পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে বিকৃতি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর জ্ঞানবিদ্যা অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। আধুনিকতা ও সেকুলারিটির নামে ধর্মীয় ব্যাপারে, বিশেষ করে ইসলাম বিষয়ে পশ্চিমি পণ্ডিতদের এমন আচরণ ঐতিহাসিকভাবেই হয়ে আসছে। আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে ফার্সি কবি জালালউদ্দিন রুমির কবিতার যেসব অনুবাদ সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়ে আসছে এতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ নিয়ে ‘দি নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনে রোজিনা আলীর গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি ‘জবান’-এর জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হলো।
বছর কয়েক আগে কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের ভোকালিস্ট ক্রিস মার্টিন যখন অভিনেত্রী গোয়েনেথ পালট্রো-র সঙ্গে ডিভোর্সের কারণে খারাপ সময় পার করছিলেন ওইসময় তার এক বন্ধু তাকে চাঙ্গা করতে একটি বই দিয়েছিল। সেটি ছিল ১৩০০ শতাব্দীর পারস্য কবি জালালউদ্দিন রুমির কোলম্যান বার্কস অনূদিত কবিতা সংকলন। মার্টিন পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটা আসলে আমার জীবনকেই বদলে দিয়েছে।’ কোল্ডপ্লে-র সাম্প্রতিক অ্যালবামে বার্কস অনূদিত একটি কবিতা ব্যবহার করা হয়, This being human is a guest house/Every morning a new arrival/A joy, a depression, a meanness,/some momentary awareness comes/as an unexpected visitor.”
ম্যাডোনা, টিল্ডা সুইনটনসহ অনেকের আধ্যাত্মিক বোঝাপড়ায় খোরাক জুগিয়েছেন রুমি। তাদের অনেকে নিজেদের কাজের মধ্যে রুমিকে ব্যবহারও করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় রুমির গভীর লাইনগুলো মানুষকে প্রতিদিন অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। If you are irritated by every rub, how will you ever get polished- সেগুলোর একটি। এছাড়া Every moment I shape my destiny with a chisel. I am a carpenter of my own soul. ইন্টারনেট দুনিয়ায় বার্কস-এর অনুবাদই বেশি ছড়িয়েছে। ওই লাইনগুলোই অবশ্য আমেরিকার বইয়ের দোকানগুলোর তাকে ও বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়ে থাকে। রুমিকে অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সর্বাধিক বিক্রীত কবি হিসেবে বলা হয়ে থাকে। তাকে সাধারণত রহস্যপুরুষ, সুফি, দরবেশ ও আলোকিত মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সত্যিকার অর্থে যদিও তিনি পবিত্র কােরআন ও ইসলামের পণ্ডিত ছিলেন তবুও তাকে মুসলিম হিসেবে খুব কমই উল্লেখ করা হয়।
মার্টিন যেগুলো অ্যালবামে ব্যবহার করেছেন তা মূলত রুমির শেষ জীবনে লেখা মহাকাব্যের ৬ খণ্ডের কিতাব ‘মসনবি’ থেকে নেয়া। ৫০ হাজার লাইনের মধ্যে মূলত ফার্সিতে লেখা হলেও মুসলিম ধর্মীয় কিতাব থেকে নেয়া প্রচুর আরবি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সরাসরি কােরআন থেকে নেয়া নৈতিক শিক্ষা সমৃদ্ধ বহু গল্প-উপাখ্যানেও ব্যবহার রয়েছে (বহু পণ্ডিত ওই অসমাপ্ত কাজটিকে ‘পারস্য কোরআন’ নামেও বলে থাকেন)। ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্সিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক ফাতেমেহ কেসাভার্জ আমাকে বলছিলেন, রুমি সম্ভবত কােরআন মুখস্থ করেছিলেন। এ কারণে যখন খুশি কবিতায় কােরআনের আয়াত ব্যবহার করতে পারতেন। রুমি নিজে ‘মসনবি’ গ্রন্থটিকে ‘ধর্মের শিকড়ের শিকড় এবং এরও শিকড়’ অর্থাৎ ইসলাম ও ‘কােরআনের তাফিসির’ হিসেবে উল্লেখ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে যে অনূদিত কবিতা বিক্রি হয় এতে ধর্মীয় ব্যাপারগুলো হারিয়েই গেছে। রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন সুফিবাদের এক পণ্ডিত জাভিদ মুজাদ্দেদি সম্প্রতি আমাকে বলেন, ‘ইংরেজিতে যে রুমিকে মানুষ ভালােবাসে তা খুবই সুন্দর একটি ব্যাপার এবং যে মূল্য দিয়ে কেনা হচ্ছে সেটি একটি সংস্কৃতি ও ধর্ম বাদ দেয়ার কাজে খরচ করা হচ্ছে।’
ওমিদ সাফি কােরআন না পাঠ করেই রুমি পাঠকে বাইবেল না পড়েই মিল্টন পড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। অবশ্য রুমি প্রচলিত ধর্মমতের নানান বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। এটি একটি মুসলিম কনটেক্সটে তিনি প্রশ্ন তুলতেন। ওই সময়কার ইসলামি সংস্কৃতি অনুযায়ী এ ধরনের মতবিরোধিতার যথেষ্ট কারণ ও সুযোগ ছিল। রুমির কাজ যে শুধু ধর্মের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে নির্মিত হয়েছিল সেটিই নয়, এটি ইসলামি পাণ্ডিত্যের ঐতিহাসিক উৎকর্ষেরও প্রতিনিধিত্ব করে
রুমি ১৩ শতাব্দীর শুরুর দিকে বর্তমান আফগানিস্তানের একটি জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি সপরিবারে বর্তমান তুর্কির কোনিয়া-য় গিয়ে থিতু হন। তার পিতা আলেম ছিলেন এবং ইসলাম প্রচারে মনযোগী ছিলেন। তিনিই প্রথম রুমিকে সুফিবাদের দীক্ষা দেন। ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনে তিনি সিরিয়ায় যান। সেখানে সুন্নি ইসলামের আইন-কানুন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে কোনিয়া ফেরত আসেন। সেখানে এক প্রবীণ পরিব্রাজক শামস-ই-তাবরিজ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। তাকে তিনি গুরু মানেন। ওই দু’জনের মধ্যকার গভীর বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এ ব্যাপারে সবাই একমত, রুমির কবিতা ও ধর্মীয় চর্চায় শামস সুদীর্ঘ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। নতুন জীবনীগ্রন্থ ”রুমি’স সিক্রেট”-এ ব্র্যাড গুচ দেখিয়েছেন, কীভাবে রুমির কেতাবি এলেমটিকে প্রশ্ন করতে শামস উদ্যত করেছেন এবং বিতর্ক করেছেন কােরআনের আয়াতগুলোর ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর একাত্মবাদের চর্চায় একাগ্র সাধনার গুরুত্ব নিয়ে। খোদার প্রতি রুমি নিগূঢ় প্রেমের নজির রেখেছেন। তা তিনি পেয়েছেন সুন্নি ইসলামের শরিয়া এলমের সুফিবাদী ধারা ও শামসের গভীর চিন্তা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষায়।
