। তৎকালীন কলম্বিয়ান মিনিস্টার অফ জাস্টিস রড্রিগোর লারা-র প্রবল বিরোধিতায় কংগ্রেস থেকে ইস্তেফা দিতে বাধ্য হয় পাবলো। লারা ওই বিরোধিতার মূল্য তাকে চােকাতে হয়েছে জীবন দিয়েই। এর আগেই কংগ্রেসে একটি বিল পাস হয় যেটি পাবলোসহ সব ড্রাগ কার্টেলের জন্য হয়ে ওঠে অসহনীয়। এক্সট্রাডিশন প্ল্যান যার ফলে কলম্বিয়ান ড্রাগ ট্রাফিকারদের আমেরিকা নিজেদের দেশে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে। এটি ছিল ডিইএর জন্য একটি ল্যান্ডমার্ক জয়। কারণ কলম্বিয়ায় যে অপরাধীকেই ধরা হোক, অপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত কলম্বিয়ার আদালত হয় তাদের টাকার বিনিময় অথবা প্রাণের ভয়ে জামিন দিয়ে দিতে বাধ্য হতেন। লারার মৃত্যুটি আসে ডিইএর জন্য বিশাল এক ধাক্কা আর পাবলোর জন্য বিজয় হয়ে।

মিনিস্টার লারা, সাংবাদিক ভ্যালেরিয়া ও আইনজীবী ডুশে

লারার মৃত্যুতে মরিয়া ডিইএ শেষ পর্যন্ত একটি সফল অভিযানে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় মেডেইন কার্টেলের নিউক্লিয়াস ‘ব্ল্যাক বিয়ার্ড’কে। কাগজ-কলমে মেডেইন কার্টেলের সামান্য হিসারক্ষক থাকলেও ব্ল্যাক বিয়ার্ডের গুরুত্ব ছিল অসীম। আর ব্ল্যাক বিয়ার্ডের সঙ্গে সঙ্গে ডিইএর হাতে জমা পড়ে পাবলোর মাদক পাচারের বে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ। নিরাপত্তার স্বার্থে ‘প্যালেস অফ জাস্টিস’কে বেছে নেয়া হয় ওই দলিল সংরক্ষণের স্থান হিসেবে। কিন্তু এটা পাবলো এস্কোবার, অন্য কেউ হলে হয়তো ঘাবড়ে যেত বা ভিন্ন পন্থায় দলিলগুলো নষ্ট করার চেষ্টা করতো। পাবলো এম১৯-এর সহায়তায় পুরো জাস্টিস ভবনটিই উড়িয়ে দিয়ে দেখিয়ে দেয় আর দশ মাদকসম্রাটের মতো নয় পাবলো এস্কোবার।

অপমানের প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে পাবলো। এর সঙ্গে শুরু করে এক্সট্রাডিশন বিল বাতিলের জন্য চাপ প্রয়োগ। লারার পর এ বিলকে সমর্থন জানানোয় প্রাণ হারায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী লুইস কার্লোস গালান। তাকে হত্যার পরও থেমে থাকেনি পাবলো। গালান-এর জায়গা নেয়া সিজার গাভেরিয়া যে পরে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পুরো প্লেনই উড়িয়ে দেয় পাবলো। ডিইএ সময়মতো গাভেরিয়া-কে সরিয়ে নিতে পারলেও রক্ষা করতে পারেনি নিরপরাধ ১০৭ নাগরিকের প্রাণ। আর এ হত্যাকাণ্ড মরিয়া করে তোলে ডিইএকে। তাদের হাতে নির্মমভাবে নিজ পুত্রপ্রাণ হারায় মেডেইন কার্টেলের অন্যতম সদস্য হোসে গঞ্জালো রড্রিগ্রেজ গাচা।

প্রেসিডেন্ট সিজার গাভেরিয়া

পুরো কলম্বিয়াকে নরকে পরিণত করে তোলার ফলে যখন প্রায় সব ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ পাবলোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তখন সে হয়ে উঠলো আরো আক্রমণাত্মক। অপহরণ করে বসলো সাবেক প্রেসিডেন্ট হুলিও সিজার তুবেই-এর কন্যা ও জনপ্রিয় সাংবাদিক ডায়ানা তুবেই-কে। এক্সট্রাডিশন বিল বাতিল-এর জন্য তাকে ব্যবহার করা শুরু করলো বার্গেনিং চিপ হিসেবে। প্রেসিডেন্ট গাভেরিয়া একই সঙ্গে আলোচনা ও পাবলো-কে ধরার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এর শেষ হয় সরকারী বাহিনীর ভুলে ডায়ানার মৃত্যু দিয়ে। শেষ পর্যন্ত গাভেরিয়া পাবলোর দাবি মানতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে ছিল পাবলোর নিজের জেল নিজেই তৈরি করা যা রক্ষিত থাকবে পাবলোর নিজস্ব লোকদের দ্বারা। একই সঙ্গে বাতিল হয়ে যায় এক্সট্রাডিশন বিল। শুরু হয় লা কাতের্দালে পাবলোর জেল নামক প্রহসন-এর নাটক। সিজনটি শেষ হয় লা কাতের্দাল থেকে পাবলোর পলায়নের মধ্য দিয়ে।

