পশ্চিমা সেকুলার রাষ্ট্রগুলোর মতে, ধর্মীয় প্রতীক জনপরিসরে নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন কোন বস্ত্র, অলঙ্কাার কিংবা বস্তুকে তারা ধর্মীয় প্রতীক মনে করে। ইউরোপিয়ান কয়েকটি দেশে সম্প্রতি হিজাব নিয়ে ওঠা বিতর্ক ওই প্রশ্নটিকে আরো উসকে দেয়। সেকুলার বুদ্ধিজীবীদের দাবি, যেহেতু হিজাব একটি ধর্মীয় প্রতীক সেহেতু মুসলিম নারীদের এটা ‘পাবলিক প্লেস’ বা জনপরিসরে পরা উচিত নয়। রাষ্ট্রীয় অফিস-আদালতেও হিজাব নিষিদ্ধের দাবি করেন তারা। কিন্তু হিজাব যে একটি ধর্মীয় প্রতীক বা চিহ্ন এর যৌক্তিক ভিত্তি কী?
যখন কোনাে নির্দিষ্ট ব্যক্তি অথবা জনসাধারণের একটি অংশ প্রতীক বা চিহ্নের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত থাকে তখনই শুধু কোনো বস্তুর প্রতীক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে ওই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে। হিজাবের ‘সিম্বলিক ফাংশন’ শুধু তাদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ যারা এটাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করে। ওই ‘সিম্বলিক ফাংশন’ সবার কাছে এক নয়। হিজাবের ফ্যাশনকে যারা বাণিজ্যিকীকরণ করছে তাদের কাছে এটার কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নেই। তাই বলা যায়, ইসলামের অনুসারী যারা হিজাব ধর্মীয় কারণে পরেন তাদের কাছেই শুধু হিজাব একটি ধর্মীয় প্রতীক।
অন্য ধর্মের অনুসারী কিংবা ‘হিজাব বিষয়ে কোরআনের ব্যাখ্যা’ যারা গ্রহণ করেন না তাদের কাছে হিজাবের কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নেই।
তাদের কাছে হিজাব শুধু এক টুকরো কাপড়। ২০০৪ সালে জেন ফ্রেডম্যান ‘সেকুলারিজম অ্যাজ অ্যা ব্যারিয়ার টু ইন্টিগ্রেশন’ বইয়ে লেখেন, ‘কারো কাছে হিজাব মানে নারী অধিকার খর্ব, কারো কাছে হিজাব মানে ইউরোপিয়ান জনপরিসর দখলে নিতে মুসলিমদের একটি প্রচেষ্টা আবার কেউ কেউ এটাকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি ঐতিহ্য হিসেবেই দেখেন।’ পর্যালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে কারো কাছে যেটি সিম্বল বা প্রতীক সেটি অন্য কারো কাছে না-ও হতে পারে। এটা অনেকটা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র ওপর নির্ভর করে। এমন অনেকেই আছেন যারা হিজাবকে শুধু একটি কাপড়ের টুকরো হিসেবেই দেখেন- এর বেশি কিংবা কম নয়। এখন প্রশ্ন হলাে, যদি ‘সিম্বলিজম’ নিজেই নির্ভর করে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ সেকুলার রাষ্ট্র কীভাবে ধরেই নেয়, ‘হিজাব একটি ধর্মীয় প্রতীক এবং এ জন্য এটাকে জনপরিসরে নিষিদ্ধ করতে হবে।’
সেকুলারিজমের সমর্থকরা যুক্তি দেখাতে পারেন, যেহেতু মুসলিম নারীদের কাছে হিজাবের একটি ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে সেহেতু তাদের কাছে হিজাব অবশ্যই একটি ধর্মীয় প্রতীক। এ কারণেই রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের এটাকে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবেই গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু ওই যুক্তি ধোপে টেকে না। শুধু হিজাব পরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে স্পষ্ট করতে পারে না। কেটলিন কিলিয়ান তার ‘দি আদার সাইড অফ দি ভেইল : নর্থ আফ্রিকান ওম্যান ইন ফ্রান্স রেসপন্ড টু দি হেড স্কার্ফ অ্যাফেয়ার’ প্রবন্ধে যুক্তি দেখান, ‘মুসলিমরা ইউরোপে সংখ্যালঘু। তাদের সাম্য ও মুক্তি-সংগ্রামের প্রতীকী আন্দোলন হিসেবেও কেউ হিজাব পরতে পারেন। কেউ হয়তো বা নিজস্ব সুবিধার জন্য আবার কেউ হয়তো স্বামী বা পিতা-মাতার ইচ্ছার কারণে হিজাব পরতে পারেন’। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, সেকুলার রাষ্ট্র কীভাবে নির্ণয় করবে কোন বস্তুটিকে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ধরা হবে এবং কোনটাকে ধরা হবে না?’
দাড়ির ব্যাপারেও একই যুক্তি দেখানো যায়। দাড়ি কখন ধর্মীয় প্রতীক হয়ে ওঠে? যখন মুসলিমরা দাড়ি রাখে? শুধু মুসলিমদের দাড়ি রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়াটা বৈষম্যমূলক আচরণ। আমরা প্রস্তাব দিতে পারি দাড়ি কিংবা হিজাব তখনই নিষিদ্ধ করা যায় যখন কেউ এগুলোকে ধর্মীয় তাৎপর্য হিসেবে পালন করে। কিন্তু কারো দাড়ি রাখা কিংবা হিজাব পরার উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাষ্ট্র কীভাবে পাবে? কেউ স্টাইল করতে দাড়ি রাখলেন, নাকি ধর্মীয় কারণে রাখলেন সেটি রাষ্ট্র কীভাবে নিশ্চিত হবে? একই প্রশ্ন আমরা হিজাবের বিষয়েও তুলতে পারি। এখানে রাষ্ট্র হয়তো সবার ক্ষেত্রেই দাড়ি কিংবা হিজাব নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। আরেকটি সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র নিতে পারে। তা হলো একটি নির্দিষ্ট আকার-আকৃতির দাড়িকে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ধরে নিতে পারে। কিন্তু তখন দেখা যাবে হঠাৎ একদিন কারো দাড়ি ওই নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি ধারণ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গেতো ধর্মীয় প্রতীক হয়ে উঠলো। তাই নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনাে বস্তুকে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ঘোষণা দেয়া রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। এ কারণেই হিজাব কিংবা দাড়ির বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা একটি হাস্যকর অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করে।
মূল লেখাটি অধ্যাপক জ্যাকব ডি রোভার-এর ‘ইউরোপ, ইন্ডিয়া, অ্যান্ড দি লিমিটস অফ সেকুলারিজম’ বই থেকে নেয়া