কেসাভার্জ জানান, ওই অস্বাভাবিক (শামস-ই-তাবরিজ) প্রভাবের পর্দায় রুমি তৎকালীন অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যান। তবুও কোনিয়ায় রুমির বিশাল অনুরাগী গোষ্ঠী তৈরি হয়। তাদের মধ্যে সুফি, আলেম-ওলামা, ইহুদি, খ্রিস্টান, এমনকি সুন্নি সেলজুক শাসকরাও রয়েছেন। রুমি’স সিক্রেট-এ গুচ ওই সময়কার রাজনৈতিক ঘটনাচক্র ও ধর্মীয় শিক্ষা রুমির জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা ভালােভাবে এনেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রুমি একটি ধর্মপরায়ণ পরিবারে জন্ম নেন এবং সারা জীবন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রোজার বিধান পালন করেছেন।’ এমনকি গুচের বইয়েও এসব তথ্যের পাশাপাশি চূড়ান্ত মন্তব্যে রুমির কাজ ”সকল প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের জায়গা থেকে বাইরে দাঁড়ানো এক ‘প্রেমের ধর্ম’ হিসেবে’ বলা হয়। ওই ধরনের পাঠে রুমির মুসলিম শিক্ষা তথা তার মূল আইডিয়া থেকেই কিছু বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মোজাদ্দেদি যেমনটি বলছেন, ইউনিভার্সালিজমের সূত্রপাত হিসেবে কােরআন ইহুদি ও ক্রিশ্চিয়ানদের ‘আহলে কিতাব’ হিসেবে স্বীকার করেছে। আজকের দিনে রুমির মধ্যে যে ইউনিভার্সালিটিকে পূজা দেয়া হচ্ছে সেটি তিনি মুসলিম প্রেক্ষাপট থেকেই নিয়েছেন।
কোল্ডপ্লের সংশ্লিষ্টতার বহু আগেই রুমির কবিতা থেকে ইসলামকে বাদ দেয়া শুরু হয়েছে। ডিউক ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অধ্যাপক ওমিদ সাফি বলছেন, ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ড থেকেই পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক কবিতাকে এর ইসলামি শিকড় থেকে আলাদা করে পড়া শুরু করেছে। তখনকার অনুবাদক ও ধর্মীয় পণ্ডিরিা একটি ‘মরুর ধর্ম’ এবং তার আইনি ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে রুমি এবং হাফিজের মতো কবিদের কাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক উদ্ধারে সক্ষম হননি। আমাকে সাফি জানিয়েছেন, তারা যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা হলো, ‘ওইসব কবি ইসলামের সংস্পর্শে থাকলেও ইসলামের কারণে আধ্যাত্মিক হননি’। এটি এমন একটা সময় ছিল যখন মুসলিমদের আইনি উপায়ে বৈষম্যের জালে আটকানো হতো। ১৭৮০ সাল থেকে চলে আসা একটি আইনের মাধ্যমে কত মুসলিম যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন এর সংখ্যা সংকুচিত করে নির্ধারণ করা ছিল। এর ১০০ বছর পর এসেও যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ‘অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে, বিশেষ করে ক্রিশ্চিয়ানদের সঙ্গে মুসলমানদের ঘোর শত্রুতা’র কথা উল্লেখ করেন। ১৮৯৮ সালে মসনবির অনুবাদে স্যার জেমস রেডহাউস লেখেন, ‘যারা দুনিয়ার সবকিছু ত্যাগ করে খোদার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চান এবং আধ্যাত্মিক চর্চায় নিজেদের বিলিয়ে দিতে চান মসনবি তাদের কথা বলে।’ এসব কারণে পাশ্চাত্যে রুমি ও ইসলামকে আলাদা করা হয়েছে।
কয়েক বোদ্ধা অনুবাদকদের মাধ্যমে ইংরেজিভাষীদের রাজ্যে রুমির হাজিরা পাকাপোক্ত হয়। তাদের মধ্যে আর এ নিকলসন, এ জে আরবারি ও আনমারি শিমেল অন্যতম। আর বার্কসের মাধ্যমে রুমির পাঠকপ্রিয়তা ব্যাপকমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অনুবাদক হিসেবে নন, এখানে ভাষ্যকারের ভূমিকা নেন। তখন তিনি ফার্সি পড়তে বা লিখতে জানতেন না। ২০ শতকে এসে ১৯ শতকের অনুবাদগুলো আমেরিকান ভাষ্য আকারে হাজির করেন তিনি। এর ভাষ্য একটি বিশেষ ধরনের।