পাবলোর ওই উত্থান পর্বে একে একে আপনি পরিচিত হয়ে উঠবেন গুস্তাভো, লা কিকা, পয়জন, ব্লাকি, নেভেগান্তে, দি লায়ন, জুডি মনকাডা, গাচা, কার্লোস, হোর্হো ও ফ্যাবিও তথা ওচোয়া ব্রাদার্সসহ মেডেইন কার্টেল-এর মুখ্য সব মুখের সঙ্গে। এছাড়া পরিচয় হবেন পাবলোকে ধরার জন্য যে দুই আমেরিকান এজেন্ট নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিল। ওই স্টিভ মার্ফি ও হাভিয়ের পেনিয়াসহ তাদের সহয়তা করা অকুতোভয় কলম্বিয়ান কর্নেল কারিওর সঙ্গে। টাটা ও হার্মেইদা, পাবলোর স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে তাদেরও দেখবেন সিজনজুড়েই।

কুখ্যাত মেডেইন কার্টেল

পাবলো এস্কোবার যাকে নিয়ে এর আগে অসংখ্য বই, ডকুমেন্টারি, মুভি, এমনকি মিনিসিরিজও হয়েছে। তাকে আবরও সেলুলয়েড বন্দি করা এবং অসামান্য জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণটাও অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। এখানে মুনশিয়াটা দেখিয়েছেন ক্রিস ব্রানকাটো, কার্লো বার্নার্ড, ডাগ মিরো, ডানা কালভো, ডানা মিলার, অ্যান্ডি ব্ল্যাক, জ্যাক ক্যাইগ, অ্যালিসন অ্যাবনার ও নিক শেংক। পাবলোর জীবনটা নিঃসন্দেহে নিকষতায় ঢাকা। কিন্তু কারোর জীবন শুধু মাত্রই নিকষ নয়, তার জীবনের অন্য একটি দিকও রয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় খুনের নির্দেশ দেয়া পাবলো যখন পরম মমতাময়ী স্বামী বা পিতার রূপে হাজির হন তখন কিছুটা দ্বিধার জন্ম নেয়- ওই মানুষই আবার এত ভয়ঙ্কর! এর সঙ্গে পাবলোর রসবোধ, নিজের সদস্যদের প্রতি তার খেয়াল রাখার অভ্যাস- সব মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি মানুষের জীবনটাই তুলে ধরা হয়েছে নার্কোসে, শুধুই পাবলোর অন্ধকার দিক নয়। আর এটিই সিরিয়ালটির প্রাণ। ফলে একটি পর্ব শেষ হওয়া মাত্রই আপনি তাগিদ অনুভব করবেন পরের পর্বটি দেখার জন্য। তবে এটি দেখতে ইংলিশ সাবটাইটেল প্রয়োজন। কারণ পুরো মেডেইন কার্টেলই স্প্যানিশভাষী। সবকিছুর পরও বলতে হবে নার্কোস আপনি দেখতে বাধ্য হবেন ওয়েগনার মউরার জন্য। এমন অনবদ্য অভিনয় খুব কমই দেখা যায়।

পাবলো ও তার স্ত্রী টাটা এস্কোবার

সিজনের ১০টি পর্ব পরিচালানা করেছেন মোট চার পরিচালক। প্রথম দুটি পর্ব পরিচালনা করেছেন হোসে পারিহা; ৩ ও ৪ পর্ব নাভারো এবং ৫, ৬, ৯ ও ১০ পর্বগুলো আন্দি বাইজ এবং ফার্নান্দো কোম্বরা পরিচালনা করেছেন সপ্তম ও  অষ্টম পর্ব।

২০১৬ সালের রাইটার্স গিল্ড অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ডস, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডস, বাফটা টিভি অ্যাওয়ার্ডস, স্যাটেলাইট অ্যাওয়ার্ডস ও প্রাইম টাইম ক্রিয়েটিভ আর্টস এমি অ্যাওয়ার্ডস-এ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মনোয়ন পায় নার্কোস। পুরস্কার নসিবে না জুটলেও পাবলো চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সবার প্রশংসা কুড়ান ওয়েগনার মউরা।