বার্কস ১৯৩৭ সালে টেনেসির চ্যাট্টানুগায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বেড়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালে ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি নেন এবং একই বছর তার প্রথম কবিতার বই ‘দি জুস’ প্রকাশ হয়। ওই দশকের শেষ দিকে রুমি সম্পর্কে তিনি প্রথম জানতে পারেন। তার বন্ধু রবার্ট ব্লাই আরবারি-র করা অনুবাদের কপি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এটাকে আমাদের ঝুলি থেকে বের করতে হবে। এর মানে, আমেরিকান ভাষ্যে রূপ দিতে হবে (ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে ব্লাই-এর কবিতা ছাপা হয়। পুরুষদের অধিকার আন্দোলন নিয়ে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বিশদ বই ‘আয়রন জন : অ্যা বুক অ্যাবাউটম্যান’-এর ওই লেখকও রুমির কিছু পঙ্ক্তি অনুবাদ করেন)। বার্কস কখনো ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেননি। পরে আমাকে তাঁর জর্জিয়ার বাসা থেকে ফোনে নিজের একটি স্বপ্নের কথা জানান। স্বপ্নে তিনি একটি নদীর নিকটবর্তী একটি বাঁধের ওপর শুয়ে আছেন। অচেনা একজন চতুর্দিকে আলোয় ঘেরা অবস্থায় এসে তাকে বলছেন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। ওই ব্যক্তিকে আগে কখনো দেখেননি বার্কস। সম্প্রতি ফিলাডেলফিয়া-র কোনাে এক তরিকা সম্মেলনে তার দেখা পান তিনি। ওই ব্যক্তিই ওই সম্মেলনের নেতা। পরে সেখানে বার্কস পড়াশোনা করে দিন কাটাতে শুরু করেন এবং ভিক্টোরিয়ান আমলে ব্লাইয়ের দেয়া অনুবাদগুলো আবার পড়ে নেন। এরপর থেকে রুমিকে নিয়ে তিনি এক ডজনেরও বেশি বই লেখেন।
আমাদের আলাপে বার্কস রুমির কবিতাকে ‘হৃদয় খুলে দেয়া রহস্য’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি এমন একটি জিনিস যা আপনি ভাষায় ধরে বর্ণনা করতে পারবেন না। ওইসব বিষয়গুলো ধরার প্রয়াসস্বরূপ রুমির কাজে কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েছেন তিনি। এ জন্য ইসলামের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো বাদ দিয়েছেন। বিখ্যাত কবিতা Like This নিয়ে আলাপ করা যায়। আরবারি কিছুটা সততার সঙ্গে কবিতাটির কিছু লাইন অনুবাদ করেন, Whoever asks you about the Houris, show (your) face (and say) ‘Like this’. ইসলামে বেহেশতি হুরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা সতী। বার্কস এখানে সরাসরি শব্দটাকে এড়িয়ে অনুবাদ করেন, তার অনুবাদে লাইনটি হচ্ছে, If anyone asks you how the perfect satisfaction of all our sexual wanting will look, lift your face and say, Like this. এখানে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটই হাওয়া হয়ে গেল। এমনকি একই কবিতায় অন্য জায়গায় জেসাস ও জোসেফ নাম ব্যবহার করেন বার্কস। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘ইসলামি শব্দ ও ভাব যদি বাদ দিয়েও থাকি তাহলে সেটি এখন মুছে ফেলতে পারবাে না।’ তিনি বললেন, ‘আমি প্রেসবিটারিয়ান হিসেবে বেড়ে উঠেছি। বাইবেলের লাইনগুলো থেকে মুখস্থ করতাম এবং কােরআনের চেয়ে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট ভালাে জানতাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘কােরআন পড়তে দুরূহ লাগে।’
যারা দুনিয়ার সবকিছু ত্যাগ করে খোদার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চান ও আধ্যাত্মিক চর্চায় নিজেদের বিলিয়ে দিতে চান ‘মসনবি’ তাদের কথা বলে। এসব কারণে পাশ্চাত্যে রুমি ও ইসলামকে আলাদা করা হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ পাঠকের সঙ্গে রুমির পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে ওমিদ সাফিও অন্যদের মতো করে বার্কসের অবদান স্বীকার করছেন। কবিতাগুলো আমেরিকান ভাষ্যে হাজির করতে বার্কস কবির জীবন ও কাজের প্রতি যথেষ্ট সময় এবং দরদ দেখিয়েছেন। এছাড়া বাজারে রুমির আরো অনুবাদ রয়েছে যেগুলো থেকে আসলে রুমিকেই বাদ দেয়া হয়েছে। যেমন- দিপক চোপরা ও ড্যানিয়েল ল্যাডিনস্কি অনূদিত ‘নিউ এইজ বুকস’। এগুলো রুমির নামেই বাজারে ছাড়া হয়েছে এবং বিক্রিও হচ্ছে। কিন্তু রুমির কাজের সামান্যই এতে প্রতিফলিত হয়েছে। চোপরা আসলে আধ্যাত্মিক নানান বিষয়ে লেখেন। তিনি আসলে কবিরাজ। তিনি স্বীকারও করেন, তার কবিতাগুলো রুমির কবিতার শাব্দিক রূপান্তর নয়। ‘দি লাভ পয়েমস অফ রুমি’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, ”এগুলো হলো আমরা মূল ফার্সি থেকে বিচ্ছুরিত ‘ভাব’টিকে ইংরেজির শব্দে ধরে একটি নতুন জীবন দিয়েছি। তবে তার উৎসমূল বজায় রাখার চেষ্টাও ছিল।”
‘নিউ এইজ অনুবাদ’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ওমিদ সাফি বলেছেন, ”দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বসনিয়া ও ইস্তানবুল থেকে কোনিয়া এবং ইরানজুড়ে মুসলিম জীবনধারায় যে আধ্যাত্মিক ভাবের বিচরণ তাকে এড়িয়ে গিয়ে, মুছে ফেলে ও ছিনিয়ে নিয়ে ওই অনুবাদের কাজটিতে এক ধরনের ‘আধ্যাত্মিক উপনিবেশবাদ’-এর চর্চা করা হয়েছে।” ধর্মীয় কনটেক্সট থেকে আধ্যাত্মিকতাকে আলাদা করার মধ্যে একটা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের (সদ্য বিদায়ী) নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিন-এর মতো অনেকেই ইসলামকে প্রতিনিয়ত ‘ক্যানসার’ হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছেন। এমনকি নীতি-নির্ধারকরা পর্যন্ত বলছেন, অপশ্চিমি ও অশ্বেতাঙ্গরা সভ্যতায় কোনাে অবদানই রাখনেনি।

রুমির আসল ভাবের ক্ষেত্রে ধর্মকে গৌণ মনে করছেন বার্কস। আমাকে তিনি বলছিলেন, ‘গোটা বিশ্বের জন্যই ধর্ম একটি বিতর্কিত বিষয়। আমি আমার সত্য পেয়েছি আর আপনি আপনার সত্য পেয়ে গেছেন- এটি একদম অ্যাবসার্ড। আমরা সবাই একত্রে এই পৃথিবীতে বিরাজ করছি এবং আমি আমার অন্তরকে মুক্ত করবার চেষ্টা করছি আর এতে রুমির কবিতা অামাকে সাহায্য করে।’ এটিকে রুমির অনুসরণও বলা যায় এক অর্থে, রুমি যেমন তার কবিতায় কােরআনের আয়াত নিয়েছেন এবং বেশকিছু জায়গায় তা হুবহু না নিয়ে নিজের মতো করে এনেছেন- ফার্সিতে পড়তে গিয়ে যাতে ভাবগুলো সহজে ধরা যায়। কিন্তু ফার্সি পাঠকরা ওই কৌশলটা সহজেই ধরতে পারলেও আমেরিকান পাঠকরা ইসলামি বিষয়াদির সঙ্গে পরিচিত নন। ওমিদ সাফি কােরআন না পাঠ করেই রুমি পাঠকে বাইবেল না পড়েই মিল্টন পড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। যদিও রুমি প্রচলিত ধর্মমতের নানান বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন তবুও সেটি একটা মুসলিম কনটেক্সটে তিনি প্রশ্ন তুলতেন, ওই সময়কার ইসলামি সংস্কৃতি অনুযায়ী এ ধরনের মতবিরোধিতার যথেষ্ট কারণ ও সুযোগ ছিল। রুমির কাজ যে শুধু ধর্মের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে নির্মিত হয়েছিল সেটিই নয়, এটি ইসলামি পাণ্ডিত্যের ঐতিহাসিক উৎকর্ষেরও প্রতিনিধিত্ব করে।
রুমি কােরআন ও হাদিস এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো ব্যাখ্যার ভঙ্গিতে ব্যবহার করতেন। অনেক সময় প্রচলিত পঠন-পাঠনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতেন। বার্কসের জনপ্রিয় অনুবাদগুলোর একটি হচ্ছে, Out beyond ideas of rightdoing and wrongdoing, there is a field./I will meet you there. অথচ মূল কবিতায় rightdoing অথবা wrongdoing কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। রুমি যে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন তা হচ্ছে ইমান (religion) ও কুফর (infidelity)। এবার চিন্তা করুন, ধর্মীয় পণ্ডিত এক বলছেন, বিশ্বাসের ভিত্তি ধর্মীয় আচারবিধিতে স্থাপিত নয়, বরং সেটি প্রেমওি সমবেদনার উচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত।
এখনকার দিনে কোনাে মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তি বা ইমামকে যে অবস্থান নেয়ার কারণে আমরা উগ্রপন্থী (র্যাডিক্যাল) বলি, রুমি তেমনই অবস্থান নিয়েছেন ৭০০ বছরেরও বেশি সময় আগে।
এমন পাঠ যে, এর আগে একবারেই ছিল না তা নয়। রুমির কাজের মধ্যে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ও প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ততার হাজিরা আছে যা অন্য কারো মধ্যে মেলে না। সাফি বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক বিবেচনা মাথায় রেখে বলা যায়, হাফিজ ও রুমির কাব্যের মতো কোনাে মুসলমান কবির পক্ষেই কােরআন বাদ দিয়ে এমন চিত্রকল্প বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণেই হাতে লেখার ওই সময়ের হয়েও রুমির এত বিস্তর লেখালেখি টিকে গেছে।
লেখক ও অনুবাদক সিনান আনতুন বলেছেন, ‘ভাষা শুধু যোগাযোগের একটি উপায় নয়। এটি আসলে স্মৃতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতার একটা ভাণ্ডার।’ যখন দুটি সংস্কৃতির মধ্যে বিনিময় ঘটে তখন অনুবাদকরা সেখানে অবশ্যই একটি রাজনৈতিক জায়গা থেকে কাজ করেন। তাদের খুঁজে বের করতে হয় কীভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারস্য কোনো কবিকে সমসাময়িক আমেরিকার পাঠকদের কাছে তুলে ধরা দরকার। কিন্তু তাদের কাজটির মৌলিক ভাব বজায় রাখার দায়টাও নেয়া উচিত ছিল যাতে পাঠকরা বুঝতে পারেন শরিয়া বিষয়ক কোনো পণ্ডিত বিশ্বের সবচেয়ে বহুল পঠিত প্রেমের কবিতাও লিখে থাকতে পারেন।
জাভিদ মোজাদ্দেদি মসনবির ৬টি খণ্ডের পুরোটা অনুবাদের সুদীর্ঘ কাজ হাতে নিয়েছেন। এর ৩টি খণ্ড ইতোমধ্যে বেরিয়েছে। চতুর্থ খণ্ডও এ বসন্তেই বের হওয়ার কথা। তার অনুবাদে রুমির মূল ভাব রাখার সর্বোচ্চ প্রয়াস দেখা গেছে যেখানে রুমি ইসলামি ও কােরআনীয় টেক্সট বা আরবি শব্দ ব্যবহার করেছেন সেটি চিহ্নিত রাখতে আইটালিক করে দেয়া হয়েছে। তার বইয়ে অনেক টিকা-ব্যাখ্যাও জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটি পড়তে হলে বেশ মেহনতের দরকার হবে এবং একজনের আরোপিত ধারণার বাইরে গিয়ে দেখার ইচ্ছাটাও থাকতে হবে। আর ভিনদেশি কিছু বােঝার চেষ্টাটাই অনুবাদের মূল জায়গা। কেসাভার্জ যেমনটি বলেছেন, ‘প্রত্যেকেরই আলাদা ধনে ও ভাব রয়েছে। সবারই সংস্কৃতি ও ইতিহাস আছে। কোনো মুসলমানেরও তেমনটি থাকতে পারে।